ভ্যালেন্টাইন ডে- ২০২০। তাহিরপুর শিমুলবন, নিলাদ্রী লেক ও বারেক টিলা ভ্রমণঃ
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ শুক্রবার।
দিবসটি ভ্যালেন্টাইন ডে- ২০২০। বাংলায় যাকে বলে ভালবাসা দিবস। সিলেট থেকে ডাঃ নুরজাহান
বেগম চৌধুরীর ফোন পেলাম আগামী সাপ্তায় সিলেট এসো, বসন্তের এই সোনালি দিনে আমরা
তাহিরপুর শিমুলবনে যাবো। কেমন করে যাবে জানতে চাইলে বললেন, আমি
ফেসবুকে এড দেখে লতিফ ট্রেভেলসের সাথে যোগাযোগ করেছি। আমরা তিনজনের নাম বুকিং
করেছি। এই ভ্যালেন্টাইন ডেতে তাঁরা আমাদেরকে তাদের গাড়িতে
করে নিয়ে যাবে, দুপুরে খাওয়াবে এবং সারাদিন সুনামগঞ্জের
তাহিরপুর শিমুল বন, নিলাদ্রী লেক এবং বারেক টিলা ঘুরে দেখাবে। আমি সর্বদাই বৃহস্পতিবার ঢাকার অফিস শেষে রওয়ানা
হয়ে রাত বারটা/একটা
নাগাদ সিলেট পৌছি। জেফার ও তার মা কার নিয়ে এসে প্রায়ই চন্ডিপুল
হতে আমাকে নিয়ে যান।
তখনও করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে
আসেনি। সারা পৃথিবী জুড়ে করোনা ভীতি ছড়িয়ে পরলেও বাংলাদেশে তার ছোঁয়া
লাগেনি। তখনও দেশবাসী স্বাভাবিক জীবনে সাঁতার
কাটছে। সিলেটের মানুষ বসন্তের আনন্দে মেতে আছে। তাঁরা
দলবেঁধে চাবাগান, জাফলং, মাধবকুন্ড, লালাখাল, শ্রীমঙ্গল, সাদাপাথর, শিমুলবন ঘুরে
বেড়াচ্ছে।
শুক্রবার সাঝ সকালে উপশহরের লতিফ
ট্রেভেলসের অফিসে আসি। গাড়ি কাছের আত্মীয়ের বাসায় রেখে দেই। তখনো কোন পর্যটক আসেন
নি। ঘন্টাখানিক সময়ের মধ্যে যাত্রি এসে বাস পূর্ণ হয়। বেশ পরিচ্ছন্ন বাসটি আমরা
প্রায় ত্রিশজন পর্যটক নিয়ে সকাল ৮টা নাগাদ উপশহর ছাড়ে। বহুদিন পর আবার সুনামগঞ্জের
দিকে ছুটলাম। গোবিন্দগঞ্জ পার হয়ে একটি পরিপাঠি মসজিদের কাছে গাড়ি থামে। মসজিদের
পুকুর ও শৌচাগার সবাই ব্যবহার করেন। আমরা মসজিদ প্রাঙ্গণ ও পুকুরঘাটে বসে নাস্তা
করি।
সুনামগঞ্জ এসে এক সুদীর্ঘ সেতুর
ওপারে গাড়ি থামে। সুনামগঞ্জে সুরমানদীর উপর সেতু হয়েছে আমার জানা ছিলনা। সুরমানদী
সিলেটের চেয়ে সুনামগঞ্জে অনেক প্রশস্ত। তাই সেতুটি বেশ দীর্ঘ। আমরা হেঁটে হেঁটে এই
নতুন সেতুর মাঝখানে গিয়ে সুরমার বাতাসে নিঃশ্বাস নেই। নিলাদ্রী লেকে গিয়ে দুপুরে খাবার জন্য একটি হোটেল হতে গরম গরম রোস্ট-পোলাও আসে। এবার বনসবুজের
ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের গাড়ি সুনামগঞ্জ সুরমাসেতু পার হয়। বসন্তের বাতাস গায়ে মেখে
মেখে আমরা তাহিরপুরের শিমুলবন পানে ছুটে যাই।
জাদুকাটা নদীপারে শিমুলবাগান। আজ
বসন্তের আলোকিত দুপুর। আকাশ লালরঙে রাঙ্গিয়ে ফুটে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ শিমুল। প্রতিটি
গাছে গাছে, ডালে ডালে রঙের বন্যা বইছে। অগনিত শিমুল বৃক্ষরা বিশাল প্রান্তর জুড়ে
প্যারেড গ্রাউন্ডের সেনাবাহিনীর মত সরলরেখায়
কলাম ও সারি বিন্যস্ত হয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। বাহ, কি অপরূপ।
আজিকার বসন্তের এই ভ্যালেন্টাইন
দিবসে পাঁচ/ছয় হাজার তরুণ তরুণী লাল হলুদ সবুজ রঙ মেখে বসন্ত সজ্জায় সজ্জিত হয়ে
শিমুলবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে। বসন্তকে গায়ে ও হৃদয়ে মাখছে। তাঁরা
ঘোড়ায় চড়ে শিমুলবন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি ও জেফার ঘোড়ায় চড়ে ছবি তুলি। সারাটা
প্রাঙ্গণ ঝরে পড়া শিমুলফুলে রাঙ্গা হয়ে
আছে। পায়ের নিচে লাল-শিমুল দলে দলে হাঁটছে
সবাই। এই ঝরাশিমুল কুড়িয়ে এবং তা সাজিয়ে শিমুলতলায় নানান ডিজাইনের বড় বড় আলপনা তৈরি
করা হয়েছে। বসন্তের আলপনা, হৃদয়াকৃতির আলপনা, ভালবাসার আলপনা, LOVE লিখা আলপনা। এসব আলপনায় বসে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করছে সবাই। শিমুলবন হতে কাছের
জাদুকাটা নদী ও ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের দৃশ্য অতি মনোরম।
পৃথিবীর সব সুন্দর সৃষ্টিই কোন
না কোন সৃজনশীল মহৎ মানুষের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এই বিশাল অপরূপ
সুন্দর শিমুলবনের প্রতিষ্ঠাতা এই ভাটির সন্থান জয়নাল আবেদীন। তিনি কয়েক বছর
অক্লান্ত পরিশ্রম করে ২০০০ সালে এই শিমুলবাগান রচনা শেষ করেন। প্রতি বছর শীতের
শেষে শিমুল ফুটার সাথে সাথে শিমুলবনে বসন্ত উৎসব জমে উঠে। দূর দূরান্ত হতে আসা
মানুষের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে শিমুলবন। আমাদের সৌভাগ্য এই মহান মানুষের পত্নী ও
কন্যাকে সেই ভালবাসা দিবসে শিমুলবনে পেয়ে যাই। জয়নাল আবেদীন বসন্তকালে শিমুলবাগানে
আসা মানুষের জন্য এই শিমুলবনে গণশৌচাগার, বসার চেয়ার, ওয়াচ টাওয়ার, রঙের ঘোড়া,
খাবার স্টল, বিশ্রামাগার, তৈরি করে যান। শিমুলবনে ঢুকার জন্য নামমাত্র ভাড়া
জনপ্রতি মাত্র ২০টাকা করে আদায় করা হয়। তাঁরা বললেন এই শিমুলবনের প্রতিষ্ঠাতা
জয়নাল আবেদীন ২০০৬ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় দুনিয়া হতে বিদায় নেন। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে এই সুন্দর শিমুলবাগানে বসেই আমরা তাকে বিনম্র
শ্রদ্ধা জানাই।
বিকেল ৩টা নাগাদ শিমুলবন ছেড়ে আমরা নিলাদ্রী লেকে ছুটে যাই। পথে খাসিয়া নারীদেরকে ধানক্ষেতে পুরুষের
মত গরু দিয়ে হালচাষ করতে দেখি। খাসিয়া সমাজ মাতৃতান্ত্রিক, মেয়েরা সর্বেসর্বা।
খাসিয়া নারীরা সংগ্রামী, পরিশ্রমী, সে তুলনায় পুরুষরা অলস।
পাহাড়ঘেরা নিলাদ্রী লেক। এককালে এই লেকে
ছিল সাদা চুনাপাতরের বিশাল পাহাড়। সুউচ্চ রশিপথে একটার পর একটা
যান্ত্রিক বালতির এসে অবিরাম এখানকার চুনাপাথর নিয়ে যায় ছাতক সিমেন্ট কারখানায়। বছরের পর বছর চুনাপাতর
উত্তোলনে টেকেরঘাটের চুনাপাহাড় একদিন উদাও
হয়ে যায়। চুনাপাহাড় কেটে কেটে নিঃশেষ হয়ে গেলে এবার ভূমি খনন
করে চুনাপাতর উত্তোলন চলে দিনের পর দিন। সৃজন হয় পাহাড়ঘেরা স্বচ্চ জলের গভীর লেক
নিলাদ্রী। আমি, জেফার ও ডাঃ নুরজাহান একটি নৌকা ভাড়া করে সারাটা সুন্দর লেক ঘুরে
বেড়াই। নিলাদ্রী লেকের জলের রঙ কখনো সবুজ কখনো নীল দেখা যায়। এই লেক
বাংলাদেশের একমাত্র খাঁটি মিনারেল ওয়াটার খনি।
নিলাদ্রী লেকপারের টিলায় টিলায় সাজানো গুছানো কয়েকটি পিকনিক স্পট। লেকপারের একটি টিলার চূড়ায় আমরা বাপ-বেটা বেয়ে উঠি। এই টিলার
ওপারে বড়ছড়া বাজার ও স্থলবন্দর। জায়গাটি সত্যি অপরূপ।
নিলাদ্রী লেক হতে আমরা তিনজন
সবার সাথে যাই বারেক টিলায়। সন্ধ্যার সূর্য তখন বেশ নিস্তেজ হয়ে গেছে, প্রকৃতিতে
আলো আঁধারের খেলা চলছে। এমনই গোধুলি বেলায় একটি সীমান্ত গ্রামের ভিতরে সুউচ্চ ঢালু বেয়ে বেয়ে আমরা বারেক টিলায় আরোহন করি। পাশেই সুরম্য জাদুকাটা
নদী ভারতের সুউচ্চ পর্বতমালা হতে নেমে এসেছে বালি ও পাথরের উপত্যকায়। বালি ও পাথরের
বিশাল উপত্যকাকে মনে হয় একটি মরুভূমি। বৃক্ষ-লতা-ঘাসের কোন চিহ্ন নেই, শুধু বর্নিল
বালু ও পাথর। মধ্যভাগে বইছে স্বচ্ছ পরিস্কার জলের জাদুকাটা নদী। নদীর নাম
জাদুকাটা, পৃথিবীর একটি অনন্যসুন্দর নদী এই জাদুকাটা। এখানে এই নদীর
পরিস্কার ক্রিস্টাল জলে সুর্যের কিরণ
পড়ে সবুজ, লাল, নীল, হলুদ রঙ্গমেলা তৈরি করে।
এই নদীর বালু ও পাতর ট্রলারে করে চলে যায় সারাটা বাংলাদেশে।
বারেক টিলার কিনারে দাঁড়িয়ে দেখি
সামনের জাদুকাটা নদী পেরিয়ে দূরের দিগন্তরেখা গিয়ে মিশে গেছে মেঘালয়ার আকাশছোঁয়া
প্রশান্ত পাহাড়ের গায়। এযেন মেঘালয়া কিংবা হিমালয় কন্যা নেপালের
কোন এক গিরিখাদ। মনে হয় আমরা বাংলাদেশে নয়, মেঘালয়ায়
কিংবা নেপালের কোন পাহাড়ি স্পটে দাঁড়িয়ে আছি। পাশের দোকান হতে
সিঙ্গারা ও ডাব কিনে খাই। চোখের সামনে জাদুকাটা নদীর বালুকাবেলায় সূর্য অস্ত গেল।
বারেক টিলা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। পর্যটকগণ নামতে লাগলেন। রাতের ভূতুড়ে টিলায় আর
কাঁহাতক? মিয়া-বিবি-পুত মিলে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে বেয়ে অন্যদের সাথে নিচে নেমে এলাম।
কাছেই লাউড়ের গড়। সিলেটের
প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী। এখানে প্রতিবছর জাদুকাটার পারে বসে বারুনী মেলা।
শীতকালে পুণ্যস্নানে ও বারুনী মেলায় জনতার ঢল নামে। এখানে আছে হজরত শাহজালালের(রঃ)
একজন সাগরেদ আরফিন শাহের(রঃ) মাজার। আসলে জায়গাটি হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্পদায়ের
মানুষের তীর্থস্থান এবং মিলনকেন্দ্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন