অভিনেতা সালমান শাহের মামাবাড়ি দর্শনঃ
একদিন আমার অনুজ নিশাত বলল, বনের
পশু পাখিরা স্নেহমমতা পেলে মানুষকে ভয় করেনা বরং মানুষের সাথে নির্ভয়ে মেলামেশা
করে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়। সে নাকি এমন একজন মানুষকে পেয়েছে যার কাছে বনের বক,
কলিম পাখি, গাংচিল, ঘুঘু, শালিক, কবুতর ইত্যাদি এসে বসে ও নির্ভয়ে জড়াজড়ি করে
বেড়ায়। এবার নিশাতের কাছে এই অদ্ভুদ মানুষটার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলল, তিনি
জেনারেল ওসমানি ও শাহজালালের(রঃ) মত একজন মজররদ অর্থাৎ চিরকুমার, বাসা সিলেটের
দাড়িয়াপাড়া। তিনি কুমকুম চৌধুরী, বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী
ইমন ওরফে সালমান শাহের ছোটমামা।
নিশাতকে নিয়ে এক শুক্রবার বিকেলে
সপরিবারে ছুটে গেলাম দাড়িয়াপাড়ায় কুমকুম চৌধুরীর বাসায়। দারোয়ানের সাথে নিশাতের
পূর্ব সম্পর্কের কারনে সহজেই গেট খোলে গেল। এবার ভিতরে কুমকুম চৌধুরীর মিনি
চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করি। এটি এমন এক চিড়িয়াখানা যেখানে কোন পশুপাখি পিঞ্জিরায়
বন্দি নেই। একপাশে কলিম পাখির বাসপোযুগী জলাবন, এখানে কলিমপাখি বাসা নির্মান করে
ডিম পাড়ে, ডিমে তাপ দিয়ে বাচ্চা বের করে। এখন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ছুটাছুটি করছে,
জলায় সাঁতার কাটছে।
কাছেই বড় দুইটি গাংচিল ও বেশ কয়েকটি
সাদাবক ও লাল সরালী হাটাহাটি করছে, কুমকুম চৌধুরীর দেয়া ছোট মাছ খেয়ে সাবাড় করছে। পাশের
বৃক্ষের মগডালে ঝোপঝাড়ে ওদের নির্মিত বাসায় ডিম দেখা যাচ্ছে। পল্লবঘন একটি আমগাছের
ডালে ডালে অজস্র চড়ুই কিচির মিচির করছে। এত চড়ুই এই বৃক্ষে এলো কেমন করে প্রশ্ন
করতেই কেয়ার টেকার বলল, এখানেও স্যারের তেলেসমাতি আছে। এই গাছের কুঠরে কুঠরে আশপাশে
স্যার প্রতিদিন ধান চাল ও গম ছিটিয়ে দেন। তাই বুনো চড়ুই এখানে সব সময় ঝাকবেধে
বসবাস করে। এদের কিচির মিচির শব্দে এখানকার বাতাস সারাক্ষন মুখরিত থাকে। খোপমুক্ত কবুতর
উড়াল দিচ্ছে, বাকবাকুম করছে। একটি গাছের ডালে নির্মিত টাওয়ারে দড়ি-মই বেয়ে উঠে বিছানায়
শুয়ে শুয়ে কুমকুম চৌধুরী তার এই চিড়িয়ারাজ্য পর্যবেক্ষন করেন।
এখানে এই বনবিহঙ্গরা সবাই
নির্ভয়। আমরা তাদের কাছে গিয়ে পালকে হাত বুলিয়ে দিলেও কোন ভয় পাচ্ছেনা। কয়েকজন
বাসাকর্মি পশুপাখিদের খেদমতে ব্যস্ত আছেন। একজন বললেন এই চিড়িয়াখানা চালাতে
সাহেবের প্রচুর টাকা খরচ হয়। প্রতিদিন মৎস্যজীবিরা এখানে কয়েক চ্যাঙারী ছোটমাছ
সরবরাহ করে, যার দাম দুইতিন হাজার টাকার কম হবেনা। পোষা পদ্মগোখরা সাপ প্রচুর দুধ
খেয়ে সাবাড় করে। চড়ুইরা খায় কয়েক কেজি ধান ও গম। কুকুর, বিড়ালরা মাংস আহার করে
কয়েক কেজি।
এবার সালমান শাহের স্মৃতিবিজড়িত
টিনের ঘরে প্রবেশ করি। কুমকুম চৌধুরী তখন বাসায় ছিলেন না। ডানে বড় কক্ষটি সালমান
শাহ স্মৃতিকক্ষ। এখানে সালমান শাহের বিশাল পোট্রেট বসানো আছে। সালমান শাহের
ব্যবহৃত বেশ কিছু স্মারক বস্তু এখানে দর্শকদের চোখে অশ্রুবিন্দু তৈরি করে। আমার নয়নেও
জল ঝরল, এই যে চিরতরুণ নায়ক সালমান শাহ। যার জন্ম বাংলাদেশের জন্মবর্ষ ১৯৭১ সালে।
আমার জন্মের মাত্র পাঁচ বছর পরে তার জন্ম, আমি বেঁচে আছি অথচ তিনি নেই। আম্মা
বলতেন প্রদীপ নেভার আগে তীব্র হয়ে জ্বলে ওঠে। বিশ্বায়ন হোক বা অন্যকোন কারণেই হোক
সালমান শাহের অকালমৃত্যুর সাথে সাথে বাংলাদেশের সিনেমা শিল্প বড় ধরনের ধাক্কা খায়।
সালমান শাহ ঢাকাই সিনেমার আকাশে জ্বলে ওঠা উল্কা যিনি এলেন, জয় করলেন, অকালে চলে
গেলেন। বাংলা সিনেমা শিল্প নিভু নিভু হবার আগে শেষবারের মত তিনি একটি উজ্জ্বল
স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে যান। তারপর ঢাকার বাংলাছবির জগত নিস্থব্ধ ও নীরব হয়ে যায়।
এবার আমাদের ফেরার পালা।
কেয়ারটেকার বলল স্যারের পদ্মগোখরা সাপ দেখবেন না, এই সাপকে সাথে নিয়ে স্যার ঘুমান।
বললাম সাপ নিয়ে ঘুমালে সাপতো তাকে ছোবল দিয়ে মেরে ফেলতে পারে। কেয়ারটেকার বলল,
পোষা সাপ কখনও মালিককে ছোবল দেয়না, পদ্মগোখরাটি স্যারের পালঙ্কের তলায় কাচের জারে
ঘুমায়, স্যার উপরে ঘুমান। তখন স্মরণ হল ইতিহাস প্রসিদ্ধ আলেকজান্ডার দা গ্রেটের
মাতা মহারানি অলিম্পিয়ার কথা, যিনি অনেকগুলো সর্পের সাথে একই কক্ষে পাশাপাশি
ঘুমাতেন। ডাঃ নুরজাহান ভয়ে কম্পিত হয়ে বললেন সাপ দেখার দরকার নেই। এসো চলে যাই। কিন্তু
আমি কি আর সুযোগ পেয়েও সাপ না দেখে চলে যেতে পারি? এবার কাচের জারে ঘুমিয়ে থাকা
পদ্মগোখরা সাপ নিয়ে কেয়ারটেকার সামনে হাজির হল। সাদা ধবধবে পদ্মগোখরা সাপটি কুমকুম
চৌধুরীর পালঙ্কে শোয়ে আছে, কেয়ারটেকার ওর গাত্রে হাত বুলিয়ে দিলে সে আরাম পেয়ে
মাথা নুয়ায়ে জিহবা বের করে নাড়াতে থাকে। কেয়ারটেকারের আঙ্গুল বিলি কেটে কেটে সাপের
মাথার উপরের সুন্দর মনিতে চলে আসে। সাপও আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে জিহবা নাচাতে থাকে। মনে
হল এ যেন সাদা প্লাস্টিকের তৈরি একটি সুন্দর সর্প আমাদের সামনে শুয়ে আছে। কেয়ারটেকার
বলল, স্যার আপনিও সাপটার মাথায় বিলি কাটতে পারেন। তার কথায় আমিও এই সাপের ফনার উপর
দুই আঙ্গুল রেখে সামান্য বিলি কেটে দিলাম। বিষাক্ত সাপের ফনার উপর কারুকার্য্যময়
নাগমণীতে জীবনের এই প্রথম এবং সম্ভবতঃ শেষবারের মত আমি হাত রাখলাম। আমার পুত্র
জেফারও ভয়ে ভয়ে এই সাপের গাত্রে একটু হাত বুলিয়ে দেয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন