নতুন কর্মক্ষেত্র
পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, প্রিন্সিপাল অফিস, সিলেটঃ
৫ জানিয়ারি ২০২২ সাল। গ্রিনলাইন বাস
ঢাকা হতে দীর্ঘযাত্রায় তাজপুর-গোয়ালাবাজার আসতেই নুরজাহান বেগমকে মোবাইলে জানিয়ে
দেই, আমি হাজির, ত্রিশ মিনিটের মধ্যে চন্ডিপুলে এসে যাব। বিকেল ৩টায় গাড়ি সিলেট
আসে। চন্ডিপুলে বাস থামে, বাসের মালখানা হতে চারটি ব্যাগ নামিয়ে পাশাপাশি জড় করি।
টেক্সিচালকরা এসে নিয়ে যেতে ডাকাডাকি শুরু করে।
বেশ কিছুক্ষণ পর বাসার লালকারের
মুখ দেখা গেল। জেফার গাড়িটি থামালে ব্যাগগুলো বেনেটে ভরে নেই। এই গাড়ি আমি নিজে
চালাতে সাচ্ছন্দবোধ করি। তাই ছেলেকে পিছন সিটে পাঠিয়ে আমি ও
বেগম সাহেবা সামনে বসি। বাসায় এসে গোসল করে নামাজ পড়ি।
স্বল্পভাষী বুদ্ধিমতি ফাতু বেগম
সুনামগঞ্জের বীরগাঁওয়ের মেয়ে, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সে এখানে রান্নাবান্না করে।
স্বল্পভাষী বাবুর্চি ফাতু বেগম ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজায়। খেয়েদেয়ে লম্বা একটি ঘুম দেই।
এবার ঘরে এসে ওহুম শান্তি। ঢাকা
ফেরার তাড়া নেই, তাই বেশ প্রশান্তি প্রশান্তি লাগে।
বেগমকে বললাম, কেমন লাগছে?
লাগবে আবার কেমন? ছয় বছর ধরে একহাতে
সব সামাল দিচ্ছি, এবার বাঁচা গেল।
ঢাকায় রাত পোহালেই নামাজ পড়ে ব্যায়াম করি ও ত্রিশ মিনিট নিয়মমাফিক হাঁটি, তারপর অফিসের গাড়ির অপেক্ষা। সময় পেলে দ্রুত গোসল সেরে নিতাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে গিয়ে
সচিবালয়ের পাশ দিয়ে মতিঝিলে পৌঁছাতে একঘন্টা শেষ হত। মতিঝিলে পৌঁছে সকালের চানাস্তা সেরে নিতাম।
সিলেটে বদলি হয়ে আসি প্রিন্সিপাল
অফিসে। এই অফিস সিলেট বিভাগের প্রধান কার্যালয়। সিলেট বিভাগের চারটি জেলা এই
অফিসের আওতায়। তিনটি আঞ্চলিক অফিস, সিলেট পূর্ব, সিলেট পশ্চিম (সংযুক্ত সুনামগঞ্জ)
এবং মৌলভিবাজার (সংযুক্ত হবিগঞ্জ) এই অফিসের অধীনে কাজ করে। তাই এই অফিসকে পূবালী
ব্যাংকের সিলেট বিভাগের রাজঅফিসই বলা যায়।
সকাল ১০টায় অফিস, গাড়ি চালিয়ে
সাগরদিঘিপার সিলেটের বাসা হতে তেলিহাওর প্রিন্সিপাল
অফিসে আসতে সময় লাগে বড়জুর দশ মিনিট।
সিলেটে আসায় একটি বড় লাভ হল, প্রতিদিন ঢাকার রাস্থায় অপচয় হওয়া তিনচার ঘন্টা সময়
বেঁচে গেল। ভাবলাম এই সময়টা সুকর্মে কিংবা সৃজনশীলতায় লাগাব।
একটানা ছয় বছর সিলেটের বাহিরে
থাকায় আমার কারের অবস্থা ভাল নয়। নতুন চালক জেফারের চালনায় গাড়ির ডেইন্ট পেইন্টের
বেহাল অবস্থা। কিন্তু গাড়ির এসি ভাল, ইঞ্জিন ভাল। ১৩০০ সিসি ছোট কারটিকে আমি
রিকশার মত দিবানিশি ব্যবহার করি। স্মল ইজ বিউটি। এই ছোট কারের আমি
নিজেই চালক, সিলেটের ছোট ছোট রাস্থায় ছোট্ট গাড়িটি ইচ্ছেমত ঘুরানো ফেরানো যায়। ডেইন্ট পেইন্ট করে নেই যাতে এই গাড়িতে চড়ে চাকুরী জীবনের বাকি সময়টুকু পার করা যায়।
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ গাড়ি স্টার্ট
দিয়ে মাত্র সাত মিনিটে সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসে এসে গেলাম। সাতবছর আগে ২০১৫ সালের
জানুয়ারিতে বেশ মনঃক্ষুন্ন হয়ে এই ভবন ছেড়ে জন্মভূমির চৌধুরীবাজার শাখায় যাই।
সিলেটের বাহিরে এত বছরের নানা চরাই উৎরাই পেরিয়ে আবার এলাম আমার সাবেক অফিস ভবনে।
এই ভবনের জায়গায় ছিল সিলেটের
একজন নামকরা স্ত্রীরোগ চিকিৎসক হাসি রানির মালিকানাধীন বাসা। খ্রিস্টান
ধর্মানুসারী হাসি রানির হাতে অনেক নবজাতকের জন্ম হলেও তিনি ছিলেন নিঃসন্থান। শেষ বয়সে
হাসি রানি অস্ট্রেলিয়া চলে গেলে তাঁর নিকটাত্মীয়রা এই বাড়িতে বসবাস করতেন। সিলেটের
আওয়ামী লীগ নেতা ইফতেখার হোসেন শামিম ওরফে চাক্কা শামিম এই বাড়ির বাসিন্দাদেরকে
জুরপূর্বক তাড়িয়ে দিয়ে গড়ে তুলেন আটাশ তলা তিনটি সংযুক্ত টাওয়ার। সম্পদ হারানোর
শোক সইতে না পেরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান এই খ্রিস্টান বাড়ির বৃদ্ধ পুরুষ বাসিন্দা।
পূবালী ব্যাংকের ঋণের টাকায়
নির্মিত হয় এই দৈত্যাকার ভবনমালা। সুচতুর চাক্কা শামিম ঢাকা হতে সিলেট ফেরার পথে
এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর অকালমৃত্যুতে এই ভবনে ফ্ল্যাট বিক্রি মন্থর হয়ে
যায়। ব্যাংকের বড় অংকের টাকা আটকা পড়ে। এই ঋণের টাকা উদ্ধারের কৌশল হিসাবে কিছু
অংকের ঋণের বিনিময়ে পূবালী ব্যাংক এই ভবনের দশ হাজার বর্গফুট জায়গা কিনে নেয় এবং
ফাঁদে পড়ে কেনা এই জায়গায় গড়ে উঠে পূবালী ব্যাংকের সিলেট শাখাসহ তিনটি প্রধান
কার্যালয়। আখেরে এই অফিস স্পেস কিনে ব্যাংক বেশ লাভবান হয়। ব্যাংকের মালিকানাধীন বন্দরবাজারের
পাঁচতলা সাবেক নিজস্ব ভবনে একটি নতুন শাখা, গোদাম, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাঠাগার ও
রেস্ট হাউস স্থাপন করা হয়।
কাজিরবাজার মাদ্রাসার সামনের এই
সেই অফিসভবন, যেখানে ২০১৪ সালে কর্মরত থাকাকালে আমি সিলেট শাখা, সিলেট পুর্ব ও
সিলেট পশ্চিম আঞ্চলিক অফিসদ্বয় এবং সিলেট প্রিন্সিপাল অফিস চালু হতে দেখি। আঞ্চলিক
অফিস সিলেট ইস্ট হতে ভগ্নহৃদয়ে বিদায় নিয়েছিলাম ২০১৫ সালে, ফিরে এলাম একই ভবনের
অন্য জায়গায়, প্রিন্সিপাল অফিস সিলেটে ২০২২ সালে। রাজধানী ঢাকার রিজিক শেষ, তাই
আবার শিকড়ে ফেরা।
উপমহাব্যবস্থাপক মশিউর রহমান খান,
এজিএম আব্দুল মুমিত চৌধুরী এবং এসপিও আব্দুন নুর ছাড়া ২০১৪ সালের নেতৃস্থানীয়
কাউকে পেলাম না। এই সাত বছরে তাঁরা হয়তো অবসরে গেছেন, নয়তো বিভিন্ন জেলায় বদলি হয়েছেন।
নতুনরা অপরিচিত, পুরাতনরা বয়সের ভারে জর্জরিত মুরব্বী আমলা। আদ্যিকালের যে
দুইচারজনের দেখা পাই, তাঁদের চাকুরীও শেষপ্রান্তে। অবসরে গেলে তাঁরা কি পাবেন, না
পাবেন, তাই গুণাগুণি করছেন।
মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসে আমার
প্রিয় সহকর্মী ছিলেন এডভোকেট মোঃ আবু তাহের। তাকে এখানে পেয়ে বেশ খুশি হই। দু’বছর
আগে মোঃ আবু তাহের সিলেট আসেন ও পদোন্নতি পেয়ে সহকারী
মহাব্যবস্থাপক হন। ইতিমধ্যে তিনি অনলাইনে আমেরিকা হতে ডক্টরেট ডিগ্রি সংগ্রহ
করেছেন। ব্যাংকার্স ক্লাব সিলেটের নেতা হয়েছেন। তিনি দুইদিন সিলেটের হোটেলে ঘুমান
এবং তিনদিন কার নিয়ে মৌলভীবাজার হতে আসা যাওয়া করেন। তাঁকে সিলেটে বেশ খুশ মেজাজে
দেখতে পাই।
সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসে এসে
দীর্ঘ কয়েক বছর পর চেম্বারবিহীন একটি চেয়ারে বসি। একজন বয়স্ক সহকারী মহাব্যবস্থাপক
চেম্বারবিহীন আসনে বসা মানায় না। নতুন এজিএম চেম্বার করার মত স্থানও এখানে নেই।
বেশ অপ্রস্তুত ভাব নিয়ে বাহিরের খোলা আসনে বসে অফিসের কাজকর্ম করে যাই।
জিএসডিডি অফিসে আমার সাবেক
সহকর্মী সহকারী মহাব্যবস্থাপক সালমা শাফি ফোন করে একদিন বললেন, কেমন আছেন। বললাম,
ভাল আছি, তবে এখানে বসার মত কোন চেম্বার নেই। তিনি সবিষ্ময়ে বললেন, কোন এজিএম
চেম্বার নেই? বললাম, আছে মাত্র একটি, সেই চেম্বারে সদ্য পদোন্নতি পাওয়া এজিএম এডভোকেট
মোঃ আবু তাহের বসেন। সালমা আপা স্বাগতুক্তি করলেন, উনার চাকুরী আর বেশিদিন নেই।
উনাকে সিলেটে রেখে শেষবেলা কেন কষ্ট দেওয়া হচ্ছে।
বললাম, হ্যাঁ তিনি পরিবার পরিজন
মৌলভীবাজারে রেখে বুড়ো বয়সে একা একা সিলেটে আছেন। তাঁকে চাকুরী জীবনের বিদায়বেলা একটু আরাম দেওয়া উচিত হবে। এবার সালমা সাফি বললেন, তিনি একজন
ভাল মানুষ, তাঁকে আমরা তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজার পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
কিছুদিনের মধ্যেই সহকারী
মহাব্যবস্থাপক আবু তাহেরের মৌলভীবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ে বদলির আদেশ আসে। সালমা
শাফির আপন দুলাভাই জাহিদ আহসান পূবালী ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি এবং ডি এম ডি।
খুবসম্ভব তাঁর সৌজন্যে মোহাম্মদ আবু তাহের বিনা পরিশ্রমে ও বিনা চেষ্টায় নিজ শহর
মৌলভীবাজার ফিরে যাবার সুযোগ পেয়ে যান।
আবু তাহেরের পত্নী অসুস্থ্য হয়ে
ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁকে দুইবার হাসপাতালে স্বস্ত্রীক দেখতে যাই।
তাঁর প্রচুর চিকিৎসা বিল আসে। আমি তখন তাঁকে পঞ্চাশ হাজার টাকা কর্জ প্রদান করি।
১৭ মার্চ ২০২২ সাল। সন্ধ্যায়
সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসে ডঃ মোঃ আবু তাহেরের বিদায়ী অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে
কেবল সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসের চাকুরেগণ অংশগ্রহণ করে। সভাপতিত্ব করেন
মহাব্যবস্থাপক আবু লাইছ মো. শামসুজ্জামান। আমি সুদীর্ঘ বক্তৃতায় আবু তাহেরের সহিত
মৌলভীবাজার আঞ্চলিক অফিসের তিন বছরের স্মৃতিচারণ করি। মোঃ আবু তাহের একটি আকর্ষণীয়
জীবনবৃত্তান্ত আমি তুলে ধরি। একে একে সবাই স্মৃতিচারণ করেন। তাঁকে তাঁর ছবি
সম্বলিত একটি স্মৃতিস্মারক ও একটি মোবাইল সেট উপহার দেওয়া হয়। সিলেট পশ্চিমাঞ্চল
প্রধান সাইফুল ইসলাম একটি হাদিস গ্রন্থ এবং কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষে একটি
পুস্পস্থবক প্রদান করা হয়।
এই অফিসে আমার বস আবু লাইছ মো.
শামসুজ্জামান মহাব্যবস্থাপক। এইমাত্র কিছুদিন আগে তিনি এই অফিসে যোগদান করেছেন। বদনে লাগদাড়ি আবু
লাইস মোঃ এস জামান উত্তরবঙ্গের জাতক, বাড়ি কুড়িগ্রাম। রংপুরের অঞ্চল
প্রধান হতে পদোন্নতি পেয়ে সোজা চলে আসেন সুদূর সিলেটে। দেখতে খানিকটা ছোটখাটো,
অসাধারণ মেধাবী, সেইসাথে বুদ্ধিমান। তিনি নটরডেম কলেজের ছাত্র এবং ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় হতে গণিতে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি পেয়ে ২০০১ সালে পূবালী ব্যাংকের
সিনিয়র অফিসার পদে যোগ দেন। ধারাবাহিক প্রতিটি পদোন্নতি পেয়ে এক যাত্রায়
হয়ে যান ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক। তাঁর মুখে সব সময় হাসি লেগে
থাকে। তিনি নামাজি ও ধার্মিক।
আবু লাইছ মো. শামসুজ্জামান স্যার
খুব মিশুক ও বন্ধুবৎসল মানুষ। তিনি খুব সহজেই আমাকে আপন করে নেন। ভাবলাম সুদুর
রংপুর হতে অচেনা জায়গায় অপরিচিত লোকজনের মাঝে এসেছেন, তাই একাকিত্ব সরাতে একটু সংগ
দেয়া দরকার। তাই তাঁকে নিয়ে আমি সিলেটের কিছু সুন্দর জায়গা যেমন বিমানবন্দর,
টিলাগড় ইকোপার্ক, চা-বাগান ইত্যাদি ঘুরে বেড়াই।
আমরা দুই পরিবার চাইনিজে মিলিত
হই। দুই পরিবার মিলে মিশে একাকার হয়ে যাই।
এই ভবনে এসেই আমি
উপমহাব্যবস্থাপক মশিউর রহমান খানের চেম্বারে যাই। তিনি সম্পর্কে ভাগনা। সেখানে
বসামাত্র চা ও ভাল অলিম্পিক বিস্কুট চলে আসে। ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। আমি মশিউর রহমান
খানের চেম্বারে বসে খুশগল্প করছি। এমন সময় হাজির হন সিলেট ইস্টের ডিজিএম চৌধুরী
শফিউল হাসান। আমরা আলাপরত থাকাকালে ফোন আসে পূবালী ব্যাংকের সাবেক সহকারী
মহাব্যবস্থাপক গিয়াসউদ্দিন নাফেরার দেশে চলে গেছেন। গিয়াস স্যারের সাথে আমার অনেক
স্মৃতি আছে। তিনি কুশিয়ারাপারের চন্দরপুর শাখার ব্যবস্থাপক থাকাকালে ছুটি নিয়ে
লন্ডনে যান। প্রায় তিনমাস আমি তাঁর পরিবর্তে শাখাটির ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন
করি। সিলেট শাখায়ও তাঁর সাথে কাজ করি বহুবার। তিনি শিবগঞ্জের সোনারপাড়ায় বাসা
কিনেন এবং তিনি আবু সফিক, মামুন বখতসহ পূবালী ব্যাংকের অনেককে এই পাড়ায় জায়গা কিনে দেন।
আমরা তিনজন ব্যাংকের একটি গাড়ি
নিয়ে ছূটে যাই বিয়ানীবাজারের প্রত্যন্ত পল্লী দেউলগ্রাম। বসন্তে গ্রামবাংলা বেশ
উপভোগ্য। আমরা সবুজের বুক চিরে কুশিয়ারা পার হয়ে দেউলগ্রাম মাদ্রাসা মাঠে নামাজে
জানাজায় অংশ নেই।
গিয়াসউদ্দিন স্যারের সাথে দেখা হয়নি বহুবছর। গালে সুন্দর দাড়ি, শান্তসৌম চেহারায় তাঁকে
শায়িত দেখি শবাধারে। তাঁর স্বজনেরা বাড়ি নিয়ে যেতে চান কিন্তু আমরা ব্যস্ত থাকায়
তাঁর বাড়িতে না গিয়ে চন্দরপুর কুশিয়ারা ব্রিজ দিয়ে সিলেটে ফিরে আসি।
মশিউর রহমান খানের সাথে এই অফিসে
২৬ মে পর্যন্ত চারমাস একসাথে কাজ করি। তাঁর চেম্বারে বসে অনেকবার চানাস্তা করি। বৃদ্ধ
মাতা খুজেস্তা খানম চৌধুরী হেনার অসুস্থতার কারণে তিনি একটানা নয় বছর এই অফিসে
ছিলেন। আমি এই অফিসে যোগদানের কিছুদিন আগে তাঁর মাতা ইন্তেকাল করেন। তাঁকে দরগার
মহিলা ইবাদাতখানার পিছনে দাফন করা হয়। আমি তাঁর বংশীয় ভাই হিসাবে কবর জেয়ারতে শরিক
হই।
মশিউর রহমান খান বদলির আশংকায়
ছিলেন এবং বাহিরে যাবার জন্য মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন। ঢাকায় বদলি হবার সম্ভাবনা
থাকায় ঢাকা নিয়ে আমার সাথে প্রায়ই আলাপ করতেন। আচমকা একদিন তিনি নিরীক্ষা বিভাগ,
প্রধান কার্যালয়, ঢাকায় বদলির আদেশ পান।
২৬ মে ২০২২ সাল। আমরা এক
সাদামাটা সভায় মশিউর রহমান খানকে বিদায় সম্বর্ধণা দেই। সম্পূর্ণ
ঘরোয়া পরিবেশে প্রিন্সিপাল অফিসে এই অনুষ্ঠান হয়। অফিসের
লোকজন সবাই মিলে তাঁকে নিয়ে ফটোসেশন করি এবং স্মৃতিচারণের মাধ্যমে বিদায় জানাই। মহাব্যবস্থাপক আবুলাইছ মো.
শামসুজ্জামান প্রিন্সিপাল অফিসের সবার পক্ষ হতে একটি স্মৃতিস্মারক ও
মোবাইল সেট মশিউর রহমান খানের হাতে তুলে দেন।
সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার প্রবীর
কুমার দাম সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসের ঋণ বিভাগের হর্তাকর্তা। এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাশ করার ক্ষমতা প্রত্যেক ডিজিএম অঞ্চল
প্রধানের রয়েছে। এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ হতে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত সিলেট বিভাগের সবগুলো ঋণ পাশ করার ক্ষমতা সিলেট
প্রিন্সিপাল অফিসের মহাব্যবস্থাপকের উপর ন্যস্ত। তিনটি অঞ্চলিক অফিস হতে পাঠানো এই
সীমারেখার ঋণ সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসের ক্রেডিট কমিটিতে অনুমোদন দেয়া হয়। তিন কোটি টাকা সীমার উপরে ঋণগুলো আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অনুমোদনের জন্য
প্রধান কার্যালয় ঢাকায় পাঠাই। সিলেট বিভাগে হওয়া লেটার অফ ক্রেডিটগুলোর অনুমোদন
আমরা দিয়ে থাকি। এসব জটিল এবং ঝুঁকিবহুল কাজের দায়িত্ব পালন করেন প্রবীর কুমার দাম।
তাঁর গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার গোলগাঁও গ্রামে। শাহজালাল
বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে শিক্ষানবিস অফিসার হিসাবে ২০০৫ সালে
যোগদেন পূবালী ব্যাংকে। যথেষ্ট বুদ্ধি এবং ধীশক্তির অধিকারী তিনি। ধর্ম, সমাজ,
রাষ্ট্র, দর্শন এবং শেয়ারবাজার নিয়ে তাঁর সাথে প্রায়ই আমার মুক্তালাপ হত। ২রা ফেব্রুয়ারি
২০২৩ বিকেলে জি এম চেম্বারে ডাক আসে। রানেশ কান্তি আমাকে চেম্বারে নিয়ে গেলে দেখি
সেখানে প্রবীর বাবুর বিদায় সভার আয়োজন হচ্ছে। কিছু প্রাইজবন্ড উপহার দিয়ে আমরা
তাঁকে আঞ্চলিক অফিস সিলেট ইস্টে বিদায় জানাই।
সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার
মোহাম্মদ খায়রুল আলমের বাড়ি জকিগঞ্জ উপজেলার বলরামেরচক গ্রামে।
তিনি এম সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স করেন। স্কলার্সহোম স্কুল
এন্ড কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ২০১২ সালে পূবালী ব্যাংকে
শিক্ষানবিস সিনিয়র অফিসার হিসাবে যোগদান করেন। আমি শাহি ইদগাহ শাখার
ব্যবস্থাপক থাকাকালে প্রায়ই তিনি স্কলার্সহোম স্কুলের নানা কাজে ব্যাংকে আসতেন।
সেই থেকে পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা। আমি প্রিন্সিপাল অফিসে যোগদানের কিছুদিন পর তিনি
মহিলা কলেজ শাখার ব্যবস্থাপক হতে বদলি হয়ে এখানে আসেন। তিনি বুদ্ধিমান এবং যথেষ্ট
কমিউনিকেশন ও নেগেশিয়েসন ক্ষমতার অধিকারী। কিছুদিন পর তাকে শাহজালাল উপশহর শাখার ব্যবস্থাপক করা হয়। শেষমেষ তিনি সপরিবারে কানাডা চলে যান।
জুমারা জাহান চৌধুরী পি ও (আইন)
আঞ্চলিক অফিস সিলেট পূর্বাঞ্চলে ২০১৪ সালে আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি ব্রাক
বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিষয়ে মাস্টার্স করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি বিশ্বনাথ উপজেলার
দশঘর গ্রামে। তাঁর মাতা কুলাউড়ার হাজিপুর চৌধুরী পরিবারের কন্যা, যিনি সিলেট সিটি
কর্পোরেশনের মহিলা কমিশনার ছিলেন। জুমেরা জাহান ২০১২ সালে সিনিয়র অফিসার (আইন) পদে
পূবালী ব্যাংকে যোগ দেন। জুমারা মাবাবার একমাত্র সন্তান। প্রথম বিয়ে হয় পূবালী
ব্যাংকের একজন জুনিয়র কর্মকর্তার সাথে, কুলাউড়ার টিলাগাওয়ে,
কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। তারপর আবার বিয়ে হয় কানাইঘাটে। এই বিয়ের পর
২০২২ সালে তিনি দুইটি জোড় পুত্রের মা হন। এক পুত্র জন্মের পর মারা যায়। আমরা একটি
সেন্টারে গিয়ে তাঁর দ্বিতীয় নবজাতকের আকিকায় যোগ দেই। জুমেরা খুব স্টেইট ফরওয়ার্ড
মহিলা। স্বার্থ আদায়ের জন্য কিংবা ক্ষতি হবার ভয়ে জুমেরা জাহান কাউকে তুষামুদি
কিংবা পরওয়া করার মত লোক নন।
প্রিন্সিপাল অফিসার গৌতম রায় এই
অফিসে আসেন ১০ জানুয়ারি ২০২৩। তিনি এই অফিসের ঋণ বিভাগে অতীতে কাজ করেছেন কয়েক
বছর। আগের দায়িত্ব আবার তাঁর উপর অর্পিত হয়। তিনি প্রবির কুমার দামের স্থলাবিষিক্ত
হন।
রানেশ কান্ত দাস এস ও (ক্যাশ) এই
অফিসের একজন নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তা। তাঁর পিতার নাম রামানন্দ দাস। রানেশের বাড়ি
নয়াখেল, সারিঘাট, জৈন্তাপুর, সিলেট। তিনি সারিঘাট উচ্চবিদ্যালয় হতে এস এস সি,
জৈন্তিয়া কলেজ থেকে এইচ এস সি এবং এম সি কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে
অনার্সসহ মাস্টার্স পাশ করেন। তিনি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের
শিক্ষকতা চাকুরি ইস্তোফা দিয়ে ১৯ জুন ২০১১ তারিখে পূবালী ব্যাংকে
যোগদান করেন। সিলেট প্রিন্সিপাল অফিস নানাভাবে এই সুদক্ষ অফিসারের উপর নির্ভরশীল। আমার প্রতি রানেশ কান্ত দাসের মমতা
অপরিসীম। আমার উন্নতি নিয়েও তাঁর ভাবনা সীমাহীন।
মোঃ শিহাব উদ্দিন এস ও (সিভিল)
তিনি বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সিভিল টেকনোলজি। সিলেট বিভাগের সিবিল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর
পিতার নাম মোঃ নজিব আলী। গ্রামের নাম মাঝবন, জকিগঞ্জ। তিনি ৭ নভেম্বর ২০১০ সালে
পূবালী ব্যাংকে যোগদান করেন। ২০১৪ সাল থেকে সিলেট প্রিন্সিপাল অফিসে আছেন।
ওয়াফা খানম চৌধুরী (সিভিল
ইঞ্জিনিয়ার)। সে আমার পত্নী নুরজাহান বেগম চৌধুরীর মামাতো ভাই রনকেলি গ্রামের
আরবাব হোসেন চৌধুরীর কন্যা। গ্রামের বাড়ি গোলাপগঞ্জের রনকেলি হলেও তাঁর প্রকৌশলী
পিতা আরবাব চৌধুরী মদীনায় কর্মরত থাকাকালে সেখানে তাঁর জন্ম হয়। ওয়াফার স্বামী পূবালী
ব্যাংক কর্মকর্তা তাহমিদ চৌধুরী আমার ফুফুতো ভাতিজি সেফুর পুত্র।
সৈয়দ নাজমুল আরেফিন এস ও (ক্যাশ)
গোলাপগঞ্জ উপজেলার পূর্বভাদেশ্বর গ্রামের সৈয়দবাড়ির জাতক। তিনি লিডিং
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্সে বি এস সি অনার্স করে ১১/১০/২০১১ সালে জুনিয়র
অফিসার (কম্পিউটার) পদে যোগদান করেন। জালালাবাদ সেনানিবাসের সামনে ওয়ালী সিটিতে
তাঁর বাসা।
শামসুদ তিব্রিজ এস ও
(ইলেক্ট্রিক) স্বল্পভাষী, তিনি বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বিদ্যুৎ প্রকৌশলী
হিসাবে ব্যাংকে যোগ দেন।
মোঃ হাফিজুর রহমানের অফিসার
(ক্যাশ) বাড়ি জকিগঞ্জের নিয়াগোল গ্রামে। ডাক মুলিপাড়া। তিনি সিলেট এইডেড স্কুল হতে
এস এস সি এবং মদন মোহন কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্সসহ মাস্টার্স করেন। তিনি
লিডিং বিশ্ববিদ্যালয় হতে ব্যাংকিং এন্ড ফিনান্সে এম বি এ করেন। ২০১৩ সালে জুনিয়র
অফিসার হিসাবে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করেন। সব ধরনের ব্যাংকিং কাজে তাঁর বেশ
দক্ষতা রয়েছে।
আমার পত্নীর মামাতো ভাই রনকেলী
গ্রামের আরবাব হোসেন চৌধুরীর একমাত্র কন্যা ওয়াফা চৌধুরী। তাঁর জন্ম পবিত্র
মদীনায়। সিলেট লিডিং ইউনিভার্সিটি হতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সে ২০২২ সালের
১০ নভেম্বর সে এসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) পদে আমাদের অফিসে যোগদান করে। তাঁর
স্বামী ফুলবাড়ি গ্রামের তাহমিদ চৌধুরী আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, সে পূবালী ব্যাংক সিলেট
শাখার কর্মকর্তা। ওয়াফা হাসিখুশি মেজাজের মেয়ে। তাঁর আই টি এবং ইংরেজি দক্ষতা প্রশংসনীয়।
তাঁকে পেয়ে আমি বেশ খুশি হই।
মোঃ ইমাদউদ্দিন চৌধুরী ওরফে জীবন
কৃষ্ণ রায় এজেও (ক্যাশ) সম্পর্কে আগে আর লিখেছি। সে ইসলাম গ্রহণ করে ফুলতলী পীরের
নামানুসারে নিজের নাম রাখে মোঃ ইমাদউদ্দিন চৌধুরী। আমি বললাম তুমি তাঁর বংশীয় পদবী
চৌধুরীও খেয়ে ফেললে। সে জবাব দেয়, হুজুর আমাকে নিয়ে উমরা হজ্জ করেছেন, তিনি আমার
প্রিয় মানুষ তাই আমি তার সবটুকুই পান করলাম। কিছুদিন পর আমরা জীবনকে
তাঁর জন্মভূমি জকিগঞ্জে বদলি করে দেই। ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইমাদ রোগাক্রান্ত হয়ে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। আমরা টাকা তুলে তাকে সহায়তা করি। জুন মাসের কোন একদিন জানতে পারি সে পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করে অল্প বয়সে পরলোকে পারি জমিয়েছে। সে পবিত্র হজ্জ পালন করে। তাকে ইসলাম ধর্মানুসারে জকিগঞ্জের মাটিতে দাফন করা হয়।
ফর্সা মোঃ সাদিকুর রহমান
(শ্রমিক) আমার ঘনিষ্ঠ লোক। বেতন প্রতিদিন ১০০০/- টাকা। শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকায়
এই দুইদিন তাঁর কোন বেতন নেই। আমার চেম্বারের চানাস্তা, পরিচ্ছন্নতা ও ফুটফরমাশ
করা তাঁর কাজ। সাদিকের বাড়ি কুশিয়ারাপারের মিরগঞ্জ, গ্রামের নাম বসন্তপুর।
মোঃ জাকির হোসেন এবং মোঃ দেলওয়ার
হোসেন এই অফিসের দুইজন বার্তাবাহক। জাকিরের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। মোঃ মকসুদ
আহমদ গাড়ি চালক। তিনি ভদ্রজন, কিন্তু ডায়রিয়া রোগী।
আমাদের প্রিন্সিপাল অফিসের অন্য আরেক অফিস বন্দরবাজার পূবালী ভবনের চারতলার গোডাউন। সেখানে সিলেটের দুই আঞ্চলিক অফিসের সব ধরনের
সিকিউরিটি পেপার ও মালামাল রেখে বিলি করা হয়। প্রিন্সিপাল অফিসের গোদামে কাজ করতেন
সুলতানা বেগম এস ও (ক্যাশ) এবং কেয়ারটেকার শাহজামাল আকন্দ। তাঁদের সাথে আমাদের
কালেভাদ্রে দেখা হত। কোন এক নারী দিবসের কেককাটা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে প্রিন্সিপাল
অফিসে এলে মধ্যবয়সী সুলতানা বেগমের সাথে আমার দেখা হয়।
আমি সিলেটে আসার আট মাস পর ১০
অক্টোবর ২০২২ ঢাকায় আমার বিগবস ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আলম খান চৌধুরী অতিরিক্ত
ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলীর হাতে (ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক) দায়িত্ব
দিয়ে অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকায় থাকাকালে স্যারের সাথে জি এস ডি ডির নানা কাজে আমার
অনেকবার দেখা হয়।
একবার ফাইলের একটি ভূল দেখে
আমাকে তাঁর চেম্বারে ডাকেন। তাঁকে বললাম এই চেয়ারে আমি নতুন এসেছি। আগের অফিস কপি
দেখে নোটসিট লিখেছি। এবার ফাইল ঘেঁটে স্যার দেখেন আগের অনুরূপ ভূল নোট লিখেছেন
ফারুক হাসান এজিএম। এম ডি স্যার এবার ফারুক হাসানকে চেম্বারে এনে ধমক দিয়ে বললেন,
আপনার চাকুরি আর কতদিন আছে। ফারুক হাসান জবাব দেন আগামী বছর। এবার এমডি স্যার
রাগের সাথে বললেন, ফারুক আপনি বিদায় হবেন কবে। তাড়াতাড়ি বিদায় হলে ব্যাংক প্রাণে
বাঁচে।
শফিউল আলম খান চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে অনার্সসহ মাস্টার্স করে সিনিয়র অফিসার হিসাবে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করেন। সুদীর্ঘ ৩৯ বছরের চাকুরী জীবন একই প্রতিষ্ঠানে সম্মানের সাথে পার করেন এবং ৬৫ বছর বয়সকাল পূর্ণ করে সসম্মানে অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকায় পূবালী ব্যাংক মিলনায়তনে ঘটা করে তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা হয়। তিনি দুইপৃষ্ঠার একটি স্মৃতিময় বিদায়বানী লিখে সবার কাছে পাঠিয়ে দেন। তিনি এক সুদীর্ঘ বিদায়ী ভাষণ দেন এবং করুন সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে সবার চোখে বৃষ্টি ঝরান।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে পূবালী ব্যাংকে আবার পদোন্নতির খেলা জমে ওঠে। এজিএম পদবীর আমি ২০১৫ সাল হতে দুবছর অন্তর অন্তর ডিজিএম হবার আশায় এই খেলায় অংশগ্রহণ করে আসছি। এবারের খেলায় ভিন্নমাত্রা যোগ হল। তা গাণিতিক কেপিআই এবং ডিজিটাল প্রমোশন। এবার সবাইকে সাক্ষাৎকার নিতে ডাকা হলনা। হাতেগুনা কয়েকজনের ইন্টারভিউ নিয়ে ১২ জনকে প্রমোশন দিয়ে উপমহাব্যবস্থাপক করা হল। আমিও ঢাকার রাজবাড়ি গিয়ে রাজমুখ দর্শনে যাবার ঝামেলা হতে রেহাই পেলাম।
অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি আমার চেয়ে শিক্ষাগত ডিগ্রি এবং কেপিআই নম্বর অনেক কম এমন কয়েকজনকে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। সিলেট বিভাগের চার জেলার একমাত্র ডিজিএম প্রতিযোগী আমাকে ভাইভা বোর্ডে পর্যন্ত ডাকা হলনা, অথচ এটাই হত পূবালী ব্যাংকে আমার জীবনের পদোন্নতির হয়ত শেষ সাক্ষাৎকার, প্রমোশন হলেও তা হত অবসরে যাবার আগ মূহূর্তে বিদায়ী সম্মান। এত অনিয়মের দেশে ধিক্কার জানাই কারে। এটাই ভবিতব্য, এটাই আমাদের পোড়াকপাল। আর একটি ইন্টারেস্টিং খবর আছে। সর্বোচ্চ মহাব্যবস্থাপক পদে কয়েকদিন পরই সাক্ষাৎকার নেয়া হল কিন্তু কয়েকমাস পেরিয়ে গেলেও ফলাফলের খোঁজখবর কেউ জানেনা। তাহলে মহাব্যবস্থাপক হবার মত তৈলের জুর কি এবারের প্রার্থীদের কারো নেই।
পাঁচ বছর জজকোর্টে প্র্যাকটিস করে ব্যাংকের এসপিও পদে যোগ দেন এডভোকেট মশিউর রহমান। মেধাবী এই আইনবিদ সিলেট আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাড়ি সাতক্ষিরা। তাকে আঞ্চলিক অফিস সিলেট পশ্চিমে নিয়োগ করা হয়। এই অফিসের আইন কর্মকর্তা মাহবুব আহসানকে মৌলভীবাজার বদলি করা হলে তিনি তদবির করে তা বাতিল করান। মশিউর রহমান অনিচ্ছাসত্বেও মৌলভীবাজার চলে যান। এক বছর পর তিনি বদলি হয়ে আমার অফিসে যোগ দেন।
আবুলাইছ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে ভারতে গিয়ে হার্টে বাইপাস সার্জারি করান। সিলেট স্টেডিয়াম শাখার ব্যবস্থাপক ফসিহ উদ্দিন মাহতাব এবং আমাদের অফিসের রানেশ কান্তি তাকে আগরতলা হয়ে চেন্নাই নিয়ে যান। জুন ২০২৪। মাসের শেষ সাপ্তাহে মহাব্যবস্থাপক আবুলাইছ মোঃ শামসুজ্জামানের হেডঅফিস ঢাকায় বদলির আদেশ আসে। আমরা ৪ জুলাই তার সম্মানে প্রিন্সিপাল অফিসে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করি। ভোজ শেষে ক্রেস্ট ও কিছু উপহার তাঁর হাতে তুলে দেই।
জি এম আবুলাইসের বিদায় উপলক্ষে পরদিন শুক্রবার সকাল ৯ ঘটিকায় সিলেট স্টেশন ক্লাবে এক বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়। সিলেট বিভাগের চার জেলার সকল ব্যবস্থাপক এবং প্রিন্সিপাল অফিসের সবাই এই অনুষ্ঠানে যোগদান করি। সিলেটে অবস্থানকারী অবসরপ্রাপ্ত অনেক পূবালী নির্বাহী এই সভায় আসেন। সর্বজনাব ফরিদ উদ্দিন, ফারুকউদ্দিন, সিরাজুল হক চৌধুরী, মামুন বখত, আবু তাহের, আব্দুন নুর, সিলেট পশ্চিম প্রধান মোঃ মোশাহিদ উল্লাহ, সিলেট পূর্ব প্রধান চৌধুরী সফিউল হাসান, মোলভীবাজার প্রধানের পক্ষে আসেন সরোয়ার আলম এজিএম, বিদায়ি অতিথি আবুলাইছ, তাঁর পত্নী পুত্র জারিফ ও কন্যাকে নিয়ে সামনের সারিতে বসেন। অনুষ্ঠানে কোন মঞ্চ ছিলনা। চৌধুরী সফিউল হাসানকে সভাপতি ঘোষণা করা হয়। অনেক বক্তা ভাষণ দেন। আমিও প্রায় ১১ মিনিট স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন