প্রথম
দেখা জেলা শহর সুনামগঞ্জঃ
জেলা শহর
সুনামগঞ্জে আমার প্রথম যাবার স্মৃতি আজও মনে পড়ে। আমাদের সুনামগঞ্জ শাখার একজন
গার্ড ইউনুস আলী চাকুরিরত অবস্থায় দুইপত্নী রেখে মারা যান। সিলেটের পুবালী ব্যাংক
কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা আতাহার হোসেন ও মিজানুর রহমান জানাজায় অংশ নিতে অফিসের
একটি গাড়ি নিয়ে সুনামগঞ্জ রওয়ানা হন। আমি সুনামগঞ্জ শহর দেখার জন্য অধীর আগ্রহে
অপেক্ষায় ছিলাম। এবার সুনামগঞ্জ যাবার এই মোক্ষম সুযোগটি হাতের নাগালে পেয়ে সাথে
সাথে লুফে নিলাম।
ভাটির
জলকন্যে সুরমাবিধৌত সুনামগঞ্জ, মেয়র কবি মইনুল মউজদিনের বিদ্যুৎবাতি বন্ধকরে
ভরাপূর্নিমায় রুপালী চাঁদ দেখার শহর সুনামগঞ্জ, মরমিকবি হাসন রাজার গানের শহর
সুনামগঞ্জ, ষাটের দশকে আমার জনক ও জননীর নতুন সংসার রচনার শহর সুনামগঞ্জ, আমার
প্রিয়তমা পত্নী নুরজাহান বেগমের জন্মশহর সুনামগঞ্জ; এযেন আমার স্বত্তায়, আমার
আত্মায় নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা এক রুপকথার স্বপ্নপূরী অথচ জন্মের ত্রিশটি বছর পেরিয়ে
এসে এইমাত্র তারসাথে আমার প্রথম দেখা হল।
মরমি কবি
হাসন রাজার সমাধির বড় কবরগাহে একটি বগলি কবরে ইউনুস আলীর দাফন হল। গার্ড কুব্বাদ
আলী ও শুক্কুর আলী কুদাল হাতে সহকর্মির শেষবিদায়ের সমাপনী কাজ সুচারুভাবে সমাধা
করলেন। এবার আমার প্রিয় মরমী কবি হাসন রাজার মাজারের পাশে গিয়ে আমি তাকে সশ্রদ্ধ
সালাম পেশ করলাম। একটি পুরানো প্রাচীর ঘেরা কবরে হাসন রাজা তার আম্মাজান মোছাম্মত
হুরমতজান বিবির পাশাপাশি কবরে ঘুমিয়ে আছেন। সমাধীটি ঘাসে ছাওয়া ও পাশে ছাতা হয়ে
একটি বৃক্ষ দাড়িয়ে রয়েছে। ভাঙ্গাচুরা সমাধি প্রচীরটিতে বহুকাল চুনকাম করেনি কেঊ,
মুছে গেছে এপিটাক। বেশ কষ্টকরে এপিতাক পড়লাম, কবির জন্মতারিখঃ ৭ পৌষ ১২৬১ বাংলা
(২৯ ডিসেম্বর ১৮৫৪ সাল) মৃত্যুঃ ৬ ডিসেম্বর ১৯২২ সাল।
কবি হাসন রাজা জীবিত থাকাকালেই তার এই সমাধি নির্মাণ করেছিলেন। মনে হল সিলেটের এই
গৌরব রবি হাসন রাজা যেন বড় অনাদর অবহেলায় এখানে চিরশায়িত রয়েছেন।
হাসন রাজার
পিতৃভূমি বিশ্বনাথের রামপাশা হলেও তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মাতৃভুমি
সুনামগঞ্জের সুরমাপারের লক্ষনশ্রি এলাকায় যা আজ তার নামানুসারে হাসননগর নামে
পরিচিত। এবার পাশে হাসননগরে হাসন রাজার বাড়িতে গিয়ে ঢুকলাম। মনের রাজ্যে বেজে উঠল
মরমি কবির গানের কলি ও সুরের ঝঙ্কার, কানে ভেসে এল সিংহগোফ জমিদার কবি হাসন রাজার
খড়মের খটখট আওয়াজ, এই যেন তিনি আমার আশপাশে হাটছেন। হাসনরাজা যাদুঘরে কয়েক যুগ
আগেকার সিলেটের অভিজাত বনেদী জীবনের অজস্র চিহ্ন ও নিদর্শন দেখে চমকে উঠলাম। এখানে
এসে সেই বৃটিশ আমলে আমার পিতামহ মোঃ মোফজ্জিল চৌধুরীর (জন্মঃ ১৮৪৯ সাল
মৃত্যুঃ ১৯৩৯ সাল) জীবন ও সময়কাল চোখের সামনে যেন
দেখতে পেলাম। কারণ হাসন রাজা আমার পিতামহের সমকালের রংমঞ্চের একজন জীবন নায়ক
ছিলেন।
সুনামগঞ্জ
শাখা একটি বড় জেলা শাখা, এই শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন তখন অন্য আরেকজন এম এ মান্নান,
যাকে কেঊ বলত দাড়িওয়ালা মান্নান স্যার আবার কেউবা বলত সুনামগঞ্জী মান্নান।
সুনামগঞ্জের ভুমিপুত্র এই সুনামগঞ্জী মান্নান স্যার আমাদেরকে একটি দামী হোটেলে
পাঠালেন, আমাদের সেবায় এগিয়ে যান গার্ড শুক্কুর আলী ও কুব্বাদ আলী। সুনামগঞ্জ
হাওয়রের এত বড় মাছের টুকরো পাতে পড়ল যে ভাত রাখার স্থান অবশিষ্ট রইলনা। মাছ খেয়েই
পাকস্থলী পরিপূর্ন হয়ে গেল।
আমার শ্বশুর
এনাম উদ্দিন চৌধুরীর সাথে আমার বস এম এ মান্নান স্যার একই বাসায় কিছুদিন অবস্থান করে অফিস করেন। সেই সুবাধে
তিনি আমার শ্বশুরেরও একজন অসমবয়সী বন্ধুজন ছিলেন। আমার শ্বশুর সুনামগঞ্জ শহরে তার
বৃদ্ধ বোনকে দেখতে উদগ্রীব হলে আমি স্যারকে বলতেই তিনি অফিসের একটি বড় লেইটেস
বরাদ্ধ করে দেন। এক শুক্রবারে ব্যাংকের ড্রাইভার মজনুর গাড়ি চড়ে আমরা জায়া পতি
পূত্র, শ্বশুর শ্বাশুড়ি, মনাক্কা আপা ও ভাগ্নি তানিয়াকে নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরের
জামাইপাড়ায় ফুফু শ্বাশুরির বাসায় উপস্থিত হলাম। হ্যাঁ
পাড়াটির নাম জামাইপাড়া, এরও একটি ইতিহাস আছে। এই পাড়াটি ছিল সুনামগঞ্জ শহরের ধনী
হিন্দু মহাজনদের বসতি। এইসব মহাজনদের অধিকাংশেরই অঢেল ধন আছে তো পুত্রসন্থান
ছিলনা। পরবর্তীকালে তাদের কন্যাদের পাণিগ্রহণ করে শ্বশুরের সম্পত্তিতে চলে আসেন
অনেক জামাই। তাই এই পাড়াটি হয়ে যায় জামাইপাড়া। এখন এই পাড়াটিতে রাজত্ব করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এইসব ঘর জামাইয়ের
দল।
জামাইপাড়ার
সুন্দর নিরিবিলি দুতলা বাসায় বসবাসকারী ফুফু শ্বাশুড়ির বয়স প্রায় নব্বই বৎসর
ছুইছুই করছে। ঈদ উপলক্ষে ঘরেফেরা ফুফুতো এনাম, শেরোয়ান, ফয়েজ, মনন, কয়েস ও রওনক
ভাইয়ের সাথে পরিচয় ও দেখা হল। ফুফু শ্বাশুড়ির জ্যা এবং আমার চাচাত বোন হুজেলা খানম
চৌধুরীর সাথে পাশে তার বাসায় গিয়ে দেখা করলাম।
হুজেলা আপার ছেলে জিয়াউল হক চৌধুরী বাবুল আমাদের ব্যাংকের একজন ডি জি এম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন