দৈত্যাকার
গ্রন্থ ‘ইসফাক কুরায়শী রচনাসমগ্র’ বিতরণ কাহিনি
প্রথম বইটি লালবাজার মোহাম্মদি
অফসেট প্রেস হতে সংগ্রহ করে নিয়ে এসে একদিন আমার আম্মা আসমতুন্নেছা চৌধুরীর কক্ষে
প্রবেশ করলাম। আমার মায়ের শরীর তখন খুব একটা ভাল যাচ্ছিল না। তার রোগশয্যার পাশে
তখন বসে ছিলেন আমার বড়বোন রেহা। আমি বইটি তার হাতে তুলে দিলে নিস্পৃহ মনে একটু
নাড়াচাড়া করে বড়বোনকে বললেন, আমার ছেলে এই বই ছাপাতে তার বড়কষ্টে রোজগার করা
প্রচুর টাকা নষ্ট করেছে।
বড়বোন রেহা এবার জানতে চাইলেন
আমি এই অকাজে কত টাকা নষ্ট করেছি, সেইসাথে এই বই বিক্রি করে এই টাকা উদ্ধার হবে
কিনা তাই নিয়েও তারা বেশ চিন্তিত। আসলে তাদের ভাবনায় বিরাজ করছে তখন আমার প্রচুর টাকা
গচ্চা যাবার ব্যাপারটা। এবার বড়বোন রেহা বললেন, এই এত টাকা অন্যকোন কাজে লাগালে হয়ত
অনেক ভাল হত।
কয়েকজন আত্মীয় ও শুভাকাঙ্খী এসে
বইটি নাড়াচাড়া করে বললেন, এত বড় সাইজের বই পাঠকের পড়তে অসুবিধা হবে। এখন লোকের
পাঠাভ্যাস কমে গেছে। এই হাতীমার্কা বই দেখলেই লোক ভয় পেয়ে যাবে। তবে বেশির ভাগ
স্বজনই আমাকে বাহবা দিলেন, আমি যেন এক বিশাল কাজের কাজ করে ফেলেছি।
খালাত মাহবুব ভাই গানের বই নিয়ে
আপত্তি করলেন, গানগুলো প্রতি পাতায় একটি করে না ছেপে পাশাপাশি বসিয়ে দিলে বইটি
আকারে বেশ ছোট হত, খরচও বাচতো। তার এই বক্তব্য আমার কাছে বেশ যুক্তিযুক্তই মনে হল।
এসব কথাবার্তা শোনে আমার মনে
সাংবাদিক আব্দুস সবুর মাখন ভাইয়ের পরামর্শ মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, কুরেশী ভাই
আপনি একটি বড়গ্রন্থ না করে একটি একটি করে
দশটি বই দুইচার বছর সময় নিয়ে একটা একটা করে প্রকাশ করুন। তাহলে বই প্রকাশ সহজ হবে
এবং ভুলভ্রান্তি থাকবেনা। তাছাড়া আপনার পাঠক পরিচিতিও ভাল হবে। কিন্তু তখন মনে
কেবল সেই চিন্তাই কাজ করছিল আমার বিশাল লেখাসমুদ্রকে একসাথে প্রকাশ করে কিভাবে
রক্ষা করা যায় । আমি নাই হয়ে গেলে আমার এই লেখাভান্ডারও আমার সাথে চিরতরে নাই হয়ে
যাবে।
তখন মনে হল হয়ত বন্ধুবর মাখন
ভাইয়ের পরামর্শই সঠিক ছিল। আমি অযথাই এত অস্থিরতা করলাম। আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান
বেগম বলতেন, তুমি কিছু করতে চাইলে অস্থির হয়ে যাও, চিন্তা ভাবনা করে ঠান্ডা মাথায়
এগুতে পারনা। এই অস্থিরতা অনেক ভুল ভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিন বৎসর বারবার
লেখামালা কাটাকাটি ঘাটাঘাটি করেও অস্থিরতার অভিযোগ নির্বাক চিত্তে কাঁধে তুলে নিতে
বাধ্য হলাম।
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে পুবালী
ব্যাংক লিমিটেডের সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলের ব্যবস্থাপক সম্মেলন হোটেল নির্ভানা ইনে
অনুষ্ঠিত হয়। আমি অঞ্চল প্রধান মোসাদ্দিক চৌধুরীকে আগের দিন ছোট্ট করে বললাম আমার
একটি বই প্রকাশ হয়েছে, ঢাকা হতে আগত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উর্ধতনদেরকে
কিছু বই উপহার দিতে চাই। কিন্তু স্যার সম্মেলন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকায় খুব একটা
গুরুত্ব দিলেন না। তিনি হয়ত মনে করলেন, চটি বই জাতীয় কিছু একটা হবে, ফরমাল আনুষ্ঠানের
মাঝে চটি বইয়ের আগমন যদি ঢাকার বড় স্যারদের বিরক্তির কারণ হয়। সম্মেলনের আগের রাতে মাত্র চারটি বই আমার হাতে
আসে। আমি সিন্ধান্ত নিলাম কতৃপক্ষের কোন ইতিবাচক সিগন্যাল না পেলেও আমি যে ভাবেই
হউক আমাদের ব্যাংকের মহাজ্ঞানী মেধাবী সুপ্রিম কতৃপক্ষকে যে কোন প্রকারেই হউক এই
চারটি গ্রন্থ উপহার দেব। করর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদবিই লোকের ক্ষমতা ও মর্যাদা
নির্ধারণ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানের বাহিরের অন্য কোন প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রতিভা এখানে প্রায়
মূল্যহীন।
সম্মেলনে আগত চারজনকে দেবার মত
কেবলমাত্র চারটি বইই আমার হাতে আছে। এই চারজন মান্যবরকে আমি বাছাই করলাম, হেলাল
আহমদ চৌধুরী ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আব্দুল হালিম চৌধুরী অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা
পরিচালক, মোহাম্মদ আলী মহাব্যবস্থাপক এবং মোঃ মোসাদ্দিক চৌধুরী উপমহাব্যবস্থাপক।
আগের রাতে কিছু একটা লিখে চার বইতে অটোগ্রাফ দিলাম। লাল ব্যাগে করে চারটি বই সম্মেলন
কক্ষে নিয়ে আসি সত্য, কিন্তু বিতরণ করার সুযোগ হচ্ছিল না। দুপুরের খাবারের বিরিতির
সময় চারটি বই চারজন মান্যবরের চেয়ারের সামনের টেবিলে রেখে দিলাম।
অনুষ্টানের বিকেলের অধিবেশন শুরু
হবে। মঞ্চে নিজ নিজ আসনে বসেই চার মহারতি তাদের চোখে সামনে রাখা আমার মহাগ্রন্থটি
দেখতে পান। মাননীয় এম ডি হেলাল আহমদ চৌধুরী বইটি একটু পাতা উল্টায়ে দেখে আমাকে
দাড়াতে বললেন। তিনি এই বড় বইটি রচনা করায় সবাইকে দাড়িয়ে হাততালি দিয়ে আমাকে
অভিনন্দন জানাতে বললেন। পূরো সেমিনার কক্ষে হাততালির ঝড় বয়ে গেল। এই বইটির প্রতি
কতৃপক্ষের এত আগ্রহ দেখে কেউ কেউ বললেন আমাদেরকে আগে বললে এমডি স্যারকে দিয়ে ফিতা
কেটে বইটির মোড়ক উম্মোচন করার ব্যবস্থা করতাম। তবে দোষটা আমারই, আমি আঞ্চলিক
প্রধানকে বুঝাতে পারিনি যে, বইটি বিশাল এটা হেলাফেলা করার মত আদৌ কোন চটি বই নয়।
একদিন মোহাম্মদি অফসেট প্রেস হতে
ফোন পেলাম, স্যার আপনার সবগুলো বই তৈরি হয়ে গেছে। এবার বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। আমি
আনন্দের উত্তেজনায় লালকার চালিয়ে লালবাজারে উপস্থিত হলাম। মনে করলাম গাড়ির বেনেটে
ভরে সব বই নিয়ে আসব। সেখানে প্রেসের গোদামে ডুকে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এক বিশাল
বইয়ের স্থুপ, এযেন আমার স্বপ্নের বিশাল গ্রন্থ সমুদ্র। রুমেলকে বললাম এত বই নিয়ে
যেতে হলে একটি বড় ট্রাক ডাকতে হবে। রুমেল জবাব দিল ট্রাক লাগবেনা, আমরা কয়েকটি
ঠেলাগাড়িতে করে পাঠিয়ে দিতে পারব।
কিন্তু আমার ভাবনায় তখন খেলা
করছে দশবারটি ঠেলাগাড়ি ভর্তি বই বাসায় নিয়ে গিয়ে কেমনে ঠেলা সামলাব, এত কিতাব
রাখার জায়গা কোথায়! এই বিশাল বইয়ের জঞ্জাল দেখলে আমার ঘরবাসীদেরও চোখ কপালে উঠে
যাবে। এই বই নিয়ে আমার মত এত মাথাব্যাথা আর কারও যে নেই। গাড়িঘরের পাশের ড্রাইভার
কক্ষে রাখলে কেমন হয়, না ইদুরের দল কেটেকুটে সব বই খেয়ে সাবাড় করে দেবে। একটি
বইয়ের মূল্য ধরা হয় মাত্র এক হাজার টাকা/ পনের ইউ এস ডলার। এই হাজার খানিক বইয়ের
বাজার মূল্য প্রায় দশ লক্ষ টাকা। এই দশ লক্ষ টাকার মালামাল যেখানে সেখানে ফেলেতো
নষ্ট করা যাবেনা। আবার ঝড় বৃষ্টি ছারপোকা কিংবা ইদুরের হাতেও তুলে দেওয়া যাবেনা।
ঠেলাগাড়ি চালকরা গাড়িঘরে বই
স্থুপকরে ফেলে একটা ছোট্ট টিলা করে ফেলল। আমি ভয় পাচ্ছি আমার বেগম সাহেবা এই টিলা
দেখে নাজানি কি প্রতিক্রিয়া দেখান। চালকরা ভাড়া চাইছে, আর আমি ভাবছি কেমনে এই
বইয়ের ঠেলা সামলাই। আমার পত্নী একজন স্থিরধীর মহামানবী, তিনি একটি ঠান্ডা বক্তব্য
ঝাড়লেন- এত বই দিয়ে তুমি কি করবে? আর কম সংখ্যক বই ছাপালেই পারতে।
এবার বই দেখতে দুতলা হতে নেমে
আসলেন দুইজন নিরক্ষর মানুষ, একজন আমাদের কাজের মেয়ে ছোট জরি, অন্যজন আমাদের মৌসুমি
গৃহকর্মী সেনুরা বেগম। দুইজন এসে বইয়ের উপরে মনযোগ দিয়ে চেয়ে দেখে চিৎকার দিলেন, এইতো
দেখছি বইয়ের উপরে আমাদের মামার একটা বড় ফটো।
এবার এই দুইজন দুইটা চারটা করে
বই দুতলায় উঠাতে লাগল। বাসার সবগুলো কক্ষের কার্নিশ, ওয়াল আলমিরা, টেবিল ‘ইসফাক
কুরায়শী রচনাসমগ্র’ বইটিতে ছেয়ে গেল।
লাউয়াই গ্রামের বাউল শাহরুর রেজা
আমার কাছ থেকে একটি বই চেয়ে নেন। কিছুদিন পর তিনি সাদা পাজামা ও হলুদ পাঞ্জাবী পরে
কাধলম্বা চুল এলিয়ে আমার সামনে বসলেন। চায়ের কাপের জল শেষ হলে বললেন, স্যার আমার
সাথে একটু আসবেন। আমি বললাম এখন অফিস ব্যস্ত, বিকেলে অবসর হলে যাব। বিকেলে আবার
আসলেন, এবার হেটে হেটে নুরজাহান মহিলা কলেজের পিছনে তার টিনের ছোট্ট বাসায় নিয়ে
যান। ঘরে পা রেখে দেখলাম সেখানে আলো আধারের মাঝে কয়েকজন ঝাকড়া চুলের বাউল বসে আমার
অপেক্ষা করছেন। তাদের সবার হাতে ডোল, করতাল, একতারা, দুতারা, বাশের বাঁশি, একপাশে
হারমোনিয়াম।
তারা গাইবার জন্য সবাই মিলে ইতিমধ্যে
আমার বই হতে বেশ কয়েকটি গান নির্বাচন করেছেন। বাউল শাহরুর রেজা সুর করলেন। আমার
অনুমতি নিয়ে তিনি কিছু কিছু কঠিন শব্দ বাদ দিয়ে গানের উপযোগি মসৃন শব্দ ঢুকিয়ে
দিলেন। বাউলদের ডোল করতাল দুতারা বেজে উঠল। বহুদিন পর বাশের বাশির মধুর সুরও কানে ভেসে
এলো। এই বইয়ের কয়েকটি গান তারা আপন মনে গেয়ে গেয়ে ক্যাসেট রেকর্ড করলেন। ঘরের
বাইরে গান শুনতে বালক দলের ভীড় জমে গেল। পাশের ঘর হতে একজন নারী চা পরিবেশন করলেন।
টেপরেকর্ডার পরে বাজানো হল। আমার
লিখা গানের ক্যাসেট এই প্রথম কানভরে শুনলাম। বিভিন্ন বাউল গানের সুর অনুসরণ করেই
বাউল রেজা এই গান প্রস্তুত করলেন। শুনে মনে হল যেন আমি হাসন-লালন-রমন-দুর্বিনের
গান শুনছি। বাউল শাহরুর রেজার বাসায় সেই বিকেলে আমার নিজের সৃষ্টি গান শুনে নিজেই
পুলকিত হলাম।
দৈনিক সিলেটের ডাকের সম্পাদক
আব্দুল হামিদ মানিক ভাইকে একটি কপি হাতে তুলে দিতেই তিনি ভাল করে নেড়েচেড়ে দেখলেন,
তারপর বললেন অসংখ্য লেখক তার টেবিলে প্রতিদিন বই রেখে দেয়। কিন্তু খুব মানসম্মত বই
না হলে তিনি তা সংরক্ষণ করেন না। এবার বললেন, আপনার এই ডাউস বইটি সংরক্ষণ করার মত
একটি মূল্যবান বই। এটি পত্রিকার পাঠাগারে সংরক্ষণ করব।
সিলেট শহরের সবগুলো গনপাঠাগারে
আমি বিনামুল্যে বই বিতরণ করলাম। আমার অটোগ্রাফের নিচে মোবাইল নাম্বার পেয়ে
সুনামগঞ্জ জেলা পাঠাগারের একজন পাঠক বইটি পড়ে আমাকে ফোন করলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত
সিলেট শাখায় এসে আমার সাথে দেখাও করলেন। সিলেট বিভাগীয় পাঠাগার তিন কপি বই পেয়ে
আমাকে তারা একটি সার্টিফিকেট প্রদান করলেন। ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রিয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ
পাঠাগারে দশকপি দিয়ে একটি সার্টিফিকেট পেলাম। কেমুকাসের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল
হামিদ মানিক ভাই বললেন আপনাকে একটা মূল্য আমরা পরিশোধ করে দেবো। কিন্তু আমি আর কোনদিন
এই দশটি বইয়ের মূল্যগ্রহণ করতে যাইনি।
রাজা জিসি হাইস্কুলে আমার দেয়া
বইটি গিয়ে পড়ল আমার সহপাঠী বন্ধু নজরুল ইসলামের হাতে। আমরা একই সনে চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স ফাইন্যাল পাশ করেছি। তবে আমি রাষ্ট্রবিঞ্জানে এবং
নজরুল ভাই বাংলা সাহিত্যে। তিনি তখন রাজা জিসি হাইস্কুলের শিক্ষক। রাতে তিনি আমাকে
ফোন দিলেন, গড়গড় করে আমার সবকটি ছোটগল্পের কাহিনিগুলো বলে গেলেন। বিষ্মিত হলাম, এত
অল্প সময়ে এত গল্প তিনি পড়ে শেষ করলেন কেমনে?
সবগুলো পাঠাগার অতি আগ্রহে বই
গ্রহণ করলেও কিনব্রিজ সংলগ্ন সারদা হলের সিলেট পৌর পাঠাগারে বই দিতে গিয়ে বিপদে
পড়লাম। বই গ্রহণ করার মত লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। যে দুই একজন দায়িত্বে আছেন
তাদেরও তেমন কোন আগ্রহ নেই। চিন্তা করে বুঝলাম, এরা কিতাব লাইনের লোক নয়। বই
পুস্তকে এদের কোন আকর্ষণ নেই। হয়ত কোন রেড চেনেলে চাকুরি সংগ্রহ করে এখানে ঢুকে
প্রতিষ্ঠানের বারটা বাজাচ্ছে।
একদিন সিলেট সরকারী বালিকা
বিদ্যালয় ও কলেজ পাঠাগারে বই দিতে যাই। কলেজের অধ্যক্ষা ছিলেন একজন হিন্দু মহিলা।
আমি অনুমতি নিয়ে তার কক্ষে ডুকলাম এবং বললাম তার প্রতিষ্টানকে আমি লেখা একটি বই
দেবো। তিনি আমার দিকে তাকালেন না, আমাকে তেমন কোন গুরুত্বও দিলেন না। আমার কাছে
বিষয়টি বিস্ময়কর ঠেকাল। খাদিম শাহপরান উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে যখন আমার একটি বই
দেই, সেদিন তাদের কার্যকরী কমিটির সভা হচ্ছিল। তারা বইটি পেয়ে সভা স্থগিত করে
আমাকে ডেকে নেন এবং সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। তাদের সম্মান পেয়ে আমি অভিভূত হই।
আর এখানে ঘটলো উলটো ঘটনা। আমি কিছু কথা বলতে চাইলে অধ্যক্ষা শুনতে চাইলেন না, যেন
আমি একজন অনাহুত আগন্তুক। বই দিতে গিয়ে চা নাখেয়ে কোন প্রতিষ্টান হতেই আমি ফিরে
আসতে পারিনি। এখানে চা দূরে থাক, সৌজন্যের খাতিরে আমার বইটি একবার ছুয়েও দেখলেন না
এই ভদ্র মহিলা।
আমি আর কোন কথা বলার চেষ্টা
করলাম না।
বইটি রেখে বেরিয়ে এসে মনে হল এই
অধ্যক্ষার কিসের অপরাধ? তিনি হয়ত ভীত ছিলেন এই ভয়ে যে কোথাকার এই উঠকো লোকটা যদি কথার
মায়াজালে তার এই হাতিমার্কা বইটা গছিয়ে দিয়ে মূল্যবাবদ যদি বড় অঙ্কের টাকা চেয়ে
বসে।
আমার মহাগ্রন্থটির ঝাকজমকের সাথে
একটি প্রকাশনা উৎসব করার খুব ইচ্ছে ছিল। লেখক ও বৃক্ষপ্রেমিক আফতাব চৌধুরী খুব
উৎসাহ দেখিয়ে বললেন, এত বিশাল কাজের একটি বড় প্রকাশনা উৎসব হওয়া প্রয়োজন। তার মতে
ঢাকার বিখ্যাত কোন গুনীজনকে দিয়ে বইটির মোড়ক উম্মোচন করলে ভাল হবে। আফতাব চৌধুরী একজন
গুনী মানুষের নাম প্রস্তাব করলেন। এই গুণীজন ঢাকা প্রেসক্লাবের সভাপতি চিরকুমার জনাব
হাসান শাহরিয়ার। তার বাবা বৃটিশ ও পাকিস্থান আমলের সিলেটের প্রখ্যাত সাংবাদিক
মকবুল হোসেন চৌধুরী। আমি জনাব হাসান
শাহরিয়ারের ঢাকার বাসার ঠিকানায় একটি বই কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেই। অটোগ্রাফের স্বাক্ষরের
সাথে আমার মোবাইল নাম্বার ছিল। বইটি পেয়েই এই মহান ব্যক্তি মোবাইলে আমাকে ফোন করেন
এবং বইটি পাঠানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। আমি তার বিনয়ে বেশ অভিভূত হই। এবার বইটির
প্রকাশনা উৎসবে তাকে উপস্থিত হবার জন্য অনুরোধ জানালে সম্মতি দিয়ে বললেন, আগামী
ঈদের ছুটি আমি সিলেটে কাটাবো। সেই সময়ে প্রকাশনা অনুষ্ঠান করা হলে আমি অবশ্যই
যোগদান করতে পারব।
এবার কবি আবিদ ফয়সলের সাথে আলাপ
করলে তিনি আমাকে এই ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করলেন। আব্দুল হামিদ মানিক ভাইয়ের কাছে
কেমুকাসের সম্মেলন কক্ষ ‘শহিদ সোলেমান হল’ ভাড়া নিতে চাইলে জবাব দেন, এধরনের কাজে
আমরা সাধারণত এই হল ভাড়া প্রদান করিনা, অন্য কোথায়ও আয়োজন করতে পারেন।
ইতিমধ্যে আমার মায়ের অসুস্থতা ও
অকালমৃত্যু, অফিসে কাজের চাপ, ব্যবসায়িক ও পারিবারিক দুশ্চিন্তা আমাকে অস্থির করে
রাখে। মায়ের মৃত্যু ২০১৩ সালকে আমার জীবনের সবচেয়ে ব্যদনাদায়ক শোকের বছরে পরিণত
করে। কোন জমকালো অনুষ্ঠান করার অভিরুচি আমার কল্পনা হতে উদাও হয়ে যায়। মাকে
হারানোর যন্ত্রণা সারাটা বছর হৃদয়ের প্রকুষ্ঠে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। এমনি করে একদা
চুপে চুপে ২০১৩ সাল পার হয়ে গেল।
তখন মনে হল ‘ইসফাক কুরায়শী
রচনাসমগ্র’ নামক গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসব করার সময় আর নেই, সেই সময়টা ২০১৩ সালের
বিদায়ের সাথে সাথে তামাদি হয়ে গেছে। ঢাকডোল পিটিয়ে আমার মহাগ্রন্থটির প্রকাশনা
উৎসব করার স্বপ্ন আর কোনদিন পুর্ণ হলনা, এক অব্যক্ত দুঃখবোধ জীবনের আকাশে মেঘ হয়ে
ভেসে রলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন