স্টুডেন্ট ভিসায় বৃটেন গমনে ছাত্রছাত্রীদেরকে সহায়তা প্রদান প্রসঙ্গঃ
ব্যাংকিং
পেশার ভিত্তি সুদের উপর স্থাপিত হলেও আমার মনে হত, এটা একটি মহৎ পেশা। ঝুঁকি নিয়ে
একজন ব্যবসায়ীকে ১০০/- টাকা ঋণ দিয়ে
ব্যাংক সারাবছরে মাত্র ১০/১২ টাকা সুদ নেয়, যাহা আমার কাছে কোনমতেই শোষন মনে হয় না।
যে ব্যক্তি ব্যাংকের টাকায় ব্যবসা করে এই মাত্র ১০/১২ টাকা সুদ পরিশোধ করতে পারে না
তার ব্যবসা না করাই ভাল।
দেখলাম
ব্যাংকে বসে দেশ ও দশের জন্য অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। বাংলাদশের সবচেয়ে বড়
সমস্যা বেকারত্ব ও দারিদ্রতা। ব্যাংক পুঁজি সরবরাহ করে অনেক খামার, শিল্প কারখানা,
উৎপাদন, সেবা ও ব্যবসা প্রতিষ্টান গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ফলে দরিদ্রতার সাথে
বেকারত্ব কমে আসে। আমার মনে হত এটা আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরী
কাজ, যেটি আমরা অফিসে বসে করে থাকি।
মানুষ
বিদেশে গেলে বেকারত্ব কমে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে। একজন মানুষের
জীবনেরও একটি স্থায়ী গতি হয়। আমার মাবাবার কাছে এসে সবাই সাহায্য পেত, তাই আমার
কাছে কেউ এসে একেবারে শূন্যহাতে ফিরে যাক তা আমার মন চাইতনা। আমার বন্ধু সিদ্দিকুর
রহমান নির্ঝর আমার সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসএস করে দক্ষিণসুরমা
উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। কিন্তু তিনি যে সামান্য বেতন পান তাতে তার পোষায়না। আমি
১৯৯৭ সালে তার ছোট্ট সাইনবোর্ড সর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্টান ‘সবুজসাথি’ লাইব্রেরির
হিসাবে ছয়মাস আমার নিজের অনেক টাকা রেখে লেনদেন করলাম। এই ব্যাংক বিবরণী
দেখিয়ে তিনি সহজেই বৃটেনের মাল্টিপুল ভিসা পেয়ে গেলেন। সিলেট শাখার আমার সহকর্মি
নজরুল ইসলামের পূত্র অস্ট্রেলিয়ার একটি কলেজে ভর্তি হল, আমি তার হিসাবে টাকা
রাখলাম। এই টাকা দেখিয়ে সে ছাত্র ভিসা পেয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। ঈদগাহ শাখায় আসার
পর পরিচিত অনেক লোকজন বিভিন্ন সময় এব্যাপারে আমার স্মরণাপন্ন
হলে তাদেরকে আমি সাহায্য করতাম।
পুবালী
ব্যাংকে আমি সামান্য বেতনের চাকুরী করলেও আমার চিকিৎসক পত্নী নুরজাহান বেগম
চৌধুরীর সৌজন্যে মহান আল্লাহ আমার হাতে প্রচুর অর্থের সমাবেশ ঘটাতেন। ছোটখাট
ব্যবসায়ও লাভ হত প্রচুর। আমার মনে হত দয়াল আল্লাহ এমনি এমনি আমাকে অকাতরে এতএত
টাকা হাতে তুলে দিচ্ছেন, জীবনে কারও কাছে তিনি আমাকে মুখাপেক্ষি হওয়া থেকেও সযতনে
বাচিয়ে রাখছেন।
একমাত্র
পূবালী ব্যাংক ছাড়া অন্য কোথায়ও আমার কোন ধারকর্জ নেই। আল্লাহের
অপার মেহেরবানিতে কারও কাছে আমাকে কখনও ঋন কিংবা
সাহায্যের জন্য হাতপাততে হয়নি। আমার যা চাওয়া পাওয়ার আছে সবই যেন এক সর্বশক্তিমান
স্বত্তা দেখতাম তার অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে যথাযত সময়ে আমাকে এগিয়ে দিচ্ছেন। সেই
দয়াময়ের প্রতি কৃতঞ্জতা প্রকাশের অংশ হিসাব তার কোন বান্দা আমার কাছে বিপদে পড়ে
আসলে কিংবা আমার সাধ্যে কুলায় এমন কোন সহায়তা চাইলে আমি কখনও তাকে ফিরিয়ে দিতাম না।
এপ্রিল ২০০৯
সাল, আমি শাহী ঈদগাহ শাখায় বসে আছি। হঠাৎ আমাদের কালিঘাট শাখার ব্যবস্থাপক মাহবুব
আহমদের ফোন বেজে উঠল, তিনি বললেন, কুরেশী তুমি আমার একজন আত্মীয়কে একটু সাহায্য
করতে পারবা? আমি বললাম কিসের সাহায্য? উত্তর পেলাম, জকিগঞ্জ হতে আমার একজন আত্মীয়
এসেছে, সে লন্ডনে একটি কলেজে ভর্তি হয়েছে তার স্পন্সর প্রয়োজন। আমি অনেক চেষ্টা
করেও তাকে সাহায্য করতে পারিনি। তার হিসাবে দশবার লক্ষ টাকা মাসদিনের জন্য রাখার
কোন ব্যবস্থা করে দিলে সে খুব উপকৃত হবে। মাহবুব সাহেবকে ‘পরে জানাবো’ বলে আমি
টেলিফোন রেখে দিলাম।
এই ছাত্রটার
ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হয়। দুই একদিনের মধ্যে স্কয়ারফার্মার শেয়ার বিক্রি করে
প্রচুর লাভসহ প্রায় ৩৩লক্ষ টাকা আমার হাতে এসে পড়ে। পরদিন অফিসে গিয়ে মাহবুব
সাহেবকে বললাম, ছেলেটাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও, দেখি কিছু করা যায় কিনা। একদিন সকালে
এই ছাত্রটি আমার অফিসে এসে হাজির হল। সে
আমাকে মাহবুব সাহেবের সাথে মোবাইলে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল তার হিসাবে ১২,৬০,০০০/- টাকা
একমাসের মত রাখলেই চলবে। আমি এই ছাত্রটির নামে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলে ১১লক্ষ টাকা
আমার তরফ থেকে জমা করে দিলাম। ছাত্রটি বাকী প্রয়োজনীয় টাকা জমা রেখে দুই একদিন পর
এসে ব্যাংকের সঞ্চয়ী সনদপত্র এবং হিসাব বিবরনী নিয়ে গেল।
দশবার দিন
পর এই ছেলেটি অফিসে এসে এক আনত সালাম দিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ। আমি
আপনার প্রতি খুব কৃতঞ্জ, আপনি সাহায্য করায় আমি সহজে ভিসা পেয়ে গেছি। আমি সারা
মুল্লুক ঘুরে কা’রো সাহায্য পাইনি। আপনি আমার আত্মীয় প্রতিবেশী কিছুইনা অথচ আমাকে
হেল্প করেছেন, আপনাকে আমি কি বলে যে কৃতঞ্জতা জানাবো ভাষা খুজে পাচ্ছিনা। তাকে
বললাম, আমি আপনাকে সাহায্য করিনি, মহান আল্লাহ আমাকে দিয়ে আপনার এই কাজটি সহজ করে
দিয়েছেন, কাজেই আমাকে নয় মহান আল্লাহকে কৃতঞ্জতা জানান।
এই ছাত্রটি
আমাকে জানাল, বৃটেনে এখন রিসিশন (মহামন্দা) চলছে তাই তাদের কলেজগুলো ছাত্র
পাচ্ছেনা। ফলে তারা সহজেই ছাত্র ভিসা দিচ্ছে।
আগামি জুন সেমিস্টারে এভাবে সহজে ভিসা দেবে, তারপর এই সুযোগ হয়ত বন্ধ
হয়ে যাবে।
আমি ঈদগাহ
শাখায় এসেই মেসার্স কামাল এন্টারপ্রাইজের মালিক রাজনগরের কামাল ভাইকে একটি বড় সিসি
ঋণ বরাদ্ধ করে দেই। তার এক ভাগনা লেখাপড়ার ফাঁকে তার
মামাকে ব্যবসার কাজে সহায়তা করত। সে আমাকে মামা বলে ডাকত। পাশে বসে সে আমাদের এই
আলাপ শুনছিল। ছাত্রটি চলে যাওয়া মাত্র কামাল ভাইয়ের ভাগনা বলল, মামা আপনি আমাকে
যদি অনুরূপ সাহায্য করেন, তাহলে আমি ছাত্র ভিসা নিয়ে লন্ডনে চলে যাব। আমার হাতে
প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা তখন অলস পড়ে আছে, তাই আমি স্বভাববসতঃ তাকে ‘না’ বলতে পারলাম
না। আমি তাকে বললাম লন্ডনে ভর্তি হয়ে এসো, তারপর দেখা যাবে।
জিন্দাবাজারের
একটি ফার্মের মাধ্যমে এই ভাগনাটি সহজেই বৃটেনের একটি কলেজে ভর্তি হয়ে আমার কাছে
ছুটে আসল। আগের ছাত্রটির মত আমি তাকে আমার নিজের পকেটের টাকা দিয়ে তাকে সাহায্য
করলাম। জালালাবাদ গ্যাসে চাকুরী করেন এমন একজন লোকের পূত্র ছিল এই ভাগনার বন্ধু,
দুই একদিন পর এই বন্ধু কামাল ভাইয়ের ভাগনাকে নিয়ে আরেকটি স্পন্সারের জন্য আমার
কাছে ধর্না দেয়। আমি একটু গড়িমসি করলেও তাদের অনুরোধের ঠেলায় পড়ে আবার আমার হাতের
টাকা তার হিসাবে রাখলাম। দুই বন্ধু মিলে একদিন ভিসা আনতে যায়। ভাগনা ভিসা পেয়ে গেলেও
তার বন্ধুটি আপিলে পড়ে। তবে দশবার দিন পর সেও ভিসা পেয়ে গেল। এবার
দুই বন্ধু খুশিতে আটকানা হয়ে মিষ্টির পকেট নিয়ে আমার অফিসে ছুটে আসে।
তারা দুইজন বলল, মামা আপনি মানুষকে মাগনা সাহায্য করছেন, কিন্তু দেড়দুই লক্ষ টাকা
দিয়েও কেউই সারাদেশে স্পন্সার খুঁজে পাচ্ছেনা। মামা, আল্লাহ আপনার মঙ্গল
করুন।
ফেন্সুগঞ্জ
সারকারখানায় চাকুরী করতেন একজন ভদ্রলোক। আমার
ভাগনার মাধ্যমে তিনি এবার তার দুইজন পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে আমার দরবারে আসলেন। এই
ভাইবোন যুগল বয়সে টিন এজ। আমি তাদের মধ্যে লন্ডন যাত্রার এক সুতীব্র উম্মাদনা
দেখতে পেলাম। ইতিমধ্যে আমার পুর্ব প্রদত্ত টাকা ফেরত আসলে তাদেরকে দেবার মত অর্থ
আমার হাতে এসে যায়। তাদের দুইজনকে আমি সাহায্য করলাম এবং ভাইবোন দুজনই অল্প সময়ে
একসাথে ভিসা পেয়ে গেল।
নর্থইস্ট
মেডিকেল কলেজ এন্ড সার্ভিসেসের তেলিহাওর ইউনিট ১৯৯৬ সালে আরম্ভ হয়ে ২০১০ সাল
পর্যন্ত প্রায় চৌদ্দ বৎসর চালু ছিল। আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী এখানে
গাইনি বিভাগে সুচনা হতে শেষ পর্যন্ত কাজ করে যান। হবিগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ের তার
সহপাঠিনী হোসনা খানম এখানে প্রায়ই আসতেন। তার পতি টেকনিকেল কলেজে চাকুরী করতেন।
তাদের সুরমাপারের সরকারী বাসায় প্রচুর তরিতরকারি, শাক সবজি এবং ফলমূল হত। এই
স্নেহশীলা যামিনি তার কৌশরবান্ধবী এবং সহপাঠিনী ডাঃ নুরজাহান বেগমকে নিজহাতে ফলানো
ফসলের অংশ উপহার না করে নিজে ভক্ষণ করতেন না।
একদিন এই হোসনা বোনের ছেলে পলাশ আমার অফিসে এসে খালুর কাছে স্পন্সারের জন্য ধর্না
দিল। তার বাবার ছোট চাকুরী, কোন সঞ্চয় নেই। আমি একদম
নিঃস্বার্থভাবে তাকে স্পন্সর দিয়ে সাহায্য করলাম। আমি সাহায্য না করলে
সে কোনমতেই স্পসর জোগাড় করতে পারতনা এবং তারপক্ষে লন্ডন যাওয়াও সম্ভব হতনা। সে
লন্ডনে গিয়ে কৃতঞ্জতা প্রকাশে অনেকবার আমার বাসায় টেলিফোন করে।
আমার শাখার
শিক্ষানবিশ অফিসার জকিগঞ্জের কাওসার আহমদের দুই ভাইকে স্পন্সর দেই। দুইজনই লন্ডনে
চলে যায়। অফিসে আমার সেকেন্ডম্যান মতিউর রহমানের পূত্রকেও সম্পূর্ন ফ্রি সহায়তা
করি কিন্তু সে ভিসা লাভে ব্যর্থ হয়।
আমার নিজের
গাঁটের টাকায় এই জনসেবা করে এবার দারূন বিপদে পড়লাম। দলে দলে ছাত্র ছাত্রিরা এসে
আমার অফিস এবং বাসা ঘিরে ফেলল। সবার দাবী একটাই, স্যার আমরা যুক্তরাজ্য যাবো, আপনি
দয়া করে আমাদেরকে স্পন্সার দিন। এতসব নাছুড়বান্দারা কাটালের আটার মত আমার অঙ্গে
লেপ্টে গেল। এদিকে একটি ওভার ড্রাফট ঋণ নিয়ে ভাতিজা আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী আমাকে
বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
ইদগাহ শাখায়
আমার ম্যানেজারির তিন বছরই টার্গেটের দুইগুন তিনগুন করে লাভ হয়। ২০০৯ সালের ৩১
ডিসেম্বরের লাভের টার্গেট এতই বেড়ে গেল যে তা অর্জন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।
গেয়ে গেয়ে নিজের প্রশস্তি সবার কাছে গাওয়ার চেয়ে আমি নিরবে কাজের মাধ্যমে আমার
সক্ষমতা প্রকাশ করতে ভালবাসতাম। কেঊ ঈর্ষা করলে কিংবা ভুল বুঝলে আমি কখনও তার ধার
ধারতাম না।
একটা ছাত্র
কিংবা ছাত্রি লন্ডনে গেলে একটা মধ্যভিত্ত কিংবা নিম্নভিত্ত পরিবার বেঁচে যায়। এতে
দেশ ও দশের বর্ননাতীত উপকার হয়। যে যাই মনে
করুক না কেন আমার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ তা হল নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য কাজ করে
যাওয়া। ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের ব্যাংক শাখার লাভের টার্গেট অর্জনে এবং লন্ডনগামী
ছাত্রদেরকে ভিসা প্রদানে সহায়তা করতে আমি দৃঢ়প্রতীঞ্জ হই, কারন একাজ আমার জন্য
মানবতার সেবা ও দেশ সেবাই প্রতিপন্ন হল। এবার নিরবে ধ্যানে বসে বৃটেনের এই মহামন্দার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য
প্রদত্ত সুযোগটা আমার দেশের বেকার ছাত্রদের আমি বেশী করে কিভাবে পৌছে দিতে পারি,
তার একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করি।
ইদগাহ শাখায়
ব্যবস্তাপক হবার পর আমার অনেক আত্মীয় কুটুমকে ডেকে এনে এখানে এফডিআর করাই। আমার
কুমারপাড়া ঝর্নারপারের খালা মরিয়মুন্নেছাকে দিয়ে চল্লিশ লক্ষ টাকা এবং আরামবাগের
চাচাত ভাই ফজলুর রহমান কুরেশীকে দিয়ে পঞ্চান্ন লক্ষ টাকার দুটি এফডিয়ার কোন এক সময়
আমি করিয়ে ছিলাম। আমার বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান
নির্ঝরের বোনের একটি এফডিয়ার আমার হাতে ছিল। সে সময় পুবালীর এফডিয়ার লিয়েন করে ঋণ
প্রদানের ক্ষমতা ব্যবস্থাপকের হাতে ছিল। আমি তাদের অনুমতি নিয়ে এই এফডিয়ার তিনটি
লিয়েন করে একটি ওভার ড্রাফট সীমা তৈরী করি। এখান হতে অনেক ভিসাপ্রার্থি ছাত্রছাত্রীর
সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা জমা করে তাদেরকে সহায়তা করি।
ইতিমধ্যে
সিলেটে ছাত্রভিসা নিয়ে লন্ডনে যাবার এক মহাধুম লেগে গেছে। এবার স্পন্সরের জন্য
আমার অফিসে ভীড়, বাসায় ভীড়, রাস্থায় ভীড়, মসজিদেও ভীড় লেগে গেল। এমন কি বাথরূমে
লুকিয়েও পার পাবার পথ রইলনা। খবর আসল লন্ডনে গিয়ে এসব ছাত্রছত্রিরা বেশ কষ্ট করছে,
ইস্ট লন্ডনের মসজিদের মেঝে শুয়ে রাত কাটাচ্ছে। মন্দার কারনে লন্ডনে তখন
কর্মসংস্থান বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। আমি সবাইকে ভেবে চিন্তে লন্ডনে যাবার পরামর্শ দিলে
এসব ছাত্রছাত্রি ও তাদের অভিভাবকের দল কিছুই শুনতে রাজী হল না। আমি
আর বললাম লন্ডনে গিয়ে সমস্যায় পড়লে আমাকে অভিশাপ দিতে পারবেনা। এতকিছু জানানোর পরও
তাদের একটাই আবদার, লন্ডনের কষ্ট আরাম যাই হোক এসব আমাদের ব্যাপার, আপনি আমাদেরকে
স্পন্সর তৈরি করে দেন। মনে
হল এসব তরুনেরা যেন আগুনে ধাবমান পতঙ্গের দল, তারা পুড়ে মরবে, অথচ ফিরবে না।
তাদের ধাওয়া
খেয়ে নিদারুণ যন্ত্রনায় একবার মনে হল কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে দূর
কোথাও পালিয়ে যাই। না, আমি একজন ক্ষুদে ব্যাংকার ইসফাক কুরেশী ইচ্ছে করলেও আমার পক্ষে ব্যাংক হতে পালানোর পথ নেই। এবার
আমার প্রতিবেশী চাচাতো ভাই মইন উদ্দিন কুরেশীর(আনজির) স্মরণাপন্ন
হলাম। তিনি আম্বরখানায় একটি পাচতলা মার্কেটের মালিক। এই মার্কেটে ইউসি বিএলের কাছে
তিনি তাদের আম্বরখানা শাখা অফিস ভাড়া দেন। এই ব্যাংকে তার দুইকোটি টাকার একটি
এফডিয়ার ছিল। আমি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ২০লক্ষ টাকার ১০টি এফডিয়ার নিয়ে এসে ইউসিবিএল
হতে লিয়েন করে ৮০% অর্থাৎ আর এককোটি ষাটলক্ষ টাকা ছাত্রদেরকে প্রদানের ব্যবস্থা
করলাম। ইহা এমন এক ধরনের ঋণ যে ডানহাতে
ঋণ তুলে বামহাতে রাখা এবং ছাত্রভিসা হয়ে গেলে বামহাত হতে
ডানহাতে ফিরিয়ে নিয়ে ঋণ সমন্নয় করে ফেলা। এই ফাঁকে ব্যাংক
হাজার হাজার টাকা সুদ অর্জন করে তার লাভের ভান্ডার স্ফীত করে তুলে।
আমি সিকিউরিটি
রেখে ঋণ তৈরি করে দিলেও সিলেট স্টেডিয়াম
শাখাসহ কিছু শাখার ব্যবস্থাপক কোন সিকিউরিটি না রেখেই কেবল ছাত্রদের সঞ্চয়ী
হিসাবের স্থিতি লিয়েন দেখিয়ে স্পন্সর করে দেন। বিষয়টি কতৃপক্ষের নজরে এলে এক
হুলুস্থুলু কান্ড আরম্ভ হল। আমাদের উর্ধতন কতৃপক্ষের এসব কান্ড দেখে মনে হল, আমি
যেন ব্যাংকের সব টাকা তুলে আমার নিজের পকেটে পুরে ফেলেছি। কিছু ঈর্ষাকাতর লোক বলল,
আমি অফিসে বসে ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছি।
স্টেডিয়াম
শাখার সুদর্শন ব্যবস্থাপক মোঃ সাইফুল ইসলাম কোন সিকিউরিটি ছাড়াই কিছু ছাত্রকে
স্পন্সর দিয়ে বিপদে পড়েন। আপদের গন্ধ পেয়ে তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ
মজুমদারের পিএ লোকমান উদ্দিন চৌধুরীকে ধর্ণা দেন। এই
সময় কোন এক ছুটির দিনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী সিলেটে এসে আমাদেরকে
স্টেডিয়াম শাখায় সমবেত করলেন। এখানে এক ভাষণে তিনি বললেন, আমি ঢাকায় ফিরে গিয়ে
সঞ্চয়ী হিসাবের স্থিতি লিয়েন করে ছাত্রদেরকে ঋণ
প্রদানের একটি নীতিমালা তৈরি করে শীঘ্রই পাঠিয়ে দেব। শীঘ্রই এই নীতিমালা আসল,
কিন্তু আমাকে নির্দেশ দেওয়া হল আমি একটি ছাত্রকেও যেন আর কোন স্পন্সর ইস্যু না
করি। ডিজিএম ফরিদ উদ্দিন স্যারের এই কঠোর আদেশ পেয়ে এতদিনের রণক্লান্ত আমি বললাম,
আলহামদুলিল্লাহ। আমি বাঁচলাম, আমাকে জ্যোকের মত খামচে ধরা
লোকজনকে স্টেডিয়াম এবং সিলেট শাখায় তাড়িয়ে দিয়ে বহুদিন পর শান্তিভরে ঘুমাতে গেলাম।
কিন্তু
ইতিমধ্যে বৃটিশ হাইকমিশন ছাত্র ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এই নীতিমালার
আওতায় যেসব অজস্র ছাত্রকে স্পন্সর করা হয়, তাদের তেমন কেঊই ছাত্রভিসা পায় নি।
অথচ আমার প্রদত্ত স্পন্সরের মাধ্যমে প্রায় ৯০% ছাত্রছাত্রী
ভিসা পেতে সক্ষম হয়। মনে হল, যে যাই বলুক মহান আল্লাহ জানেন আমার উদ্দেশ্য সৎ ও
মহৎ। আমি সফল হয়েছি, কারন আমার ঊদার সহায়তায় এতগুলো পরিবার আজ উপকৃত হয়েছে।
অযথাই আমাকে
হেনস্থা করার জন্য হেড অফিস এবং
আঞ্চলিক অফিসের অডিটারের দল ছুটে আসলেন। কিন্তু তারা কিছুই খুঁজে পেল না
যা অনিয়ম বলা যায়। হেডঅফিসের অডিটার এমদাদুল হক
এস পি ও ইউসিবিএলের দুইকোটি টাকা মূল্যের দশটি
এফডিয়ার নিয়ে সঠিকতা মিলাতে ছুটে যান তাদের আম্বরখানা
শাখায়। ফিরে এসে আমাদের প্রধান কার্যালয়ের
অডিট বিভাগের অডিটার এসপিও মোঃ এমদাদুল হক একটি একটি করে সব ফাইল পরীক্ষা করে
বললেন, এত হৈ চৈ শুনলাম অথচ এখানে আমি আপত্তিকর কিছুই দেখতে পেলাম না।
অন্যরা যেখানে কোন সিকিঊরিটি ছাড়াই ছাত্র ঋণ
দিয়েছে, সেখানে আপনি পর্যাপ্ত এফডিয়ার সিকিউরিটি লিয়েন করে ঋণ
প্রদান করেছেন।
এখন প্রশ্ন আসতে
পারে সিলেটের মাত্র দুইচার জন ব্যবস্থাপক কেন এই ছাত্র ঋণ
দিতে গেলেন। তার কারণ তখনকার সময় ৩৫ লক্ষ
টাকা হাতে অলস পড়ে আছে এমন কোন ব্যবস্থাপক কেউ ছিলেন না। এই ৩৫ লক্ষ
টাকা আসলে আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহানের বহুকষ্টে উপার্জিত আয় হতে সঞ্চয় যা আমি
শেয়ারে বিনিয়োগ করে আল্লাহর কৃপায় যথেষ্ট পরিমান বৃদ্ধি করে নেই। তাই এই প্রশ্নের
সহজ উত্তর আমার হাতে টাকা আছে তাই আমি ছাত্রদেরকে ফিরিয়ে দেই নি,
অন্যদের নিজের কোন টাকা নেই তারা কেমন করে ছাত্রঋণ
দেবে। আমার আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে ঈদগাহ শাখায় লাখ লাখ টাকার এফডিয়ার করিয়েছি, যে
এফডিয়ার আমার পক্ষে লিয়েন করে ঋণ
তৈরি করা সম্ভব হয়, যা করার এই সুযোগ ভিন
জেলা হতে আগত, এমন কি সিলেটি ব্যবস্থাপকদের আদৌ ছিল না।
আমার এই
ছাত্রভিসা পরিকল্পনা সুন্দরভাবে বাস্তবায়নের ফলে ২০০৯ সালের এপ্রিল হতে অক্টোবর
মাসের মধ্যে মোঠ ৭৪জন (চৌহাত্তুর) ছাত্রছাত্রী
বৃটিশ ভিসা পেয়ে লন্ডনে চলে গেল। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাকে একটিমাত্র পুত্র
সন্থান দিয়ে জীবন ধন্য করেছেন, কিন্তু আমার মাধ্যমে ৭৪টি মানব সন্থানকে একটি উন্নত
দেশে অন্তভুক্ত করে দিয়ে আমাকে যেন ৭৪জন সন্তানের জন্মদাতা বাবা হবার মত গৌরব দান
করেছেন। এত মানসিক চাপের মধ্যে থেকেও মনে হল এই ৭৪জন উদিয়মান তরুনের স্বপ্ন পুরনের
অংশীদার হতে পেরে আমার জীবন যেন সফল এবং স্বার্থক হল।
ছাত্রছাত্রী
ও ব্যাংকের স্বার্থে পূবালী ব্যাংকে আমি এই ছাত্রঋণের
সুচনা করলাম। পরে আমার এই চিন্তাধারা নীতিমালা করে এই ব্যাংকে স্থায়ীভাবে প্রচলন
করা হল। ব্যাংকের লাখ লাখ টাকা লাভ হল, অথচ আমাকে সহ্য করতে হল এক সাগর গঞ্জনা। আর
যারা পিছন হতে আমাকে
অনুসরণ করে এই ছাত্রঋণ
দিল, তাদের কোন অপরাধ হল না। সব দুষ,
নন্দঘোষ এই ইসফাক কুরেশীর কাঁধে চাপিয়ে আমাকে সিলেট শাখায় পাঠিয়ে দেওয়ার সিন্ধান্ত
হল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন