শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

নুতন এক জীবন- ডাঃ নুরজাহান ও আমিঃ

 

নুতন এক জীবন- ডাঃ নুরজাহান ও আমিঃ    

১৯৯৬ সালে আমি গ্রামের বাড়ি হতে সিলেট শাখায় আসা যাওয়া করি কিন্তু চাকুরী ও চেম্বার পরিচালনার জন্য ডাঃ নুরজাহান চৌধুরী সিলেট শহরেই অবস্থান করেনতিনি ৪৬, কাজলশাহের বাসার বারান্ধায় পর্দা টানিয়ে রোগী চেম্বার তৈরী করেন। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের একটু আগে ডানদিকের রাস্থা দিয়ে সামান্য ঢুকে একটি সুন্দর দীঘির ডান কিনারার ধারে বাসাটির অবস্থান।  প্রতিদিন নতুন পুরাতন মিলিয়ে দশবার জন মহিলা রোগী আসতেন। যে সব রোগীরা আসতেন তাদের ডেলিভারিপুর্ব নয়মাস দেখাশুনাসহ নবজাতকের জন্ম হওয়া পর্যন্ত সবকাজ করে যেতে হত। ডেলিভারী, ফরসেফ ডেলিভারি কিংবা সিজারিয়ান পর্যন্ত সর্বকর্ম সমাপ্ত করে তবে নিস্তার পেতে হত।

রোগীর পর রোগী, ডেলিভারীর পর ডেলিভারী লেগেই থাকত। এযেন পাইপলাইন দিয়ে প্রবাহিত জলের মত একটি ধারাবাহিক রোগীর স্রোতধারা, পাইপের একমুখ দিয়ে ঢুকছে অন্যমুখ দিয়ে সমভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে। মহিলাদের প্রসবব্যদনা প্রায়ই রাত্রিবেলা শুরুহয়। প্রকৃতি নাকি রাতের নীরবতাকে একাজের জন্য আদিকাল হতে নির্ধার করে দিয়েছে। প্রাচীনকালের বনবাসী আদিম নারীর জন্য রাতই ছিল প্রসবের নিরাপদ সময়, কারন এসময় হিংস্র পশুরা ঘুমিয়ে থাকত। একজন ডেলিভারী রোগী ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে তার চিকিৎসককে ডাক দিলেই সেই রোগীকে নিয়ে তার কর্মব্যস্ত অর্ধরাত কিংবা পুরোরাত পার হয়ে যেত

স্ত্রীরোগ ও প্রসুতি চিকিৎসকগন প্রায়ই মধ্যরাতের পর ঘুমান, ফলে তাদেরকে সকাল ৮/৯ ঘটিকা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকতে হয়। এই চিকিৎসা জীবন বেশ কঠিন, প্রতিদিন সকাল ৮/৯ ঘটিকায় ঘুমভাঙ্গার পর কাজ শুরু হয় যার সমাপ্তি ঘটে মধ্যরাতের পর অবিশ্রান্ত কাজের সমুদ্রে সাতারের ইতি হলে। আমি বিয়ে করে একজন চিকিৎসক ডাঃ নুরজাহানের কঠিন পরিশ্রমি জীবনের সহসঙ্গী হলাম। মুক্তি পাওয়া রোগীরা এসে যখন আনন্দচিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত কিংবা মিষ্টি নিয়ে আসত তখন আমাদের মন এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে যেত। 

তখন রোগীর ভিজিট ছিল নূতন ২০০ টাকা ও পুরাতন ১০০ টাকা। ক্লিনিকে একজন চিকিৎসক নরম্যাল ডেলিভারি ১০০০ টাকা, ফরসেফ ডেলিভারি ১৫০০ টাকা, ডি এন্ড সি ২০০০ টাকা ও সিজারিয়ান অপারেশনে ৫০০০ টাকা  করে পারিশ্রমিক পেতেন। কাজেই সিলেট শহরে তখনকার দিনে একজন স্ত্রীরোগ ও প্রসুতি চিকিৎসক কঠিন পরিশ্রম করলেও পারিশ্রমিক হিসাবে যা পেতেন তা একেবারে নগন্য কিছু ছিলনা।

ডায়াগনেষ্টিক সেন্টারে ডাঃ নুরজাহান হিসটারো প্যাথলজি করতেন, এই শহরে আর কেঊ এই কাজটি করতে পারত না। হিসটারো প্যাথলজি হল মহিলাদের বাচ্চাদানীর ভিতর যন্ত্র প্রবেশ করিয়ে ঔষধ ঢুকিয়ে ইউটেরাসের চেম্বারগুলো এক্সরে ও ক্লিনিং করা। বহুবছর ধরে বাচ্চা হচ্ছেনা এমন সব রোগীদের এই পরীক্ষা করে দেওয়ার পর প্রায় ক্ষেত্রেই উদরে সন্তান আসত। নিরাশার সাগরে ভাসা এসব দম্পতিরা  খুশিতে গদগদ হয়ে মিষ্টি নিয়ে আসত বাসায়, মনেহত এরা যেন বহুদিনের হারানো জীবনটাকে আবার ফিরে পেয়েছে। তারা যখন দুইহাত আকাশে তুলে দোয়া করত, তখন মনে হত আমাদের জীবন ধন্য, জীবনে আর কিবা আছে পাবার।

সময় যতই পার হল ততই সিলেট শহরের কি এক মায়াজালে জড়িয়ে গেলাম। বিকেলে অফিস হতে বের হয়ে আর আট মাইল দূরে ছুটে যাবার চেয়ে কাছের আস্থানায় চলে যাওয়া অনেক স্বস্তিদায়ক মনে হত। এক সময় আমি আধা শহর ও আধা গ্রামবাসী হয়ে গেলাম। সাপ্তাহের দিনগুলো শহর ও গ্রামে ভাগ করে কাটিয়ে দিতাম। অবশ্য ছুটির দিন গ্রামেই কাটত 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন