সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

অফিসের গাড়িকাহিনিঃ

 অফিসের গাড়িকাহিনিঃ

ঢাকায় যাবার পর আমার থাকার ব্যবস্থা হল ধানমন্ডি লেকপারের উইন্ডসর প্যালেসের চারতলা ফ্লাটে। থাকার একটা উত্তম ব্যবস্থা হল বটে তবে কর্মস্থলের অবস্থান প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার দূরে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, প্রধান কার্যালয়, মতিঝিল। দুইচারদিন বেবিটেক্সি কিংবা টেক্সিক্যাবে গিয়েছি তবে ভাড়া অত্যাধিক হওয়ায় পরে গণপরিবহনই বেছে নেই। গণপরিবহনে অফিস সময়ে ভীষণ ভীড় জমে এবং যুদ্ধ করে গাড়িতে উঠতে হয়। ধাক্কাধাক্কি করে অতি ঝুঁকি নিয়ে পুরুষ নারী সবাই গাড়িতে উঠে প্রায়ই দেখেন সিট খালি নেই, লাইনে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। নারীদের সংরক্ষিত তিনটি সিট সর্বদা পূর্ণ থাকে। মধ্যপথে কেউ নেমে গেলে মাঝে মাঝে বসার সিট মেলে। বাসাফেরার সময় রাত্রে শাপলাচত্বরে বাসে আসন মেলে সত্য কিন্তু বাস ছাড়তে অনেক দেরি হয়।

অফিস যাবার বেলা গাড়ি পাওয়া প্রায়ই কঠিন হত, তাই বিসমিল্লাহ বলে হাঁটা শুরু করতাম। প্রায়ই মাইলখানেক হাঁটার পর হয়ত গাড়ি পাবার সৌভাগ্য হত। দুইচারদিন পায়ে হেঁটেও অফিসে কিংবা বাসা পর্যন্ত পৌঁছে গেছি যে কিভাবে, বুঝতে পারিনি। কোন এক রমজানের দিনে রোজা রেখে বাসায় ফিরি হেঁটে হেঁটে, কারণ কোন গাড়ি পাচ্ছিনা, আর কেবল হাঁটছি। রমনা পার্কের ছায়ায় খানিক জিরিয়ে নিয়ে আবার ছুটেছি। রমজানে আসরের নামাজ পড়েছি কাটাবন কিংবা সুপ্রিমকোর্ট জামে মসজিদে। মানুষ পারে, বাধ্য হলে মানুষ চার পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারে অনায়াসে। আমিও পেরেছি। পেরেছি বেশ কয়েকবার। আসলে ঢাকায় দূরবর্তী অফিস-বাসা আসা-যাওয়া ভীষণ রকম যন্ত্রণাময়, বিশেষ করে গরিব ও মধ্যভিত্ত জনতার জন্য। শেষমেশ ভূক্তভোগীর জন্য কষ্টে কেনা ফ্ল্যাট হয়ে যায় কেবলমাত্র রাতের নিদ্রামহল।

আমার এই কঠিন পরিবহন যন্ত্রণা দেখে একদিন হাবিব মহসিন বলল, স্যার আপনি পুলের গাড়িতে করে বাসায় আসা-যাওয়া করতে পারেন। সহকারী মহাব্যবস্থাপকগণের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা আছে। আমি পুলের গাড়ির জন্য আবেদন করি। কিন্তু ধানমন্ডিগামী গাড়িগুলোতে কোন সিট খালি নেই। আমাকে জানানো হয় কোন গাড়িতে সিট খালি হলেই সুযোগ পাবেন।

প্রায় ছয়মাস অনেক কষ্টে ধানমন্ডি হতে কলাবাগান এসে যানবাহনে মতিঝিল আসা যাওয়া করি। প্রায়ই কলাবাগান আসার কিংবা মতিঝিল যাবার সঠিক গাড়ি পাওয়া যেতনা। ফলে ভিন রোডের গাড়িতে উঠে দূরে নেমে অনেক পথ হেঁটে গন্তব্যে যেতে হত।

আমার অফিসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ফারুক হাসান পুলের গাড়িতে আসা যাওয়া করেন। তিনি পূবালী ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক আনয়ারুল হকের পূত্র। তাঁর পৈত্রিক নিবাস রংপুর। তাঁর বাবা চাকুরীর সুবাদে ঢাকায় ছিলেন ও মিরপুরে জমি কিনে চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। হঠাৎ একদিন পাশের চেম্বারের এজিএম ফারুক হাসান বললেন, কুরেশি সাহেব আজ থেকে আপনি পুলের গাড়িতে করে আমাদের সাথে বাসা যাবেন। তাঁর কথা শুনে খুব খুশী হলাম, কারণ অনেকদিন হতে আমি এই সুখবরের অপেক্ষায় ছিলাম।

প্রধান কার্যালয়ে একটি রীতি প্রচলিত যে পূবালী ব্যাংকের অতি গুরুত্বপূর্ণ সব খবর সাথে সাথে প্রতিটি তলায় তলায় গিয়ে একজন ঘোষক চোঙ্গায় মুখ রেখে উচ্চস্বরে এলান করে দেন। ঘোষকের এলান শোনামাত্র সবাই কাজকর্ম বন্ধ করে কানখাড়া করে সেই বার্তা শুনেন। এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীর মা এবং সাবেক এমডি ইব্রাহিম খালেদের মৃত্যুসংবাদ এই ঘোষণার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক আমাদের কানে আসে।

একদিন ঘোষক উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন সহকারী মহাব্যবস্থাপক জিয়াউদ্দিন হার্টএটাক হয়ে মারা গেছেন। জিয়াউদ্দিন ১৯৯০ সালে আমার সাথে ব্যাংকে যোগ দেন এবং অবসর গ্রহণের কয়েক বছর আগেই অকালে দেহত্যাগ করেন। পুলের গাড়িতে তাঁর শূন্য আসন আমার জন্য বরাদ্ধ হল।        

সেদিন বিকেলে মহানন্দে ফারুক হাসান স্যারের সাথে অফিসের মাইক্রোবাসে গিয়ে বসি। ফারুক হাসান সবার সিনিয়র এজিএম, পদোন্নতি হয়না তাই চাকুরী জীবনের অর্ধেক সময়কাল জুড়ে এজিএম পদে আছেন। তিনি মুরব্বি, তাঁর শক্ত তাড়া খেয়ে সবাই দ্রুত এসে হাজির। গাড়িতে বসেই সদ্যপ্রয়াত যাত্রী সহকারী মহাব্যবস্থাপক জিয়া উদ্দিনের প্রশান্তি গেয়ে যান যাত্রীরা সবাই। মরহুমের স্মৃতিচারণ চলে পরবর্তী বেশ কয়েকদিন।

গাড়ির যাত্রীরা ছিলেন কাজি ইশতিয়াক সজল, এজিএম, তিনি একজন আইনজীবীর পুত্র বাড়ি রাজশাহী, তিনি আই টি প্রকৌশলী, ফ্লাট কিনেছেন মিরপুর। তিনি অগ্নিসিস্টেম কোম্পানির চাকুরি ইস্তোফা দিয়ে পূবালী ব্যাংকের আভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ বিভাগে সরাসরি এজিএম হিসাবে যোগ দেন। তিনি আমার চেয়ে বয়সে প্রায় দশবার বছরে ছোট। ইশতিয়াক সজল হাসিখুশী প্রাণবন্ত মানুষ।   

ফারুক হাসান শিক্ষায় বিএ, পদে এজিএম, জিএসডিডি, বাড়ি রংপুর। মোহাম্মদপুর তাঁর চারতলা পৈত্রিক বাড়ি। তিনি সম্পর্কে ইতিপূর্বে অনেক লেখা হয়ে গেছে।

খানিক ছোটখাটো মিজানুর রহমান, এজিএম, নিরীক্ষা বিভাগ, হেডঅফিস। তাঁর সুন্দরী পত্নী নির্ঝরা খানম অর্থনীতিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স। মিজান সাহেব বেশ বাচাল। তিনি অনবরত কথা বলতে ভালবাসেন। মিজানুর রহমানের পরিবারের সবাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। রাজশাহীতে তাঁর বহুতল ভবন এবং আমের বাগান আছে। স্ত্রী নির্ঝরা খানম ও একমাত্র কন্যা তাইবা খানমকে নিয়ে মিজান সাহেব একবার আমার সাথে গ্রিনলাইনে সিলেট আসেন। আমি তাদেরকে নিয়ে জাফলং ও সাদাপাথর ঘুরে বেড়াই। তাঁরা সিলেটে আমার বাসায় আসেন এবং আমি ঢাকায় তাঁদের কলাবাগানের বাসায় দাওয়াত খাই। মিজান নির্ঝরা দম্পতির একমাত্র কন্যা তাইবা খানম ঢাকার ভিখারুন্নেছা স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।

খোরশেদ আলম এজিএম, তিনি অডিট বিভাগে কাজ করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ভূগোলে মাস্টার্স করে তিনি সিনিয়র অফিসার হিসাবে পূবালী ব্যাংকে যোগ দেন। তাঁর বাড়ি বাগেরহাট, বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তিনি মিরপুরে ফ্লাট কিনে সেখানে বসবাস করতেন। একই ভবনে ফ্লাট কিনে বসবাস করতেন আমার ভাগ্নী পলির শ্বশুর দক্ষিণ ভাদেশ্বরের আব্দুল গনি চৌধুরী। খোরশেদ আলম একজন প্রাণবন্ত হাসিখুশি লোক। পরে একথা জেনে খুব দুঃখনুভব করি যে তিনি ক্যান্সারাক্রান্ত এবং গলে অপারেশন করান ধানমন্ডি আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে। তিনি আমার অনুজ নিশাত কুরেশীর সমবয়স্ক জেনে তাঁর প্রতি আমার স্নেহমমতা আর বেড়ে যায়। তিনি খুব বিদ্বান ও বুদ্ধিমান। ব্যাংকের কাজ ও আই টিতে তিনি খুবই দক্ষ।

খোরশেদ আলম আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন নিয়ে অনেক গল্প শুনাতেন যখন গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকে যেত। হাইকোর্ট মাজারে গিয়ে বুয়েট, ঢাবি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্রদের গাজার কল্কিতে সুখটান মারার গল্প তাঁর মুখে শুনতে পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ইতিহাস লুকিয়ে আছে যা কেউ জানেনা, তিনি এসব কাহিনি শোনাতেন। এখানে বাংলার বারভূইয়া প্রধান ইসা খানের পুত্র মুছা খানের মাজার থাকার সংবাদ তাঁর কাছে পেলাম। কঠিন রোগ সত্বেও তাঁর মনোবল ছিল সুদৃঢ় এবং তিনি নিয়মিত অফিস করতেন। মহান আল্লাহ তাকে সুস্থ্য করুন এবং দীর্ঘজীবন দান করুন আমিন।        

মনে পড়ে প্রথম দিনে চালক মোহাম্মদ আলী গাড়ি চালিয়ে অফিসের আঙ্গিনা হতে বের হয়েই যানজটে পড়ে। রাস্থায় রাস্থায় নিছিদ্র ভীড়। যানজট ঠেলে ঠেলেই গাড়ি এগিয়ে যায়। প্রতিটি পয়েন্টে ১০/১৫ মিনিট অপেক্ষা, তারপর সারি সারি গাড়ির ভূদৌড়। এক একটা ভূদৌড় মেরে মেরে যানজটে থেমে থেমে গাড়ি এগিয়ে যায়। লক্ষ্য করি ফুটপাথে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলোও প্রায় আমাদের সাথে সাথেই যায়। ইশতিয়াক সজল বললেন, কুরেশী স্যার আমেরিকায় কি রকম যানজট হয়। জবাব দেই, আমেরিকান কেউ ঢাকায় এসে এরকম যানজটে পড়লে সোজা এয়ারপোর্ট ফিরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রগামী বিমানে চেপে বসবে। নিউইয়র্কে গাড়ি ঘণ্টায় ৪০/৪৫ মাইল বেগে চললে ওরা বলে ট্রাফিক জামে আছি।   

অফিসের গাড়ি কখনও শাগবাগ হয়ে, কখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে, নীলক্ষেত ও নিউমার্কেট হয়ে আবার কখনও ভিনপথে কাওরানবাজার-প্রান্তপথ হয়েও আমার ঠিকানা ধানমন্ডি যেত।  

প্রথমদিনের নতুন যাত্রী ইসফাক কুরেশী প্রায় দুইঘন্টার এক দীর্ঘযাত্রা পেরিয়ে কলাবাগানে যখন নেমে যাই, তখন অন্য সাথিরা বললেন আমাদের বাসা পৌঁছিতে আর দুইতিন ঘন্টা লেগে যাবে। প্রায়ই বাসায় গিয়ে দেখেন, তাঁদের সন্থানরা ঘুমিয়ে আছে। পরদিন সকালে সন্তানদেরে ঘুমে রেখেই চলে আসতে হয় অফিসের বাসে। আমি ভাবি এটা কি জীবন হল, যেন কেবল ঘুমানোর জন্য অফিস হতে বাসায় ফেরা।  

তাদেরে প্রশ্ন করি তারচেয়ে রাতে অফিসে ঘুমের ব্যবস্থা করে ফেললে কেমন হয়? ব্যাংক যদি অফিসে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে কত না ভাল হত। ঢাকায় খাওয়া দাওয়া তেমন সমস্যা নয়, সমস্যা হল কেবল ঘুমানো। ঘুমানোর জন্য রোজ রোজ চারপাঁচ ঘন্টা রাস্থার কাটাতে হয়। জবাব আসে ব্যাংকে রাতে ঘুমাতে পারেন কুরেশী সাহেব, তবে হঠাৎ একদিন পুলিশ এসে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে লালঘরে।                            

সহযাত্রী শহিদ আহমদ এজিএম কাজ করেন প্রধান কার্যালয়ের মানবসম্পদ বিভাগে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স। তাঁর বাড়ি নোয়াখালী এবং পৈত্রিক বাসা মোহাম্মদপুর। তিনি হৃদরোগী অথচ ধূমপান ছাড়তে পারেননি। আমাদেরকে প্রায়ই তিনি চা-নাস্তা করাতেন, আমি কখনও বিল পরিশোধ করতে পারিনি।

আলমগীর জাহান এজিএম ছিলেন ১৯৯৭ ব্যাচের সিনিয়র অফিসার। এই ব্যাচ ছিল খুব ভাগ্যবান। ৯৭ ব্যাচের সবাই ডিজিএম/জিএম। শাহাদাত হোসেন ও মোহাম্মদ ঈসা হয়েছেন ডিএমডি। এই ব্যাচের যে দু’একজন এজিএম পদে রয়েছেন তাঁদের একজন আলমগীর জাহান। তাঁর বাড়ি রংপুর। তিনি কথা বলতেন অল্পস্বল্প। ব্যাংকিং বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। আইটিতেও দক্ষ ছিলেন। সব সক্ষমতা এবং জ্ঞান থাকলেও উন্নতির প্রধান দক্ষতা তুষামুদির কলাকৌশল তিনি রপ্ত করতে পারেননি। ফলে যেখানে তিনি আজ থাকার কথা, সেখানে নেই।

মুরব্বি ফারুক হাসান স্যার প্রতিদিন সামনের সিটে বসতেন। সামনের সিটে তিনি কখনও কাউকে বসতে দিতেন না। পাশের আসনে বসে চালকদেরকে অনবরত নির্দেশনা দিয়ে বিরক্ত করতেন। একদিন চালক মোহাম্মদ আলী বিরক্ত হয়ে বলে উঠে, স্যার আপনি দয়া করে আমার সিটে এসে গাড়ি চালান, আমি নেমে যাই। একদিন চালক মোহাম্মদ আলী হেড অফিসের আঙ্গিনায় রাখা অন্য গাড়িতে আচমকা ধাক্কা মেরে দেয়। খুবসম্ভব সে অন্যমনস্ক ছিল কিংবা ব্রেক কাজ করেনি। এই ঘটনায় ফারুক হাসান বেশ ভয় পেয়ে যান এবং ভাবতে থাকেন তিনি সামনের আসনে বসবেন কিনা।

তিনি প্রচুর ১০ টাকার নোট নিয়ে গাড়িতে বসতেন এবং প্রতি পয়েন্টে গাড়ি থামামাত্র এগিয়ে আসা ভিক্ষুকদেরে ১০ টাকা করে বিতরণ করতেন।

বঙ্গবন্ধু ভিনিউ শাখার জসিম উদ্দিন এজিএম প্রথমদিকে আমাদের সাথে যেতেন। তিনি অসুস্থ এবং নিয়মিত ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিতেন। তাকে ঐ শাখার কাছ হতে আমরা তুলে নিতাম।      

বঙ্গবন্ধু এভিনিউইয়ের একটি হোটেলে খুব মজাদার দেশী নাস্তা ও খাবার তৈরি হয়। খোরশেদ আলম ফোনে আগেই বুকিং দিতেন। আমরা গাড়ি থামিয়ে এই ব্যস্ত দোকান হতে খাবার, পানি ও কুক নিয়ে গাড়িতে বসে খেয়ে খেয়ে বাসায় ফিরে দেখতাম উদর পূর্ণ।

সাপ্তাহখানিক পর পর আমরা রাতে গাড়ি নিয়ে ধানমন্ডি স্টারকাবাবে ঢুকে যেতাম। কাবাব, নানরুটি, কুক, দৈ, মাঠা সহকারে চালকসহ আমরা পাঁচজন উদরপূর্তি করে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে যেতাম। প্রতিবার আমরা একেক জন একেক দিন বিল পরিশোধ করতাম। স্টারকাবাবের সামনের পানসুপারীতে নানা ধরনের উপাদান মিশাতেন দোকানী, যা হত স্বাদে সুমিষ্ট ও মজাদার। আমি খানিকক্ষণ চিবিয়ে এইপানের স্বাদ নিয়ে লালরস ডাস্টবিনে ফেলে দিতাম, যাতে রক্তে সুগার বেড়ে না যায়। তবে এই পানের সুগন্ধ পরদিন সকালেও অনুভব করতাম।

একদা ঢাকায় প্রচুর করোনা সংক্রমণ ঘটে। সরকার ঢাকায় লকডাউন ঘোষণা করে। ইতোমধ্যে মহামারির ভয়ে গৃহকর্মী সুমন মৌলভীবাজার চলে যায়। কলাবাগান ও মতিঝিলে হোটেল ও খাবার দোকান বন্ধ। এমতাবস্থায় ঢাকায় অবস্থান বেশ ঝুঁকিজনক। আমি অফিস থেকে বেরিয়ে আরামবাগ, ফকিরাপুল, কমলাপুরসহ সর্বত্র ঘুরে ঢাকা ছাড়ার জন্য কোন বাসটিকেট পেলামনা। নেটে বিকাশে ঢুকে কোন উড়াল টিকেটও পেলামনা। এজিএম খোরশেদ আলম বললেন লকডাউন রাত ১২ঘটিকা হতে কার্যকর হবে। আপনি উবারের কারে ঢাকা হতে এখনই পালান।

এজিএম কাজি ইসতিয়াক সজল উবার এপসে ঢুকে একটি কার ডাকেন। উবার চালক হিসেব করে বলল ৬৫০০/- টাকা বিল আসবে, আপনি রাজি। বললাম, আমি রাজি।

উবারের বাস আমাকে সন্ধ্যায় সিলেটের জেফার ভবনে পৌঁছে দেয়। সেদিন উবারে সিলেট না এলে দীর্ঘদিনের জন্য ঢাকায় আটকা পড়তাম। কয়েক সাপ্তাহ করোনার জন্য লকডাউন থাকায় আমার ঢাকা ফেরা সম্ভব হয়নি। সময়টা সিলেটে পরিবারের সাথে খুব ভালই কাটে। এসময় আমি ভাগনা কম্পিউটার প্রকৌশলী মুফতি মোহাম্মদ তাসনিম হিমুর কাছে আইটি শিখি। সে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় হতে কম্পিউটার বিজ্ঞানে এম এস সি। তাঁদের বাসা আমার বাসার খুব কাছে এই সাগরদিঘিরপারে।

যখন ফিরে এলাম ঢাকায়, লক্ষ্য করি এ জি এম ফারুক হাসান আমাকে ভয় পাচ্ছেন। তাঁর ধারনা সিলেট লন্ডনি জেলা, তাই এখানে করোনা ভাইরাস অত্যাধিক। পরদিন ধানমন্ডির বাসা হতে আমাকে অফিসগাড়িতে করে নিয়ে আসতে ভয় পান তিনি। আমি সকালে গাড়ির অপেক্ষা করে তাকে বার বার ফোন করি। রিংটোন বাজছে অথচ কোন সাড়াশব্দ নেই। করোনার কারণে যানবাহন নেই, তাই অফিসে যাবার জন্য হাঁটা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। আমার ভীষণ রাগ হল। এবার গাড়িবিভাগের প্রধান ও আমার বস আবু হাবিব খায়রুল কবির স্যারকে ফোন করে বিষয়টি জানাই। তিনি সাথে সাথে আমাকে নিয়ে আসতে ফারুক হাসানকে কড়া আদেশ দেন। তাঁরা এবার আমাকে আনতে কলাবাগান ফিরে যান কিন্তু আমি এতক্ষণে পদব্রজে মতিঝিল পৌছে যাই। ফারুক হাসানের সাথে অফিসে দেখা হলে তিনি বললেন আমরা কলাবাগানে সারাদিন আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। বিশ্বাস করুন আমরা আপনাকে ফেলে আসিনি।

ব্যাপারটা কি? তা আমার বস মহাব্যবস্থাপক খায়রুল কবির বিশদ জানতে চাইলে আমরা সবাই মিলে জবাব দেই, তেমন কিছুনা, মিস কমিউনিকেশনের কারণে এমনটি হয়েছে।

আমাদের গাড়িতে কয়েকজন উপমহাব্যবস্থাপক যাতায়াত করতেন। বেলায়েত হোসেন তাঁদের একজন। তাঁর বাড়ি চাঁদপুর। তিনি বেশ বিনয়ী লোক। কিছুদিনের মধ্যেই অবসরে চলে যান।

ডিজিএম ইমামুর রশিদ চৌধুরীর বাড়ি নোয়াখালী জেলার বখসিরহাট। তিনি চাকুরী জীবনে তাঁর পৈত্রিক জমিতে একটি বিশাল গরুর খামার গড়ে তুলেন। তিনি বেশি বেশি গল্প বলতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়ি প্রবেশ করলেই তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে যেতেন এবং ছাত্রজীবনের নানান কাহিনি শুনাতেন। নোয়াখালির অভিজাত পরিবারের সন্থান ইমামুর রশিদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স করে সিনিয়র অফিসার হিসাবে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করেন। তাঁর পুত্র বিদেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ত। তাঁর পত্নী ছিলেন সরকারি কলেজের অধ্যাপিকা। ঢাকায় তাঁর বাসাবাড়ি থাকলেও অবসর গ্রহণ করেই তিনি তাঁর গ্রামে ফিরে যান। গরুর খামার আর প্রসারিত করেন। আমাদেরকে তাঁর খামারে যেতে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু করোনার জন্য নোয়াখালী গিয়ে তাঁর খামারবাড়ি আমাদের দেখা হয়নি। আমি সিলেটে ছিলাম এমন কোন এক সময়ে তিনি ঢাকা এসে আমাকে অনেক খোঁজাখোঁজি করেন। হয়ত আমাকে শেষ দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমি ঢাকায় গিয়ে জানতে পারি তিনি ইতোমধ্যে নোয়াখালির গ্রামে ফিরে সেখানে পরলোকগমন করেছেন। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতের বাসিন্দা করুন আমিন।          

উপমহাব্যবস্থাপক নূরে আলম সরকার ছিলেন কুমিল্লার জাতক। তিনি গণিতে অনার্সসহ মাস্টার্স করে সরকারি হাইস্কুল শিক্ষক হন। পরে শিক্ষকতা ছেড়ে সিনিয়র অফিসার হিসাবে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করেন। তাঁর পত্নী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর পদবীর কর্মকর্তা। তাঁরা থাকতেন সেনাবাহিনীর সরকারি বাসায়। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটি ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন করছে। তিনি প্রায়ই আমাদের সাথে যাওয়া আসা করতেন।  

ড্রাইভার মোহাম্মদ আলী ছিল বরিশালের লোক। সে গম্ভীর প্রকৃতির। চালক জুয়েল চতুর এবং আনিস বেশ নম্রভদ্র।

বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাভাষী আমরা ক’জন নির্বাহী একত্রে অফিসের গাড়িতে বসে দিনের দুইতিন ঘন্টা সময় পার করতাম। সময়টা কাটতো মোবাইলে গান ও কৌতুক শুনে। কাজি ইশতিয়াক সজল ভাইরাল হওয়া গানগুলো বাজিয়ে অর্থসহ আলোচনা করতেন। সিলেটের ভাইরাল হওয়া নয়া দামান্দ গান- আইলারে নয়া দামান আসমানেরও তেরা। বিছানা বিছাইয়া দিলাম সাইল ধানের নেরা। বও দামান বও।/ বও দামান কও রে কথা, খাওরে বাটার পান, যাইবার কথা কও যদি কাইটা রাখমু কান। বও দামান বও।

অনেক সিলেটি গানের অর্থ সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার।

শহিদুল হক এবং ইমামুর রশিদ চৌধুরী নোয়াখালীর গান ও গল্প শুনাতেন। নোয়াখালীর ভাষা কৌতুকের, এই ভাষায় যেমন হাস্যরস তৈরি হয়, তা বাংলাদেশের অন্য কোন আঞ্চলিক ভাষায় সম্ভব হয়না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ কৌতুকই নোয়াখালী ভাষায় রচিত এবং অভিনীত হয়।

রাজশাহীর নানানাতির গান শুনাতেন কাজি ইশতিয়াক সজল। ভাইরাল হওয়া রাজশাহির গান- বড় লোকের বেটিলো, লম্বা লম্বা চুল। এমন মাথায় গেঁথে দেব লাল গেন্ডা ফুল

শ্রীলংকার গায়িকা ইউহানির গান- ‘মানিকে মাগে হিতে, দূরে নেগা হেত’ শুনে শুনে কান জ্বালাপালা। কাজি ইশতিয়াক এই সিংহলি গানের বঙ্গানুবাদ করে মর্ম বুঝিয়ে দিতেন।

একদিন ফারুক হাসান গুলিস্থানে একজন রোগা লোক দেখিয়ে বললেন, এই দেখুন ওর হাতে মানব মল। আমি ভাল করে চেয়ে দেখি সত্যি পচা হলুদ মল ব্যাগে ভরে হাতে নিয়ে হাঁটছে।

দেখতে নেশাখুরের মত এই লোকটির কি কোন ঘেন্না নেই, ও কিভাবে কাচা মল হাতে নিতে পারে। বলতেই কাজি ইশতিয়াক সজল বললেন, কুরেশী স্যার এটা ঢাকার নেশাখোরদের অর্থ উপার্জনের একটি সহজ পেশা। ঐ লোকটা ফুটপাতবাসী গাঁজাখোর। সে রিকশারোহী কোন মহিলাকে টার্গেট করে গায়ে মল লাগিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে বড় অংকের টাকা আদায় করে নেবে।

আমি বললাম, এভাবে পচা মানবমল কি কেউ হাতে নিতে পারে? খুবসম্ভব ময়দার সাথে হলুদগুঁড়ো মিশিয়ে মানবমলের মত হলুদ হালুয়া বানিয়ে ফেলেছে।

আমার যুক্তি শুনে গাড়ির সবাই জুরে হেসে দেন।       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন