সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সিঙ্গাপুরের ডায়রিঃ

 সিঙ্গাপুরের ডায়রি

সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া আসিয়ান জোটভুক্ত তিনটি পূর্ব এশীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমার পরিচিত অনেক লোক এসব দেশ সফর করেছেন, তাদের বর্ননায় এসব দেশের বিবরন অনেক শুনেছি। এই দেশগুলোর অনেক ছবি ও বর্ননা বইপত্র ও টেলিভিশনে দেখেছি। এভাবে এদেশগুলোর যে মনছবি কল্পনায় অঙ্কন করেছি তা বাস্তবে মিলিয়ে দেখার একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হওয়ায় বেশ কিছুদিন হতে প্রার্থনায় মহান আল্লাহের দরবারে উক্ত দেশগুলো আমাকে বাস্তবে দেখানোর আবেদন পেশ করি। হঠাৎ একদিন আমার ভাগনা রনকেলী নিবাসী জিন্নুন বখত চৌধুরীর সাথে দেখা হয়। তিনি সিলেটের ওয়ালী সিটি আবাসনের চেয়ারম্যান ও সৌকিন পর্যটক। তিনি ভ্রমনের অদম্য নেশায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা, ভারত, নেপাল ইত্যাদি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার তিনি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া সফর করেছেন। আই টি এবং ইংরেজি ভাষায় দারুণ দক্ষ একজন করিৎকর্মা লোক তিনি। একদিন তাকে পেয়ে বললাম এসব দেশে গেলে আমাকেও যেন সফরসঙ্গি করা হয়।কিছুদিন যেতে না যেতে হঠাৎ জিন্নুনের ফোন পাই- “মামু, আমরা তিনজন সিঙ্গাপুর যাচ্ছি, শরীক হতে হলে পাসপোর্ট পাঠিয়ে দাও”। এই দেশগুলো ভ্রমনের জন্য আমি এতই উদগ্রীব ছিলাম যে আগপিছ না ভেবে সাথে সাথে ভিসার জন্য পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেই। একমাসের মধ্যে পর্যায়ক্রমে তিনটি দেশের ভিসা পেয়ে যাই।

আমি পূবালী ব্যাংক লিমিটেড বরইকান্দি শাখার ব্যবস্থাপক। সামনে ৩০ জুন ২০১৩, ব্যাংকের অর্ধ-বার্ষিক সমাপনী। ব্যাংকের প্রচুর কর্মকান্ড, এমতাবস্থায় ছুটি চাওয়াটা অস্বস্তিকর। তারপরও ছুটি না নিয়ে উপায় ছিলনা। কারন আমাদের সফরদলের সদস্য ব্যবসায়ী রাসেল আহমদ রমজানে বিক্রির জন্য ব্যাংকক হতে মালামাল কিনবেন। তাছাড়া সামনে রমজান, রমজানের আগেই দেশে ফিরে আসতে হবে।

২৭জুন ২০১৩ রোজ বৃহস্পতিবার। সকাল সাড়ে দশটায় শাহজালাল উপশহরে ভাগনা জিন্নুনের বাসায় যাই। সকাল ১১টায় ওয়ালী সিটির মাইক্রোবাসে রনকেলী গ্রামের জিন্নুন বখত চৌধুরী, ইউনুস আহমদ চৌধুরী খোকন, আব্দুর রহমান চৌধুরী দারা এবং আমি ঢাকা শাহজালাল বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। সেদিন রাত ১১টার সময় সিঙ্গাপুর টাইগার এয়ারওয়েজের একটি মধ্যম আকৃতির বিমানে আমরা ঢাকা ত্যাগ করে ভোর ৫টায় সিঙ্গাপুর চ্যাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরন করি।

সিঙ্গাপুর অবস্থানকারী জিন্নুনের বন্ধু রিমন একটি হোটেল বুকিং দিয়ে রাখেন। হোটেলটির ঠিকানা- Hotel Star Asia, 44, Rowell Street, Little India, Singapore. হোটেলটির ব্যবস্থাপনায় আছেন ভারতীয় তামিল লোকজন। চারজনের একদিনের ভাড়া ২২ সিঙ্গাপুরী ডলার, অর্থাৎ ২২x৬০=১৩৬০ বাংলাদেশী টাকা। হোটেল ভাড়া বেশ সস্তাই মনে হল। সিঙ্গাপুর বিমানবন্দর হতে ভোর রাতে যে সুন্দর ও দামী কারটি আমাদেরকে হোটেলে নিয়ে আসে সে ভাড়া ৩০ সিঙ্গাপুর ডলার। লিটল ইন্ডিয়াতে প্রচুর বাংলাদেশী ও ভারতীয় তামিল লোকজন বসবাস করেন। ভোরে এক তামিল হোটেলে খাবার খাই। ম্যানুতে ছিল ভোনা খিচুড়ি, ডিম ও শাক সবজি। এই প্রথম দেখি খিচুড়ির উপর কুচি কুচি সামুদ্রিক ছোট মাছের শুটকি, খিচুড়ির সাথে শুটকি আমাদের দেশে পরিবেশিত হতে জীবনে কখনও দেখিনি। তবে খেতে বেশ ভালই লাগল। তারপর আসে বড় বড় পেয়ালায় সুমিষ্ট চা।

২৮ জুন ২০১৩ রোজ শুক্রবার। ১১ ঘটিকায় ঘুম হতে উঠে গোসল করে সবাই বের হই। লিটল ইন্ডিয়ার শাহী বিরিয়ানি হোটেলে দুপুরে খেয়ে ভূগর্ভস্থ মেট্রো ট্রেনে সন্তোষা দ্বীপে গমন করি। এটি আমার জীবনের প্রথম ভূগর্ভস্থ ট্রেন ভ্রমণ। কখনও মাটির নিচ কখনও উপর দিয়ে ট্রেনটি পথ চলে। উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার আমাকে হতবাক করে দেয়। সন্তোষা গিয়ে টিকেট করে স্কাই ফ্লাইয়ারে চড়ে আমরা প্রায় হাজার ফুট উপরে উঠি। সুউচ্চ ফ্লাইয়ার হতে সমগ্র সিঙ্গাপুর দ্বীপ ও দ্বীপের উপকূল রেখা দৃষ্টিগোচর হয়। মেরিনা বের পাশে তিনটি ৭০/৮০ তলা তিনটি ভবনের শিরোভাগে জাহাজ আকৃতির বিশাল স্টিলের কাঠামো চোখে পড়ে। সেখানে এত উপরে সুইমিংপুল, পামবাগান, কুসুমবাগ দৃষ্টিসীমায় ধরা পড়ে। মনে হল এযেন প্রাচীন বেবিলনের শূন্য উদ্যান। নিচদিকে চেয়ে দেখি সিঙ্গাপুর দ্বীপ হতে সেতু দ্বারা সংযুক্ত বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর ছোট ছোট শ্যামল দ্বীপমালা। একটি দ্বীপে যাবার জন্য অনেকগুলো খুটির মাথা সাগরে ভাসছে। খুঁটির মাঝখানে সাগরের উর্মিমালা খেলা করছে। এই খুটিদের মাথায় পা রেখে রেখে পর্যটকগন সাগর পারি দিয়ে পা রাখছেন এই সুন্দর বাগান দ্বীপে।

স্কাই ফ্লাইয়ার হতে নেমে ট্যুরিস্ট বাসে সাইট সিইং করতে বের হই। সিঙ্গাপুরের ট্যুরিস্ট বাস অতি উন্নত। দুতলা বাসের নিচতলায় চালক বসেন। এখান থেকে যাত্রিদেরকে এয়ারফোন দেয়া হয়। লম্বা গাড়ির পিছনে শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত আসন কক্ষ। মধ্যভাগের সিরি বেয়ে উপরে উঠে উপর তলার পিছন দিক ছাদে ঢাকা এবং সামনা খোলা। দুতলায় সিটে বসে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে সবগুলো জায়গা ও স্থাপনার ইতিহাস ও বিবরন ইংলিশে শুনে শুনে সারাটা শহর ঘুরে দেখি। মানুষ্য সাজানো অসম্ভব সুন্দর দ্বীপদেশ সিঙ্গাপুর। ৫/৬ ঘন্টায় ট্যুরিস্ট বাসে চড়ে এই সুন্দর ক্ষুদে দেশটি দেখা হয়ে যায়। দেশটিতে সমতল ভূমিই বেশী, তবে বেশকিছু টিলা ও প্রাকৃতিক বৃক্ষশোভিত ঘন বনভূমিও রয়েছে। রাত ৯টায় আমরা সিঙ্গাপুর সাফারী পার্ক দেখতে যাই। খুব ধীরগতির তিন বগী বিশিষ্ট খোলা ট্রেনে যাত্রা শুরু হয়। টিলা ও জঙ্গলাময় সুন্দর পার্কটিতে রাতের প্রাকৃতিক পরিবেশে অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি দর্শন করি। বাঘ, সিংহ, হরিন, ময়ূর, বনগরু, মহিষ, জেব্রা, জিরাফ, ক্যাঙ্গারু কিছুই বাদ পড়েনি। চিড়িয়াদের উপর ঘন বনের ফাক দিয়ে লাইটের আলো পড়ছে। কচ্চপ-গতি ট্রেনের অতি কাছে বাঘ, ভালুক, সিংহ, বানর, গরিলার মত হিংস্র পশুরা চলাফেরা করছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে গভীর রাতের ভূতুড়ে আলোয় হিংস্র প্রানীদের সহিত সহবস্থান সত্যিই এক বিরল অভিঞ্জতা। রাত ১টায় সাফারি পার্ক দর্শন শেষ হয়। স্টেশনে নেমে বাহিরে এসেই পেয়ে যাই কয়েকটি টিলার ঢালু ও উপত্যকা জুড়ে সার্কাস ভেন্যু। টিলার ধাপে ধাপে সিড়ি কাটা, সিঁড়িতে বসার চেয়ার সাজানো। শত শত বিদেশী পর্যটক সিঁড়িতে বসে পশুপাখির নানা বিচিত্র ধরনের খেলা দেখছে। হাতী একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে, একপা তুলে সালাম দিচ্ছে। মিরক্যাট ছোট ছোট বল কুড়িয়ে পাত্রে জমা করছে, বিশাল অজগর পাঁচ ছয় জন লোকের কাঁধে বসে আছে, তারপর একজন লোককে পেছিয়ে ভয়ঙ্কর হা মেলে আছে। কুকুরদল বল খেলছে, ঘোড়া লাফ দিয়ে উচ্চ দেয়াল পার হচ্ছে ইত্যাদি। রাত ২টায় সার্কাস হতে বের হয়ে আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেনে লিটল ইন্ডিয়া স্টেশনে নেমে হোটেল স্টার এসিয়ায় ফিরে আসি।

২৯ জুন ২০১৩ রোজ শনিবার। ঐদিন ঘুম থেকে উঠে সবাই একে একে গোসল করি। পরিচ্ছন্ন হয়ে বের হই এবং বাংলাদেশী হোটেলে খাবার খাই। হেঁটে একটু দূরে গিয়ে মোস্তফা প্লাজায় যাই। মোস্তফা প্লাজা রাস্থার দুই দিকে সুউচ্চ দুটি টাওয়ার, মাটির নিচে চারতলা যাহা রাস্থার নিচ দিয়ে এসে দুটি টাওয়ারকে সম্পুর্ন যুক্ত করে রেখেছে। বেশ বড় মার্কেট, এখানে গাড়ি, উড়োজাহাজ, ট্রেন, হাতী এধরনের পন্য ছাড়া প্রায় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়া যায়। এক এক লেবেলে, এক এক দিকে, এক এক ধরনের পন্যের সমাহার। এখানে দ্রব্যমূল্য নিদৃষ্ট ও একদর। টোকেন গ্রহন করে লাগেজ বাহিরে রেখে মার্কেটে প্রবেশ করতে হয়। এখানে নগদে ও কার্ডে বেচাকেনা হয়। মোস্তফা প্লাজার মালিক একজন ধনী ভারতীয় মুসলিম। এই মার্কেটে তুলনামূলক সস্তায় ভাল মালামাল পাওয়া যায়।

অতঃপর আমরা মেট্রো ট্রেনে মেরিনা বে গমন করি। সেখানে সিঙ্গাপুর নদীর রিভার ভিউ পয়েন্ট হতে টিকেট করে সুন্দর পর্যটন নৌকায় আরোহন করি। নৌকাটি কাষ্টনির্মিত শব্দহীন যান্ত্রিক জলযান। সিঙ্গাপুর নদী, সিঙ্গাপুর নদীর মধ্যবাগ দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোট্ট সুন্দর নদী। নদীটি কোথায়ও কোথায়ও প্রশস্থ লেকের আকার ধারন করে আছে। নদীর মোহনায় মেরিনা বের আয়তন ১০/১২ বর্গ মাইলের কম নয়।  একটি ডাইক নির্মান করে সাগর থেকে মেরিনা বে কে আলাদা করা হয়েছে। নদী এবং মেরিনা বের তটরেখা কোথায়ও পাতর দিয়ে কোথায়ও কংক্রীট ব্লক দিয়ে সুন্দরভাবে বাঁধানো রয়েছে। নদী ও হ্রদাকৃতির উপসাগরের তীরে তীরে গড়ে উঠেছে সুরম্য অট্টালিকার সারি। ভবনগুলোর কাচের আলো প্রতিফলিত হয়ে পড়ছে নীলজলে। ভবনমালার দৃশ্য নয়নাভিরাম। অসংখ্য সুরম্য সেতুর নিচ দিয়ে জলযানটি অগ্রসর হয়। বিভিন্ন যুগে নির্মিত সেতুগুলো সে যুগের চিহ্ন হিসাবে যুগযুগ ধরে একই ডিজাইনে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। নদীর তীরে কিছু বাগান বাড়ি দর্শন করি। প্রতিটি বাড়িতে সুইমিংপুল রয়েছে। এক একটি বাড়ির মূল্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। নদীর মোহনায় মেরিনা ব্যারেজ নির্মান করে সমুদ্রের সাথে নদীকে সংযুক্ত করা হয়েছে।

সিঙ্গাপুর নদী প্রশস্থতায় আমাদের চেঙ্গেরখাল কিংবা সারী নদীর মত একটি ছোট্ট নদী। সিঙ্গাপুরবাসী নদীর মধ্যে কয়েকটি লেক তৈরি করে করে নদীটিকে অপরূপ সুন্দ্রের খনিতে পরিনত করেছে। নদীর মিষ্টিপানি ধরে রাখার জন্য মোহনায় বাধ নির্মান করে পানিকে একই নাব্যতায় ধরে রাখা হয়েছে। ফলে সিঙ্গাপুর নদীতে তেমন স্রোত নেই এবং এই সিঙ্গাপুর নদী ও এর হ্রদগুলোকে কেন্দ্র করে সিঙ্গাপুরের প্রধান বানিজ্য ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। মেরিনা বে তে নৌকার খুব কাছাকাছি সিঙ্গাপুরের জাতীয় প্রতীক মেরলায়ন পরিদর্শন করি। মেরলায়ন উপরের অর্ধেক সিংহ ও নিচের অর্ধেক মৎস্য আকৃতির আজব মূর্তি। সিংহের মুখগহ্বর হতে পানির ফোয়ারা অনেক দূর পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। প্রাচীনকালে একবার সাগরে প্রবল ঝড় হয়। সিঙ্গাপুরের মানুষ তখন সমুদ্রের দেবতা মেরলায়নের দেখা পান। তার আগমনে সাগর শান্ত হয়ে আসে এবং সিঙ্গাপুর রক্ষা পায়। সেই থেকে মেরলায়ন সিঙ্গাপুরের জাতীয় প্রতীক। প্রাচীন সিঙ্গাপুরবাসীদের বিশ্বাস ছিল, দেবতা মেরলায়ন তাদেরকে বিপদাপদ হতে রক্ষা করেন এবং তিনি এই দ্বীপের সৌভাগ্যের বরপুত্র।

পর্যটন নৌকা হতে যে সুদৃশ্য বস্তুমালা পরিদর্শন করি এগুলোর মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর ফ্লাইওভার, বে-পয়েন্ট সাউথ, মেরলায়ন পার্ক, এস্প্লেনেড থিয়েটার, অনন্যা বে, ফুলারটন হেরিটেজ, ফুলারটন হোটেল, বেফ্রন্ট ইত্যাদি। ওইদিন লান্স করি মেরিনা হোটেলে, মাথাপিছু খরচ হয় বিশ সিঙ্গাপুরী ডলার। অথচ লিটল ইন্ডিয়ায় খরচ হত মাত্র চার সিঙ্গাপুরী ডলার। সেদিন আমরা মেরিনা বেতে মেরলায়ন মনুম্যান্ট দেখি। সন্ধ্যার পর রাত নেমে এলে সেখানে আতশবাজি হয়। পানির অনেক নিচ হতে আতশবাজির আলো বের হয়ে আকাশে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে কামান দাগা হয়। মেরিনা ব্যারেজ হতে রংবেরঙ্গের রিমোট কন্ট্রোল ঘুড়ি সাগরের আকাশে উড়তে থাকে। ঐদিন জিন্নুনের ঢাকাইয়া বন্ধু রিমন আমাদের সঙ্গি ছিলেন।

৩০ জুন ২০১৩ সাল, রোজ রবিবার। ঐদিন সকাল ১০ টায় ফারের পার্ক মেট্রোরেল স্টেশন হতে আমি, জিন্নুন, দারা মিয়া এবং খোকন ভূগর্ভস্থ ট্রেনে সন্তোষা স্টেশনে গমন করি। ঐদিনটি ছিল আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। ছোট্ট পর্যটন দ্বীপ সন্তোষায় আমরা মাথাপিছু ১৩৯ সিঃ ডলারে ট্যুর প্যাকেজ টিকেট সংগ্রহ করি। স্কাই টাওয়ারে আরোহন করে স্কাই ক্যাবল কারে সন্তোষা ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে গমন করি। প্রায় দুইশত ফুট উপর দিয়ে ক্যাবল কার চলতে থাকে। যাত্রি আমরা চারজন। ক্যাবল কারের মেঝে ছাড়া চারপাশে গ্লাস, নিচে সিঙ্গাপুর নদী এবং মেরিনা বের পর্যটন জাহাজ দেখা যাচ্ছে। বড় বড় তিন-চার তলা পর্যটন জাহাজ তিন-চার শত যাত্রি নিয়ে সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সুইমিংপুল যুক্ত অনেক সুরম্য কটেজ। সমুদ্রের উপর দিয়ে এই ক্যাবল কারে আমরা সুন্দর ছোট্ট দ্বীপ সন্তোষায় যাই। এখানে ক্যাবল কার স্টেশনে নেমে লিফটে ১৫০ফুট নিচে নেমে আমরা ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে প্রবেশ করি। একজন মহিলা গাইড আমাদেরকে খেলনা ট্রেনে করে সিঙ্গাপুর স্কাই টাওয়ারে নিয়ে আসেন। অত্যন্ত হাসিখুশি অর্ধবয়স্কা এই মহিলা কৌতুকের মাধ্যমে চীনাসুরের ইংরেজিতে সবাইকে আনন্দ দেন ও সিঙ্গাপুর সম্পর্কে বিদেশীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। আমি পার ক্যাপিটা ইনকাম অফ সিঙ্গাপুরি পিপল জানতে চাইলে তিনি হেসে হেসে বললেন, আমাদের অর্থমন্ত্রিকে এই প্রশ্ন করতে ভাল হয়। তিনি এর উত্তর ভাল জানেন।

সিঙ্গাপুর স্কাই টাওয়ার প্রায় হাজার ফুট উচ্চ একটি মিনারাকৃতির বৃত্তাকার টাওয়ার, যে টাওয়ারটির নিচে গ্রাউন্ড লেভেলের চারদিক পরিবেষ্টন করে একটি কাচের চাক্তি রয়েছে। গোলাকার চাক্তির মধ্য বৃত্তাকারে চেয়ার বসানো। ৫০/৬০ জন পর্যটক চাক্তির ভিতর প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করা হয়। চাক্তির টাওয়ারকে কেন্দ্র করে ধীর গতিতে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠতে থাকে এবং হাজার ফুট উচ্চতায় টাওয়ারের চূড়া স্পর্শ করে। সারাটা সিঙ্গাপুরের নদী, সমুদ্র, কৃত্রিম লেক, বাগান বাড়ি, সান্টেক শহরের সুরম্য অট্টালিকার অপূর্ব দৃশ্যাবলী তখন নয়ন দুটিকে বিমোহিত করে দেয়। তারপর চাক্তিটি ধীরে ধীরে আবর্তন করে নিচে নেমে এসে ভূমি স্পর্শ করে।

তারপর সিঙ্গাপুর জুরাসিক পার্কে প্রবেশ করি। এখানে কোটী কোটী বৎসর আগে বিলুপ্ত হওয়া নানা প্রজাতির পশুপাখির ফসিল ও ভাস্কর্য্য রয়েছে। সিঙ্গাপুর রোলার কোস্টার বেশ বিখ্যাত। অন্যরা ভয়ে বিরত থাকলেও জিন্নুন এবং আমি দুই ধরনের রোলার কোস্টারে আরোহন করি। কোমর ও গলায় ব্যাল্ট পরানো হয়। ভয়ঙ্কর গতি নিয়ে রোলার কোস্টার হেলেধূলে দৌড় দেয়। মনে হয় আসাড় মেরে ছাতু বানিয়ে ফেলবে। একসময় মাথা নিচে এবং পা উপরের দিকে চলে যায়। মানুষ পরান সপে চিৎকার দেয়। আমরাও গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে ভয়কে তাড়াই। এখানে রোলার কোস্টার চড়া এক সাহসী এডভেঞ্চার। রোলার কোস্টার হতে প্রতিবার নেমে অনুভব করি মাথা গরম হয়ে গেছে। প্রচন্ড কেন্দ্র বিমুখি বলের প্রভাবে হাতের আঙ্গুলের অগ্রবাগে রক্ত জমে লাল হয়ে আছে। তারপর আমরা প্রাচীন মিশরীয় মৃত্যুপুরী ও ভূতের দেশ পিরামিডে প্রবেশ করি। এক ভূতুড়ে রাস্থা দিয়ে মানব কংকাল স্থূপ পার হয়ে মমির দেশে প্রবেশ করি। এক অন্ধকার গা-শিউরে উঠা সুরঙ্গ খালপথ। পানির উপর নৌকা ধরনের ট্রেনে চড়ে সুরঙ্গ পথে প্রবেশ করি। ঘিসঘিসে অন্ধকারে মাংস খসে পড়া কংকালাকৃতির ভূত তেড়ে আসে। পথে পথে ভয়ঙ্কর গরিলা, বানর, নরখাদক ভয় দেখায়। হঠাৎ একটি দেয়ার এসে রেলপথ আটকে দেয়। ভয়ে আঁতকে যাই রেলটি বুঝি প্রচন্ড বেগে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সংঘর্ষ ঘটার আগ মূহূর্তে রেলগাড়ি পিছনদিকে ছুটে যায়, মনে হয় একটুর জন্য বাঁচলাম। এবার দেয়াল সরে যায়, রেলগাড়ি ভয়ঙ্কর নরকে প্রবেশ করে। আগুন প্রজ্জলিত নরক, ভয়জাগা তার রূপ। তারপর পুতুলাকৃতির প্রানীজগত পেরিয়ে শুরুর পিরামিড স্টেশনে এসে নেমে পড়ি।

দেশবিদেশের পাঁচ ছয় শত মানুষের সাথে এবার একটি সুরম্য অডিটরিয়ামে প্রবেশ করি। লাল নীল বাতি জেলে উঠে রঙ্গমঞ্চে। একজন শ্বেতাঙ্গ অভিনেতা কৌতুক অভিনয় করেন, হাস্যরসে উপচে পড়ে হল। মঞ্চের পাচটি দরজা দিয়ে আট দশ জন অভিনেতা এবং গায়ক গায়িকা এসে হাজির হন। অভিনয়ের সহিত পশ্চিমা সঙ্গীতের এক উচ্ছল মুচ্ছনা দর্শকদেরকে অপার আনন্দ দান করে।     

এই অডিটরিয়ামে সুন্দর অনুষ্টান উপভোগ করে আমরা এক সুরম্য থিয়েটারে প্রবেশ করি। স্পেশাল কালোগ্লাসের চশমা চোখে দিয়ে থ্রি- ডায়মেলশন সিনেমা দেখি। সাপ, মাকড়াসা, বিচ্ছু ইত্যাদি মনে হয় এসে গায়ে পড়ে যাচ্ছে, দর্শকরা ভয়ে চিৎকার করেন। সাধারন টিভি পর্দায় ছবির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আসে কিন্তু থ্রি- ডায়মেলশন ছবিতে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের সাথে উচ্চতাও চলে আসে। ফলে মনে হয় ছবি যেন ছায়া নয়, বাস্তব ও জীবন্ত ঘটনা সামনে ঘটছে। সিঙ্গাপুর কার্নিভাল দর্শনের জন্য এবার আমরা একটি মার্কেটের নিচতলার রাস্থা পার হই। মার্কেটের গ্রাউন্ড লেবেলে নদী ধরনের সুইমিংপুল, যার বাউন্ডারি কাচঘেরা। এই সুইমিংপুলে শিশুরা নেমে প্লাস্টিকের নৌকা চড়ছে। প্রতি রবিবার সিঙ্গাপুর কার্নিভালের বিচিত্র মিছিল ও রথযাত্রা অনুষ্টিত হয়। আজ রবিবার আল্লাহের মেহেরবানীতে আমরা সিঙ্গাপুর কার্নিভাল উপভোগ করার সৌভাগ্য লাভ করি।

সিঙ্গাপুরের চকচকে পরিস্কার রাস্থা ও ফুটপাতে শত শত নর-নারী- শিশু পাশাপাশি বসে যান। বেশ কয়েক ধাপে কার্নিভাল মিছিল অনুষ্টিত হয়। প্রথম মিছিলে আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যেসব পশুপাখি বিচরন করেছে এসব প্রানীর মুখোশ পরে শতাধিক মানুষের মিছিল যায়। চাকাওয়ালা গাড়ির উপর বিভিন্ন প্রানীর যান্ত্রিক বড় বড় পুতুলের নৃত্য সহকারে এই মিছিল পার হয়।

তারপর আসে প্রাচীন রোমান সভ্যতার মানুষের মিছিল। সেযুগের রোমান পোষাকে সুসজ্জিত বল্লমধারি সৈনিক এবং অভিজাত শ্রেনীর লোকজন এগিয়ে যান। সেনাদলের মাঝে সে যুগের কাটের চাকার ঘোড়ার গাড়িতে দেখা পাই অভিজাতদের অবস্থান। প্রাচীন মিশরীয়দের মিছিল আমার মন কাড়ে। ঘোড়ার গাড়িতে বসা ফারাওয়ের মুকুটে ঈগলের মুখ, লাটিগুলোর অগ্রভাগে সাপের উদ্ধত ফনা। দুইলাটির মধ্যভাগে দু’পা রেখে প্রায় পনের ফুট উঁচু মানুষের মিছিল। পিরামিড আকৃতির গাড়িতে করে মমি কবরে নিয়ে যাওয়ার মিছিল মিশরকে ফুটিয়ে তুলে। আফ্রিকার জংলী অর্ধনগ্ন কালো মানুষের বিচিত্র নৃত্যসহ মিছিল মন কেড়ে নেয়। তারপর পাশ দিয়ে যায় নাঙ্গা তরবারি হাতে মুসলিম সুলতানকে ঘিরে ৭০/৮০ জন সৈনিকের মিছিল। এরা সবাই টুপি পরা এবং মুসলিম পোষাক পাজামা পাঞ্জাবী শেওয়ানি সজ্জিত। তাদের চেহারায় এক বেপরওয়া ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে। মিছিলের শেষ পর্বে আধুনিক সভ্যতা এবং সিঙ্গাপুরের কৃষ্টি ও জীবন ফুটিয়ে তুলা হয়। সিঙ্গাপুর কার্নিভাল দর্শন আমার জীবনের এক বিচিত্র অভিঞ্জতা, ইতিমধ্যে তিনঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, বিকেল শেষে সন্তোষা দ্বীপে রাত নামছে।

এবার আমরা সামুদ্রিক প্রানী দর্শনের জন্য এক বিশাল ফিস একুরিয়ামে প্রবেশ করি। ভূগর্বস্থ প্রবেশ পথের দেয়াল জুড়ে গ্লাসের একুরিয়ামে বিশ্বের সব ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ, ঝিনুক, চিংড়ি, কাকড়া, শৈবাল, অক্টোপাস ইত্যাদি দেখা হয়। এমন কি পথের মেঝে স্থাপন করা গ্লাসের নিচে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সোনালী ইত্যাদি নানা বর্নের অপূর্ব সুন্দর সামুদ্রিক মাছ বিচরন করতে দেখি। অসংখ্য মাছকে জুনাকী পোকার মত জ্বলে নিভে আলো বিতরন করে সাতার কাটতে দেখে মুগ্ধ হই। আমরা এক জায়গায় একটি বিশাল কাচের দিঘী আকারের একুরিয়ামে যাই। এই একুরিয়াম দীঘির চারপাশে স্টেডিয়ামের মত ধাপে ধাপে বসার জায়গা। এই দীঘি একুরিয়ামে সাতার কাটছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাণী তিমি মাছ। প্যাভেলিয়নে বসে এই তিমির দলকে দেখে মনে হল কাচ ভেঙে বেরিয়ে আসলে এরা ক্ষনিকের মধ্যে আমাদেরকে খেয়ে সাবাড় করে দেবে। সমুদ্রের এত সব বিচিত্র ধরনের মখলুকাত দর্শনের সুযোগ দানের জন্য দয়াময় আল্লাহকে অশেষ শুকরিয়া জানিয়ে আমরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসি। ১৩৯ ডলারে টিকেট কেটে মনে করেছিলাম অনেক খরচ হয়ে গেছে কিন্তু সারাদিনের এত এত অনুষ্টানমালা উপভোগ করে সান্তনা পেলাম টিকেটের ৮০০০টাকা পুরোটাই সার্থক হয়েছে।   

সিঙ্গাপুর চ্যাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের একটি অত্যাধুনিক সুন্দর স্থাপনা। এটি দামি নির্মান সামগ্রী দ্বারা নিখুঁতভাবে নির্মিত। রয়েছে চলন্ত বেল্টে চলার ব্যবস্থা। রয়েছে আর্কিড ও কুসুমবীথি সমৃদ্ধ বাগান। বাগানের মাঝখানে সুদৃশ্য রঙ্গীন মৎস্য একুরিয়াম, তার মাঝে এপাশ ওপাশ সেতু। সেতুর দুদিকে বসার সোফাসেট।

মালায়ান সিঙ্গা শব্দের অর্থ ‘সিংহ’ এবং পুর শব্দের অর্থ ‘দেশ’। তাই সিঙ্গাপুরের বাংলা দাড়ায় ‘সিংহদেশ’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি রাষ্ট্রবিঞ্জানে মাস্টার্স অধ্যয়নকালে শত শত বছর টিকে থাকা গ্রীসের প্রাচীন স্বাধীন সার্বভৌম নগর রাষ্ট্রসমূহ সম্পর্কে অবহিত হই। প্লেটো ও এরিস্টেটলের গবেষনায় উদ্ধৃত গ্রিক নগর রাষ্ট্র এথেন্স, স্পার্টা, থেবেস ইত্যাদি অধ্যয়ন করে কোন এক নগর রাষ্ট্র পরিদর্শনের ইচ্ছে জাগ্রত হয়। নগর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর সফর করে আমার সেই ইচ্ছে কিছুটা পূর্ন হয়।

দেশটির আয়তন ২৪০ বর্গমাইল এবং আমার সফরের সময় জনসংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষ। সিঙ্গাপুর একটি বহুজাতিক মানুষের দেশ, এখানে জনগনের ৭৪% চীনা, ১৩% মালয়ী, ৯% ভারতীয় এবং ৪% অন্যান্য। ধর্মেও বেশ বৈচিত্র রয়েছে। সিঙ্গাপুরীরা ৩৩% বৌদ্ধিষ্ট, ১০% তাও, ১৯% খ্রিষ্টান, ১৮% ধর্মহীন, ১৪% মুসলিম, ৫% হিন্দু এবং ১% অন্যান্য। এখানে বহু ভাষাভাষী লোকজন বসবাস করেন। এই দেশে ভাষা হিসাবে ইংরেজী ৩৭%, চীনা মেন্ডারিন ৩৫%, মালয় ১১%, তামিল ৩% এবং অন্যান্য ভাষা ১৪% মানুষ ব্যবহার করেন।

আমার কাছে বিস্ময় লাগে চারটি ধর্মের, চারটি ভাষার, তিনটি আলাদা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্টি নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও বিশ্বাস সযতনে লালন ও ধারন করে সর্বক্ষেত্রে বিশ্বের শ্রেষ্ট জাতিতে পরিনত হয়েছে। তাদের মধ্যে ধর্ম, বর্ন, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা রাজনীতি নেই। তারা ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে থাকে। সিঙ্গাপুরী চীনাদের মধ্যে তেমন কোন ধর্মচারন লক্ষ্য করিনি। বাংলাদেশীদের কাছে শুনেছি চীনারা খুবই ভদ্র, পরিশ্রমী ও বিনয়ী। বিশাল জনগোষ্টি নাস্তিক্য ধর্মের অনুসারী হয়েও তাদের নৈতিকতার মান আমাদের মত ধর্মভীরু দেশের নৈতিকতার মানের অনেক উপরে রয়েছে। প্রতি বৎসর জাতিসংঘের সূচকে সিঙ্গাপুর সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশের তালিকার এক হতে তিনের মধ্যে অবস্থান করে। সিঙ্গাপুরের প্রাচীন জনগোষ্টি মালয়ীরা আরব বনিকগন কতৃক ইসলাম ধর্মে ধীক্ষিত হন। পরে আসেন চীনারা। বৃটিশরা উপনিবেশিক আমলে সিঙ্গাপুর বন্দর ও জাহাজ শ্রমিক হিসাবে দক্ষিণ ভারত হতে তামিল জনগোষ্টিকে নিয়ে আসে। এরা সিঙ্গাপুরের কালো ও শ্রীহীন জনতা। তাদের মন্দির, পূজাপার্বন, রথযাত্রা ইত্যাদি সিঙ্গাপুরের সংস্কৃতির একটি অংশে পরিনত হয়েছে। সিঙ্গাপুরে প্রায় ১০/১২ লক্ষ বিদেশি কর্মজীবী মানুষ রয়েছেন। এদের কোন নাগরিত্ব নেই, কেবল ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। লিটল ইন্ডিয়ায় রবিবার রাতে ফিরে এসে একটি মাঠে ৪০/৫০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকদের জমায়েত দেখতে পাই। সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশিরা রবিবার ছুটির দিনে এখানে এসে সমবেত হন। চাপাশের বাংলাদেশী হোটেলগুলোয় স্বদেশী খাবার খেতে প্রবেশ করা লোকের ভিড়ে বসার ঠাই নাই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এদেশে বাংলাদেশীরা আরামেই আছেন। কাজকর্ম যান্ত্রিক, কর্ম পরিবেশ উন্নত, কাজ তেমন কষ্টকর নয়।

সিঙ্গাপুর সব সুচকেই বিশ্বে প্রথম সারিতে আবস্থান করে। এখানে দুর্নীতি নেই, চুরি-ডাকাতি নেই, নেই মাদক সামগ্রী। এটি বিশ্বের প্রথম সারির একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ। মানুষ সোনা-রূপা, ডলার নিয়ে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করে। রাত ২টার নাইট সাফারি হতে ফেরার সময় লক্ষ্য করি স্বল্প বসনা অনিন্দ্যসুন্দরী নারীরা নিঃশঙ্ক চিত্তে নির্ভয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছেন, যা বাংলাদেশে চিন্তাই করা যায়না। আমাদের দেশের ব্যাধি ইভটিজিং কিংবা বখাটেদের উৎপাত সিঙ্গাপুরবাসীরা কল্পনাও করতে পারেনা। এদেশে মাদক বহন গুরুতর অপরাধ, মাদকসহ স্বদেশী বা বিদেশি কেউ ধরা পড়লে তারা নিস্তার দেয়না। অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেয়। মাদক বহন করে এখানে বেশ কয়েকজন বিদেশি মৃত্যুদন্ডের শিকার হয়। আমার ভাগনা জিন্নুন ইউরোপ ও আমেরিকা সহ সারাটা বিশ্বভ্রমন করেছে, সে সিঙ্গাপুরের ডিজিটাল ব্যবস্থা লক্ষ্য করে বলল, ‘সিঙ্গাপুর ডিজিটালে ইউরোপের বাবা’। এখানে সবকিছু স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চলে। টাকা ডুকালে অটো ট্রেনের টিকেট বের হয়। টেপের নিচে হাত নিলেই পানি আসে, সরালেই বন্ধ হয়। হাইকমোড হতে উঠা মাত্রই অটো ফ্লাশ হয়। বাতাস পাইপে হাত রাখলেই গরম/ঠান্ডা বাতাস এসে হাত শুকিয়ে দেয়, সরালেই বন্ধ হয়। ট্রেনের টিকেট ভূগর্বে ছুয়ালেই প্লেটফর্মের দরজা খোলে যায়। ডুকামাত্র অটো বন্ধ হয়। অত্যন্ত হাইটেক অটোমেশনের দেশ সিঙ্গাপুর। পঞ্চাশ লক্ষ লোকের ক্ষুদ্র দেশ সিঙ্গাপুর, অথচ এখানে রাস্থায় খুব একটা লোকভীড় দেখা যায়না। কারন এখানে মানুষ চলাচল করে আরামদায়ক ভূগর্বস্থ ট্রেনে। ভূউপরিভাগে স্বর্গউদ্যান সম ফুল, লতা, বৃক্ষরাজির বুক চুরে বয়ে যাওয়া রাস্থাগুলো দিয়ে বিচরন করে ট্যুরিস্ট বাস, কিছু দামি কার এবং জলেস্থলে বিচরনকারী উভচর ‘ডাক ভেহিকল’ যানবাহন রাস্থায় চলাচল করে এবং নেমে যায় সিঙ্গাপুর নদী ও সাগরে।

দেশটিতে কোন মশামাছি নেই, নেই কোন ময়লার ছিটে ফোটে। লিটল ইন্ডিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক ও তামিলরা থাকেন। রোববারের বাঙ্গালী সমাবেশ মাঠে দুচারটি কাগজের টুকরা টাকরা দেখতে পাই। আমাদের দেশে লোকজন ফুটপাতে প্রস্রাব করে, কিন্তু সিঙ্গাপুরে রাস্থায় থুথু ফেললে কুড়ি সিঙ্গাপুরী ডলার অর্থাৎ ১২০০ টাকা জরিমানা দিতে হয়। এখানে পানীয়ের চেয়ে খাবার পানির দাম বেশি। সারাটা দেশে ঝর্না ও ফোয়ারায় পানির নাচ নয়ন মুগ্ধ করে। সিঙ্গাপুরে পুলিশ খুব একটা দেখা যায় না। সারাটা দেশ সিসিটিভির আওতায় রয়েছে। কোথায়ও অপরাধ করে পার পাওয়ার উপায় নেই- সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়বেই এবং সাথে সাথে পুলিশ এসে হাজির হবেই। এখানে মারামারি করাতো দূরের কথা মানুষের মধ্যে বাগবিতন্ডা হবারও উপায় নেই। ৯৯৯ নম্বারে কল কলেই পুলিশ এসে হাজির হয় এবং সিসিটিভির কথাবার্তা পরীক্ষা করে কে দোষি বের করে। এদেশে অপরাধীর দ্রুত বিচার হয় এবং দ্রুত দন্ড কার্যকর হয়। আমরা যে হোটেল স্টার এসিয়ায় অবস্থান করি তা পরিচালনা করেন ভারতীয় তামিলরা। এরা মূল সিঙ্গাপু্রীদের মত সৎ নয়। ভাগনা জিন্নুন তিনদিন অবস্থান করার হোটেল ভাড়া অগ্রীম পরিশোধ করে। বের হতে ঘন্টাখানিক দেরী হওয়ায় তারা আর একদিনের ভাড়া দাবী করে বসে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে জিন্নুন বলল, ‘আমি পুলিশ ডাকছি, তারা এসে সিসিটিভিতে আমাদের কথাপোকথন পরীক্ষা করে যদি বলে তাহলে আমরা আরেকদিনের ভাড়া দেবো। একথা শুনামাত্র তারা তাদের দাবি হতে সরে যায়। এবার বুঝলাম পুলিশ আসলে বিদেশীদের সাথে প্রতারনার জন্য তারা বড় অঙ্কের জরিমানার সম্মুখীন হত।

কলেজে অধ্যয়নকালে ‘লাভ ইন সিঙ্গাপুর’ নামক একটি ঢাকাইয়া ছবিতে সিঙ্গাপুরি মেম প্রত্যক্ষ করি। ভূগর্বস্থ ট্রেনে স্বল্পবসনা এইসব অনিন্দ্যসুন্দরী মেমদের এবার স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়। ক্ষুদে হাফপ্যান্ট এবং গায়ে হাতকাটা টি-সার্ট, গেঞ্জি, সেমিজ কিংবা ট্রাউজার পরিহিত সেসব মেয়েরা সত্যই অপরূপা। তারা অনেকটা আমাদের মনীপুরী মেয়েদের মত সুন্দরী, তবে আরো ফর্সা ও স্মার্ট। তাদের চুল মনীপুরীদের মত খাড়া ও মসৃন। সবার হাতে আইপেড, তাদের কথা অল্প- আইপেডে সবার চোখ। মেমদের প্যান্ট হাটুর অনেক উপরে থাকলেও ছেলেদের প্যান্ট হাটুর নিচে কিংবা আমাদের মত পায়ের গিট্ট পর্যন্ত প্রসারিত। তাদের গায়ে রয়েছে ফুল অথবা হাফ সার্ট কিংবা গেঞ্জি।

সিঙ্গাপুরে সাপ্তাহে মাত্র একটি পত্রিকা বের হয়, অথচ জনগন আইপেডে চোখ রেখে লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনি কিংবা পিকিংয়ের সংবাদপত্র ট্রেনে বসে বসে পড়ে নেয়। সিঙ্গাপুর নামক ক্ষুদ্র নগর রাষ্টটির জনসম্পদ ছাড়া তেমন কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। কৃষি নেই, খনি নেই। এমন কি খাবার ও ব্যবহার্য্য পানিও মালয়েশিয়া হতে আমদানি করতে হয়। দেশটি ১৯৬২ সালে মালয়েশিয়ার একটি অংশ হিসাবে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মালয়েশিয়া এই চীনা জন অধ্যুষিত ঘনবসতির এই দ্বীপটিকে জঞ্জাল মনে করে ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট স্বাধীনতা প্রদান করে। অবশ্য এতে ইংরেজদের ষড়যন্ত্র ও স্বার্থ কার্যকর ছিল। তাই অনেকে কৌতুক করে সিঙ্গাপুরকে বৃটেনের অবৈধ কন্যা বলে অভিহিত করেন। আমাদের মত স্বাধীন হয়ে সিঙ্গাপুরের লাভই হয়েছে। আজ মালয়েশিয়ার মাথাপিছু আয় যেখানে ৯০০০ মার্কিন ডলার, সেখানে সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় ৫৭,০০০ মার্কিন ডলার, যাহা মালয়েশিয়ার ছয়গুণেরও বেশী এবং বিশ্বের রাষ্ট্রসমুহের মধ্যে প্রথম। ৪০,০০০ মাথাপিছু আয় নিয়ে ইউরোপিয়ান দেশ নরওয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশি বিদেশি মিলে প্রায় পঁয়ষট্টি লক্ষ লোক এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রে বসবাস করলেও তেমন ভীড় দেখা যায়না। অসংখ্য দৈত্যাকার বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে মানুষ হারিয়ে যায়। দেশটিতে কাজের তুলনায় জনবল কম। জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, তাই মাদেরকে সন্থান জন্মদানে উৎসাহিত করার জন্য দেড় বৎসর মাতৃত্ব ছুটি প্রদান করা হয়। একটি ছয় মাইল দীর্ঘ্য সেতু সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়ার সাথে যুক্ত করেছে। পশ্চিমে ২০/২৫ মাইল সাগর পার হলেই ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ। দুই ভূভাগের মাঝখানের সাগরে সিঙ্গাপুরের অবস্থান, তাই এখানে সমুদ্র অগভীর ও শান্ত। আমাদের কক্সনাজারের মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অনুপস্থিত হলেও উচ্চ প্রযুক্তির সাহায্যে লোকজন কৃত্রিমভাবে দেশটাকে সাজিয়ে নিয়েছে। সমুদ্রের স্থানে স্থানে ময়লা জমিয়ে ছোট ছোট দ্বীপমালা তৈরী করে নিচ্ছে। সিঙ্গাপুর ব্যবসা সফল দেশ। পর্যটন, চিকিৎসা, শিক্ষা, শেয়ার, ক্যাসিনো, নাইট ক্লাব, এয়ারলাইন, জাহাজ পরিবহন, প্রতিটি ব্যবসা তারা নিপুনভাবে পরিচালনা করে দেশটকে বিশ্বের সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশে পরিনত করেছে। পুলিশ ও প্রতিরক্ষা খাতে তাদের তেমন খরচ নেই।

দেশটিতে সংসদীয় গনতন্ত্র রয়েছে। সব ধর্ম, বর্ন ও ভাষার লোক মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী একজন তামিল। দেশটিতে কোন বেকার নেই, জেইসি পাস করামাত্রই চাকুরী অবধারিত। দেশটির অফিস আদালত শনিবার অর্ধ দিবস ও রবিবার পূর্ন দিবস বন্ধ থাকে।

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াকে বলা হয় চির বসন্তের দেশ। এখানে ঋতুচক্র নেই, বারমাস তাপমাত্রা আমাদের দেশের মার্চ-এপ্রিল মত বিরাজ করে। প্রতিদিন অল্প অল্প বৃষ্টি হয়। তাই এখানে গাছতলায় পানি সেচনের তেমন প্রয়োজন হয়না এবং বৃষ্টিস্নাত বৃক্ষগুলো ঘাড় সবুজ রঙ্গ নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। আমি সিঙ্গাপুর অবস্থানের তিন রাতই হালকা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে দেখেছি।

১ জুলাই ২০১৩  রোজ সোমবার। আজ সিঙ্গাপুরে আমাদের শেষ দিন। সিঙ্গাপুরের আমাদের ঠিকানা লিটল ইন্ডিয়ার হোটেল স্টার এসিয়া হতে বেরিয়ে বাংলাদেশী হোটেলে খাই। তারপর কেনাকাটার বেগেজ মোস্তফা প্লাজার বাহিরে রেখে মার্কেটে প্রবেশ করি। মোস্তফা প্লাজা হতে বের হয়ে পাশের ফারের পার্ক আন্ডার গ্রাউন্ড রেল স্টেশনে প্রবেশ করি। সিঙ্গাপুর চ্যাঙ্গি বিমানবন্দরের টিকেট কেটে রেলে চড়ি। ভূগর্ব এবং ভূপৃষ্টের কয়েকটি স্টেশন পার হয়ে ট্রেন আবার ট্যানেলে প্রবেশ করে মাটির অনেক নিচ দিয়ে যেয়ে ১১টা ৩০মিনিটে সিঙ্গাপুর চ্যাঙ্গী বিমানবন্দরের ভূগর্বস্থ স্টেশনে থামে। এই ভূগর্বস্থ স্টেশন হতে লিফটে উপরে উঠে আমরা সিঙ্গাপুর চ্যাঙ্গি বিমানবন্দরে আবিস্কার করি। এবার মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের একটি বিমানে আরোহন করে দুপুর ১২টা ৩০মিলিটে যাত্রা শুরু করি। তখন সূর্যের আলো আকাশে ঝলমল করছে। সাদা  সাদা মেঘেরা ডানা মেলে বাতাসে ভাসছে। ধীরে ধীরে সিঙ্গাপুর সিটির ভবনমালা অদৃশ্য হয়ে যায়। মনে মনে বলি গুডবাই সিঙ্গাপুর, আবার যেন দেখা হয়।      

সিঙ্গাপুর- অনন্য সুন্দর একটি দেশ। দেশটির প্রকৃতি ও মানুষ আমার দারূন পছন্দ লেগেছে। এদেশের রাজনীতিবিদ ও জনগণকে ধন্যবাদ জানাতে হয়, তারা এমন একটি অতুলনীয় দেশ ও সমাজ গড়তে পেরেছে যা সারা বিশ্বের জন্য অনুকরনীয়। আমি এই ভাল মানুষের অনন্য সুন্দর দেশটির উত্তর উত্তর মঙ্গল ও সমৃদ্ধি কামনা করে সিঙ্গাপুর ভ্রমনের ইতি টানলাম।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন