আগস্ট
২০০৭ সাল, টাঙ্গুয়ার হাওর পরিদর্শনঃ
এতদিন
টাঙ্গুয়ার হাওরের অনেক গল্প শুনতাম। শীতকালে পত্র পত্রিকায় এই হাওরে ঝাকে ঝাকে
অতিথি পাখি উড়ার ছবি দেখতাম। একদিন আমাদের
বরইকান্দি শাখার ব্যবস্থাপক ফারুক আহমদ আমাকে ফোন করে বললেন, কুরেশী ভাই আমাদের
নেতা পুবালী ব্যাংক লিমিটেড সিলেটের আঞ্চলিক প্রধান আব্দুল করিম চৌধুরী স্যার
সবাইকে নিয়ে একদিন একরাতের সফরে টাঙ্গুয়ার হাওয়রে যাবেন।
আপনি যেতে চাইলে আড়াই হাজার টাকা পাঠিয়ে দিন। আমি তার এই প্রস্থাব সাথে সাথে লুফে
নিলাম।
আগস্ট ২০০৭
সাল। এক শুক্রবার সাত সকালে আমাদের নেতা মহাব্যবস্থাপক আব্দুল করিম চৌধুরী অফিসের
কয়েকটি গাড়ির একটি বড় লাটবহর নিয়ে সিলেট হতে সুনামগঞ্জের দিকে যাত্রা শুরু করলেন।
আমাদের দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড ছিলেন সিলেট আঞ্চলিক অফিসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক
মামুন বখত স্যার। কালিঘাটের ব্যবস্থাপক মাহবুব আহমদ, কদমতলীর ফয়ছল আহমদ,
বরইকান্দির ফারুক আহমদ, চৌকিদেখির আরিফুর রহমান, মহিলা কলেজ শাখার মশিউর রহমান খান
এবং ঢাকা হতে আগত মোঃ শামস, সুকান্ত বনিক প্রমুখ ব্যবস্থাপকগন সহ
অনেকে এই যাত্রায় এসে শরিক হন।
আমাদের
সুনামগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য ব্যবহারে খুব আমায়িক এবং
সর্বকাজে একজন করিৎকর্মা লোক। তিনি সুনামগঞ্জে এক জাঁকজমকপূর্ন নৌ সফরের আয়োজন
করেন। বৌদি মিতা ভট্টাচার্য্য ও একমাত্র আদরের কন্যা
ঐন্দ্রিলা ভট্টাচার্য্যকে নিয়ে তিনি পাশে একটি বাসায় বসবাস
করতেন। সুনামগঞ্জে এসেই বউদির হাতে সযতনে তৈরি চা নাস্তায় আমাদেরকে চুমুক দিতে হল।
সুনামগঞ্জ শাখায় ভুরিভোজ করে আমরা সুরমানদীর ঘাটে ছুটে গিয়ে দেখলাম এই শাখার
গ্রাহক একজন ধনী ব্যবসায়ী আবু সাইদ মোঃ খালিদ সাহেবের
সুরম্য বড় গয়না নৌকা নদীঘাটে আমাদের অপেক্ষায় নোঙ্গর করে জলে ভেসে আছে।
সুনামগঞ্জের
কয়েকজন সুহৃদ ব্যক্তি নৌকায় আদর আপ্যায়ন করতে আমাদের সাথে ছুটলেন। সুরমা নদীর
দক্ষিনপারে সুনামগঞ্জ শহর, এবার গয়না নৌকাটি আমাদেরকে নদীর উত্তরপারে যাদুকাটা নদীর মিলনস্থলে নিয়ে
হাজির হল। গয়না নৌকাটি বেশ বড়, ছইয়ের নিচে দুইদিকে বসার চেয়ার বসানো, মাঝখান দিয়ে
দুই গলুইয়ে চলাচলের সরু রাস্থা। গলুই হতে মই বেয়ে ছইয়ের ছাদে উঠে দেখি সেখানেও বেশ
কিছু চেয়ার পাতা রয়েছে। আমি ছাদের উপর একটি চেয়ারে বসলাম। তখন ছিল বর্ষাকাল,
যাদুকাটা নদী জলে থৈ থৈ করছে। নদীর জল উপচে উঠে দুইতীর জলে ডুবে আছে। নদীপারের
জনপদ জলে এমনই নিমজ্জিত যে কেবল ভিটেমাটি কোনমতে ভেসে আছে। জলেডুবা রাস্থায় মানুষ
লুঙ্গি হাটুতে তুলে চলাচল করছে। এত জল, জল আর জল, এযে সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল।
যাদুকাটা
নদীতে সারিসারি বালি ও পাতরের লম্বালম্বা কাটের নৌকা একটার সাথে অন্যটা দড়ি বেঁধে
দশবারটি নৌকার ঐক্যজোট তৈরি করে মাঝিরা বেয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এযেন ট্রেনের কয়েকটি
বগির একত্র সংযোজন। এবার একটি বড় খালপথে আমরা শনির হাওরে প্রবেশ করলাম। জলভরা
হাওয়ের একস্থানে বিশাল গয়না নৌকাটির তলা ঠেকে গেল। আমাদের সুনামগঞ্জের সুহৃদগণ জলে
নেমে নৌকায় দড়িবেধে জীবনের ঝুকি নিয়ে অনেক টানাটানি করে নৌকাটিকে শনির হাওয়ের
কূলহীন জলে ভাসিয়ে দেন।
শনি ও
টাঙ্গুয়ার হাওরের সীমানারেখা আমাদের জানা নেই। সুনামগঞ্জের বন্ধুরা একসময় বললেন
আমরা এখন টাঙ্গুয়ার হাওরে ভাসছি। একের পর এক আফাল (বড় ঢেঊ) এসে ছপাত ছপাত করে
নৌকার গাঁয়ে আছড়ে পরছিল। তখন আমি বুঝতে পারলাম হাজার
বছরেরও আগে শ্রীহট্টে ভ্রমন করতে আসা বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং কেন তার
ভ্রমন কাহিনীতে লিখেছিলেন, শ্রীহট্টের পশ্চিমে সাগর রয়েছে, শ্রীহট্ট সমুদ্রপারের
জনপদ। তিনি হয়ত কোন এক বর্ষাকালে সিলেটের পশ্চিমে গিয়ে এই ভাটির দিগন্তহীন জলে
সাগরের গর্জন ও তরঙ্গমালা দেখে যান।
টেকেরঘাট
রেস্টহাউসের প্রান্তরে আমদের গয়না নৌকা এসে নোঙ্গর করল। এবার আমরা হাফপেন্ট পড়ে
টাঙ্গুয়ার মায়াবী জলে সাঁতার কাটতে ঝাঁপ দিলাম। পরিস্কার পানি নয়ন মুগ্ধ করলেও
সাঁতার কাটতে গিয়ে বুঝলাম সবুজ শেওলার কি ভীষন যন্ত্রনা। সারাটা শরীর সবুজে
পিচ্ছিল হয়ে গেল। মুরব্বী করিম স্যারও বেশ আগ্রহ নিয়ে সাতারে নামলেন, কিন্তু বয়সের
কারনে একটু সাতরে হাফিয়ে উঠলেন। বহুকাল পর ফয়সল সাহেব, মাহবুব সাহেব, ফারুক সাহেব,
মামুন বখত স্যার ও আমি বেঘুরে সাঁতার দিলাম। ফয়সল সাহেব বললেন শৈশবে তার বাবা
জাঊয়াবাজার জনতা ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন। জাউয়াবাজারের চারপাশের গহীন জলে সাঁতার
কেটে তার ছোটবেলা কেটেছে। আমি বললাম বাড়ির সামনে আমাদের বাড়ির প্রাচীন দিঘি,
যেখানে ডুব সাঁতার কেটে কেটে আমার বাল্যকালের
গ্রীষ্মের দুপুরবেলা কাটিয়ে দিতাম।
টেকেরঘাট
রেস্টহাউস আমাদেরকে আভ্যর্থনা জানাতে তৈরি ছিল। ভারতের
মেঘালয়া রাজ্যের সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশে অপূর্ব সুন্দর স্থানে এই রেস্টহাউস। এই
রেস্টহাউসের উত্তরে সারি সারি মাইলখানেক উচু আকাশ ছোঁয়া পাহাড় এবং দক্ষিনপাশে
টাঙ্গুয়ার বিশাল জলরাশি সাগরের বিশালতা নিয়ে দণ্ডায়মান। চারপাশে বাগানঘেরা
পাকাটিনের রেস্টহাউসের বাবুর্চিরা আমাদের জন্য রান্নাবান্না করেন। এখানে আমাদের
টেকেরঘাট শাখার ব্যবস্থাপক মাহিম উদ্দিন আমাদেরকে বরন করে নেন। দুপুরে মাছ ও
মাংশের বেশ কয়েক আইটেমের ভুরিভোজ হল।
সেদিন আকাশ
ছিল একটু মেঘাচ্ছন্ন, ভ্যাপসা গরমে অস্বস্তি লাগছিল। বাদমাগরিব আমরা চাঁদনীরাতের
ভরা পূর্নিমা উপভোগ করতে আবার গয়না নৌকায় চড়লাম। সুশীতল হাওরি বাতাসে সব অস্বস্তি
তখন স্বস্তি ও আনন্দে রূপান্তরিত হল। নৌকা হিজল করস
বৃক্ষের ঘা ঘেষে ঘেষে শান্ত জলাধারে রাজহাঁসের মত ভেসে ভেসে
সাঁতার কাটতে থাকে। আকাশের পূর্নিমার চাঁদ তখন জলের ঢেউয়ে প্রতিবিম্ব ফেলে জলতলে
অজস্র চাদে পরিনত হচ্ছিল।
নৌকায় বসে
আমি নোঠখাতায় চারলাইন কবিতা লিখলাম- ‘ভাটিদেশে বরুন ফোটে, জলেতে করচ তুলে শির,/
টাঙ্গুয়ার ঢেউয়ে ভাসে বুনোহাস, বক বাঁধে নীড়।/ পূর্নিমার রাতে ঢেউ ভেঙ্গে মুখহাসে
চাঁদ রূপালীর,/ অজস্র পরিযায়ী পাখি, ভাসমান ডালে রচে ভীড়’।
হাওরের
মধ্যে মধ্যে কয়েক স্থানে খুটিদিয়ে তৈরি পাকা আনসার ক্যাম্প দেখলাম। বেশ নিচে পানি,
মইসিড়ি বেয়ে উপরে মাচাং দালানে নির্মিত এইসব
ক্যাম্পে শৌচকর্ম ব্যবস্থা খুবই অস্বস্তিকর। এই আনসাররা একজন ম্যাজিস্টেটের
নেতৃত্বে বিশ্বঐতিহ্য এই টাঙ্গুয়ার হাওর পাহারা দেন। তারা এখানে জলজ উদ্ভিদ ও
প্রাণীবৈচিত্র রক্ষায় কাজ করে যান।
ফেরার সময়
গভীর রাতে আমরা টেকেরঘাটের একজন ধনী ব্যবসায়ীর মেহমান হলাম। তিনি পুবালী ব্যাংকে
এলসি করে টেকেরঘাট স্থলবন্দর দিয়ে কয়লা আমদানি করে থাকেন। তার জলে ভাসমান দুতলা
পাকাবাড়ি। বাড়িতে আলো ঝলমল করছে জেনারেটরের তৈরী বিদ্যুতে। ঘাটে একটি স্পীডবোট
বাঁধা। এখানে ভারী চা নাস্তা হল। টেকেরঘাট রেস্টহাউসে এসে আবার টেবিলে খাবারের
ছড়াছড়ি, অথচ পেটে কোন ক্ষিদে নেই। সবাই বসলেন, যা পারেন খেয়ে উঠলেন। আমরা আমাদের
দুই বস মামুন বখত ও আব্দুল করিম চৌধুরী স্যারকে একটি পালংকে শোয়ায়ে মশারী টাঙ্গিয়ে
দেই। এবার রেস্টহাউসের পাকা মেঝেতে আমরা পনের বিশ জনের শোবার আয়োজন করলাম।
গ্রীষ্মের এই গরম রাতে আমরা এক আলাদা ধরনের ঘুমের স্বাধ নিলাম। পাকামেঝ ভালভাবে
ধুয়েমুছে পরিস্কার করে চাদর বিছানো হল। বালিশ হিসাবে আমাদের ছোট ছোট ব্যাগ মাথার
নিচে ব্যবহার করলাম। মশার হাত হতে বাঁচতে কয়েল জ্বালিয়ে দেওয়া হল। ছাদেঝুলে
সশব্দে ঘুরছে বৃটিশ আমলের বড়বড় কয়েকটি ফ্যান। আমি ও মাহবুব সাহেব পাশাপাশি শোয়ে
গেলাম। সারাদিন জার্নি ও সাঁতার কেটে পরিশ্রান্ত হওয়ায় শোয়ামাত্রই গভীর ঘুমে সবাই
আচ্ছন্ন হয়ে গেল। পরদিন বেশ বেলা করে উঠে গাঁয়ে বেশ জ্বালা অনুভব করলাম। বুঝলাম
মশার কয়েল জ্বলে নিঃশ্বেষ হয়ে গেলে কিছু মশা উড়ে এসে মহানন্দে রক্তপান করে তাদের
জনমধন্য করেছে।
রেস্টহাউসের
একজন বুড়ো কর্মচারি তার ছোটবেলার কাহিনি বললেন, সেকালে ভারতের সুউচ্চ পাহাড় হতে
গ্রীষ্মকালে যখন ঝাকে ঝাকে এক ধরনের মশা নেমে আসত, তখন দেখা দিত ম্যালেরিয়া
মহামারি। চিকিৎসক ছিলনা, ঔষধ ছিলনা। মানুষ মশার কামড়ে বেঘুরে প্রান হারাত। কেউ কেউ
দূর গাঁয়ে পালিয়ে যেত। একবার তার গ্রামের অর্ধেকের বেশি মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা
যায়। কবর খোড়ার মত মানুষ পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে।
আমরা পায়ে
হেটে ভারতের সীমান্তরেখার স্মারক চকমকি পাতরের কাছে পৌছে গেলাম। সুদুরে প্রায় অর্ধ
মাইল উপরে পার্বত্য পথে বি এস এফ কে
বন্দুক হাতে টহল দিতে দেখলাম। তারা আমাদের প্রতি যেন নজর রাখছে। তারা গুলীবর্ষন
করলে আমরা সবাই এই নিম্নভূমিতে শেষ হয়ে যাব। এবার আমরা টেকেরঘাট স্থলবন্দর
পর্যবেক্ষন করে সীমান্তের কাছাকাছি চুনাপাতরের খনিতে
গিয়ে উপস্থিত হই। এই খনির চুনাপাতর তারপথে ছাতকে নিয়ে
সিমেন্ট তৈরী করা হয়। এখানে চুনাপাতর উঠানোর ফলে এক বিশাল হ্রদ সৃষ্টি হয়ে গেছে।
বৃষ্টির জলের মত স্বচ্চছ পরিষ্কার এই পানি নাকি কেউ কেউ বললেন বিশ্বের সেরা খনিজ
মিনারেল ওয়াটার।
এবার
ব্যবসায়ীর স্পীডবোটে বসে আমি ও মামুন স্যার মহানন্দে টাঙ্গুয়ার অসীমতায় হারিয়ে
গেলাম। বাকীরা আমাদের পিছনে পিছনে গয়না নৌকায় অনুগামী হন। আব্দুল করিম স্যারকে
টাঙ্গুয়ার হাওরের এক বিশাল রুইমাছ উপহার দিতে সুনামগঞ্জ শাখার একজন ব্যবসায়ী এসে
টেকেরঘাট রেস্টহাউসে হাজির হন। আব্দুল করিম স্যার বললেন, আমি একা
মানুষ একা থাকি, এত বড় মাছ দিয়ে আমি কি করব, না না আমি নেবনা। পেরে উঠতে না পেরে
এই নাছুড়বান্দাকে শেষে বললেন, আপনি যখন ছাড়বেনই না, তাহলে একটি কাজ করুন, মাছটি
কেটে আমার ম্যানেজারদের মধ্যে ভাগ করে দেন। মাছটি কেটে
ভাগ করে আলাদা আলাদা ব্যাগে ভরা হল।
প্রতিভাগে দেড়দুই কেজি করে এই সুস্বাধু রুইমাছ আমরা সবার বাসায় গেল।
আমরা
টাঙ্গুয়ায় গেলাম যাদুকাটা নদীপথে উজান বেয়ে আর ফিরলাম পরদিন বিকেলে ভাটির টানে। রোববার
অফিসে বসতেই বরইকান্দির ব্যবস্থাপক ফারূক আহমদের
ফোন পাই। কোরেশী ভাই, আমার কাছে আপনাদের রাখা
ফান্ডের একটি টাকাও
খরচ হয় নাই। সুনামগঞ্জের ম্যানেজার দেবাশীস বাবু টাঙ্গুয়ার হাওর
ভ্রমণের সমুদয় খরচপাতির ব্যবস্থা
করেছেন। অথচ এই আড়াই হাজার টাকা চাঁদার ডাক শুনে অনেক ব্যবস্থাপকই
টাঙ্গুয়া যাননি। নিশ্চয়ই যারা যাননি তাঁরা ভাগ্যহীন এবং আমরা ভাগ্যবান কারণ বিনে জরিমানায় দুইদিনের এক গর্জিয়াস আনন্দভ্রমণ
আমাদের ভাগ্যে জোটে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন