একটি
অংশীদার ব্যবসার অভিজ্ঞতা, একটি শিক্ষাঃ
২০০৬ সালে
এই প্রথম একটি ছোট্ট শরিকি ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ করে আমরা প্রায় পুরো টাকা হারাই।
সেই কাহিনী এখন আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরব। নর্থইস্ট
মেডিকেল কলেজে আমার গিন্নির সাথে
একসময় কাজ করতেন তরুন চিকিৎসক ডাঃ সজিব, তার বাড়ি ময়মনসিংহ। মেরিনোভা
ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনি একবার কোন এক রোগীর সাথের লোকজনের
হাতে অজ্ঞাত কারনে প্রহৃত হয়ে গুরুতর আহত হন। প্রচন্ড মারধর খেয়ে তার নাকমুখ দিয়ে
প্রচুর রক্ত নির্গত হয়। মেরিনোভার কর্মচারিরা তাকে নিয়ে পাশের ওসমানী মেডিকেল
কলেজের হাসাপাতালে ভর্তি করে দেন। আমি ও ডাঃ নুরজাহান হাসপাতালে তাকে দেখতে গেলাম।
কথাবার্তা বেশ মধুর ও আস্থায় রাখা যায় এমন একজন মানুষ তাকে আমার মনে হল। কয়েকদিন
হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্যহয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি।
একদিন ডাঃ
সজিব আমার ম্যাডামকে বললেন, নুরজাহান আপা আমরা কয়েকজন মিলে রিকাবিবাজারে
‘সেন্ট্রাল ডায়াগনেস্টিক সেন্টার’ নামে একটি ডায়াগনষ্টিক ব্যবসা সুচনা করছি, আপনি
একটা শেয়ার রাখলে আমরা খুশি হব। তাছাড়া এখানে আপনি আল্ট্রাসনোগ্রামও করতে পারবেন।
তিনি জবাব
দিলেন আমার সাহেবকে জানাবো, দেখি তিনি কি বলেন। সজিবের বারবার অনুরোধে আমি একদিন
রিকাবিবাজারে ব্যবসাকেন্দ্রটি দেখতে গেলাম। সিলেট স্টেডিয়াম মার্কেট হতে
লালাবাজারের পথে খানিকটা এগুলেই একটি তিনতলা ভবনের পুরো দুতলা ভাড়া নিয়ে খোলা হয়েছে
এই ‘সেন্ট্রাল ডায়াগনেস্টিক সেন্টার’ নামক ব্যবসা প্রতিষ্টান। আমি জরিপ করে দেখলাম
জায়গাটি এই ব্যবসার জন্য খুব উপযুক্ত, তাছাড়া এখানে অনেক চিকিৎসকও জড়িত। বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসক বসানোর জন্য অনেক কক্ষও রয়েছে। তাছাড়া সজিব বললেন ভবিষ্যতে পুরো
ভবনটি ভাড়া করে একটি হাসপাতালও করার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।
এই
ডায়াগনস্টিকটির শেয়ারটির মুল্যও তেমন নয়, মাত্র ১,২৫,০০০/= টাকা। আমি নানাদিক
বিবেচনা করে শেষপর্যন্ত একটি শেয়ার ক্রয়ের সিন্ধান্ত নেই। ২০০৬ সালের শেষের দিকে
প্রতিষ্টানটির উদ্বোধনের আগেই দুইটি চেকের মাধ্যমে ১২৫০০০/=টাকা পরিশোধ করে দিলাম।
প্রথম সভায়
বসেই মনে হল ভূল করলাম, এখানে ডুকা আদৌ ঠিক হয়নি। সজিব এই ব্যবসায় বেশ কয়েকজন
প্রবীন ব্যাংকারকেও নিয়ে আসে। প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপক সাঘরদীঘিরপারের মছরুভাই
তাদের একজন। প্রথম বৈঠকেই ডাঃ সজলের কথাবার্তায় অনেক স্বার্থপরতা ও আগের আলাপের
ভিন্নতা শুনতে পেলাম। সর্বমোঠ ২৮টা সমান শেয়ার ছিল, কিন্তু সজিবরা দুইটা বৃদ্ধি
করে ৩০টা করে ফেলে। সজিবের দাবি তিনি ও আর কে একজন নাকি প্রচুর পরিশ্রম করে এই
প্রতিষ্টান করেছেন তাই ২টি শেয়ার তারা উদ্যোক্তা হিসাবে বিনামূল্যে পাবেন। সভাজুড়ে
কেবল হাউমাউ, ঝগড়াঝাটি। মুরব্বী আমি ও নুরজাহান পড়লাম বিপদে, আমরা যেন এখানে
মারামারি ভাঙ্গাতে এসেছি। অনেক চিল্লাচিল্লির পর ২টা শেয়ার দুইজন অতিরিক্ত পেয়ে
যাবার সম্মতি পান, এই শর্তে তারা এই প্রতিষ্টান সর্বক্ষন দেখবাল করবেন। পরে বুঝলাম
কোন বিনিয়োগ ছাড়াই তারা ২৮টির মধ্যে ১টি শেয়ার ইতিপূর্বে মেরেছে, এবার কৌশলে
আরেকটি শেয়ার বাগিয়ে নিয়েছে। কোন বিনিয়োগ ছাড়াই ডাবল শেয়ারের মালিকানা। ইলিশের তৈল
দিয়ে ইলিশ ভাজার গল্প আগে অনেক শুনতাম, এবার শূন্য বাতাস দিয়ে ডাবল ইলিশ বাজতেও
দেখলাম।
এমবিবিএস
চিকিৎসক ডাঃ সজিব নিজেকে সার্জারি বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে আগ থেকেই এখানে রুগি
দেখতেন, ব্যবসা দেখবাল করতে গিয়ে তার যেসব রোগী তিনি এখানে পরীক্ষা করান, সব লাভ
কমিশন হিসাবে নিজের পকেটে পুরে দেন। শুক্রবারে ফ্রি সার্জারী রোগী দেখার একটি বড়
সাইনবোর্ড সামনের রাস্থায় টাঙ্গানো হয়। গরীব রোগী আসলে
ভিজিট ফ্রি কিন্তু এই মহান ডাক্তার সাহেব দুই আড়াই হাজার টাকার নানা
টেস্ট দিয়ে গরীবদের গলা কাটেন। কমিশন হিসাবে সব টাকাই তার হলুদ পাঞ্জাবীর পকেটে
নিয়ে যান। এখানে ডাঃ সজিবের বন্ধু স্বপন নামের
অনুরূপ চরিত্রের আরেকটি লোকও পরিচালক হিসাবে সক্রিয় ছিল।
আমি কোনদিনই
প্রতারনা সহ্য করতে পারি না। আমার বেগম সাহেবাও একজন চিকিৎসক কিন্তু তাকে টাকার
জন্য রোগীদের সাথে প্রতারনা করতে আমি কক্ষনো দেখি নি। আল্লাহ আমাদেরকে যে হালাল
রুজি দিয়াছেন, সেজন্য তাকে হাজার শোকরিয়া
জানাই। প্রতারণা করে লোক ঠকিয়ে রুজি করা হারাম টাকার
আমাদের কোন দরকার নেই। অনেক প্রাইভেট হাসপাতালে সুযোগ পেয়েও আমার চিকিৎসক পত্নী
শেয়ার রাখতে যান নি এই ভেবে যে এখানে অনেক রোগী এসে
ধারকর্জ করে, এমন কি ভিক্ষা করে এনেও বিল পরিশোধ করে। এই ভিক্ষার টাকাও এসব
হাসপাতালের ধনী মালিকদের উদরে যায়।
আমি এখানে
এসব তরুন চিকিৎসকদের এতসব প্রতারণা ও যেনতেন ভাবে অর্থ
উপার্জনের চিত্র দেখে মনে মনে বেশ আঘাত পাই। এই অল্প বয়সের তরুন এসব লোভী
চিকিৎসকরা যেন পচেগলে দুর্গন্ধময় মানবমল হয়ে গেছে। মহান চিকিৎসা পেশাকে এই ধরনের
চিকিৎসকরা কলঙ্কিত করে তুলে এবং মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটি তারা একেবারে নিঃশ্বেষ
করে দেয়। ডাঃ নুরজাহান বেগম এখানে কিছুদিন আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাকালে এসব অনৈতিক
কায়কারবার দেখে ভীষনভাবে বিষিয়ে উঠেন ও আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
সভা ডাকলেই
কেবল হৈ চৈ চেঁচামেচি, লাভের কোন খবর নেই কেবল সমস্যা আর সমস্যার চিৎকার। তিনচার
ঘন্টা সময় অযথা উপোষ নষ্ট হয়। আমার মনে হল এই সেন্ট্রাল ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে যে
কয়জন সক্রিয় পরিচালক পরিচালনা করেন তারা ছিল হয়তো অযোগ্য নয়তো অসৎ। একজন হিন্দু
মহিলা বহু চেষ্টা তদবির করে কোনমতে মাত্র ৮০,০০০/= টাকা আদায় করে বাকী ৪৫,০০০/=
টাকার দাবি ছেড়ে পালিয়ে যান। তারপর আর অনেকে
ভিক্ষায় মুষ্টি কিছু টাকা হাতে পেলে পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজতে থাকেন।
১,২৫,০০০/=
টাকা বিনিয়োগের দশ বছর পর আমিও শেষমেশ ২০১৬ সালে মাত্র ২৫,০০০/= টাকা অনেক হাতে
পায়ে ধরে আদায় করে বাকী একলক্ষ টাকা ফেলে রেখে পাততাড়ি গুটাই। ২০০৬ হতে ২০১৬ এই দশ
বছরে আমরা একটা টাকাও লাভ পাইনি। অথচ রিকাবিবাজারের সেই মার্কেটে ‘সেন্ট্রাল
ডায়াগনেস্টিক সেন্টার’ আজও ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং সগৌরবে টিকে আছে।
চোখের সামনে
দেখলাম কিছু ঠগবাজ লোক তাদের তেমন কোন বিনিয়োগ ছাড়াই কিভাবে অন্যদের টাকায় একটি
ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে নিজেরা সুকৌশলে দখল করে নিল।
এরা তাদের জীবনের সূচনা ঘটাল অসততার বিষাক্ত নাগবিষ চুষে নিয়ে। আমারও শিক্ষা হল-
তারপর অনেক ব্যবসায়ী আসলেন আমার কাছে তাদের ব্যবসা কোম্পানির শেয়ার বেচতে, আমি কিনলাম না, এইখানের শিক্ষা আমাকে বিরত করল। একলক্ষ
টাকা খুইয়ে আমি সাবধান হলাম, হয়তো মহান আল্লাহ এই ছোট মারটা আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে
আমাকে বড় কোন মারের হাত হতে বাঁচিয়ে দেন। কে একজন বলল ‘ও ভাই, বিনে পয়সায় কেঊ
শেয়ার দিলে অংশিদারী লেট্রিনেও শরিক হবেন না, দেখবেন কোন এক বেবাট (বোধশক্তিহীন)
শরিকান ভিতরে ঢুকে শৌচকর্ম সেরে লম্বা গোসলে লেগে
গেছে, আর আপনি কড়া নেড়ে নেড়ে দরজার বাহিরে দাড়িয়ে কাচুমাচু খেতে খেতে কাপড় চোপড়
নষ্ট করে ফেলছেন’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন