সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

জকিগঞ্জে ফুলতলী পীর সাহেবের বাড়ি সফরঃ

 জকিগঞ্জে ফুলতলী পীর সাহেবের বাড়ি সফরঃ

সিলেটের সুবিখ্যাত আলেম ও ওলিআল্লাহ মৌলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী হুজুর কিবলায়ে ফুলতলীর(রহঃ) ছিটেফোটা কিছু স্মৃতি আমি ইতোপূর্বে এই আত্মজীবনীতে বয়ান করেছি। বাংলাদেশ ও আসাম অঞ্চলে ধর্মীয় পীর-মুরিদী প্রথা কয়েক যুগ ধরে প্রচলিত। দাউদপুর চৌধুরী পরিবারের লোকজন কয়েক পুরুষ ধরে সিলসিলায়ে ফুলতলী- সিলসিলায়ে বদরপুরী- সিলসিলায়ে জৈনপুরীর মুরিদ ছিলেন। জমিদারদের সাথে এই এলাকার জনগণও এই সিলসিলায় নিজেদেরকে বিলীন করে দেন। এই সিলসিলার বংশগত ও প্রথাগত একজন মুরিদ আমাকে বলা যেতে পারে, যদিও এই ব্যবস্থার প্রতি আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই।

এই ফুলতলী সিলসিলার আলেমদের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে অনেক অনেক মসজিদ মাদ্রাসা পরিচালিত হত। আমাদের গ্রামের জামে মসজিদ, ফাজিল মাদ্রাসা এবং হাফিজিয়া মাদ্রাসা আমরা আমাদের জমিতে স্থাপন করলেও এই প্রতিস্থানগুলো পরিচালনা করতেন ফুলতলী সিলসিলার আলেম, ইমাম ও হাফেজগন। ফুলতলীর আনুগত্য ও অনুমোদন ছাড়া এখানে কারো চাকুরী হতনা, এমনকি হুজুরে কিবলা ফুলতলীর বিরাগভাজন হলে চাকুরীও থাকতনা। ফলে এখানে একতরফা কেবল হুজুর কিবলার প্রশংসা ও বন্ধনা চলত। এখানে হুজুরের বিপক্ষে টু শব্দটি করার সাহস কারো নেই, কারন মুরিদরা ক্ষেপে গেলে পিষে ফেলবে। এখানকার গ্রামবাসীরা কয়েকপুরুষ ধরে এই পীর সিলসিলার মুরিদ। এখানে এই পীরসাহেবের সমালোচলা করা লোকে আল্লাহের বিরোধীতা বলে মনে করে। আল্লাহ, আল্লাহর রসুল মোহাম্মদ(সঃ) ও পীরেকামেল ওলীআল্লাহ ফুলতলী(রঃ) এই তিনজনকে সিলেটের পল্লীগ্রামের সহজ সরল জনতা ইসলাম ধর্মের মূলভিত্তি হিসাবে গন্য করে থাকেন।

এইগ্রামে যে দুএকজন দেওবন্দি ঘরানার আলেম ছিলেন তাদের এখানে কোন স্থান হতনা। তারা দূরের দেওবন্দি মসজিদে গিয়ে জুমুয়ার নামাজ আদায় করতেন। জামাতে ইসলামের লোকজন এবং তাবলিগ জামাতীরাও হুজুর কিবলা ফুলতলীকে(রঃ) খুব একটা ভাল চোখে দেখতো না। আসলে সিলেট এলাকার ধর্মীয় নেতৃত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে একটা নিরব প্রতিযোগিতা সব সময় লেগেই থাকতো। এই প্রতিযোগিতা মাঝে মধ্যে টুকটাক ঠেলাধাক্কায় গিয়েও ঠেকতো। পীরে পীরে ঘষাঘষি, মুরিদেরা পিষে মসলা গুঁড়ো।    

হুজুরে কিবলা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলীর(রঃ) জন্ম জকিগঞ্জে ১৯১৩ সালের ২৫ মে এবং প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারি সিলেট শহরে তিনি পরলোকগমন করেন। আমার পিতার জন্ম ১লা সেপ্টেম্বর ১৯১৬ সালে তাই হুজুর কিবলা আব্বার জন্মের তিন বছর আগে ভূমিষ্ট হন। আব্বার তিন বছরে সিনিয়র পীর সাহের আব্বার মৃত্যুর (২৪ নভেম্বর ২০০৭ সাল) প্রায় একই সময়ে দেহত্যাগ করেন। একথা বলার অর্থ হল তারা দুইজনের জীবনের পরিধি ছিল বেশ দীর্ঘ্য, সেইসাথে সমান ও সমান্তরাল। তাছাড়া তারা দুজনই পুরাপূরী একই সময়কালে জীবন পার করেন।

১৯৯৫ সাল হতে আমি সিলেট শহরে বসবাস শুরু করি। সিলেটের এই মশহুর ফুলতলী পীর সাহেবের গ্রামের বাড়ি দেখার একটা স্বপ্ন শৈশব হতেই আমার অবচেতন মনে সব সময় সুপ্ত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের এত দূরে গিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসা তখন খুব সহজ কাজ ছিলনা। এক সময় হুজুরে কিবলা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলীর(রঃ) পুত্র মুফতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর সাথে আমার কানিহাটি হাজিপুরের ফুফুতো ভাই আব্দুল অহিদ চৌধুরীর কন্যা রাফুর বিয়ে হয়। এই বিয়ে এই ওলী আল্লাহর সাথে আমাদের এক আত্মীয়তার বন্ধন রচনা করে দেয়। হুজুর জীবিতকালে আমি একদিন তার সুপানিঘাটের বাসায় গেলাম। আজকের আলিফ ভবনের স্থানেই ছিল পীরসাহেবের বাংলো প্যাটার্নের সুন্দর টিনের বাড়ি, চারপাশে ছিল প্রচুর খালি জায়গা। আমার পরিচয় পেশ করামাত্রই অতি বুদ্ধিমান ফুলতলী পীরসাহেব আমাকে বেয়াই অভিধায় ভূষিত করলেন। এই পরিচয়ের পর এদিকে গেলেই আমি তার সাথে দেখা করতাম এবং একটা সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করাকালেই সামনে চানাস্তা চলে আসত।

ওয়াজ ও দাওয়াতি কাজে হুজুর সর্বদা ব্যাতিব্যস্ত থাকায় বাসায় গেলেই যে তার দেখা পেতাম এমন নয়। মনে পড়ে একদিন বাসায় ডুকে হুজুর কিবলার দেখা পেলাম। বেশ আয়েশে আলেম ও তালবা পরিবেষ্টিত হুজুর কিবলাকে পেয়ে সেদিন আমি তার কাছে ফুলতলী সাহেববাড়ি দেখার অভিলাশ ব্যক্ত করলাম। লাগদাড়ী সবুজ পাগড়িপরা সুদর্শন হুজুর কিবলা ফুলতলী জবাব দেন, বেয়াই সাহেব আমি প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ফুলতলী যাই এবং শুক্রবার দিনটি ফুলতলীতে কাটাই। বেয়াই, আপনি এক বৃহস্পতিবার বিকেলে আসেন, চাইলে আমার জিপে করে আমার সাথে ফুলতলী যেতে পারেন।

প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমিও তখন সপরিবারে দাউদপুর বাড়িতে ছুটে যেতাম। শুক্রবার আমার বেগম সাহেবার গ্রামের বাজারে রোগী দেখার প্রগ্রাম থাকত। তাই যাবো যাবো করেও হুজুর কিবলার জিপে চড়ে তার সাথে আমার আর ফুলতলী যাওয়ার সৌভাগ্য হলনা।        

আমি ২০১৩ সালের এপ্রিলে এই মহান পীরে কামেল আব্দুল লতিফ চৌধুরীর(রঃ) ফুলতলী গ্রামের আস্থানা সফরে যাই। হুজুর কিবলা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী(রঃ) তখন আর বেচে নেই। একদিন তার পুত্রবধু রাফু ভাতিজীকে ফোন করে বললাম আমরা কালকে ফুলতলী আসছি। ভাতিজী বললেন, আসেন চাচা আমরা আছি, আপনারা আসলে আমরা খুব খুশী হবো। সেদিন ছিল পবিত্র শুক্রবার, সকালের নাস্তা শেষে আমার কার ফুলতলীর দিকে স্টার্ট করলাম। ড্রাইভে আমি সাথে আছেন পত্নী ডাঃ নুরজাহান ও পূত্র জেফার। চারখাই পার হয়েও আর অনেকদূরে ফুলতলী গ্রামের অবস্থান। রাস্থায় একস্থানে গাড়ি থামিয়ে জানলাম কালীগঞ্জ পার হয়ে আটগ্রাম বাজারের রাস্থা বরাবর গিয়ে ফুলতলী পৌছতে হবে। আটগ্রামের কাছে বারকোট নামক স্থানে আমাদের নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক ডা বাহার ভাই কতৃক তার নানার নামে প্রতিষ্টিত আব্দুল মতিন চৌধুরী স্কুল এন্ড কলেজটি দেখতে পাই।

সামনে এগিয়ে এক অজপাড়াগায়ের রাস্থায় ডুকলাম। একটি ইটভাটা এবং চারপাশে হাওর ও সবুজ মাঠ। গরীব মানুষের ঘরবাড়ি। এবার দূরে একটি ছোট্ট শহর চোখে ধরা পড়লো। বেশকিছু বহুতল ভবন ও স্থাপনা দেখা যাচ্ছে। ভাবলাম অজপল্লীর এই স্থানটিই নিশ্চয় ফুলতলী দরবার শরীফ। একটি বিশালাকার মাদ্রাসা ও এতিমখানা পার হলাম। ডানে পীরবাড়ির পারিবারিক গোরস্থান। তারপর সামনে দুইটি বিশাল জোড়া-দীঘির পারে উপনীত হলাম। প্রথম দীঘিপারে একটি বিশাল দ্বিতল মসজিদ, যে মসজিদের উত্তর পাশে ওয়ালঘেরা সুরম্য স্থানে পীরে কামেল আব্দুল লতিফ চৌধুরীর(রঃ) মাজার শরীফ। পারিবারিক কবরগাহ হতে বেশদূরে এখানে তিনি একাকী সমাহিত আছেন। এই দীঘির উত্তর পাশে মাদ্রাসার একটি একাডেমিক ভবন। একটি দুতলা ভবনে ফুলতলী প্রকাশনা অফিস ও ছাপাখানা দেখতে পেলাম, যেখানে হুজুর কিবলার ছাত্র সংঘটন তালামিজে ইসলামির প্রধান কার্যালয় রয়েছে।

দ্বিতীয় দীঘির পারে হুজুরে কিবলার একটি বাংলো যেখানে তিনি জীবিতকালে অবস্থান করতেন। এখানে একে একে তার দশ পুত্রের দুতলা একতলা পাকা বাড়ি রয়েছে। সেখানে দূরের একটি আবদ্ধ পাকাঘরে একাকি বাস করেন পীরে কামেল আব্দুল লতিফ চৌধুরীর(রঃ) প্রথম বেগম সাহেবা। তিনি এই আবদ্ধ ঘর হতে খুব একটা বের হন না। খাবারদাবার সব সেখানেই পাঠানো হয়। নির্জনে জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই বেগম সাহেবা ছিলেন বিখ্যাত বদরপুরী পীরের কন্যা । এই পীরকন্যাকে সবাই জিন্দা পীরানি মনে করেন এবং তাকে বিয়ে করে পীরে কামেল আব্দুল লতিফ চৌধুরীর(রঃ) ভাগ্য ফিরে, তিনি জৈনপুরী পীরসাহেবের(রঃ) আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার লাভ করে এই বিশাল ধর্মীয় সাম্রাজ্যের রাজত্ব পান। এই পিরানী মায়েরই সন্থান আমাদের ভাতিজি বর মুফতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী।  

একটি বড় ওয়ালের অন্তরালে অবস্থিত এই বাড়িগুলোতে মহিলাদের অন্দরমহল। এখানে পুরোপুরি একটি ইসলাম ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থার মধ্যে সব নরনারীরা বসবাস করেন। বোরকা এবং ইসলামী লেবাসের বন্ধনে এক আল্লাময় জীবনের ছায়া এখানে এক প্রশান্তির জগত তৈরী করে রেখেছে। গেট পেরিয়ে ভাতিজি রাফুর বৈঠকখানার সোফায় বসলাম। রাফু বললেন, চাচা তোমার ভাতিজি বর বাহিরে ওয়াজে গেছেন, শীঘ্রই ফিরবেন। আমরা চায়ে চুমুক দিতে না দিতেই ভাতিজি বর মুফতি গিয়াস উদ্দিন সাহেব এসে হাজির হন। মুফতি গিয়াস উদ্দিন আমাকে মাদ্রাসায় নিয়ে যান। মাদ্রাসার এতিমখানা ও আবাসিক হোস্টেলে থাকেন প্রায় দেড় হাজার তালবা। পাকঘরে ডুকে দেখি বেশ কিছু ঠেলাগাড়িতে করে এসেছে চাল, ডাল, মাছ, মোরগ, তরিতরকারী- চলছে দেড় হাজার লোকের জন্য রান্না বান্নার এক বিশাল লঙ্কাকাণ্ড। দৈনিক দেড় হাজার লোকের তিনবেলার খাবার ইন্তেজাম করা চাট্টিখানি কাজ নয়। এবার হুজুর কিবলার মাজারে ডুকে কবরের পূর্বদিকে দাঁড়িয়ে জেয়ারত করলাম। সামনের একাডেমিক ভবনে গিয়ে বর্তমান গদীনসীন পীর বড়সাহেবজাদায়ে ফুলতলী আল্লামা নুর উদ্দিনের(রঃ) সাথে দেখা করলাম। একজন দানশীল ব্যক্তি হিসাবে তার খুব নামডাক রয়েছে। তার কাছে জানলাম, এই সবকিছুই তার পিতার ওয়াকফ করে দানকৃত প্রায় শত একর জায়গার উপর গড়ে উঠেছে। ফুলতলী সাহেব বাড়িকে আদৌ কোন গ্রাম মনে হয় না। মনে হয় জোড়াদীঘির পারে যেন গড়ে ওঠা এক ছোট্ট উপজেলা শহর। তাও আবার বাংলাদেশের পূর্বসীমানা ঘেষা এক প্রত্যন্ত হাওর এলাকায়। ভাবলাম ধর্মীয় নেতৃত্ব মানুষকে অনেক সম্মানের অধিকারী করতে পারে, এখানে জড় অজড় সবকিছুই যেন ফুলতলী ফুলতলী করছে।

জুমুয়ার নামাজ এখানকার সুন্দর দুতলা গম্বুজওয়ালা মসজিদে পড়লাম। সামনের মাঠে অনেকগুলো কার পার্কিং করা হয়েছে। বর্তমান পীর নুর উদ্দিন(রঃ) সাহেবের ফয়েজে বরকত পেতে এবং হুজুর কিবলা আব্দুল লতিফ চৌধুরীর(রঃ) মাজার জেয়ারত করতে আমার মত এখানে ছুটে এসেছেন অনেক অনেক মুরিদ। মুফতি গিয়াস উদ্দিনের সাথে ফুলতলী রাজ্যে অনেকক্ষন ঘুরেফিরে এবার ছুটে এলাম তার ঘরে। বেশ তবররুখ আসল। ভাতিজী মজার মজার রান্না খাবারে টেবিল ভরে দেন।

দিঘিপারের মাঠে আমার অল্প বয়স্ক তালবা নাতির সাথে ব্যাডমিন্টন খেললাম। সুন্নতি খেলা, খেলুড়েদের সবার গাঁয়ে সুন্নতি পোষাক- পাজামা পাঞ্জাবী, তবে সটকেকে পরার ভয়ে অনেকের মাথায় টুপি নেই। এই নাতি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। 

খাবার শেষে ভাতিজী রাফু তার জিপের চালককে ডেকে পাঠান। জকিগঞ্জ ও আশপাশের দর্শনীয় সবকিছু দেখিয়ে নিয়ে আসতে তিনি ইয়াদাড়ি ও পাগড়িওয়ালা এক চালক হুজুরকে আদেশ করলেন। চালক হুজুর আমাদেরকে সারাটা জকিগঞ্জ ঘুরে দেখালেন। আমি অনেকবার জকিগঞ্জ গেলেও আমার বেগম সাহেবা নুরজাহান বেগম এবং সাহেবজাদা জেফার রহমানের এটাই ছিল প্রথম জকিগঞ্জ সফর। তারা প্রানভরে কুশিয়ারার পারে হেঁটে হেঁটে দেখলেন জকিগঞ্জ ও অপারের করিমগঞ্জ, আমলসিদে সুরমা ও কুশিয়ারার অপূর্ব মিলন দৃশ্য। 

এই বাড়িতে এসে পীরে কামেল আব্দুল লতিফ চৌধুরীর(রঃ) প্রতি আমার ভক্তিশ্রদ্ধা আর বেড়ে গেল। আমার মনে হল পীরে কামেল আব্দুল লতিফ চৌধুরী(রঃ) কোন সাধারন মানুষ নন, যেন একটি প্রতিষ্টান। প্রতি বৎসর ১৬ জানুয়ারী হুজুর কিবলা আব্দুল লতিফ চৌধুরীর(রঃ) মৃত্যুর তারিখে তার সম্মানে ইছালে ছওয়াব অনুষ্টান হয়, তখন বাড়ির উত্তরের হাওর লোকে লোকারন্য হয়ে যায়।

কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন সিলেট বিভাগের কোন মানুষটি সবচেয়ে ভাগ্যবান? তবে আমি নির্দিদ্বায় বলব তিনি পীরে কামেল আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী(রঃ)। জীবিতকালে তাকে খেদমত করার জন্য সব সময় আশপাশে মুরিদরা মুখিয়ে থাকত, হুজুর কিবলার একটু খেদমত করার সুযোগ পেলে তাদের জীবনটা যেন ধন্য হত। অযথা ভক্তদের এই এত সেবাযত্ন মাঝে মধ্যে তাকে বিরক্ত করে তুলত। যেখানে যেতেন সেখানেই ভক্তদের ঢল নামত। ভক্তদের মধ্যে তার নেতৃত্ব ছিল নিরঙ্কুশ এবং তাকে চ্যালেঞ্জ করে এমন বুকের পাঠা কারো ছিলনা। সিলেট এলাকায় তার ধর্মীয় সম্রাজ্যে তিনি একজন মর্যাদাবান সম্রাটের আসনে আসীন ছিলেন।  

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশেও তার মুরিদরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। এসব দেশে তার সদা যাতায়াত ছিল, সেইসাথে যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল। মহান আল্লাহ তাকে ধনে জনে এবং সম্মানে পরিপূর্ন করে দিয়েছিলেন। তার হাতেই গড়ে উঠে দশ পুত্র ও অগনিত মুরিদদের জন্য এই সুন্দর নগরী ফুলতলী, যেখানে আছে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, হাসপাতাল, প্রকাশনী সংস্থা, কিতাবখানা, হেফজখানা, মাজার শরিফ, দুইটি জোড়া দিঘী, তালামিজ অফিস, দারুল কেরাত মজিদিয়া অফিস, খেলার মাঠ, ঈদগাহ ইত্যাদি।   

হুজুরে কিবলা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী(রঃ) পঁচানব্বই বছরের এক সুদীর্ঘ্য সুখী জীবনকাল উপভোগ করে যান। হুজুর একটু অসুস্থ হলে সিলেটের গ্রামগঞ্জের মসজিদ মাদ্রাসায় তার জন্য এত দোয়াদুরুদ করা হত যে তিনি সেরে উঠতেন। লোকে মনে করত, মানুষের দোয়ার বদৌলতে তার আয়ু বেড়ে যাচ্ছে। এমন কি তার মুরিদ হুজুররা কেউ কেউ তাদের জীবন থেকে একটু একটু আয়ু নিয়ে হুজুর কিবলার জীবন আর বর্ধিত করে দেওয়ার জন্য আল্লার দরবারে ফরিয়াদ করত। এসব ভক্তরা পিতামাতা মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলে তাদের আয়ু হতে এক সেকেন্ড পরিমান আয়ু বাপ-মাকে দিত কিনা সন্দেহ, কিন্তু পীরের জন্য পুরো আয়ু দান করে দিতে তাদের কোন আপত্তি নেই। তাদের বিশ্বাস এর বদৌলতে পীর সাহেব তাদেরকে সাথে করে বেহেশতে নিয়ে যাবেন, হাতের কাছের এমন সুবর্ন সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়! অতিবৃদ্ধ বয়সে বার্ধক্যের জ্বালাতনে আতীষ্ট হয়ে আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী(রঃ) তার ভক্তদেরকে বলতেন, তোমরা আর আমার দীর্ঘায়ুর জন্য দোয়া করনা বরং দোয়া কর আল্লাহ যেন আমাকে শয্যাশায়ী না করে ঈমানের সাথে তুলে নেন।

পবিত্র কোরানের অমোঘ বানী-‘কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মউত’ ‘জীবন্ত সবাইকে মৃত্যুর পেয়ালা করতে হবে পান’। একদিন আল্লাহর পাঠানো মরনের স্বাধ নিলেন হুজুর কিবলা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী(রঃ), কিন্তু মরন তার সম্মান একটুও মুছে ফেলতে পারেনি। বরং মৃত্যুর পর তিনি দিনে দিনে আর উদ্ভাসিত হন।

তার মাজার জেয়ারত করতে শতশত লোকের ভীড় দেখে আমার মনে হল হুজুর জীবনে যেমন সুখী ছিলেন, মরনেও যেন তাই রয়ে গেলেন। তিনি দিঘীপারের সুন্দর মসজিদের উত্তরপাশে অপূর্ব সুন্দর কবরে দিচ্ছেন পরম শান্তির ঘুম। তার সাহেবজাদারা, মুরিদ ও তালবারা এখানেও তাকে সযতনে ঘিরে আছেন পরম মমতায়। আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করুন। আমিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন