স্মৃতিময় মতিঝিলঃ
শীতকালের মিস্টি রোদে হাঁটা আমার আজন্ম
অভ্যাস। অফিসে তাই কাজের চাপ কম হলে আমি দুপুরে খাবার পর শীতের মতিঝিলে বেশ হেঁটে নিতাম।
মতিঝিল জনবহুল এলাকা, রিকশা, বেবিটেক্সি ও গাড়ির জাম লেগে থাকে।
শীতের বিকেলে মতিঝিলের চিপায় চাপায় হাঁটা বেশ আনন্দের। ফুটপাতের
চাটনি, সিঙ্গারা, চানাচুরভাজা এবং টনিক চায়ের স্বাদ অসাধারণ। টনিক চায়ে
লেবুরস, আদা, কাঁচামরিচ, চিনি ইত্যাদি মেশানো হত। আমি বেশি যেতাম প্রেসিডেন্ট
ভবনের সামনে ওসমানী উদ্যানে। পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হতে বার মিনিট
হাঁটলেই প্রেসিডেন্ট ভবনের পাশ দিয়ে ওসমানী উদ্যানে পৌঁছা যায়। উদ্যানের মাঝে একটি
বড় বর্গাকার দিঘি। এই দিঘি ঘিরে চারপাশে বাগান। এই বাগানে প্রচুর সুদৃশ্য বটবৃক্ষ।
আমি প্রায়ই ওসমানী উদ্যানের পুকুরটি হেঁটে
হেঁটে প্রদক্ষিণ করি।
বায়তুল মোকাররম
মসজিদের ডিজাইন অসাধারণ। আমি বেশ কয়েকদিন এই মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ি। মসজিদের
গেটে সাতপ্রকার ফল মিশ্রিত শরবত বিক্রি হয়। আমি দুষণ ভয়ে এই শরবত উপেক্ষা করতাম।
একদিন হেঁটে হেঁটে বেশ পিপাসার্ত হয়ে গেলে ভাবলাম, এত এত মানুষ এই
শরবত পান করে সবাই সুস্থ্য শরীরে তবিয়তে বহাল আছে। যা হবার হবে একবার খেয়ে
দেখিনা কেমন লাগে। আঙ্গুর বেদানা আপেল কলা পেঁপে তুকমা ইসুবগুল ইত্যাদি
নানা ধরনের ফলের নির্যাস এই শরবত খেয়ে দেখি ভারি মজাদার।
এখানে আছেন প্রচুর ভবঘুরে গৃহহীন নরনারী, টুকাই বালক ও পথশিশু । আছে বেওয়ারিশ কুকুরের পাল। সর্বহারা জনতার
জীবনাচরণ দেখার জন্য এটি বেশ উপযুক্ত স্থান। এখানে রূপসি বেদে তরুণীরা নানা
ভেল্কিভাজি করে কাউকে ঠকানোর তালে সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। একদিন তিনজন মেয়ে
আমাকে ঘিরে ধরে, রহস্যময় কিছু কথাবার্তা বলে আমাকে সম্মোহন করার চেষ্টা করে। আমি
কোনদিন এসব কবিরাজি ও টুটকাবাজি বিশ্বাস করিনা। আমি পালাতে চাই, ওরা ঘিরে ধরে,
বাবু সাব সামান্য কবজ নিয়ে যা, সারারাত একটানা বিরামহীন করতে পারবি।
শক্ত লোহার মত খাড়া হবে। আমি বললাম, আমি বুড়ো মানুষ, এসবে আমার দরকার নেই।
আমার দিকে বাড়ানো একটা বেদে মেয়ের
হাতের তালুতে অলৌকিকভাবে আগুন জ্বেলে উঠে। সে বলতে থাকে বাবু তোমার
অনেক রোগ আছে, সব রোগ পুড়িয়ে দিলাম।
ওরা গরিব মানুষ, আমি তাই ওদের হাতে একশত
টাকার একটি নোট গুজে তাবিজ কবজ ফেলে দৌড়ে পালিয়ে এলাম। পিছনে কেবল ডাক শুনলাম,
নিয়ে যা বাবু, কাজে লাগবে। রাতে সস্তা পতিতা ও দিনে উদ্যানে ঘুমিয়ে থাকা এইসব
নারীদের জীবন আড়চোখে দেখে নিতাম। তাঁরা ইট দিয়ে চুলা তৈরি
করে কাগজ ও শুকনো পাতা পুড়িয়ে রান্না করত। পাশে তাঁদের বাচ্চা কাচ্চা ও কুকুরের দল
গোলাকারে বসে রান্না করা দেখত। রান্নার উপাদান বড়চাল এবং তাতে কিছু তরকারীর টুকরা।
মসলার তেমন নামগন্ধ নেই, একেবারে পাতলা পানি। আমি হয়ত এই
খাবার মুখে নিতে পারবনা। অথচ রান্না শেষ হলে নারী, শিশু পুরুষমানুষ
ও কুকুরেরা মিলে মিশে ভাগাভাগি করে মহানন্দে খেয়ে নিত। এসব দৃশ্য দেখে চোখে জল আসতো এবং এই নিঃস্ব জনতাদের জন্য আমি হৃদয়ে এক গভীর ব্যদনা ও টান
অনুভব করতাম।
পাশের নাট্যমঞ্চের সামনের মাঠে ও
উদ্যানে কুকুর ও টুকাই বালকরা একে অন্যকে জড়ায়ে এমন ভাবে
ঘুমাতো যেন তাঁরা শত জনমের বন্ধু। এসব দেখে বেশ মনঃকষ্ট হত।
মতিঝিলের স্কাইলাইন দেখা বেশ আনন্দের। প্রায়ই ছাদে গিয়ে মতিঝিলের দিগন্তরেখায় নয়নমেলে দিয়ে বিমুগ্ধ হতাম। ভবনের পর ভবন, উপরে চিলের ঝাঁক ভাসছে।
আমার চেম্বার ছিল পূবালী ব্যাংকের তের
তলায়। চেম্বারের পিছনে তিনফুট ওয়ালের উপর সারাটা গ্লাসে ঢাকা। এই গ্লাসের ওয়ালে
তাকিয়ে সুদূর দিগন্ত দেখা যায়। মতিঝিলের আকাশ জুড়ে সব সময় শত
শত ঈগল (চিল) দলবেঁধে ভেসে বেড়ায়। বহুতল ভবনমালার এসির আড়ালে আবডালে ওরা বাসা বাঁধে। আমার চেম্বারের পিছনেও এক ঈগল দম্পতি খড়কুটা
বিছায়ে বাসা বাঁধে। মাঝে মাঝে কান্নার মত করুন সুরে
ডেকে উঠলে আমরা টের পেতাম প্রতিবেশীরা আছেন জানালার ওপাশে।
আমি তাঁদের জীবনাচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি। স্বামী ও স্ত্রী ঈগলযোগল
পাশাপাশি উড়ে উড়ে পিছনের কার্নিশে এসে তাঁদের শুকনো খড়কুটোর বাসায় বসতো। অভিনয়ে তাঁরা যেন অবিকল হিন্দি ছবির নায়ক নায়িকা। তাঁরা মানুষের
মত সযতনে বাচ্চাদেরে মুখে খাবার তুলে দিত, উড়াল শেখাতো।
এই ঈগলেরা ছিল অনেক বড়। এক একটা ঈগল
তিনচারটা কাকের সমান, অথচ এরা নিচে নামার কিংবা উপরে ওঠার সময় কাকেরা খুব বিরক্ত করে। তাঁরা ছোবল দিলে কাকের মরণদশা ঘটিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু চিলেরা কাকের সাথে কখনও মারামারি করে না। তাঁরা কাকের ঠোকর খেয়ে খেয়ে দ্রুত
উপরে কিংবা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ফলে কাকেরা ক্লান্ত হয়ে একসময় পালাতো।
সন্ধ্যায় চিলেরা ঝাঁক বেঁধে
বেঁধে মতিঝিলের আকাশে চক্কর মেরে মেরে ফিরে যেত নিজ নিজ আশ্রয়ে। মতিঝিলে অফিসের
কাঁচের জানালা দিয়ে শেষবিকেলের এই ঈগলের ঝাঁকের আশ্রয়ে ফেরার শান্ত আবর্তন গতি
দেখে কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতা স্মরণ হত ‘সন্ধ্যা আসে, ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে
ফেলে চিল/ সবপাখি ঘরে ফিরে, সব নদী, ফুরায় এজীবনের সব লেনদেন।‘
মনে হত সব ফিরে যায় ঘরে, আর আমি
রাতে ফিরি আমার একাকি আস্তানা ধানমন্ডি লেকপারের বিজন আস্থানায়, উইন্ডসর ক্যাসেলে।
কোথায় সিলেটে আমার বাড়ি, স্ত্রী-পুত্র-সংসার, আর কোথায় ধানমন্ডির রাজপ্রসাদে এই
একাকি নির্জনবাস।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাজধানী
ঢাকায় আমার তিন বছর সমাপ্ত হয়। তাই মনে হত এই শীতই হবে মতিঝিলে আমার শেষ শীত।
ওয়ারীর বলদা গার্ডেনের পাশে
ফুফুতো ভাই আব্দুল্লাহ চৌধুরীর ফ্লাটে অতীতে কিছুদিন ছিলাম। তাই বলদা গার্ডেন নিয়ে
আমার বেশ কিছু স্মৃতি আছে। সুযোগ পেলেই শব্দ দূষণমুক্ত এই বাগানে বসে বসে অতীতে
অনেক সময় কাটাতাম। এক ঠান্ডা দিনে দুপুরের
খাবারের পর জিএসডিডি অফিস থেকে বের হই এবং একাকি হেঁটে হেঁটে বলদা গার্ডেন দেখতে
যাই। সেদিন রাষ্ট্রপতি ভবন পার হয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের
পুজারীদের ভিড় ঠেলে বলদা গার্ডেনে হাজির হই।
বলদা গার্ডেনের সেই ফ্ল্যাট
বিক্রি করে আব্দুল্লাহ ভাই সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান অনেক আগে। সেই বাসার
একদিকে বলদা গার্ডেন আগের মতই আছে কিন্তু অন্যপাশে রাজপথের উপর নির্মিত হয়েছে
প্রশস্থ ও সুদীর্ঘ মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। অর্থাৎ সামনের ব্যস্ত মহাসড়কটি এখন
দ্বিতল সড়ক হয়ে গেছে।
বিশ টাকার টিকেট কেটে বলদা
গার্ডেনে ঢুকে আবর্তন করি। অপরূপ ও অভিনব পুকুরঘাটে
নেমে বাগিচায় নীরবে হেঁটে যাই।
সামনের জলে ভাসা আমাজান লিলি, পারে পারে নাম না জানা কুসুমরাজি। শশব্যস্ত পুরান
ঢাকার নিসর্গ এই বাগানে ঘুরে মন বেশ প্রশান্ত হয়।
পশ্চিমাদেশের পার্কের মত এখানেও কিছু
কপোতকপোতী বলদা গার্ডেনের আনাচে কানাচে নগ্ন ভালবাসায় মজে আছেন। অরণ্যের আড়ালে
আবডালে এসব হচ্ছেটা কি। তাহলে যুগের তালে বাংলাদেশেও কি বদলে
যাচ্ছে? এখানেও কি পশ্চিমের প্রকাশ্য নগ্নতা এসে নিঃশ্বাস ফেলছে। বয়স হয়েছে, তাই
এসব লীলাখেলা না দেখার ভান করে এগিয়ে যাই।
এত বছর পর স্মৃতিময় বলদা গার্ডেনের
সাথে আবার দেখা হল। স্মৃতি আমাকে এভাবেই পুরাতন জায়গায় বারংবার টেনে নিয়ে যায়।
ঢাকা আসার তিন বছর পার হয়ে গেছে। এত দিন আসি আসি করেও এই বাগানে আসা হয়নি।
অথচ আজ এই বলদা গার্ডেন সফরের
সাথে সাথেই আমার ঢাকা ছাড়ায় বিদায় সানাই বেজে উঠে।
শীতকালের মিস্টি রোদে হাঁটা আমার আজন্ম
অভ্যাস। অফিসে তাই কাজের চাপ কম হলে আমি দুপুরে খাবার পর শীতের মতিঝিলে বেশ হেঁটে নিতাম।
মতিঝিল জনবহুল এলাকা, রিকশা, বেবিটেক্সি ও গাড়ির জাম লেগে থাকে।
শীতের বিকেলে মতিঝিলের চিপায় চাপায় হাঁটা বেশ আনন্দের। ফুটপাতের
চাটনি, সিঙ্গারা, চানাচুরভাজা এবং টনিক চায়ের স্বাদ অসাধারণ। টনিক চায়ে
লেবুরস, আদা, কাঁচামরিচ, চিনি ইত্যাদি মেশানো হত। আমি বেশি যেতাম প্রেসিডেন্ট
ভবনের সামনে ওসমানী উদ্যানে। পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হতে বার মিনিট
হাঁটলেই প্রেসিডেন্ট ভবনের পাশ দিয়ে ওসমানী উদ্যানে পৌঁছা যায়। উদ্যানের মাঝে একটি
বড় বর্গাকার দিঘি। এই দিঘি ঘিরে চারপাশে বাগান। এই বাগানে প্রচুর সুদৃশ্য বটবৃক্ষ।
আমি প্রায়ই ওসমানী উদ্যানের পুকুরটি হেঁটে
হেঁটে প্রদক্ষিণ করি।
বায়তুল মোকাররম
মসজিদের ডিজাইন অসাধারণ। আমি বেশ কয়েকদিন এই মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ি। মসজিদের
গেটে সাতপ্রকার ফল মিশ্রিত শরবত বিক্রি হয়। আমি দুষণ ভয়ে এই শরবত উপেক্ষা করতাম।
একদিন হেঁটে হেঁটে বেশ পিপাসার্ত হয়ে গেলে ভাবলাম, এত এত মানুষ এই
শরবত পান করে সবাই সুস্থ্য শরীরে তবিয়তে বহাল আছে। যা হবার হবে একবার খেয়ে
দেখিনা কেমন লাগে। আঙ্গুর বেদানা আপেল কলা পেঁপে তুকমা ইসুবগুল ইত্যাদি
নানা ধরনের ফলের নির্যাস এই শরবত খেয়ে দেখি ভারি মজাদার।
এখানে আছেন প্রচুর ভবঘুরে গৃহহীন নরনারী, টুকাই বালক ও পথশিশু । আছে বেওয়ারিশ কুকুরের পাল। সর্বহারা জনতার
জীবনাচরণ দেখার জন্য এটি বেশ উপযুক্ত স্থান। এখানে রূপসি বেদে তরুণীরা নানা
ভেল্কিভাজি করে কাউকে ঠকানোর তালে সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। একদিন তিনজন মেয়ে
আমাকে ঘিরে ধরে, রহস্যময় কিছু কথাবার্তা বলে আমাকে সম্মোহন করার চেষ্টা করে। আমি
কোনদিন এসব কবিরাজি ও টুটকাবাজি বিশ্বাস করিনা। আমি পালাতে চাই, ওরা ঘিরে ধরে,
বাবু সাব সামান্য কবজ নিয়ে যা, সারারাত একটানা বিরামহীন করতে পারবি।
শক্ত লোহার মত খাড়া হবে। আমি বললাম, আমি বুড়ো মানুষ, এসবে আমার দরকার নেই।
আমার দিকে বাড়ানো একটা বেদে মেয়ের
হাতের তালুতে অলৌকিকভাবে আগুন জ্বেলে উঠে। সে বলতে থাকে বাবু তোমার
অনেক রোগ আছে, সব রোগ পুড়িয়ে দিলাম।
ওরা গরিব মানুষ, আমি তাই ওদের হাতে একশত
টাকার একটি নোট গুজে তাবিজ কবজ ফেলে দৌড়ে পালিয়ে এলাম। পিছনে কেবল ডাক শুনলাম,
নিয়ে যা বাবু, কাজে লাগবে। রাতে সস্তা পতিতা ও দিনে উদ্যানে ঘুমিয়ে থাকা এইসব
নারীদের জীবন আড়চোখে দেখে নিতাম। তাঁরা ইট দিয়ে চুলা তৈরি
করে কাগজ ও শুকনো পাতা পুড়িয়ে রান্না করত। পাশে তাঁদের বাচ্চা কাচ্চা ও কুকুরের দল
গোলাকারে বসে রান্না করা দেখত। রান্নার উপাদান বড়চাল এবং তাতে কিছু তরকারীর টুকরা।
মসলার তেমন নামগন্ধ নেই, একেবারে পাতলা পানি। আমি হয়ত এই
খাবার মুখে নিতে পারবনা। অথচ রান্না শেষ হলে নারী, শিশু পুরুষমানুষ
ও কুকুরেরা মিলে মিশে ভাগাভাগি করে মহানন্দে খেয়ে নিত। এসব দৃশ্য দেখে চোখে জল আসতো এবং এই নিঃস্ব জনতাদের জন্য আমি হৃদয়ে এক গভীর ব্যদনা ও টান
অনুভব করতাম।
পাশের নাট্যমঞ্চের সামনের মাঠে ও
উদ্যানে কুকুর ও টুকাই বালকরা একে অন্যকে জড়ায়ে এমন ভাবে
ঘুমাতো যেন তাঁরা শত জনমের বন্ধু। এসব দেখে বেশ মনঃকষ্ট হত।
মতিঝিলের স্কাইলাইন দেখা বেশ আনন্দের। প্রায়ই ছাদে গিয়ে মতিঝিলের দিগন্তরেখায় নয়নমেলে দিয়ে বিমুগ্ধ হতাম। ভবনের পর ভবন, উপরে চিলের ঝাঁক ভাসছে।
আমার চেম্বার ছিল পূবালী ব্যাংকের তের
তলায়। চেম্বারের পিছনে তিনফুট ওয়ালের উপর সারাটা গ্লাসে ঢাকা। এই গ্লাসের ওয়ালে
তাকিয়ে সুদূর দিগন্ত দেখা যায়। মতিঝিলের আকাশ জুড়ে সব সময় শত
শত ঈগল (চিল) দলবেঁধে ভেসে বেড়ায়। বহুতল ভবনমালার এসির আড়ালে আবডালে ওরা বাসা বাঁধে। আমার চেম্বারের পিছনেও এক ঈগল দম্পতি খড়কুটা
বিছায়ে বাসা বাঁধে। মাঝে মাঝে কান্নার মত করুন সুরে
ডেকে উঠলে আমরা টের পেতাম প্রতিবেশীরা আছেন জানালার ওপাশে।
আমি তাঁদের জীবনাচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি। স্বামী ও স্ত্রী ঈগলযোগল
পাশাপাশি উড়ে উড়ে পিছনের কার্নিশে এসে তাঁদের শুকনো খড়কুটোর বাসায় বসতো। অভিনয়ে তাঁরা যেন অবিকল হিন্দি ছবির নায়ক নায়িকা। তাঁরা মানুষের
মত সযতনে বাচ্চাদেরে মুখে খাবার তুলে দিত, উড়াল শেখাতো।
এই ঈগলেরা ছিল অনেক বড়। এক একটা ঈগল
তিনচারটা কাকের সমান, অথচ এরা নিচে নামার কিংবা উপরে ওঠার সময় কাকেরা খুব বিরক্ত করে। তাঁরা ছোবল দিলে কাকের মরণদশা ঘটিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু চিলেরা কাকের সাথে কখনও মারামারি করে না। তাঁরা কাকের ঠোকর খেয়ে খেয়ে দ্রুত
উপরে কিংবা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ফলে কাকেরা ক্লান্ত হয়ে একসময় পালাতো।
সন্ধ্যায় চিলেরা ঝাঁক বেঁধে
বেঁধে মতিঝিলের আকাশে চক্কর মেরে মেরে ফিরে যেত নিজ নিজ আশ্রয়ে। মতিঝিলে অফিসের
কাঁচের জানালা দিয়ে শেষবিকেলের এই ঈগলের ঝাঁকের আশ্রয়ে ফেরার শান্ত আবর্তন গতি
দেখে কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতা স্মরণ হত ‘সন্ধ্যা আসে, ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে
ফেলে চিল/ সবপাখি ঘরে ফিরে, সব নদী, ফুরায় এজীবনের সব লেনদেন।‘
মনে হত সব ফিরে যায় ঘরে, আর আমি
রাতে ফিরি আমার একাকি আস্তানা ধানমন্ডি লেকপারের বিজন আস্থানায়, উইন্ডসর ক্যাসেলে।
কোথায় সিলেটে আমার বাড়ি, স্ত্রী-পুত্র-সংসার, আর কোথায় ধানমন্ডির রাজপ্রসাদে এই
একাকি নির্জনবাস।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাজধানী
ঢাকায় আমার তিন বছর সমাপ্ত হয়। তাই মনে হত এই শীতই হবে মতিঝিলে আমার শেষ শীত।
ওয়ারীর বলদা গার্ডেনের পাশে
ফুফুতো ভাই আব্দুল্লাহ চৌধুরীর ফ্লাটে অতীতে কিছুদিন ছিলাম। তাই বলদা গার্ডেন নিয়ে
আমার বেশ কিছু স্মৃতি আছে। সুযোগ পেলেই শব্দ দূষণমুক্ত এই বাগানে বসে বসে অতীতে
অনেক সময় কাটাতাম। এক ঠান্ডা দিনে দুপুরের
খাবারের পর জিএসডিডি অফিস থেকে বের হই এবং একাকি হেঁটে হেঁটে বলদা গার্ডেন দেখতে
যাই। সেদিন রাষ্ট্রপতি ভবন পার হয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের
পুজারীদের ভিড় ঠেলে বলদা গার্ডেনে হাজির হই।
বলদা গার্ডেনের সেই ফ্ল্যাট
বিক্রি করে আব্দুল্লাহ ভাই সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান অনেক আগে। সেই বাসার
একদিকে বলদা গার্ডেন আগের মতই আছে কিন্তু অন্যপাশে রাজপথের উপর নির্মিত হয়েছে
প্রশস্থ ও সুদীর্ঘ মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। অর্থাৎ সামনের ব্যস্ত মহাসড়কটি এখন
দ্বিতল সড়ক হয়ে গেছে।
বিশ টাকার টিকেট কেটে বলদা
গার্ডেনে ঢুকে আবর্তন করি। অপরূপ ও অভিনব পুকুরঘাটে
নেমে বাগিচায় নীরবে হেঁটে যাই।
সামনের জলে ভাসা আমাজান লিলি, পারে পারে নাম না জানা কুসুমরাজি। শশব্যস্ত পুরান
ঢাকার নিসর্গ এই বাগানে ঘুরে মন বেশ প্রশান্ত হয়।
পশ্চিমাদেশের পার্কের মত এখানেও কিছু
কপোতকপোতী বলদা গার্ডেনের আনাচে কানাচে নগ্ন ভালবাসায় মজে আছেন। অরণ্যের আড়ালে
আবডালে এসব হচ্ছেটা কি। তাহলে যুগের তালে বাংলাদেশেও কি বদলে
যাচ্ছে? এখানেও কি পশ্চিমের প্রকাশ্য নগ্নতা এসে নিঃশ্বাস ফেলছে। বয়স হয়েছে, তাই
এসব লীলাখেলা না দেখার ভান করে এগিয়ে যাই।
এত বছর পর স্মৃতিময় বলদা গার্ডেনের
সাথে আবার দেখা হল। স্মৃতি আমাকে এভাবেই পুরাতন জায়গায় বারংবার টেনে নিয়ে যায়।
ঢাকা আসার তিন বছর পার হয়ে গেছে। এত দিন আসি আসি করেও এই বাগানে আসা হয়নি।
অথচ আজ এই বলদা গার্ডেন সফরের
সাথে সাথেই আমার ঢাকা ছাড়ায় বিদায় সানাই বেজে উঠে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন