আনন্দময় নিস্তরঙ্গ
ঢাকা-জীবনঃ
৫ জানুয়ারি ২০১৯ হতে ৪ ফেব্রুয়ারি
২০২২
তিন বছর এক মাস।
ধানমন্ডি লেকবাগানের
স্মৃতিঃ
রাজধানী ঢাকায় প্রতিটি মানুষের
জীবনই শশব্যস্ত। এই মহানগরে মানুষ কাজের মাঝে ডুবে থাকে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। আমার ঢাকাজীবনে দিনগুলো এতই দ্রুত
দৌড়াতো যে ঘুম হতে উঠার পর কিভাবে যে দিন পেরিয়ে রাত হয়ে যেত তা টাহর পেতাম না।
রবি হতে বৃহস্পতি পাঁচদিন রাতে ধানমন্ডি ও দিনে মতিঝিল, এই ঘুর্ণীচক্রে পার
হত।
এই ঘূর্ণীচক্র পেরিয়ে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক
ছুটির দিন হাতেগুনা কয়েকজন আত্মীয়ের বাসা গিয়ে এবং ধানমন্ডি লেকপারে
হেঁটে হেঁটে সময় কাটাতাম। তবে করোনার কারণে কারো সাথে মেলামেশা
নিষিদ্ধ থাকায় পরিচিতদের বাসাগমন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
বাসার সামনে লেকের
পারে এক অত্যাধুনিক স্থাপত্যশৈলীর বাগানবেষ্ঠিত তাকওয়া মসজিদ।
মসজিদের পিছনে লেকঘাট। মসজিদটি স্টিল,
গ্লাস ও কাষ্ট নির্মিত। খানিক নিচে অজুখানা ও মহিলা এবাদাতখানা।
মসজিদের চারতলা শুক্রবারে লোকারণ্য হয়ে যায়। আমাদের বাসার গ্রাউন্ড লেভেল, সামনের
রাস্থা, লেকের ভিতরের রাস্থাসমূহে এত মুসল্লি জমায়েত হন যে ভিতরে বাহিরে এই সংখ্যা
দশ হাজার পার হবে নিশ্চিত। এখানে আজান ও কেরাত এত সুললিত যে নামাজ পাড়ার সময় মনে
হয় মক্কা কিংবা মদিনায় নামাজ পড়ছি। তাকওয়া মসজিদের যে কোন তলায় নামাজ পড়া বেশ
আনন্দের, চারপাশের দৃশ্য নয়নাভিরাম। এই মসজিদের বাহিরে খোলা আকাশের নিচের বাগানে
কিংবা লেকপারে নামাজ পড়ার আনন্দও কম নয়; লেক, ফুল, পাখি ও বৃক্ষলতার অপার সৌন্দর্য্য
মন ফুরফুরে করে দেয়।
তাকওয়া মসজিদের চারপাশে প্রচুর ভিক্ষুকের
আনাগুনা। তাঁদের বেশিরভাগই শারীরিক কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধি। তাঁরা পরিচ্ছন্ন
ফুটপাথে ঘুমাতো ও প্রচুর টাকা ভিক্ষা পেত। অফিসে যেতে তাঁদের সামনে প্রায়ই মোরগ
পোলাও ও মজাদার বিরিয়ানীর প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখি। জনগণ এসব হতদরিদ্র ফুটপাথবাসীগণকে
প্রচুর খাবার বিলিয়ে দিত। শীতকালে জনতা এসব হতদরিদ্র
লোকদেরকে প্রচুর কম্বল ও গরমকাপড় দিত। তাঁরা এসব ভিক্ষালব্ধ পণ্য পানির দামে
বিক্রি করে দিত। গৃহকর্মী সুমন ভিক্ষুকদের কাছ থেকে সস্তা দরে অনেক কম্বল কিনে মৌলভীবাজার
পাঠাতো।
একদিন একজন মেডামকে দেখি দামী গাড়ি হতে
নেমে ভিক্ষুকদের কাছ থেকে তাঁদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করছেন। কারণ জানতে চাইলে
সুমন বলল, মেডাম হয়ত জাকাত বিতরণ করার লোক খোঁজে পাচ্ছেন না। তাই ওদের মোবাইল নম্বার
নিয়ে বিকাশের মাধ্যমে দানখয়রাত করবেন। মেডাম বেশ চালাক বিনে কষ্টে বিনে যন্ত্রণায়
গোপনে জাকাত দানের ফরজ কাজ অনলাইনে বিকাশে সেরে ফেলবেন।
করোনা মহামারিকালে তাকওয়া মসজিদে লাশ
আসা বেড়ে যায়। প্রতিটি নামাজের ওয়াক্তে এম্বুল্যান্সে করে দুইচারটা
লাশ আসত। করোনায় মরা এসব লাশের সাথে আসেন স্বেচ্ছাসেবী লোকজন, যারা প্রাণের
ঝুঁকি নিয়ে এসব লাশের দাফন কাফন করতেন। আমরা ভয়ে তখন দীর্ঘসময়ের জন্য মসজিদে গমন
বন্ধ করে দেই। করোনা মহামারিকালে মসজিদে না গিয়ে বাসার বারান্দায়
দাঁড়িয়ে তাকওয়া মসজিদের জুমুয়ার জামাতে শরিক হতাম।
বাসার সামনে লেকের ওপারে
বঙ্গবন্ধু জাদুগরের সামনে সর্বদা নানা রাজনৈতিক কর্মকান্ড লেগে থাকে, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান শোনে তাকিয়ে দেখতাম দামী গাড়ির সারি,
আওয়ামি লিগের নানা অঙ্গসংঘটনের লোকজন মিছিল করে জাদুঘরে আসছেন। পুলিশ কর্ডনে স্বদেশী
কিংবা বিদেশী ভিআইপিরা এসে বঙ্গবন্ধু প্রতিকৃতিতে পুস্পস্তবক দিচ্ছেন। জাদুঘরের
সামনে ৩২ নম্বর সড়কে দুইটি পুলিশ ফাঁড়ি, রাজনৈতিক ঢামাডোল হলেই পুলিশ এই সড়ক বন্ধ
করে দিত, ফলে দীর্ঘপথ পেরিয়ে কলাবাগান যেতে হত।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের বজরা
আইল্যান্ডে চা পান, বাদাম চিবানো ও লেকের চারপাশের হাওয়াখানায় বসে নতুন প্রজন্মের
মানুষের নানান রংতামাশা দেখে সময় যেত। বাগানের কোন কোন হাওয়াখানায় রঙ্গিন বেলুন
সাজিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে জন্মদিনের কেক কাটা, জেমস/ আয়ুব বাচ্চুর
ব্যান্ড, কোনখানে সারি, জারি, ভাটিয়ালি সুরে গাইতো গায়কেরা। কোথায়ও বাউল সম্রাট
আব্দুল করিম কিংবা হাসন রাজার গান গায় সমবেত তরুণতরুণীরা।
রবীন্দ্রসরোবর পারের গণচত্বরে
প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানি নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে। বর্ষবরণ, বসন্তবরণ,
ভ্যালেন্টাইন ডে, বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস আর কত কি উৎসব লেগে থাকে বারমাস। এখানে
জনতার ভিড়ে বসে বড়পর্দায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও ফুটবল ম্যাচ দেখার মজাই আলাদা।
শত শত বাঙ্গালির এসব মিলনমেলায়
বসে চা ও কপি পান করে করে হৈ হল্লা করে আমার ঢাকার সময় মহানন্দে কেটে যেত। ঢাকার
একাকিত্বের জীবন ভরে যেত আনন্দের মধুরসে।
১লা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে
লাল-নীল এবং বসন্তবরণ উৎসবে লাল-হলুদ-সবুজ সাজে সুসজ্জিত নরনারী হৈহল্লায় মেতে উঠে
সারাটা ধানমন্ডি লেকবাগানে। বর্ষাবরণে দেখা যেত সাদা-হলুদ পোষাকের ছড়াছড়ি।
হাঁটাপথের পাশে গ্রাম্যমেলার মত পসরা সাজিয়ে নানান হস্তপণ্য বিক্রি করত দোকানীরা। উৎসবে
মাতোয়ারা জনতার ভিড়ে হেঁটে বেড়াতে সে কি যে মজা হত তা বলার ভাষা নেই আমার। সে সব
স্মৃতি কি ভূলতে পারি সহজে।
বাসার সমনে ধানমন্ডি লেকবাগানে শিল্পীরা
জলছবি ও তৈলছবি এঁকে এঁকে লেকপারে লাইনে লাইনে সাজিয়ে রাখতেন। তাদের আঁকা সাজিয়ে রাখা চিত্রশিল্পের পসরা বেশ খুতিয়ে
খুঁতিয়ে দেখতাম। লম্বাচুলধারী কয়েকজন চিকনদেহী চিত্রশিল্পী চোখের পলকে কাটপেন্সিল দিয়ে মানুষের হুবহু ছবি এঁকে দিয়ে প্রচুর
টাকা কামাতেন।
প্রতিদিনই লেকপারে বেডমিন্টন
খেলে ও ব্যায়াম করে ঘন্টাখানেক সময় চলে যেত। পেডেল নৌকায় বসে
লেকের জলে ভেসে কত যে অলস সময় কাটাতাম, রাখিনি
হিসেব।
ধানমন্ডি লেকপারে ছিল হিজড়াদের উৎপাত। তারা খোঁজে খোঁজে
প্রেমিকযুগলদেরে টার্গেট করে সুকৌশলে চাঁদা আদায় করত।
বিস্ময়কর ব্যাপার তারা আমাকে কখনও বিরক্ত করেনি। হয়ত এই দয়ালু হিজড়ারা
ভাবতো লেকপারের স্থায়ী বাসিন্দা এই বুড়ো লোকটাকে পরখ করে কিছুই মিলবেনা, ও কে ঘেঁটে অযথা
সময়ের অপচয় করা ছাড়া অন্য কোন ফায়দা হাসিল
হবেনা।
বরশীতে মাছ ধরা এই লেকপারের এক
মজার ইভেন্ট। লোকেরা গভীর জলে বরশি ফেলে ধ্যানমগ্ন হয়। অনেক মাছ ধরা পড়ে, তবে সারাদিনের
ধ্যানের তুলনায় তা তেমন কিছু নয়। কিন্তু কাজটা শখের, প্রায়ই বরশিখোরেরা লেকপারে
ধ্যানমগ্ন হত।
ধানমন্ডি লেকপারে মাঝে মাঝে নাটক
ও সিনেমা অভিনয় হয়। নিরাপদ দূরত্ব থেকে এই অভিনয় দেখা বেশ মজার ব্যাপার। একদিন
গৃহকর্মী সুমন দুঃখভরা গলায় বলল, এই দেখুন একজন মানুষকে পার্কের মাটিতে ফেলে
কয়েকজন লোক বেধড়ক পেটাচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম একজন লোক বড় ক্যামেরায় তা ভিডিও করছে।
আমার বুঝতে ভূল হলনা এটা গণপিটুনি নয়, নাটক অভিনয় হচ্ছে।
আমাদের যুগে অনলাইন ছিলনা। এযুগে
অনলাইন মানুষের জন্য অপার সম্ভাবনার দ্বার খোলে দিয়েছে। অনলাইনে সেলিব্রেটি হবার
প্রবণতা এযুগের মানুষকে সর্বদা তাড়া করে। উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীরা সেঁজেগুজে এসে
নেচে গেয়ে টিকটক ও ইউটিউব ভিডিও বানাতে নানান তেলেসমাতি কারবারে মেতে উঠে। গ্রামের
অনেক নিরীহ মেয়েদেরকে অভিনেত্রী বানানোর লোভ দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ভারত ও
মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করে দেবার অনেক ঘটনা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কয়েকজন
প্রতারক নারীপাচারকারী টিকটক প্রডিউসার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
একটা অটিস্টিক বালক হুইলচেয়ারে
বসে গোলাপের বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিত। ছেলেটা বেশ সুন্দর, অথচ
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি। একদিন আমি তাকে ফুল না নিয়েই টাকা দেই। কিন্তু ছেলেটি ফুল ছাড়া
কিছুতেই টাকা নেবেনা। তাই গোলাপের একটি স্টিক হাতে তুলে নিতে বাধ্য হই। ধানমন্ডি
লেকবাগানে বসে চা পান, বাদাম চিবানো ও ডাবের পানি খাওয়া ছিল আমার নৈমিত্তিক কাজ।
একদিন লেকপারের ফুটপাতে আমের আচার কিনে খাই। একটা বার তের বছরের রিকশাচালক
ঘর্মাক্ত বালক আচার কিনতে আসে। জেফারের বয়সের বালকটিকে দেখে আমার ছেলের কথা মনে
হল। আমি তাঁর বিলও পেমেন্ট করে দেই। বালকটি আনন্দে আমার দিকে চেয়ে রয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার (সুধা মিয়া) বাসা সুধাসদনের সামনের রাস্থা দিয়ে হেঁটে প্রায়ই ধানমন্ডি লেকপার প্রদক্ষিণ করি। ধানমন্ডি লেকে একা একা প্যাডেল বোট চালানোর সময় মনে হত এইতো শেখ হাসিনা লালশাড়ি পড়ে এই ধানমন্ডি
লেকের ওপার হতে কনে সেজে এপারে আসছেন। হয়ত
তিনি বর ওয়াজেদ মিয়াসহ সুধাসদনের পিছনের ঘাটে নৌকায় চড়ে
জলপথে বৈঠা বেয়ে ১৫/২০ মিনিটে ৩২ নম্বর রোডের বাপের
বাড়ির সামনের লেকঘাটে গিয়ে নামছেন, যেমনটি সিলেটে হাওরপারের গ্রামাঞ্চলে বর্ষাকালে নৌকায় কুটুমবাড়ি আসা যাওয়া হয়। প্রায়ই নিউমার্কেট
গিয়ে কেনাকাটা করতাম। লেকপারে হেঁটে হেঁটে প্রায়ই ভাতিজা রিপনের বাসায় গিয়ে
চানাস্তা করতাম।
একদিন একটা মর্মান্তিক ঘটনা
দেখতে হয় আমাকে। প্রবল বৃষ্টিতে তাকওয়া মসজিদের লেকঘাটে লোকের জটলা দেখে এগিয়ে
যাই। সামনে লাল গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট পরা বার তের বছরের এক ফুটফুটে বালকের লাশ জনতা
লেকঘাটে শোয়ায়ে রেখেছে। কাছে পুলিশের গাড়ি। ধনীর দুলাল মনে হলেও সে তখনও পরিচয়হীন। আহারে, কোন মাবাবার আদরের ধন লাশ হয়ে
পড়ে আছে অথচ তাঁরা এখনও জানেনা তাদের প্রাণপ্রিয়
সন্থানটি বেঁচে নেই। সেদিন অঝোরধারায় বৃষ্টি হয়। তখন এই বালক
পাশের লেকে গোসল করতে আসে। সাঁতার কাটতে গিয়ে লেকের মাঝখানে
ডুবে যায়। বৃষ্টির কারণে আশপাশে তেমন লোকজন ছিলনা, তাই অসহায়ভাবে মরতে হয় তাকে।
কিছুলোক বলাবলি করে ধানমন্ডি লেক প্রতি বছর অন্ততঃ একজন
লোককে কেড়ে নেয়। এই বালকটাকেও লেকের দৈত্যরা নিয়ে গেছে।
ধানমন্ডি বাগানের ব্যায়ামাগারে কসরত করে
শরীর গঠন করছে লোকজন। আছেন জোয়ান বুড়ো, বালক বালিকা, নর নারী সবাই। সকালে কিশোর
কিশোরীদেরে স্পোর্টস ড্রেস পরায়ে দলবদ্ধ করে নিয়ে আসেন
প্রশিক্ষকরা। হৈহল্লা চিৎকার করে দীর্ঘক্ষণ চলে প্রশিক্ষণ।
মাঠের পাশে কংফু ক্যারাটি প্র্যাকটিস করে সুসজ্জিত কিশোর কিশোরীরা, এখানেও ব্যস্ত
থাকেন ইন্সট্রাক্টর।
প্রতিদিন একজন কিশোরী এমনি উল্কার বেগে দৌড়ায়
যে আমি তাঁর সাথে পারিনা। তাল মিলায়ে জুরছে হাঁটতে পারিনা উঠতি বয়সী
যুবক যুবতীদের সাথে। আপন মনে ভাবী আমি অর্ধশত বছর পেরুনো একজন প্রৌঢ় লোক, ওদের
সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হলেও বিধাতা আমাকে এখনও জুরকদমে হাঁটার যে শক্তি দিয়েছেন
সে জন্য তাকে ধন্যবাদ। একদিন সন্ধ্যায় দেখি একজন সুন্দরী প্যান্টসার্টপরা মাতাল
মেয়েকে অভিভাবক নারীরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। লোকেরা বলাবলি করছে, খাইছে রে ইয়াবা।
একবার দুই মাতালকে মারামারি করতে দেখি। একে অন্যকে ইচ্ছেমত কিল ঘুষি দিচ্ছে, যেন
মেরেই ফেলবে। লোকেরা পাশ দিয়ে যাচ্ছে, অথচ মাতালদের ঝগড়ায় কেউ জড়াচ্ছেনা। তবে আমি
৯৯৯ তে ফোন করে পুলিশকে জানাই। তারপর কি হল খবর নেইনি।
ভাল লাগে আমাদের ছেলেমেয়েরা
স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে। আমিও তাদের সাথে ব্যায়াম করি কখনও শতায়ু
অঙ্গনে, আবার কখনও রবীন্দ্রসরোবরে। সকালবেলা শতায়ু অঙ্গনে
বুড়োবুড়িরা সম্মিলিত ব্যায়াম করেন। নেতৃত্ব দেন বিভিন্ন বাহিনীর
অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। বৃক্ষতলে বসে তাঁরা চোখমুদে যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন করেন।
মানসিক বিষন্নতা তাড়াতে সবাই একসাথে
উচ্চস্বরে অট্টহাসি দেন। হাহ, হাহ, হা হাস্যধ্বনির পাশ দিয়ে
যেতে নিজেও হেসে উঠি। বুঝতে পারি হাসি ভীষণ
সংক্রামক রোগ, তাই হাসি আটকানো যায়না।
একদিন লেকপারে বসে লেকের
জলফোয়ারা দেখছি। সাতরঙ্গের আলো জলকনায় পড়ে রামধনু খেলছে। একজন লোক তখন আমার দিকে
তাকিয়ে বললেন, আপনি কি আবুল বারাকাত। বললাম না।
সরি আপনার চূল ও চেহারা দেখে
একদম আবুল বারাকাত মনে হল।
আবুল বারাকাত বাংলাদেশের একজন
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, যিনি ছিলেন শিক্ষক এবং অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
একদিন সন্ধ্যার পর তাকওয়া মসজিদ
ঘাটে বসে আছি। বাসায় ফিরতে যাব এমন সময় একটা তরুণ কাছে এসে বলল, যদি অভয় দেন একটি
কথা বলব।
বললাম, বলুন।
আমি একজন গ্রামের ছেলে। আর্থিক
সামর্থ না থাকায় টিউশনি করে ঢাকার একটি কলেজে পড়ছি। কালকে পরীক্ষার টিউশন ফি দেবার
শেষ তারিখ। আমার পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। দুই হাজার জোগাড় করেছি। চোখে অন্ধকার
দেখছি, বাকি তিন হাজার জোগাড় নাহলে পরীক্ষা দিতে পারবনা। তরুণটির কথাবার্তা ও
হাবভাব দেখে আমার বিশ্বাস হল সে সত্য বলছে। আমার ম্যানিবেগে সেদিন টাকা ছিল। আমি
তার হাতে তিন হাজার টাকা তুলে দিলে সে মহানন্দে চলে গেল যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
পরদিন অফিসের গাড়িতে গল্পটি বললে সহকারী মহাব্যবস্থাপক কাজি ইশতিয়াক সজল বললেন,
আপনি সাবধানে চলাচল করবেন, কোন অচেনা প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন নি তো।
এবার ধানমন্ডি বাসার ছাদবাগানের
গল্প বলব। আমাদের ফ্ল্যাট চারতলায়। আমাদের উপরের একমাত্র ফ্ল্যাটের মালিক শেখ
হাসিনার চাচা শেখ নাদিম লিপু। অবিকল বঙ্গবন্ধুর চেহারা, চুলও প্রায় অনুরূপ। তার বেগম
সাহেবা বরিশাল ললনা। দুইপুত্র ও এক কন্যা নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার। একদিন পূবালী
ব্যাংকের ক্যালেন্ডার ও ডায়রি নিয়ে তার সাথে দেখা করি। শেখ হাসিনা পুত্র কন্যা
নিয়ে তার বিয়েতে যোগদানের ছবি দেখি। ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি ভারতীয়
দুতাবাসের মাধ্যমে তার কাছে ইংরেজিতে লিখা একটি বড় আত্মজীবনী উপহার পাঠান। সেই
বইয়ের শুরুতে ভারতীয় প্রেসিডেন্ট সবুজকালিতে নিজহাতে শুভেচ্ছাবানী লিখে দেন। উন্নত
বাঁধাইয়ের বিশালাকার বইটি হাতে নিয়ে বেশ নাড়াচাড়া করি।
শেখ নাদিম লিপু দম্পতি ছাদে এক
বৈচিত্রময় বাগান গড়ে তুলেন। তাঁদের স্নেহে প্রতিপালিত একজন বালকের একমাত্র কাজ ছিল
সারাদিন এই বাগানের পরিচর্য্যা করা। তাছাড়া নার্সারি হতে একজন দক্ষ লোক এসে প্রায়ই
নানান জাতের ফুল ও ফলের গাছ বপন ও দেখাশুনা করতেন। জলাধারে কয়েক প্রজাতির পদ্ম ও
শাপলা ফুটতো। শুকনো কাটগুড়োয় লাগানো নানাজাতের সপুষ্পক অর্কিড ঝুলতো। ছোট্ট বামন
আম্রপলি গাছে ঝুলে থাকে থোকা থোকা আম। লেবু, কমলা, প্লাম, আঙ্গুরলতা, বরই সবই সফলা
ছিল এই ছাদবাগানে। বাগানবিলাস, রঙ্গন, জবা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা ইত্যাদি দিয়ে
সজ্জিত ছিল ছাদবাগানের বৈঠকখানা। বিষন্নতা এলেই আমি গিয়ে এই ছাদবাগানে বসতাম,
বাগানে হাঁটতাম, ওমনি মন প্রসন্ন হয়ে যেত।
প্রিয়জন কেউ এলে আমি তাদেরকে এই
বাগান না দেখে যেতে দিতাম না। এই বাগান পরিদর্শন করেন সহকর্মী সায়েদ আব্দুল্লাহ
যীশু, অনুজ নিশাত কুরেশি, ফাহমিদা লোমা ও ভাতিজি জাইমা। সহকারী মহাব্যবস্থাপক
মিজানুর রহমান ও তাঁর কন্যা এসে বেগম লিপুকে বাগানে পান। সেদিন বেশ গল্প জমে।
শেখ নাদিম লিপুর বাসার বাবুর্চি
ছিলেন জৈন্তার লোক। এখানে জৈন্তার এমপি ইমরান আহমদ প্রায়ই আসতেন। সিলেটের বেশ
কয়েকজন আওয়ামী এমপির আনাগুনা এবাসায় ছিল। শেখ নাদিম লিপু ছিলেন সরকারি দুগ্ধ
কোম্পানি মিল্কভিটার চেয়ারম্যান। টুঙ্গিপাড়ায় তার একটি বড় ডেইরি ফার্ম ছিল। তিনি
প্রায়ই টুঙ্গিপাড়া যাওয়া আসা করতেন। মাওয়ায় একটি স্পেশাল ফেরি তাঁর গাড়ি পদ্মা পার
করে দিত। আমি টুঙ্গিপাড়া যাবার আগ্রহ প্রকাশ করলে শেখ নাদিম লিপু আমাকে সাথে যাবার
আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু হঠাৎ করোনা মহামারি এসে সেই পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দেয়। শেখ
নাদিম সাহেবের সহযাত্রী হয়ে আমার টুঙ্গিপাড়া গমন আর সম্ভব হয়নি। তাই তিন বছর ঢাকায়
অবস্থান করলেও প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধুর পবিত্র মাজার জেয়ারত না করেই সিলেটে ফিরে এলাম।
ধানমন্ডি লেকে তিনটি ছোট্ট দ্বীপ
আছে। জলে ভাসা প্রতিটি দ্বীপ দুই-তিন বিঘা আয়তন বিশিষ্ট। প্রথম দ্বীপটি ছিল বঙ্গবন্ধু
জাদুগরের সামনে, দ্বিতীয়টি আবাহনী মাঠকে এপারের সাথে যুক্ত করেছে। তৃতীয় দ্বীপটি
সুধাসদনের পিছনে অবস্থিত। দুইটি দ্বীপে ছিল দুইটি হোটেল। বৃক্ষতলে প্রাকৃতিক
পরিবেশে চেয়ার টেবিল পাতা। এই হোটেলগুলোতে বসে প্রায়ই চিনিবিহীন চা পান করি। ঘন
দুধের এই চা দারুণ মজার, এতে চিনি আছে কিনা বললে তাঁরা জবাব দিত না, এটা দুধের
মিঠে।
ধানমন্ডি লেকপারের আরেকটি সুন্দর
ইবাদাতখানা বায়তুল আমান জামে মসজিদ। বিকেলে হাঁটতে বের হলে প্রায়ই এই মসজিদে আসর,
মাগরিব কিংবা এসার জামাতে শরিক হতাম। মসজিদের পশ্চিমে লেকপারে ছিল ঘন বন। এই বনটি
নানা প্রজাতির পাখির কলতানে মুখর থাকতো। এখানকার রাস্থা পাখির বিষ্টার আস্তরণে
ঢেকে যেত। সন্ধ্যায় এখানে এলে মনে হত ভাটি অঞ্চলের কোন জলাবনের পাখির মেলায় ঢুকে
গেছি। একদিন এই বনের ভিতর দিয়ে যাবার সময় পাখির সাদা বিষ্টা পড়ে আমার জামা নষ্ট হয়।
ধানমন্ডি লেকপারে অনেক প্রজাতির
বটবৃক্ষ ছিল। কুলবট, কাটলি বট, পাকুড়, অশ্বত্থ ইত্যাদি। লেকপারের ঝুটিওয়ালা বটবৃক্ষের
চারদিকে বাঁধাইকরা মঞ্চে বসে সময় কাটানোর মজাই আলাদা। প্রতি ঋতুতে এখানে নতুন নতুন
জাতের ফুল ফুটে। জলে শাপলা ফোটে। বসন্তে কৃষ্ণচূড়া, পলাশ লেকপার শোভিত করে।
মধ্যদ্বীপে একবার একটি গাছ লালকুসুমে ভরে যায়। আমি চিনতে না পেরে ছবি তুলে ফেসবুকে
পোস্ট দেই। ছোটবোন ফাহমিদা লোমা জানালেন এটি কাঞ্চন ফুল। আসলেই আমার জীবনে ভাললাগা
একটি অতি প্রিয় জায়গা ধানমন্ডি লেকবাগান। এই লেকবাগানের অনেক মধুর স্মৃতি ভূলতে
পারবনা জীবনে কোনদিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন