শ্বশুর
এনাম উদ্দিন চৌধুরীর শেষবিদায়ের সকরুণ দিনগুলোঃ
১৯৮৭ সালে
ফুড বিভাগের সরকারি চাকুরি
হতে অবসর গ্রহন করে আমার শ্বশুর ও শ্বাশুরি সিলেট শহরে বসবাস শুরু করেন। বৃদ্ধ
বয়সে আমার শ্বশুর এনাম উদ্দিন চৌধুরী স্থুলদেহ ও অতিরিক্ত ওজনের জন্য আরথ্রাইসিস,
শ্বাসকষ্ট, বিষব্যদনা সহ নানা রোগে ভোগতেন। তার একপুত্র ঢাকায় ও দুইপুত্র
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় একমাত্র কন্যা ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী সিলেটে তাদের
সেবাযত্ন ও দেখাশুনা করতেন।
নানা
শারীরিক সমস্যা সত্বেও ২০০২ সালের প্রারম্ভে আমার শ্বশুর এনাম উদ্দিন চৌধুরী
বাৎসরিক ধানকাটা ও ধান্যসংগ্রহ উপলক্ষে জন্মভূমি সাচান যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে
পড়েন। আমি অফিসের গাড়ি নিয়ে এক শুক্রবারে তাদেরকে সেখানে রেখে
আসি। এই হল মাতৃগ্রাম সাচানে আমার শ্বশুর ও শ্বাশুরির জীবনের শেষ গমন ও জনমমাটির
প্রিয় লোকজনের সাথে শেষ মেলামেশা। সেখান থেকে
ফিরে আসার কিছুদিন পর খাবার খেতে বসলে খাদ্যনালী দিয়ে খাবার যেতে তিনি একটু একটু বাঁধা অনুভব করেন। এই
বাঁধা বা গাট দ্রুত বাড়তে থাকে। তাকে খিচুড়ি ও তরল খাবার পরিবেশন করা হত। নাক কান
গলা বিশেষজ্ঞ ডাঃ সৈয়দ সাদিকে দেখানো হলে তিনি দ্রুত ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেন।
আমার ঢাকার
সমনদিক আজিজ ভাইকে সব জানান হল। তিনি তার গাড়ি নিয়ে এসে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায়
নিয়ে যান। তিনি তার প্রিয় কন্যা ডাঃ নুরজাহান ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। তাই কন্যাও
সবকাজ ফেলে রেখে বাবার সাথে ঢাকা ছুটলেন। একটি ছোট অপারেশন করে খাদ্যনালীর
টিউমারের সামান্য মাংস নিয়ে বায়োসফি পরীক্ষা করা হল। পরীক্ষার রিপোর্ট আসল
খাদ্যনালীতে ক্যান্সার হয়ে গেছে। সেইসাথে বলা হল খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করা নাহলে
খাদ্যনালী পুরোপূরি বন্ধ হয়ে যাবে। তাকে কিছুই জানান হলনা, অপারেশনের জন্য তৈরী
করা হল। তিনি আশাবাদী অপারেশন হলে আগের মত ভাল হয়ে যাবেন। একদিন অপারেশন করা হল,
খাদ্যনালীর বেশ কিছু অংশ কেটে বাদ দেওয়া হল।
পাকস্থলীতে খাবার পাঠানোর জন্য পেঠের মধ্যে ছিদ্র করে বাইপাস খাবার নল
বসানো হল।
কিছুটা
সুস্থ্য হয়ে সিলেট ফিরে আসলেন। এবার মুখদিয়ে খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। নলদিয়ে
পাঠান তরল খাদ্য গ্রহন করে তাকে বেঁচে থাকতে হল বেশ কয়েক মাস। দিনের পর দিন
মুখদিয়ে খাওয়া পানি নেই। মাঝে মাঝে পানি মুখে নিয়ে মুখ ভিজিয়ে ফেলেদিতেন। সবাই
খাচ্ছেন, পান করছেন কেবল বাবা উপোষ, তা মেনে নিতে খুব কষ্ট হত কন্যার, তাই তার
প্রিয় কন্যা কুরবানীর মাংস, পিঠা পায়েস, মজার ফলমূল বাবার মুখে তুলে দিতেন,
কিছুক্ষন চিবানো হয়ে গেলে অশ্রুসিক্ত চোখে বাবার সামনে চিলিমচি এগিয়ে দিয়ে ডাঃ
নুরজাহান বলতেন- অনেক হয়েছে, এবার ফেলে দাও বাবা।
তার বিশাল দেহ দিনের পর দিন চিকন হতে থাকে। আমেরিকা হতে তার দুই পুত্র শাহজাহান ও
সহুল এসে শেষবারের মত পিতাকে দেখে কান্নাকাটি করে চলে যান। আমার শ্বাশুড়ি অতি
পরিশ্রমি পতিপরায়না মহিলা। তিনি পতীর সেবাযত্নে এই বুড়ো বয়সে নিজেকে সপে দেন। তাকে
সহায়তা করে সেনরা নামের এক কুমিল্লার মেয়ে। সে রুগীর
কাপড় ধোয়া, ময়লা পরিস্কার করা হতে সবকাজ সযতনে করে দিত।
এবার সেনরার
কিছু গল্প বলব। কিশোরী বয়সে তার এক আত্মীয় তাকে টাকার বিনিময়ে ভারতে পাচার করে
দেয়। অসংখ্য বদলোকের নির্যাতনের শিকার হয়ে বাঁচার পথ খুঁজতে থাকে। এবার সে
নিখুতভাবে পাগলনীর অভিনয় শুরুকরে। তার আচরনে পাচারকারীরা তাকে পাগলী মনে করে আবার
বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে এসে সমাজে ঠাই হলনা, তাই কাজের সন্ধানে চলে আসে
সিলেটে। এখানে অসুস্থ হলে ভর্তি হয় সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এই হাসপাতালে
ডাঃ নুরজাহানের সহিত তার পরিচয় হয় ও সুস্থ হয়ে আমাদের বাসায় চলে আসে। জীবন
বাঁচাতে এবার হাওয়াপাড়ার এক সচ্ছল বুড়োকে সে বিয়ে করে। এক বর্ষনসিক্ত রাতে সেনরা
এক গাট্টিবুচকা ও নবজাতক কন্যাশিশু নিয়ে আমাদের
বাসায় হাজির হল। এসে কয়েকদিনের আশ্রয় প্রার্থনা করে বলল, তার বুড়ো স্বামী কিছুদিন
হয় মারা গেছে, এখন সতীনের পুত্ররা তাকে এই শিশুকন্যাসহ শুন্যহাতে বের করে দিয়েছে।
সেনরার বুড়ো
স্বামী ছিল খুব ফর্সা ও সুন্দর। তার কন্যাটি হয় বাপের অনুরূপ প্রতিমা। আমি ড্রয়িং
রোমে গিয়ে ছোট্ট মশারীর নিচে এক দুগ্ধধবল চাঁদবদনা শিশু কন্যাকে হাতপা ছুড়তে দেখে
কেন যেন মনে হল এই সর্বহারা অসহায় শিশুটির অঙ্গ হতে জ্যোতি বেরুচ্ছে, নিশ্চয়
এইশিশু স্রষ্টার আশির্বাদপুষ্ট তাই জীবনে খুব ভাগ্যবান হবে। আমি এই অসহায় রূপসী
নবজাতক শিশুর লালন পালনের জন্য আল্লাহর কাছে হাত তুলে প্রার্থনা করলাম। কিছুদিনের
মধ্যে এক নিঃসন্থান দম্পতি এসে এই শিশুটিকে দত্তক হিসাবে নিউইয়র্ক নিয়ে যায় ও নিজ
সন্থানের মত আদরযত্ন করে বড় করে। এই কন্যা শিশুটি আজ যুক্তরাষ্ট্রের একজন শিক্ষিত
ধনী নাগরিক এবং বিয়ানীবাজারের একজন ভদ্রলোকের জীবনসঙ্গিনী।
প্রথমদিকে
আমার শ্বশুর ঘরে বাহিরে কিছু হাঁটাহাঁটি করতেন। শরীরের ওজন ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
এবার আমাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে বলতেন, আমি চিটি লিখব। তার হাতে কলম ধরার মত তেমন
শক্তি নেই। লেখা আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। তাই তিনি বলতেন ও আমি লিখতাম। চাকুরি
জীবনের অনেক সহকর্মির কাছে আমি তার পত্র লিখতাম। এসব পুরান দিনের লোকজনের ঠিকানাও
তার মুখস্ত। কার ঠিকানা সুনামগঞ্জ, কারও মৌলভীবাজার, কারও হবিগঞ্জ। আমি এসব
লোকদেরে চিনিনা। অথচ রুমালে চোখ মুছে মুছে
তার শেষ জীবনের হৃদয়ের আকুতি ভরা শেষ পত্রগুলো আমি লিখে দিয়েছি এক বুক যন্ত্রণা
নিয়ে। এযেন জীবন হতে চলে যাবার আগে একজন নিশ্চিত পরকালযাত্রির একটি বারের জন্য
পুরানদিনের প্রিয় মানুষদের শেষবারের মত চোখে দেখার জন্য ফেলা বিষাক্ত নিঃশ্বাস। এই
শেষপত্র পেয়ে কেউ কেউ এসে দেখা করলেন, আবার কেউ পাঠালেন প্রতি উত্তর। তখন মোবাইল
ছিলনা, তাই পত্রই ছিল একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম। সবপত্র আমার হাতে আসল, আমাকে
কাঁদাল, ভাবলাম পত্রমিতালী কি এত করুন ও নিষ্টুর হতে পারে।
একজন বাবার
তার একমাত্র কন্যার প্রতি কতটুকু যে হৃদয়ের টান থাকতে পারে তারও একজন স্বাক্ষি
হলাম আমি। তখন সাগরদিঘির পার আমার বাসার নির্মান কাজ চলছিল।
আমার গৃহনির্মাণ ঋণ
ও আমাদের দুজনের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে হাতে জমা সামান্য টাকায় বাসার কাজ যে
সমাধা করা সম্ভব নয় তা তিনি খুব ভালভাবে জানতেন। মরণশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি সুরমা
পারে একটি জমি বিক্রি করে মেয়েকে বাসা নির্মাণে
সাহায্য করতে চাইলেন। গ্রামের জমি দেখাশুনার দায়িত্ব থাকা আব্দুস সত্তার জমিটি
দুইলক্ষ টাকায় বিক্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। আমি ও ডাঃ নুরজাহান চৌধুরী তখন সাচানের
বাড়িতে সিন্নী ও সাহায্য বিতরণ করার জন্য
গমন করি।
সব কাজ
সমাপ্ত হলে আমরা পাশের দক্ষিণে আমার ফুফু
শ্বাশুড়ির বাড়িতে ফুফুত বোন হেনা আপাকে
দেখতে যাই। এমন সময় আব্দুস সত্তার জমির মূল্যবাবদ দুই লক্ষ টাকা আমাদের হাতে
পরিশোধ করে। এই লেনদেন দেখে ফেলেন নুরজাহানের ফুফুত বোন হেনা আপার স্বামী একজন
বেঁটে প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক। তিনি সুদূর রাজধানী
ঢাকা পর্যন্ত খবর পাঠান গ্রামের পিছন দিকে একজন মাইমল (মৎস্যজীবী)
লোক জমি কিনে বাড়ি বনিয়ে সাচান গ্রামের ইজ্জত নষ্ট করে ফেলবে। অথচ জমিটির অবস্থান
সাচান গ্রাম হতে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে সুরমাপারে। সাচান গ্রামের ইজ্জতের
হেফাজতকারী এই ভদ্রলোকের বাড়ি কিন্তু বাংলাদেশে নয়, ভারতে।
এই গ্রামে তিনি একজন ঘরজামাই হয়ে দীর্ঘ্যকাল ধরে শ্বশুরের ভিটায় বসবাস করছেন। এই
ঘরজামাই ভদ্রলোকের একটি মেয়ে অক্ষম বোধহীন। এই মেয়ের বিয়েসাদি হয়নি। আমার শ্বশুর
এই মেয়ের দেখাশুনার জন্যও কয়েক বছর আগে বেশকিছু ভূমিদানও করেন।
দুইদিন পর
জমিটি রেজিস্ট্রেশন হবার কথা ছিল, কিন্তু ঢাকা হতে নির্দেশ আসল বিক্রয় করা যাবেনা।
আব্দুস সত্তার বলল এই জায়গার বদলে দূরের কোন একটি জায়গা রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া
হউক। কিন্তু সুতীব্র বাধায় তাও করা সম্ভব হলনা। আমার শ্বশুর জমি বিক্রির কথা দিয়ে
দুইলক্ষ টাকা গ্রহন করে শেষমেশ কথা রাখতে পারলেন না। তিনি ছিলেন খুব সহজ সরল
প্রকৃতির ভদ্রলোক। কোনদিন তার কথার বরখেলাফ হয়েছে এমনটি তার কোন দুষমনও বলতে
পারবেনা। তিনি বিষয়টা নিয়ে অসুস্থ শরীরে অশ্বস্তি
করতে দেখে আমি ও নুরজাহান বললাম, আমরা মনে করব বাবা, আপনার কাছ হতে দুইলক্ষ
টাকা বাসা নির্মাণে সাহায্য পেয়ে গেছি। এবার আব্দুস
সত্তারকে বলুন আপনাকে দেওয়া দুইলক্ষ টাকা সে যেন এসে নিয়ে যায়। পরদিন চুনিয়া বিলের
একটি বড়মাছ নিয়ে সত্তার বাসায় হাজির হলে আমি দুই লক্ষ টাকা তার হাতে ফেরত দিয়ে
সাচান গ্রামের ইজ্জত রক্ষা করি।
সাচানের
একটি মেয়ে এসা বেগম আমাদের বাসায় কাজ করত। তার মা গ্রামের বাড়িতে ধান ঊঠাত। এসার
চাচাত ভাইরা বিদেশে গিয়ে ধনী হয়ে পাকাঘর নির্মান করে। তারা এসাদের বাড়ি তাদের কাছে
বিক্রি করতে বাধ্য করার জন্য বাড়ির রাস্থা পাকা ওয়াল দিয়ে বন্ধ করে দেয়। এসার
দরিদ্র বাপ বাধ্য হয়ে ঘরের পিছনের পুকুরের পানির উপর দিয়ে বাশের সাকো নির্মাণ
করে ঘরে আসা যাওয়া করত। আমার শ্বশুর তাদের উপর এই অত্যাচার দেখে দারুণ
মর্মাহত হন। তিনি বড় রাস্থার পাশে এসার বাপকে বেশকিছু জমি বিনামূল্যে দান করে দেন।
এখানে বাড়ি নির্মাণ করে এখন তারা বসবাস করছে।
ডাঃ আহমেদুর
রেজা চৌধুরী তখন ছিলেন সিলেটের সিবিল সার্জন। তিনি আমার শ্বশুর এনাম উদ্দিন
চৌধুরীর একমাত্র ভাগনা। একই গ্রামের পাশের বাড়িতে আমার ফুফু শ্বাশুড়ীর বিয়ে হয়েছিল। এই
ভাগ্নাকে তিনি তার সন্তানদের সাথে লেখাপড়া করান। পরে তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজে
ভর্তির সুযোগ পান। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর তিনি তার মায়ের বাপের বাড়ির
সম্পত্তি দাবি করেন।
আমার
শ্বশুরের উপর তখন হোস্টেলে অবস্থান করে পড়াশুনারত তিনপুত্র ও এককন্যা সন্থানের
খরচের তীব্র চাপ ছিল। ভাগ্নার বাড়ির লোকজন তাকে সমর্থন করে আগ্রাসী আচরণের
মাধ্যমে আমার শ্বশুরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও ন্যায়নিষ্ট
ফুড কর্মকর্তা, সামান্য বেতন ও সাচানের জমির আয় দিয়ে খুব কষ্ট করে সবকিছু সামলে
নিয়ে যাচ্ছিলেন। এই ধরনের সময় এই বাড়তি মানসিক চাপ তাকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলে।
তিনি বোনের সমুদয় পাওনা জমি দিতে রাজী ছিলেন। তারপরও তাকে এই মানসিক অসুস্থতার মঝে
চিন্তাভাবনার কোন সময় না দিয়েই জুরাজুরি করা শুরু হয়।
এইসময় তিনি
কথা বলতেন খুব কম। লোকজনের সাথে মিশতেন না
ও একা একা ঘরকোনে অন্ধকারে থাকা পছন্দ করতেন। প্রায় ছয় মাস তিনি অফিসও করতে
পারেননি। কোনমতে চাকুরিটা আল্লাহর মেহেরবানিতে কি করে যেন
রক্ষা পায়। লোকে বলত কেউ তাকে তাবিজ কিংবা যাদুটুনা করেছে। আমার শ্বশুড়িমা অনেক
পীর ফকিরের কাছে বেশ দৌড়া দৌড়ি করেন। শেষে বোনের অংশের জমি বিক্রি করে সমুদয় টাকা
পরিশোধ করে তিনি দ্বায়মুক্ত হন।
সাচানের তিন
মাইল পুর্বে সুরমাপারের ঘোলাঘাট গ্রামে আমার শ্বশুরের দুসরা বোনের বিয়ে হয়। দুই
বোনেরই আর্থিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল ছিলনা। তাই সারাজীবন দুই
বোনকে তার সীমিত আয়ের মধ্যে অবস্থান করেও অনবরত টানতে হয়েছে। তাই নিজ কন্যাকে
ডাক্তারী পড়ানোর সময় প্রায়ই বলতেন, আমার মেয়ে চিকিৎসক হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে,
ভাইদের কাছে সাহায্যের জন্য তাকে হাত পাততে হবেনা।
শ্বশুরবাবা
তার দক্ষিনের বাড়ির বোনের সমুদয় পাওনা পাইপাই হিসাব করে পরিশোধ করে দেন। তবে
আহমদুর রেজা ভাইয়েরও সরকারী মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে অবস্থান করে পড়াশুনা চালানোর
কোন আর্থিক সামর্থ্য ছিলনা। লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহনে অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি মায়ের
সম্পত্তির অংশ আদায় করে নেন। তিনি জীবনে সফল হন, বিভিন্ন জেলায় সিবিল সার্জনের
দায়িত্ব পালন করে সবশেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের ডিপোটি ডায়রেক্টার পদ হতে অবসর
গ্রহন করেন।
সেই সময়
আমার শ্বশুরবাবা তীব্র মানসিক বিষন্নতা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় তার দৃঢ় বিশ্বাস
জন্মে কেঊ তাকে টাবিজটুকা করে এই
দুরবস্থায় ফেলে দিয়েছে। তার চিকিৎসাকারী হুজুররাও তার মনে এই ধারনা তৈরী করে দেন
যে তার এই রোগটি কোন শত্রুর যাদুটুনার ফল। তিনি তার বোনের বাড়ির ফরায়েজ আদায়কারী
লোকজনকে সন্দেহ করা শুরু করেন। এই সন্দেহ সারা জীবন তার মনে ক্রিয়াশীল ছিল। তিনি
তার বোনদের বাড়ির সবাইকে সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করলেও এই বাড়ির কেউ এলে সাবধান
থাকতে বলতেন, যাতে তারা কোন যাদুটুনা করতে নাপারে। তাই একমাত্র ভাগ্নার সহিত তার
সম্পর্ক অনেকটা ছিন্ন হয়ে যায়।
মামা
শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে ভাগনা আহমেদুর রেজা চৌধুরী দেখতে এসে একমাত্র মামাকে ঘুমের
মধ্যে দেখতেন। তিনি সজাগ অবস্থায় তার সাথে দেখা করার সাহস করতেন না। তিনি বেশ
কয়েকদিন এভাবে এসে গোপনে ঘুমন্ত মামাকে দেখে গেলে আমার ও নূরজাহানের মনে বেশ
যন্ত্রনা ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। একদিন আমি মৃত্যু পথযাত্রি শ্বশুর বাবাকে
বুঝিয়ে বললাম, আপনার দিন আছে না চলে যাচ্ছে? তিনি জবাব দেন, মনে হয় আমার দিন
ফুরিয়ে আসতেছে। তখন আমি তাকে বললাম, আপনার ভাগনা তার মায়ের ফরায়েজ নিয়ে তাতো নষ্ট
করেননি, বরং তিনি তাদিয়ে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হয়েছেন, সিলেটের সিবিল সার্জন
হয়েছেন। মামা ভাগ্নার আত্মীয়তার সম্পর্কটা দুদিনের দুনিয়ায় বিচ্ছিন্ন থাকাটা
আপনাদের জন্য যেমন অসুন্দর, আল্লাহর কাছেও তাহা কোনমতে গ্রহনযোগ্য নয়। বললাম এবার
যাদুটুনার ভয় বাদ দেন এবং এই একমাত্র ভাগ্নাকে মাফ করে দেন। আমি আপনাদের মধ্যে
মামুভাগ্নার মধুর সম্পর্কটা আবার চিরস্থাপন করে দিতে চাই। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
তুমি কি তাই বলছ? আমি বললাম হ্যাঁ আমি তাই বলছি। এবার আমাকে আর কাছে নিয়ে কানের
কাছে অস্ফুট কন্ঠে বললেন, আমার ভাগ্নাকে বল আমার সাথে সে যেন এসে দেখা করে, তার
প্রতি এখন আমার কোন মান অভিমান নেই, রাগ অভিযোগ নেই। আমি তাকে আমার হৃদয়ের
অন্তস্থল হতে মাফ করে দিলাম।
এবার রেজা
ভাইকে বাসায় আসতে বললাম, একদিন নানা মুখরোচক খাবার নিয়ে ভাবী ও রেজাভাই এসে বাসায়
হাজির হন। রোগশয্যায় শায়িত মামার কাছে যেতেই হাত বাড়িয়ে ভাগনাকে জড়িয়ে ধরেন। মামা
ও ভাগনা দুইজনের চোখ বেয়ে নেমে আসে মিলনের অশ্রুধারা। এভাবে বহুবছর আগে ছিন্ন হওয়া
মামু ভাগ্নার মধ্যকার আত্মীয়তার সম্পর্কটি এনাম উদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর দুইতিন মাস
আগে আবার পুনঃস্থাপিত হয়।
২০০২ সাল,
গলনালী বন্ধহয়ে কৃত্রিম তরল খাবারে টিকে থাকা ও ক্রমান্নয়ে ঝিমিয়ে পড়া একজন রোগীকে
নিয়ে এক দারুন যন্ত্রাণার মধ্যে আমাদের সময় পার হয়। জানুয়ারি
২০০৩ আসে, শ্বশুরবাবার শরীরে তখন গুনাযায় এমন কয়েকটা কঙ্কাল। আগে বাথরুমে
নিয়ে যেতে আমাদের কষ্ট হলেও এখন ওজনহীন হয়ে পড়ায় কোলে তুলেও হাই কোমডে বসাতে তেমন
বেগ পেতে হতনা। জানুয়ারির শেষসাপ্তাহে তার কষ্ট ও আস্থিরতা বাড়তে থাকে। আমি
শুক্রবার জরুরি কাজে বাড়ি যাই, ফিরে আসি বিকেলে। এসে দেখি তিনি খুব বেশি
ছটফট করছেন। আমাকে একবার বসাতে বলছেন, আবার শোয়াতে বলছেন। আমি তার পাশে থেকে বেশ
কয়েকবার তাকে উঠবস করাই। সেদিন ছিল ৩০ জানুয়ারি
২০০৩ সাল। এইদিন রাত ১১ ঘটিকার সময় ৪৬, কাজলশাহ বাসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করেন। ১৯৩০ সালে যাত্রা শুরুকরা এই সরল জীবনটি প্রায় বাহাত্তুর বছর সিলেট বিভাগের
চারটি জেলায় বিচরন করে এই সিলেট শহরেই ঝরে যায়।
কান্নায়
ভেঙ্গে পড়েন আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান, তিনি জন্ম হতে কোনদিন পিতামাতার স্নেহচ্ছায়া
হতে কখনও বিচ্ছিন্ন হননি। নুরজাহান মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর প্রথমদিকে
মেডিকেলের পড়ালেখা খুব কঠিন মনে হয়। বাবা তখন প্রতিদিন দিলরুবা হোস্টেলে গিয়ে
কন্যাকে সাহস যোগাতেন। সিনিয়র ক্লাসের ছাত্রী ডাঃ আজমা আপার স্বামী ডাঃ ইকরাম ভাই
প্রায়ই তাকে আসতে দেখে বলতেন, চাচা কোন চিন্তা করবেন না, মেডিকেল পড়া প্রথম প্রথম
কঠিন মনে হলেও তা আস্তে আস্তে সহজ হয়ে আসে। ডাঃ আজমা আপাও আজ নেই। মরনব্যাধী স্থন
ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে তিনি অল্প বয়সে পরলোকে পাড়ি জমান।
আমাদের
পাশের বাসার ভদ্রলোক মদরিস আহমদ তরফদার একজন পরোপকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি পিডিবিতে
চাকুরী করতেন, ছিলেন শ্রমিক ইউনিয়নের গন্যমান্য নেতা। তিনি আমাদের পরিবারে সিপার
বাপ নামেই পরিচিত। সারাটা রাত অঘুমা থেকে তিনি আমার শ্বশুরের লাশের কাছে অবস্থান
করে দোয়া দুরুদ পাঠ করেন। তিনি কষ্ট করে আমার অনেকগুলো বিদ্যুতিক মিটার বের করে
দেন। তার পুত্র তানভীর আহমদ তফাদার আজ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের বিসিএস
ক্যাডার।
আমি দরগায়
গিয়ে মুফতিবাড়ির আমার ফুফুত ভাইয়ের সহায়তায় শাহজালালের দরগা মসজিদের পিছনে টিলার
গাঁয়ে একটি সুন্দর জায়গায় কবর খোদাই করি। ফোন করে ভাতিজা মনুমিয়াকে একটি বড় বাস
ভাড়া করে তার জন্মগ্রাম সাচানের স্বজনদেরকে সিলেটে নিয়ে এসে জানাজায় শরিক হতে
বললাম। বাদ আসর জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হল। আমি কবরে নেমে লাশ নিজ হাতে মাটিতে
শায়িত করে দেই। এই সময় আজিজ ভাই সপরিবারে সিলেটে
হাজির ছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন