সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সিলেট-ঢাকা ম্যারাথন দৌড়ের তিন বছর

 

সিলেট-ঢাকা ম্যারাথন দৌড়ের তিন বছর

আমি ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ এই তিন বছর রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করি। ২০১৯ ভাল কাটলেও ২০২০ এবং ২০২১ করোনা মহামারীর ভয়ে ও আতংকে কাটে। মহামারী প্রতিরোধে সরকার প্রায়ই ঢাকা ও সারাদেশে লকঢাউন হত। লকঢাউনে রাস্থাঘাট, বাজার, লোকালয় সবকিছু অচল হয়ে যেত। লকঢাউনের গন্ধ পেলেই আমরা দ্রুতবেগে ঢাকা ছাড়তাম।

লকঢাউনে এমন কি রাস্থাঘাটেও তেমন লোকজন দেখা যেতনা। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত্রি হয়। করোনার আতংকে সারাদেশে এক পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। ঢাকায় আটকা পড়ে গেলে হোটেল, দোকান, রিকশা, যানবাহন ইত্যাদি বন্ধ থাকায় বাসায় না খেয়ে অকালে প্রাণ হারাতে হবে। সিলেটে না হয় চিকিৎসক সহধর্মিনী আছেন। আমার নিজ মালিকানাধীন নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা ইউনিট আছে। অথচ ঢাকায় করোনা হয়ে গেলে কাউকেই পাওয়া যাবেনা। তাই পড়ি মরি দে দৌড়।  

লকঢাউনের সুযোগে কভিদ-১৯ এর দুইবছর বারবার সিলেটে এসে প্রায়ই ছুটির মত দীর্ঘদিন নিজগৃহে থাকার সুযোগ পেয়ে যাই। এটা আসলে আমার জন্য ঈশ্বরের এক ধরনের আশির্বাদই বলা যায়।

প্রথম প্রথম আমি গ্রিনলাইন ও লন্ডন এক্সপ্রেসের এসি বাসে ঢাকায় যাতায়াত করি। কিন্তু এসি বাসে চড়ার সময় আমার ভীষণ ব্যমোর অস্বস্তি দেখা দিত। হাতের কাছে ব্যাগ রাখতাম যদি ব্যমো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে একটু আধটু ব্যমো হয়ে যেত। উজানভাটি রেস্টহাউসে এসে বাস হতে নেমে খানিক হাঁটার পর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেতাম।

এবার ইউনিকের ননএসি বাসে যাতায়াত শুরু করি। সিলেটের হুমাউন রশিদ চত্বর এবং কমলাপুর টিটিপাড়া হতে প্রতি ঘণ্টায় ঘন্টায় ইউনিকের বাস ছাড়ে। কোনমতে তাঁদের টার্মিনালে উপস্থিত হলেই একটি গাড়ি ছাড়ার জন্য প্রস্তুত পাওয়া যেত।

কেউ কেউ আমাকে ট্রেনে যেতে পরামর্শ দেন। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান। এখানে কালোবাজারি কিংবা ঘুষ ছাড়া টিকেট পাওয়া যায়না। আমাদের পূবালী ব্যাংক কমলাপুর রেলস্টেশন শাখায় যোগাযোগ করে দেখি অতিরিক্ত পেমেন্ট ছাড়া তারাও টিকিট সংগ্রহে অপারগ।

কোন একদিন আচমকা লকঢাউন ঘোষণা করা হয়। কোনভাবেই বাস টিকেট না পেয়ে ট্রেন ধরতে কমলাপুর রেলস্টেশনে ছুটে যাই। টিকেট পেতে লম্বা লাইনে দাড়াই। আধা ঘন্টা পর টিকেট পাবার খুব কিনারে এসে গেছি। এমন সময় জানানো হয় আর কোন টিকেট নাই। সিলেট যাবার অন্যকোন পথ নেই, তাই সিন্ধান্ত নেই স্টেন্ডিং টিকেটে সাড়া পথ দাঁড়িয়ে যেতে হলেও ট্রেনে সিলেটে যাব। টার্মিনালে পারাবত এক্সপ্রেস ছেড়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ট্রেনের একজন টিটিকে বললাম আমি টিকেট পাইনি, অথচ সিলেটে যেতেই হবে। তিনি আমাকে টিটি কক্ষের একটি বড় স্যুটকেসের উপর বসায়ে বললেন বসেন, আপনাকে একটা ব্যবস্থা করে দেব। আমি ধরে নেই এই স্যুটকেসে বসেই হয়ত সিলেট যেতে হবে। মনে মনে বলি স্রষ্টাকে শোকরিয়া, যাক, কোনমতে বসার একটা ব্যবস্থা হয়েছে, দাঁড়িয়ে তো যেতে হবেনা। গাড়ি ছাড়ার মূহূর্তে টিটি সাহেব আমাকে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথমশ্রেণির বগিতে নিয়ে সিটে বসান। তিনি ৩৫০/- টাকা নেন। আমি টিকেট চাইলে টি টি বললেন, টিকেট কিনলে দ্বিগুণ লাগবে, তারচেয়ে এভাবেই যান, সিলেট রেলস্টেশনে আপনাকে পার করে দেব। বেশ বয়স হয়েছে, তাই সেদিন মান সম্মানের ভয় বুকে নিয়ে সিলেটে আসি।

রেলের এত্তসব দুর্নীতি দেখে এই তিন বছরে আর কোনদিন ট্রেনে চড়ে সিলেট যাইনি।

ঢাকা সিলেট আসা যাওয়া ভীষণ কষ্টকর, সেইসাথে সাত আট ঘন্টা সময় নষ্ট। এক কথায় রাস্থায় দিন শেষ।  তাই ২০২০ সালে ঠিক করি, আর গাড়ি নয়, এখন থেকে বিমানে আসা যাওয়া করব। বিকাশে সহজে টিকেট কাটা যায়। বাংলাদেশ বিমান, নভোএয়ার এবং ইউ এস বাংলার অনেকগুলো ফ্লাইট প্রতিদিন পরিচালিত হয়। মতিঝিল হতে দুইঘন্টা আগে উবার মোটর সাইকেলে রওয়ানা হলে ঢাকাবিমান বন্দরে ফ্লাইট ধরতে কোন সমস্যা হয়না। সিলেট থেকে আসার সময় শাহজালাল বিমানবন্দর হতে পাঁচসাত মিনিট হেঁটে ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে আসামাত্রই কমলাপুরগামী ট্রেন পাওয়া যায়। ২০/- টাকার টিকেট প্লেটফর্মে কিংবা ট্রেনে উঠে কাটা যায়, খালি সিটও মেলে। মহাসড়কের মত জামে পড়ার ভয় নেই। তাই ঘন্টাখানিকের মধ্যেই কমলাপুর রেলস্টেশনে পা রাখা যায়।

আমি চৌয়ান্ন বছর বয়সে ঢাকায় বদলি হই। যেদিন আদেশ পাই, মনে হল মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। মনের ইচ্ছের বিরূদ্ধে ঢাকায় যাই কিন্তু কিন্তু ঢাকা গিয়ে লাভই হয়, রাজধানীর অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমাকে সমৃদ্ধ করে। পরিবার সাথে নিতে পারিনি, তাই বিষন্নতায় ভোগী। এত বেশি বয়সে বারবার সিলেট-ঢাকা দৌড়া দৌড়ি আমাকে বেশ কষ্ট দেয়, সেই সাথে দেয় বেশ অর্থদন্ডও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন