এল
বিধাতার সেরা উপহার, পূর্নিমার চাঁদ জেফারঃ
১৯৯৬ সালের
কোন একদিন ডাঃ নুরজাহান ইশারায় বললেন আল্লাহর অপার মেহেরবানিতে খুবসম্ভব আমার
গর্বে নুতন জীবনের আগমন ঘটছে। এই শুভখবর শুনে সীমাহীন খুশি হলাম ও মহান আল্লাহর
প্রতি অজস্র শোকরিয়া জ্ঞাপন করলাম। বমি বমি ভাব ও নানা উপসর্গ দেখা দিলেও ডাঃ
নুরজাহানের অবসর নেওয়ার কোন অবকাশ ছিলনা। রোগীদেখা ও ক্লিনিক ডিউটি যথারীতি চালিয়ে
যেতে হল। স্ত্রীরোগ বিশেষঞ্জ ডাঃ ফরহাত মহল আপা তার দেখা শুনা করে যান।
৩১শে
ডিসেম্বর ১৯৯৬ সাল। বছরের এই বিদায় দিনে অফিসে
সারাদিন একটানা কাজ করেও নিস্তার পাওয়া
গেলনা। পুবালী ব্যাংক সিলেট শাখায় দিন পেরিয়ে সেই তীব্র শীতের রাত বারটা পর্যন্ত
বাৎসরিক সমাপনীর কাজ করি। মধ্যরাতের পর বাসা ফিরে ঘুমানোর
সুযোগ হয়নি, শেষরাত হতে না হতেই ডাঃ নুরজাহানের শরীর খারাপ হতে শুরু করে। আমরা
তাকে নিয়ে তার কর্মক্ষেত্র লামাবাজারের আয়শা ক্লিনিকে গমন করি। আয়া ডাক্তার নার্স
হতে শুরু করে এই ক্লিনিকের সব লোকজন ছিলেন তার প্রিয়জন ও খুব কাছের লোক। কিছুক্ষণ
পর ডাঃ ফরহাত মহল ছুটে আসেন, ডাঃ শামিমা আক্তারও পাশে ছিলেন।
১লা
জানুয়ারী ১৯৯৭ সাল। ডিসেম্বর শুরু হতে না হতে সেই বছর সিলেট শহরে তীব্র শীত জেকে
বসে। হাড়কাঁপানো শীতের সুদীর্ঘ ভোর পেরিয়ে নুতন বছরের প্রথম সুর্যোদয় হল।
ডাঃ
নুরজাহান ম্যাডাম রাত জেগে জেগে অনেক অনেক নবজাতকের প্রসব কর্ম সমাধা করেছেন।
মায়েদের যন্ত্রনা দেখে দেখে অনেক অনেক বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন।
এবার নিজের উপর সেই যন্ত্রনার পালা এসে গেল। তীব্র কষ্টে বুকফুটে কাতরানির শব্দ
বের হতে লাগল। যন্ত্রণায় ম্যাডামের জীবন যখন
ওষ্ঠাগত তখন হাত ধরে সান্তনা দেন, ধর্য্য ধরার পরামর্শ দেন পাশে উপস্থিত আমার
আম্মা আসমতুন্নেছা, ছোটখালা মরিয়মুন্নেছা ও শ্বাশুরি মলিকা খাতুন।
কিন্তু কিছুতেই সেই কষ্ট আর কমেনা।
কোনক্রমেই
সময় যেন ফুরাতে চায় না। এবার কষ্ট সহ্য করতে নাপেরে সিজারিয়ান অপারেশন করার জন্য
ডাঃ ফরহাত মহল আপাকে আনুরোধ করেন। আমি অভিভাবক হিসাবে অপারেশনের অনুমতিপত্রে
কম্পিত হস্তে স্বাক্ষর করলাম। দুপুর ১২টায় অপারেশন টিম অপারেশন থিয়েটারে ডুকে কাজ
আরম্ভ করেন। বাহিরে অনেক আত্মীয়স্বজন অধীর অপেক্ষায়। আস্তে আস্তে আধার কেটে গেল।
শীতের দুপুরে উজ্জ্বল সুর্য তখন মিষ্টমধুর কিরণ
বিলিয়ে দিচ্ছে।
সেই
স্মৃতিময় দিন ১লা জানুয়ারি ১৯৯৭ সাল,
তখন দুপুর ১ঘটিকা, জোহরের আজান শুনা যাচ্ছে।
এমন এক
শীতের উজ্জ্বল দুপুরে অপারেশন থিয়েটার হতে কে একজন খবর দিল অপারেশন প্রায় শেষ
পর্যায়ে রয়েছে। পরপরই একটি নুতন প্রাণ, এই
পৃথিবীতে এক নবাগত শিশু চিকন তারস্বরে জানিয়ে দেয় সে এসেছে। প্রবল চিৎকারে যেন
পুরো জগত কাপিয়ে ঘোষণা করে দেয়- আমি এসে গেছি। আমি এসে
গেছি, এবার পৃথিবীতে আমার রাজত্ব করার পালা।
হঠাৎ অপারেশন
থিয়েটারের ভিতর হতে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ কানে প্রবেশ করতেই মনে পড়ল কবি
সুকান্তের কবিতা-“এসেছে নুতন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান”
কিংবা- “নুতন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত
করে অধিকার, জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে”।
হঠাৎ সব
ব্যথা থেমে গেল। কোন এক জাদুর কাঠি যেন হঠাৎ শান্ত করে দিল দুনিয়াটাকে। বাচ্চার
মাকে বেডে করে নিয়ে যাওয়া হল পোস্ট অপারেটিভ থিয়েটারে।
সদ্য
প্রসূতির চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে, পৃথিবীটা যেন ঘুরছে। চোখ দুটি বুজে আসতে চাইছে। ঘুম
বড় টানছে। ঠিক এমন সময় চেনা কন্ঠ তার কানে এল, ছেলেটাকে একবার দেখে নিন নুরজাহান
ম্যাডাম।
মধুকন্ঠের
সেই ডাক শুনে সব ঘুম পালিয়ে গেল। নড়ার শক্তি নেই শরীরে। আস্তে আস্তে নবজাতকের দিকে
মাথা ঘুরান ডাঃ নুরজাহান।
কে যেন
তোয়ালে পেঁচানো ছোট্ট একটা পুতুল এনে মুখের সামনে ধরল। তার ক্লান্ত চোখ ঠিকমত যেন
দেখতে পায়না। তার ঠুটের সাথে মিশল পুতুলটার মুখ। অমনি পৃথিবীর সব কষ্ট, সব ব্যদনা
নিমিষে মিলিয়ে গেল। এই তো তার সুখের পাত্র দুনিয়ায় এসে গেছে।
ডাঃ
নুরজাহান অবাক বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন- এই আমার ছেলে। এই ছেলেটাই
এতদিন ছিল আমার পেটে। হৃদয়ে নেমে আসে এক অনাবিল স্বর্গের সুখ।
এত বছর পার
করে আজও সেই দিনটির স্মৃতি মনে হলে আমাদের চোখ আনন্দের জলে ভরে ওঠে। সেইদিন
‘এত্ততুকু, এত্তটুক্কু’ ছিল, আমরা শুধু দেখতাম, কি ফর্সা একটা পুতুল। সে যে আমাদের
আজকের ছেলে জেফার।
কিছুক্ষণ পর
ভিতর হতে কে যেন এক উলঙ্গ জীবন্ত পুতুল তোয়ালে জড়িয়ে এলি আপার হাতে ছেড়ে দিল। এলি
আপা কিছুক্ষণ পর দুই হাত বাড়িয়ে পুটলিটা তুলে দেন আমার হাতে। খুব সাবধানে মোমের
পুতুল ধরার মত জড়িয়ে বুকের কাছে তুলে নেই। ঝাপসা চোখে পুতুলটার দিকে চেয়ে রই। চোখ
ভরে ওঠে পানিতে। সারা জীবন কত শত সাফল্য ও ব্যর্থতার পেছনে ছুটেছি। জীবন ভরে আছে
কত যে পাওয়ার আনন্দ, কত যে না পাওয়ার আফসোসে। মনে হল আজ জীবনের সব পাওয়া এইযেন
পেয়ে গেছি।
এই একটা
মুহুর্তে কোলে সন্থান নিয়ে আমি শুধু কিবলার দিকে তাকিয়ে মহান আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা
জানাই। আর নিজেকে বলি- স্রষ্টার তরফ হতে সেরা সম্পদটা পেলাম আজ।
টকটকে লালচে ধবল এই নবব্জাতক এত ছোট ছিল যে ওজন
মেপে দেখা গেল মাত্র সাড়ে পাঁচ পাউন্ড। আমার দুই হাতের পাতায় যখন শিশুটিকে রাখলাম
মনে হল এক ছোট্ট বিড়াল ছানা যেন তার দুই হাত ও দুই পা নাড়াচাড়া করছে। শিশুটি আকারে
ও ওজনে এত ছোট্ট হবার কারন তাকে উদরে ধারন করে মা ডাঃ নুরজাহান পর্যাপ্ত বিশ্রাম
নেওয়ার সুযোগটুকু পান নি। চিকিৎসা কাজে শশব্যস্ত সময় কাটানোর ধাক্কাটা এসে পড়েছে
উদরে বেড়ে উঠা বাচ্চাটির উপর।
এই শিশুটি
সত্যিই ভাগ্যবান কারন জন্মমাত্রই সে তার স্নেহভাজন দাদা-দাদি ও নানা-নানি এই চার
আপনজনকে সামনে পেয়ে যায়। আর আমিও তার এই শূভ জন্মদিনেই সুদীর্ঘ ছয় বছর হতাশাভরা
অপেক্ষার পর চাকুরী জীবনের প্রথম প্রমোশন পেয়ে জুনিয়র অফিসার হতে অফিসার হই।
আল্লাহর অপার মেহেরবানিতে নবজাতক
একটু কম ওজন এবং ছোট্টতনু নিয়ে জন্ম নিলেও
সে ছিল সম্পূর্ন সুস্থ ও ক্রুটিমুক্ত।
আমার অনুজ
নিশাত আমার লন্ডনের ভাতিজা আজফারের নামের সাথে মিলিয়ে নবজাতকের নাম জেফার রাখার
প্রস্থাব করেন। নামটির কোন ভাল অর্থ খুজে না পেয়ে
ডাঃ নুরজাহান কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলেও অনাপত্তি করেননি। স্কুলে ভর্তিকালে
বাপচাচার নামের সাথে মিলিয়ে তার পুর্ন নাম রাখা হয়- চৌধুরী জেফার রহমান কুরেশী।
জেফারের
জন্মের পরদিন বন্দরবাজারের পুবালী ব্যাংক লিমিটেড সিলেট শাখা ও আঞ্চলিক অফিসে
মিষ্টি বিতরন করে সবার কাছ হতে প্রথম পিতা হবার অশির্বাদ গ্রহন করি। মিষ্টি খেয়ে
দুই অফিসে আমার হিতাকাংখিরা নবজাতকের মঙ্গল কামনা করে দোয়া করেন।
২৮ জানুয়ারি
১৯৯৭ লন্ডনে আমার অগ্রজ তাহমিদ চৌধুরীর কন্যা নওশিন জন্মগ্রহণ
করে। নওশিনের জন্মের দুইএক সাপ্তাহ পর কোন এক ছুটির দিনে দাউদপুরের বাড়িতে জেফার ও
নওশিন এই দুই ভাইবোনের একটি সম্মিলিত আকিকা অনুষ্টিত হয়। আকিকার আগেরদিন দাউদপুরের
বাড়ি গেলাম। রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা ও কুয়াশা ঝরল, এই হীমঠান্ডা ঘরের ছাদের টিন বেদ
করে যেন ভিতরে প্রবেশ করল। জেফার তার ছোট্ট দুইপায়ে লাতি মেরে উপরের চাদর সরিয়ে
ফেলত। অনবরত হাতপা ছুড়াছুড়ি করত। আমি সারারাত জেগে জেগে তাকে পাহারা দিলাম। তার
তুলতুলে গাত্রের উপর হতে চাদর সরামাত্র আবার ডেকে দিতাম। এভাবে তাকে ঠান্ডার
আক্রমন হতে সারারাত নিরাপদ রাখলাম। এইরাতে শীতটা এত বেশী পড়েছিল যে মনে হল গরম
চাদর ফোড় করে এই শীত শরীরে ডুকে কাপুনি তুলে দিচ্ছে। আমার আম্মা আসমতুন্নেছা
বললেন- এটা বিদায় শীত, শীতকাল চলে যাবার আগে এভাবে একবার প্রচন্ড ঝাঁকুনি মেরে
জানান দিয়ে যায়- এই বছরের মত বিদায় নিচ্ছি, বাই।
সব কাজে
আম্মার ছিল খুব অস্থিরতা । এই শীতার্থ রাতে ভোরের আজানের সময় ঘুম হতে উঠে তিনি
তিনটি খাসী জবেহ করান এবং কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর হতেই রান্নার কাজ আরম্ভ করান। বড়
পুকুরের মাছও রান্না করা হয়। পরদিন এই আকিকা অনুষ্টানে দেশের সব আত্মীয়স্বজন এসে
গ্রামের বাড়িটিকে সরগরম করে দেন।
জরি ও মিনা
দুইবোন, তাদের বাড়ি হাজিপুর, কানিহাটি, কুলাঊড়া। তাদের মা ছিল নির্বাক এক
অস্বাভাবিক মহিলা। দুই মেয়েশিশু নিয়ে গাঁয়ের এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াত। আহার
নিদ্রার কোন স্থায়ী ঠিক ঠিকানা ছিলনা ওদের। এই
দুই শিশুবোনের কষ্টকর জীবন দেখে আমার মেঝবোন সেহা তাদেরকে আমাদের দাউদপুরের বাড়িতে
পাঠিয়ে দেন। আম্মা বেশ যতনে এই দুই শিশুকে লালন পালন করেন। আকিকা শেষে শহরে ফেরার
সময় আম্মা তার পালিত এই দুইয়ের মধ্যে ছোটবোন জরিকে আমাদের সাথে সিলেটে পাঠান। জরি
তখন নয় দশ বছরের বালিকা। বাসায় আলাদা কাজের লোক থাকায় জরির দায়িত্ব ছিল কেবল
জেফারকে দেখাশুনা করা। সে জেফারকে কোলে নিয়ে হাটত ও খেলা করত।
সিলেট
ওসমানী মেডিকেল কলেজের একটু আগে ডানদিকে একটি রাস্থা প্রবেশ করেছে। একটু ভিতরে ঢুকলে
একটি সুন্দর দিঘির দেখা মেলে, যার চারপাশ দিয়ে
পাকারাস্থা। দিঘির উত্তর ও দক্ষিণ পারে দুইঘাটে
সারাদিন লোকেরা গোসল করত। প্রতি বছর এইদিঘির উত্তরের জলে বিশাল ভাসমান মঞ্চ তৈরি
করে মহা আড়ম্বরে স্বরস্বতী পুজা হত। পুজার লাইটিং দিঘির জলে প্রতিফলিত হয়ে চারপাশে
আনন্দ ছড়ায়ে দিত। খুবসম্ভব এই পুজামঞ্চটি হত সিলেটের
কারুকার্যময় সেরা আয়োজন। দিঘি পেরিয়ে ভিতরে রাধারানী পাঠশালা ও
হিন্দু মুসলিম জনতার এক সম্মিলিত ঘন মানববসতি। এই দিঘির
পুর্বপাশেই ছিল আমাদের ভাড়া বাসা ৪৬, কাজলশাহ। বিয়ের পর এই বাসায় আমাদের জীবনের
সাতটি বছর পার হয়। এই বাসায় পুত্র জেফারেরও বাল্যকাল অতিক্রম হয়।
আমাদের
সামনের বাসায় আসেন আমার মদন মোহন কলেজের ডিগ্রি ক্লাশের সহপাঠি
প্রভাষক আমিনুন নুর। জেফারের বয়স তখন সাত আট মাস, একদিন জরি তাকে কোলে করে সামনের
এই বাসায় নিয়ে যায়। বাসাটির কার্নিশে ছিল বোলতার চাক। দুষ্ট ছেলেরা ডিল ছুড়লে
বোলতা এসে জেফারের নরম ত্বকে কামড় বসিয়ে দেয়। রাতে তার জ্বর আসে, দুএক দিনেই সে
সুস্থ হয়।
জেফারের
আরেকবার জ্বর হয়, সারারাত কান্নাকাটি করে। খুব ভোরে আমি গাড়ি চালিয়ে ছুটলাম
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মশিউদ্দিন স্যারের পুরান মেডিকেলের সরকারী বাসায়, তিনি
আমার পত্নীর মেডিকেল কলেজ জীবনের শিক্ষক। হয়ত এইমাত্র ঘুম হতে জেগেছেন, তবুও
বিরক্ত না হয়ে তিনি সযতনে দেখে চিকিৎসা দেন। আমরা অধ্যাপক মশিউদ্দিন স্যারের কাছে
ঋনী, কারন ছেলে অসুস্থ হলেই তিনি তাকে নিঃস্বার্থ চিকিৎসা সেবা দিতেন।
আরেক রাতে
জেফার সন্ধ্যার পর তীব্র বিরামহীন কান্না শুরু করলে তার মা ডাঃ নুরজাহান নিজে
পরীক্ষা করে কান্নার কোন উৎস খোঁজে না পেয়ে ভাবলেন হয়ত কানের ব্যথায় কাঁদছে। এবার
রাত একটায় গাড়ি চালিয়ে ছুটে গেলাম নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ মাসুকুর রহমান ভাইয়ের
বাসায়। প্রায় অর্ধশত রোগী দেখে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে ঘরে ফেরা মাশুক ভাই তার ভরাট
গলায় গল্পকরে হেসে হেসে আমার ছেলেকে মনযোগ দিয়ে দেখলেন। তিনি আজ আমাদের সাথে
নর্থইস্ট গ্রুপের পরিচালক।
জেফার
দুইহাত ও দুইপায়ে কয়েক মাস হামাগুড়ি দিল, তারপর ছোট্ট করে গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে
শিখল। ঘরের মেঝেতে এদিক ওদিক মহানন্দে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হেসে খেলে হেটে বেড়াত। সে
সব সময় তার মায়ের কাছে কাছে ঘুরঘুর করত, মাকে না পেলে কান্না জুড়ে দিত। তাকে ঘরে
ফেলে রেখে অফিসে কিংবা ক্লিনিকে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এম্বুলেন্সের আওয়াজ
শুনলেই বুঝে ফেলত তার মা বেরিয়ে যাবেন। তাকে পাশের ফ্ল্যাটের কালো খালাম্মার কাছে
রেখে কিংবা কোন খেলনা হাতে ধরিয়ে খেলায় ব্যস্ত রেখে গোপনে বেরিয়ে যেতে হত। যখনি
বুঝত তার মা নেই, দৌড়ে দৌড়ে সবগুলো কোঠায় মাকে খোঁজে ফিরত, তাকে নাপেয়ে তখন ভীষণ কান্না জুড়ে দিত। ঘন্টা
খানিক চিৎকার করে কেঁদে তারপর ক্লান্ত হয়ে থেমে যেত।
জেফারের
বৃদ্ধনানা তখন মোঠা শরীরে পেইন নিয়ে খানিকটা অসুস্থ্য ছিলেন ও বেতের সোফায় বসেবসে
সময় কাটাতেন। জেফার একটি কঞ্চি হাতে নিয়ে একদিন চেয়ারে বসা তার নানাকে বারবার আঘাত
করে যন্ত্রনা দিচ্ছিল। তিনি ধমক দিলে সে উত্তেজিত হয়ে তাকে আর বেশি বেশি আঘাত করতে
থাকে। আমি এসে তখন তার হাতের কঞ্চি কেড়ে নিয়ে দূরে ফেলে দেই। ওমনি সে কান্না
চিৎকার দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে সে নীলবর্ন ধারন করে।
ডাঃ
নুরজাহান তাকে কোলে নিয়ে যখন দেখলেন পাচসাত মিনিটেও নিঃশ্বাস ফিরছেনা, তখন
উচ্চশ্বব্দে কান্নাজুড়ে ছেলেকে আমার শ্বাশুড়ি মলিকা খাতুনের হাতে তুলে দেন। এইদিন
আমার গোদরালি পরগনার ধরাধরপুরের ফুফু শ্বাশুড়িও আমাদের বাসায় ছিলেন। সবাই যখন
ধারনা করছেন শিশুটির হয়ত নিঃশ্বাস আর ফিরবেনা, কেমন করে বাচ্চাটি তখন হঠাৎ হালকা
গুঙ্গানি দিয়ে আবার নিঃশ্বাস টেনে নিল।
এইদিন এই
সদ্যহাটা শিশুটি পরম করুনাময় ও দয়াময় আল্লাহতায়ালার মেহেরবানিতে খুব অল্পের জন্য
মৃত্যুর দোয়ার হতে ফিরে আসল। সেইদিন অবোধ ছেলের সাথে এমন আচরনের জন্য আমার দুইচোখ
জুরে প্রচুর পানি ঝরল। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আমার এই একমাত্র পুত্রকে আর কোনদিন ধমক
দেবনা।
সেইদিন
রাত্রে বিছানায় ঘুমাতে গেলে আমার চোখে ঘুম আসলনা। বারবার দিনের ঘটনা মনে পড়ে আমাকে
কেমন যেন চমকে দিল। বিশ্বাস হচ্ছিলনা আমার বাচ্চাটা কেমন করে বেঁচে উঠল। ছেলের
জীবন মহান আল্লাহ আমাদেরকে ভিক্ষে দেওয়ায় বিছানায় শুয়ে দুইচোখ সিক্তকরে আল্লাহর
প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গভীর রাত পেরিয়ে শেষরাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম মনে নেই।
এই আতঙ্কময় ঘটনার স্মৃতি আজও মনে হলে আমি শিহরিত হয়ে উঠি, মনে হয় কেমন করে যেন
আমার ভবিষ্যৎ বংশধারা বিলুপ্ত হবার হাত হতে আল্লাহর রহমতে রক্ষা পেয়ে গেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন