ডাঃ
নুরজাহানের কর্মক্ষেত্র দাউদপুর, মোগলাবাজার ও চারখাইঃ
সিলেট ফিরে
এসে আবার শুরু হল কর্মব্যস্ত জীবনের ঘানি টানা। সারাদিন অফিস করে বিকেলে আট মাইল
দুরবর্তী দাউদপূরের বাড়ি ফেরা ছিল বেশ ক্লান্তিকর কাজ। পাশে সহজ বিকল্প পেয়ে
যাওয়ায় আমি একসময় বিকেলে গ্রামে ফেরা বন্ধ করে দিলাম। ধীরে
ধীরে ৪৬, কাজলশাহ আমার ঠিকানা হয়ে গেল। গ্রামের
বাড়ি তখন হয়ে গেল আমার আড়াই দিনকা ঝোপড়া। প্রতি
সাপ্তাহে শুক্র ও শনিবারের দুইদিন তিনরাত
আমরা জায়া পতি ও পুত্র চলে যেতাম দাউদপুরের সবুজ আচলে মাবাবার সান্নিধ্যে তাদের
স্নেহের বাধনে। কি আনন্দভরা ছিল সেই দিনগুলো, দলবেধে গ্রামের লোকজন আসতেন। ফ্রি
সার্বিস দিতে দিতে ডাঃ নুরজাহান হাফিয়ে উঠতেন।
মোগলাবাজারের
মতিউর রহমান সাহেবের ফার্মেসীতে বসে রোগী দেখতেন আমার চাচাত ভাই ডাঃ এন এ চৌধুরী।
অকৃতদ্বার এই চিকিৎসক বুড়ো বয়সে অসুস্থ হয়ে গেলে চট্টগ্রামে তার একমাত্র বোন মমতা
আপার বাসায় চলে যান। মতিউর রহমান ডাঃ নূরজাহানকে তার ফার্মেসীতে বসার অনুরোধ করলে
তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে দাউদপুর বাড়ি যাবার পথে রোগী দেখতে সম্মতি জানান।
বাড়ি যাবার পথে মোগলাবাজারে আট দশ জন রোগী দেখে রাতে গ্রামের বাড়ি ফিরতাম।
মনু মিয়া,
তিনি ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরীর ভাতিজা। তার বাড়ি সাচান চারখাই। তিনি চারখাই
বাজারে একটি ফার্মেসী দেন। মনু মিয়া বাসায় এসে একদিন তার ফুফু ডাঃ নুরজাহান বেগমকে
তার ফার্মেসীতে প্রতি শুক্রবার রোগী দেখার অনুরোধ করেন। তিনি বারবার অসম্মতি
জানালেও শেষপর্যন্ত কয়েকটা দিন যেতে রাজী হন। আমাদের সিলেটের বাসা হতে চারখাই
প্রায় চব্বিশ মাইল দূরে অবস্থিত। আমার একটি সাদা কার ছিল, যা কিছুটা পুরাতন ও
ইঞ্জিন সেকেলে। প্রতি শুক্রবার দাউদপুরের বাড়িতে সকালে খেয়ে গাড়ি চালিয়ে হেতিমগঞ্জ
কিংবা ঢাকাদক্ষিণ ছুঁয়ে চারখাই পৌছতাম।
চারখাই যেতে
একটু দেরী হয়ে যেত, সেখানে একটি ঘরে অসংখ্য কাল বোরকাপরা মহিলা রোগী ভীড় জমাতেন।
এই অপেক্ষমাণ বেশিরভাগ রোগীই ছিলেন সুরমার ওপারের কানাইঘাটের বাসিন্দা, অর্থাৎ
জৈন্তাপুরী। নারী রোগীদের জন্য পুরুষ চিকিৎসক দেখানো তখনও সুরমার ওপারে ছিল
নাজায়েজ ও শক্ত গোনাহের কাজ। এখানে একজন মহিলা চিকিৎসকের আগমনের আগমনের খবর
কানাইঘাট অঞ্চলে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ে। তাই নিষিদ্ধ পন্য মরদ চিকিৎসকের হাত হতে বাঁচতে
প্রতি শুক্রবারে বোরকাওয়ালিদের ভীড় বাড়তেই থাকে। এতএত রোগী দেখে ডাঃ নুরজাহানের
নাভিশ্বাস অবস্থা তৈরি হয়। বিকেলে ক্লান্ত হয়ে ফেরার পথে আমি জলভরা হাওরপারে গাড়ি
রেখে নৌকা ভাড়া করতাম ও নৌভ্রমন করে হাওয়রের ঠাণ্ডা বাতাসে ফ্রেস হয়ে রাতের মধ্যেই
দাউদপুর ফিরে আসতাম। একদিন চারখাইয়ের পশ্চিমের এই হাওরে মৃদু ঝড় হয়। আকাশ লাল হয়ে
যায়। মধ্য হাওরে নৌকায় বসে প্রকৃতিকে তখন ভীষন সুন্দর লাগছিল।
শহরে কাজের ব্যস্থতা বেড়ে গেলে এক সময় চারখাই যাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। চারখাই মসজিদে
কত শুক্রবার যে জুমুয়ার নামাজ পড়েছি আজ তার কোন সঠিক হিসেব নেই, তবে দেড়দুই বছরতো
হবে সুনিশ্চিত।
২২ জুলাই
১৯৯৯ সাল। পরবর্তীকালে তরতর করে ব্যাংকের মগডালে আরোহনকারী আব্দুল হালিম চৌধুরী
সিলেট শাখায় প্রায় দেড় বছর শক্তহাতে শাসনদন্ড পরিচালনা করে দরগাগেইট শাখায় বদলি
হন। তার বিদায় সম্বর্ধণা উপলক্ষ্যে সকলে আমাকে একটি মানপত্র লিখতে বললেন। রাতে
বাসায় ফিরে মানপত্রটি লিখলাম। বিদায়
সম্বর্ধণা অনুষ্টানে সিলেট শাখার পক্ষে আমি স্বহস্তে লিখিত এই মানপত্রটি পাঠকরি।
এই অনুষ্টানে শাখার ভি আই পি কাষ্টমার, শাখার স্টাফ, অফিসার ও আব্দুল হালিম
চৌধুরীর বন্ধুগন যোগদান করে বেশ স্মৃতিচারণ করলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন
সিলেট অঞ্চলপ্রধান ডিজিএম ইলিয়াস উদ্দিন আহমদ। তার সাথে কাজ করার সময় আমার কেন যেন
মনে হত তিনি একদিন এম ডি হবেন। ভবিষ্যতে ঘটলও তাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন