বিদায় ঢাকাঃ
২রা ফেব্রুয়ারি ২০২২ সাল। এমডি,
এএমডি ও মানবসম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের কাছে ধর্ণা দিয়েও সিলেটে যাওয়া হলনা। প্রতিদিনের
মত সকালে ঘুমভাঙ্গামাত্র বেশ দুশ্চিন্তা অনুভব করি। ঢাকায় এসে আমার তেমন কোন লাভ
হয়নি, গত তিনটি প্রমোশন মিস হওয়ায় আমার ঢাকায় থাকায় ইচ্ছে একদম বিনষ্ট। বিনে লাভে
আমি কেন ঘরসংসার ফেলে সুদূর ঢাকায় পড়ে রবো? ঢাকার জীবন আমার
কাছে ভয়ানক বিষাক্ত লাগে। ধানমন্ডি লেকপারের রাজকীয় ভবনের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি
চাকুরি জীবনের বাকি চারটি বছর তাহলে কি পরিবার পরিজনহীন হয়ে একাকি কাটাতে হবে এখানে?
নাকি চাকুরি ছেড়ে সিলেটের সংসারে ফিরে যাবো। দুশ্চিন্তাকালে আল্লাহপাকের জিকির মনে
শান্তি দেয়। তাঁর পবিত্র নামসমূহের জিকির করে করে মনবাড়িতে বহা বিষন্নতার ঝড়
তাড়াই। ঘুম হতে জেগে নামাজ পড়ি, ল্যাপটপে ঢুকে ব্লগে খানিক লেখালেখি করি। মাঝে
মাঝে ব্লগের লেখা ফেসবুকে পোস্ট করি। কোন কোন দিন ব্রিজারে পানি গরম করে গোসল করি।
একবার ব্রিজারের সুইস অন করলে প্রায় দুইদিন ঈষৎ উষ্ণ পানি টেপ দিয়ে বের হয়। করোনা
মহামারিতে কারো বাসায় যেতে নেই, তাই শুক্র ও শনিবারে ঢাকায় সময় কাটে ধানমন্ডি
লেকপারে একাকি হাঁটাহাঁটি করে।
নিত্যদিন সাড়ে ৮টায় অফিসের গাড়ি
আসে। একঘন্টায় মতিঝিল প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সকালের নাস্তা করি।
নাস্তার মেনুতে থাকে তুন্দুর রুটি, ডালভাজি ও ডিমপ্যুচ। সাথে থাকে চিনিবিহিন দুধ চা
ও একটা কলা।
দুপুরে খাবার দেন মোঃ ইব্রাহিম।
বাসায় রান্না করা খাবার সুন্দরভাবে প্যাকেজ করে সাপ্লাই করেন। তিনি রবি হতে
বৃহসপতি পাঁচদিনে পাঁচ রকমের খাবার সরবরাহ করেন। মাছ, চিকেন, গরুমাংস একেক দিন
একেক আইটেম, সাথে থাকে ডাল, সবজি ও সালাদ। বৃহস্পতিবার থাকে চাইনিজ কারি, এগ রাইস, চিকেন রোস্ট, আলুস্টিক ও সস। ডায়বেটিস প্রতিরোধে এই খাবার
দুভাগ করে দুপুর ও বিকেলে দুবারে আহার করি। অফিসের কেটলিভরা
গরমজলে লেবুর রস মিশিয়ে অনবরত চিনিবিহীন গ্রিনটি পান করে
সতেজ হই।
সেদিন সকালে চার রাকাত সালাতুত
তাসবিহ নামাজ পড়ে আমাকে সিলেটে পাঠানোর জন্য আল্লাহপাকের দরবারে আবেদন জানাই। আমি
প্রার্থনায় সরাসরি কিছু না চেয়ে আল্লাহের সিন্ধান্তের উপর ছেড়ে দেই। তাই প্রার্থনা
করি হে আল্লাহ, আমার সিলেট বদলি যদি শুভকর হয়
তবে তা কার্যকর করে দিন, আমিন।
অফিসের গাড়ি প্রায়ই সকাল সাড়ে
৯টায় আমাকে মতিঝিল প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছে দেয়।
সেদিন সাধারণ সেবা ও উন্নয়ন
বিভাগে আমার চেম্বারে বসে কাজ করছি। এমন সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আলম খান
চৌধুরীর ফোন পাই।
কোরেশী সাহেব আমাকে কি চিনতে
পারছেন?
বললাম, এই কি বলছেন স্যার,
আপনাকে আমি চিনবনা? আমি যে সরাসরি আপনার জিএসডিডি টিমের সদস্য।
এম ডি মহোদয় বললেন এইমাত্র আপনার
সিলেটে বদলির আদেশে সই করলাম।
জবাব দেই আপনার প্রতি আমি খুবই
কৃতজ্ঞ স্যার, আমি প্রায় ছয়-সাত বছর ধরে ঘরসংসার ছাড়া একজন যাযাবরের মত দিনাতিপাত
করছি। আমার এই উপকারের জন্য মহান আল্লাহপাকের দরবারে আপনার মঙ্গল কামনা করি।
কিন্তু ঘটনাটা ছিল অন্যরকম। এম
ডি শফিউল আলম খান চৌধুরী স্যার আমাকে সিলেটে আগেই পাঠাতে চেয়েছিলেন কিন্তু কে বা
কারা তাকে বিভ্রান্ত করে এই বলে যে পরিচালক মনির আহমদ আমাকে সিলেটে চান না। আমার
চিকিৎসক পত্নী একাকি সংসারের ঘানি টেনে টেনে রণক্লান্ত। প্রতিবেশি মনির আহমদের পত্নী
জাহানারা খানম চৌধুরী লন্ডন থেকে সিলেটে এলে একদিন আমার বেগম সাহেবা তাকে দেখতে
যান। পরিচালক পত্নী জাহানারা জানতে চান, বেয়াইন আপনার সাহেব কোথায়? নূরজাহান বেগম
জবাব দেন, তিনি ঢাকায়। একটানা ছয় বছর ধরে আমি একা একা কষ্ট করছি। মেয়ে মানুষ হয়েও
সবকিছু আমাকেই সামাল দিতে হয়। একথা শুনে তিনি তার পরিচালক স্বামী মনির আহমদকে
বললেন, বেয়াইনকে উদ্ধার করুন, বেয়াইকে সিলেটে আনার ব্যবস্থা করে দিন। সাথে সাথে
পরিচালক মনির আহমদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আলম খান চৌধুরীকে ফোন করলেন, সি আই
আর কুরেশিকে শীঘ্রই সিলেটে পাঠিয়ে দেন।
পরিচালক মনির আহমদের পত্নীর
বোনজিকে বিয়ে করেছে আমার ভাগনা মুফতি লবিদ। সে ইস্ট লন্ডনে আছে। আমি লন্ডনে তার
সুন্দর বাসায় এক সময় সফর করি। এই সূত্রে তিনি আমাকে বেয়াই এবং আমার পত্নী ডাঃ
নূরজাহান বেগম চৌধুরীকে বেয়াইন বলে ডাকতেন।
একটু পরই আমার গাড়িসহযাত্রী কাজি
ইসতিয়াক হামিদ ডিজিএম, শহিদ আহমদ এজিএম, খুরশেদ আলম এজিএম,
সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশু এসপিও ফোন করেন, খুশির খবর আছে, আপনি সিলেট বদলি হয়ে গেছেন। তারপর আরও অনেক অনেক আপনজনের
ফোন আসে। সহসা ইমেইলে বদলির আদেশ পাই, পরদিনই রিলিজ হতে হবে।
ঢাকার প্রিয়জনদের দেখার মত তেমন
সময় হাতে নেই। তাই সবাইকে এক নজর দেখে নিতে এক লম্বা ম্যারাথন দৌড় দেই হেডঅফিসের
ভূতল হতে চৌদ্দ তলা। দেখা হয় সর্বজনাব নিথীশ কুমার রায় জিএম, মাহবুব আহমদ ডিজিএম, দিলীপ কুমার পাল, জিএম, সৈয়দ মোঃ এহিয়া এজিএম, সায়মা আক্তার এজিএম, শহিদ আহমদ এজিএম প্রমুখের সাথে। সায়েদ আব্দুল্লাহ
যীশু এসে আমাকে ডাব্লিউ ডাব্লিউ ভবনের অডিট ডিভিশনে নিয়ে যান।
সেখানে আমার চিরচেনা আরিফ রাব্বানী এজিএম, শক্তি রঞ্জন
চক্রবর্তী ডিজিএম, খুরশেদ আলম এজিএম, সফিক
উদ্দিন ভুঁইয়া এসপিও, জিয়াউল হক চৌধুরীর ডিজিএম প্রমুখের দেখা পাই।
এই সময় সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
আব্দুল হালিম চৌধুরীর ফোন পাই, কাউকে কিছু বলবেন না। সোজা সিলেট চলে যান দেরী না
করে। যে কোন ধরনের ঝায়ঝামেলা এড়িয়ে সেখানে নীরবে নিভৃতে চাকুরি জীবনের অবশিষ্ট সমইয়টুকু পার করে দেন।
দুপুরে যীশুকে নিয়ে বৈদেশিক বানিজ্য
শাখার মহাব্যবস্থাপক ফয়সল আহমদের চেম্বারে গিয়ে কফি পান করি।
সিলেটের বাগবাড়িতে আমার কাছেই তাঁর পৈত্রিক বাসা। পাশেই
লঙ্কা-বাংলা সিকিউরিটিজে গিয়ে সেখানে কর্মরত ভাতিজা তাসিম
কুরেশীর সাথে বিদায়ী সাক্ষাৎ করি। আমার সাবেক বস জগত চন্দ্র সাহাকে দেখতে এবার আমি
ও যীশু হেঁটে হেঁটে আর কে মিশন রোডে তার বাসায় যাই। জগত স্যার আমাদের দুজনকে খুব আদরযত্ন করেন।
চাকুরীর একটি রীতি বিদায়
অনুষ্ঠান। আগের দিন বদলি আদেশ পাই, অথচ বদলি হতে হবে আজই। তাই আমার প্রিয়জন সবার
সাথে দেখা করতে সময় দ্রুত পার হয়ে যায়। সকালে আমার বস উপমহাব্যবস্থাপক আলী আমজাদ
আমাকে জানালেন বিকেলে একটি সভা করে আপনাকে আনুষ্ঠানিক বিদায় দেব, তার কথার জবাবে
বললাম এই অল্প সময়ের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে আমাকে ফেয়ার ওয়েল দেয়ার কি বা প্রয়োজন।
আমি ব্যাংকের এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ না যে আমাকে সভা করে বিদায় জানাতে হবে। আলী
আমজাদ শুধু বস নন, তিনি আমার স্বদেশীও। তার বাড়ি হবিগঞ্জ হলেও তিনি লেখাপড়া করেন
সিলেট এম সি কলেজ এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক কন্যা সন্থানের জনক আলী আমজাদ
খুব উদার মনের মানুষ, তাকে কখনও আমি কারো সমালোচনা করতে শুনিনি। তার দুইভাই
পিএইচডি। তাদের একজন সাস্টের শিক্ষক, অন্যজন কানাডায়
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আলী আমজাদ সাহেব বললেন, তা কেমন করে হয় আপনি বেকসুর ঢাকা ছেড়ে
খালাস হবেন।
বিকেলে সহকর্মী সহকারী
মহাব্যবস্থাপক সালমা সাফি আমাকে ডাক দেন আপনি কোথায়? আমরা আপনাকে যে খোঁজেই
পাচ্ছিনা। আমরা আপনাকে নিয়ে একটা বিদায়সভা করব। নুরুল আমিন, জলিল ও ফুলমিয়া
জিএসডিডি অফিসের খোলা প্রাঙ্গনে চেয়ার টেবিল এনে জড়ো করেন। ব্যারিস্টার সুমন নামের
একজন লোক ঢাকার শিশুপার্ক শাখার সামনে দাঁড়িয়ে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারমেন ও
ব্যাংকের বিরুদ্ধে নানান আপত্তিকর ও বানোয়াট কথাবার্তা বলে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। এই
পোস্ট দেখে ব্যাংকের অনেক কাস্টমার ভীতসন্তস্ত্র হয়ে ফোন করতে থাকেন। কেউ কেউ
হিসাব বন্ধ করতে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় চলে আসেন। এই বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে আমার
বিগবস মহাব্যবস্থাপক মোঃ ফজলুল হক শরিফকে এক জরুরী সভায় তলব করে নিয়ে যান এম ডি
মহোদয় এস এ কে চৌধুরী। তাই এই ক্ষুদে বিদায়সভায় সভাপতিত্ব করেন উপমহাব্যবস্থাপক
মোঃ আলী আমজাদ। আমার অফিসের সহকর্মী ফাহমিদা আক্তার, এস এম শাহরিয়া হক, জান
মোহাম্মদ রাসেল, বশির উল্লাহ, এ এস এম সায়েম, নীলা সুলতানা, সাইমুম মাহবুব, সাইফুন
নাহার, ফাহমিদা করিম, তরিকুল আলম, শ্রীবিলাস কুমার দাস,
বুয়েট প্রকৌশলী আহমদ ইউসুফ, শারমিন সুলতানা, মার্জান বেগম প্রমুখ।
সবার বক্তব্য শুনলাম, হালকা নাস্তা হল, ফটোসেশন হল, রেমন্ডের
স্যুটকাপড় উপহার পেলাম। আমি এই সভায় সুদীর্ঘ তিনবছরের
ঢাকাজীবনের স্মৃতিচারণ করি। রাতে অফিসের গাড়িতে চারজন প্রাত্যহিক
সহযাত্রী শহিদ আহমদ, খোরশেদ আলম, ইশতিয়াক সজল ও তোফাজ্জল আহমদের সাথে ধানমন্ডি
ফিরে এলাম রাত নয় ঘটিকায়। সেদিন গাড়ি চালান হেডঅফিসের চালক জুয়েল আহমদ।
ছয় সাত বছর বাহিরে বাহিরে জীবন কাটিয়ে
সিলেটে নিজের ঘর-সংসারে ফেরার আনন্দে মন ফুরফুরে হয়ে যায়। আমি এতই প্রশান্তি অনুভব
করি যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ভাতিজি রহিমা চৌধুরী রিপার ফোন পাই,
চাচা রাতে আমাদের বাসায় খাবেন। ধানমন্ডি লেকের তীর বরাবর হেঁটে হেঁটে ভাতিজা
রিপনের বাসায় এলাম। আমি সিলেট ফিরে যাচ্ছি জেনে এবাসায় সবাই বেশ দুঃখ ভারাক্রান্ত
হন। রিপার বাসায় গিয়ে ভাতিজি বর সাবেক এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীর খুব আতিথেয়তা
পাই। অনেক বছর পর এম সি কলেজের সহপাঠি ঢাকা মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীর সাহ্নিধ্য পাই। তার সাথে খানিকক্ষণ
বাক্যালাপ হয়।
৩রা ফেব্রুয়ারি ২০২২ শুক্রবার।
ভাগ্নি পলির স্বামী স্কোয়ার্ডন লিডার ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রাম হতে বাংলাদেশ
বিমানবাহিনীর প্রধান কার্যালয় তেজগাঁও বদলি হয়ে এসেছেন। ফ্যালকন টাওয়ারে বাসা।
ধানমন্ডি বাসায় চা-নাস্তা সেরে তাদের বাসায় যেতে বের হই। প্রতিদিন চল্লিশ মিনিট
হাঁটা আমার রুটিন ওয়ার্ক। শীতার্থ সকালে হাঁটতে বেশ ভাল লাগে, তাই হাঁটি।
মোহাম্মদপুর, আসাদগেট পেরিয়ে জাতীয় সংসদ। তারপর পূর্ণিমা উদ্যানের সামনের রাস্থা
দিয়ে তেজগাঁও পয়েন্ট এসে যাই। এই পয়েন্ট হতে ২০ মিনিট হেঁটে প্রধানমন্ত্রী অফিস
পার হতেই বিমানবাহিনীর ফ্যালকন টাওয়ার। সোনামাখা মায়াবী রোদে একটানা প্রায় সোয়া
ঘন্টা হেঁটে অনায়াসে ধানমন্ডি হতে তেজগাঁও এসে যাই। পাকস্থলীর সব নাস্তা হাঁটার
ঠেলায় হজম হয়ে গেছে, তাই ভাগনির অনুরোধে আবার নাস্তা খেয়ে নেই। কিছুক্ষণ পর আকাশ
মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়। বিমানবাহিনীর মসজিদে জুমুয়ার নামাজ পড়ে আমরা ওভারব্রিজ দিয়ে
বাসা ফেরার পথে হালকা বাতাসের সাথে মৃদু বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এগারো তলা উচ্চতার
ফ্ল্যাট শীতল বাতাসে হিম হয়ে আসে। ভাগ্নি পলির রান্না মজার খাবার খেয়ে
আইয়াদ, ইয়ানা ও আয়ানার সাথে পালঙ্কে যেতেই এক গভীর নিদ্রা আমাকে চেপে ধরে। শিশু
আয়ানা তখন সোনালি চুলের মোমের পুতুল, একদম বিদেশি শ্বেতাঙ্গ শিশুপ্রতিমা। রাতে
বিমানবাহিনীর একটি কারে ধানমন্ডি বাসায় ফিরে আসি। এসেই ধানমন্ডির প্রতিবেশী ফুফুতো
বোন মাসুমা আপার বাসায় যাই। তাদের ঘরে করোনা ভাইরাস থাকায় আপা আমাকে ফিরে যেতে
ইশারা করেন। খানিকক্ষণ আলাপ করেই উইন্ডসর ক্যাসলে ফিরে যাই।
আমার ভাগনা ডাঃ তানভির আহমদ
চৌধুরী মুন্না তখন আমার বাসায় অবস্থান করে ডিপ্লোমা ইন কার্ডিওলজি পরীক্ষা দিচ্ছে।
আনন্দের বিষয় এবার সে উত্তির্ণ হয়ে ডি-কার্ড ডিগ্রি অর্জন করে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হয়। কিছুদিন পর এফসিপিএস প্রথম পর্ব সহজেই পার হয়। আমি বদলি হয়েছি মুন্নাকে জানালেও বাসাকর্মী সুমনকে তা জানাই নি, যদি সে
মনঃকষ্ট পায়। ভাবলাম তাকে এখন কষ্ট দেবনা, দেবো বিদায়ের
কাছাকাছি সময়ে।
সুমনকে জানিয়ে দেই ৫ ফেব্রুয়ারি
কলাবাগানে গ্রীনলাইনের বাস ছাড়বে সকাল ৯টায় এবং চিরতরে ঢাকা ছাড়ার জন্য ব্যাগ
গোছাতে বলি। আমার সমনদির চারপাঁচ জন স্থায়ী কর্মচারীর একজন সুমন। সে তার কাছ থেকে
বেতন পেত। তার খাবার হত আমার সাথে, তাছাড়া আমি সবসময় তাকে
প্রচুর অর্থ সাহায্য করতাম। আসার সময় তার হাতে কয়েক হাজার টাকা অনুদান হিসাবে তুলে
দেই। সে আমার কাপড়চোপড় দিয়ে কয়েকটি ব্যাগ ভরে ফেলে। প্রচুর অর্থ
পাওয়ায় সুমনের মন যতটা বিষন্ন হবার কথা, আসলে ততোটা সে হয়নি। সে কয়েকটি ব্যাগসহ আমাকে কলাবাগানে
নিয়ে এসে গ্রিনলাইন বাসে তুলে দেয়।
বিদায়বেলা আমেরিকা প্রবাসী আমার
সমন্দি আজিজ আহমদ চৌধুরীর পরিবারের কথা মনে হল। তাঁরা আমেরিকায়, আর আমি তাঁদের এই
বিলাসবহুল বাড়ি উপভোগ করেছি বিনা ভাড়ায় দীর্ঘ তিন বছর। অধিকন্তু তাঁদের গৃহকর্মী
সুমনের প্রচুর ফ্রি সেবা পাই। ফ্রি এসি, ব্রিজার, ফ্রিজ, টিভি সব পাই। বিশাল গাড়ি ও
ড্রাইভার পাই। কিন্তু অফিসের গাড়িতে সব কাজ সেরে যাওয়ায় এই বড় গাড়ি ব্যবহার করে
মোঠা অঙ্কের জ্বালানী খরচের বুজা বইতে যাইনি।
করোনাকালে লেকে হাঁটতে পারিনি,
তখন বাসার লম্বা করিডোরে প্রতিদিন ৩০-৪০ মিনিট করে হেঁটে নিতাম। এই বিলাশবহুল বাসায় ফ্রি থাকার সুযোগ না পেলে আমার
ঢাকাজীবন এত সুখের হতনা। আরিকের পালঙ্কে ঘুমানোর সময় মনে হত এই পালঙ্কের নরম বেডে
কে ঘুমানোর কথা, আর কে উড়ে এসে জুড়ে বসে আরাম করে ঘুম দিচ্ছি। বিদায়বেলা তাই
কৃতজ্ঞচিত্তে বাসামালিক আনিকা ভাবীর রোগমুক্তি এবং তাঁদের সবার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করে মহান
আল্লাহপাকের দরবারে সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা জানাই।
বিদায় ধানমন্ডি, বিদায় রাজধানী ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন