শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

জাতীয় ব্যবস্থাপক সম্মেলন কক্সবাজার ২০০৯, সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ

 

জাতীয় ব্যবস্থাপক সম্মেলন কক্সবাজার ২০০৯, সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রম

২০০৯ সালে কক্সবাজার জাতীয় ব্যবস্থাপক সম্মেলনে গিয়ে আমি, রুহুল আমিন এবং খলিলুর রহমান সাহেব সম্মেলন শেষে একসাথে পরদিন সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমনে যাই আমরা তিনজন ব্যবস্থাপক সেন্টমার্টিন ভ্রমনের জন্য একটি প্যাকেজ ক্রয় করি সকালে গাইড এসে হোটেল থেকে আমাদেরকে ডেকে টু্রিস্ট বাসে নিয়ে যায়। বাসটি চকরিয়া পৌছলে গাইড আমদেরকে চা নাস্তা করান। আমরা বাংলাদেশের সর্বদক্ষিনের উপজেলা টেকনাফের উপর দিয়ে যাত্রাকালে লবন ক্ষেতের দেখা পেলাম। কোথাও আল দিয়ে সাগরের পানি আটকিয়ে রোদে পানি শুকিয়ে লবণ তৈরি করা হচ্ছে। পানি কাপড়ের উপর ময়লা লবন জমে আছে। হঠাৎ আসিরগঞ্জের ব্যবস্থাপক খলিল সাহেব বলে উঠেন ও স্যার লবন ক্ষেত দেখতেছি কিন্তু লবনের গাছ কোথায়? জকিগঞ্জের ব্যবস্থাপক রুহুল আমিন বললেন, খলিল তুমি ভাল করে খোজে দেখে নাও, আমরা লবন গাছ দেখছি কিন্তু তোমার চোখে চশমা না থাকায় হয়ত দেখতে পাচ্ছনা। খলিল সাহেব এবার চোখে চশমা লাগিয়ে খুব মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে লবনের গাছ খোঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে বললেন বাস হতে নেমে সবার আগে লবণের গাছ ভাল করে দেখে নেব। নেমেই চারপাশে তাকিয়ে বললেন, আহারে আমরা এমন এক জায়গায় নামলাম যার ধারে কাছে কোন লবনের গাছ নেই।

টেকনাফে বাস হতে নেমে কোয়ারি সিন্দাবাদ জাহাজে আমরা আরোহন করলাম। এপারে বাংলাদেশ ওপারে মিয়ানমার, মাজখানে বয়ে যাচ্ছে সুবিশাল সীমান্ত নদী নাফ। অদ্ভুদ সুন্দর একটি পাহাড়ি নদী এই নাফ। কোয়ারি সিন্দাবাদ এই বিশাল পাহাড়ি নদীর বুকে ঢেউ তুলে মোহনার পানে এগিয়ে গেল। দুপারের নয়নভূলানো পাহাড়ি অরন্যের দৃশ্যাবলী নজর কাড়ল, কিছু সামুদ্রিক পাখি নদীর বুকে ঝাঁপ দিল, সাঁতার কাটল। এবার সমুদ্রে জাহাজটি পড়তেই টাইটানিকের কথা মনে পরলে আমি ভয়ে কিছুটা আড়ষ্ট হলাম, এক সময় সমুদ্রের অথৈ জলে তটরেখা অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন চেয়ে দেখলাম সিটের তলায় অজস্র লাইফ জ্যাকেট স্থুপীকৃত করে রাখা আছে। তবে দূরসাগরে দুই একটা মাছধরার নৌকা এবং সেন্টমার্টিনগামী স্পীডবোট দৃষ্টিসীমায় দেখা গেল।

কোয়ারি সিন্দবাদের চারপাশে তখন বিশাল কূলকিনারাহীন অথৈ জলরাশির বুকে খেলা করছে অজস্র উর্মিমালাজাহাজের দুই শতাধিক লোকের মধ্যে পুবালী ব্যাংকের অনেক ব্যবস্থাপকের স্বাক্ষাৎ পেলাম। আমরা সিন্দাবাদের ডেকে কখনো দাড়িয়ে কখনো বসে বঙ্গোপসাগরের অপার সৌন্দর্যে চোখ মেলে সৃষ্টিকর্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলাম। ঘন্টাখানিক পর অনেক দূরে সাগরের জলে বিন্দুর মত কি একটি ছায়া দেখা গেল। যাত্রিরা চিৎকার দিলেন ঐ যে সেন্ট মার্টিন দেখা যাচ্ছে। এবার ছায়াটি সময়ের সাথে সাথে বড় হতে লাগল। নয়ন সম্মুখে সেন্টমার্টিনের তটরেখা ভেসে উঠল, সবুজ বনের কিনারে দেখা গেল বাংলাদেশের পর্যটন দ্বীপ সেন্টমার্টিনের  জেটি

এই জেটি হতে ওপারে মিয়ানমার, তাই এই প্রণালীতে সমুদ্র শান্ত। জেটিতে নেমে সুদীর্ঘ সেতু বেয়ে মুল ভূখন্ডে যেতে হয়। জেটি হতে যেতে যেতে নিচে চোখ ফেলে দেখতে পেলাম মার্বেল পাতরের মত টলমলে পরিষ্কার জলে বিচরন করছে লাল হলুদ নীল সবুজ সোনালি নানা বর্ণের অজস্র সামুদ্রিক মাছের ঝাঁক। একঝাঁক সাতরে যাচ্ছে আরেক ঝাঁক এগিয়ে আসছে। এবার বাংলাদেশের সর্বদক্ষি সীমানার এই দ্বীপে আমাদের পায়ের স্বাক্ষর একে দিলাম। এইটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ, যা হাজার হাজার বছর ধরে সাগরের প্রবাল পোকা জমে জমে তৈরি হয়েছে। প্রবাল প্রাচীরের ফাঁকে ফাঁকে সাগরের বালি জমে গড়ে উঠেছে কয়েক বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই অপরূপ দ্বীপটি।

স্থানীয়দের কাছে একসময় এই দ্বীপটির নাম ছিল নারিকেল জিঞ্জিরা। জিঞ্জিরা একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ দ্বীপ। বৃটিশরা এই দ্বীপটি দখলে নিয়ে নাম রাখে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড। ২০০৯ সালে আমরা দ্বীপটিতে প্রবেশ করে একটি ছোট্ট বাজারের দেখা পেলাম। এই বাজারে পর্যটকরা কিনে এবং ব্যবহার করে এমন সব পন্য ও সেবার ব্যবসা দেখতে পেলাম। নেমেই দুপুরের খাবার খেতে গাইড আমাদেরকে তাদের একটি নির্ধারিত হোটেলে নিয়ে গেল। মনে পড়ে খাবার মেন্যুতে কড়কড়ে ভাজা গরম রূপচাঁদা মাছ ছিল। থাকার মত আবাসিক হোটেল কিংবা রিসোর্টের তেমন ছড়াছড়ি সেখানে দেখি নি। বেশীরভাগ পর্যটকরা সকালে যে জাহাজে আসত বিকেলে সেই জাহাজেই ফিরে যেত।

এই দ্বীপটি আসলে একটি ইউনিয়ন যা কয়েকটি পল্লীর সমাহার। দ্বীপের ভিতর দিয়ে চলে গেছে পাকা ঢালাই সড়ক, দুপাশে আধাপাকা টিনের বাড়িঘর। একটি রিকশায় উঠে আমরা দুই কিলোমিটার দূরে ছেড়াদ্বীপের উপকূল সৈকতে গিয়ে হাজির হলাম। এখানে আমরা বিখ্যাত জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমদের সাগরপারের বাড়ি দেখতে পেলাম। চাদনী প্রেমিক হুমায়ূন আহমদ এখানে বসে পূর্ণিমার রাতে সাহিত্য রচনা করতেন। সাগরে জোয়ার বাড়লে ছেড়াদ্বীপ গহীন সমুদ্রে ডুবে যায়, আবার ভাটার সময় ধীরে ধীরে ভেসে উঠে নিজের অস্থিত্ব জানান দেয়

তখন সমুদ্রে ভাটাবেলা হওয়ায় একটি রাস্থাসহ সামনের সাগরে জাহাজের মত ভেসে আছে ছেড়াদ্বীপআমরা বালির এই প্রাকৃতিক রাস্থা দিয়ে হেঁটে ছেড়া দ্বীপে পৌছে গেলাম। ছেড়াদ্বীপ হতে মূল দ্বীপের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উপকূল জুড়ে শতশত নারকেল গাছ বাতাসে পত্রমেলে হাওয়ায় দোলছে। প্রতিটি কান্ডের আগায় আগায় ঝুলে আছে থোকা থোকা ডাব ও নারিকেল সেন্টমার্টিনের পূর্ব উপকূলে সাগর শান্ত হলেও পশ্চিম উপকুলের সাগর অশান্ত ও ঝঞ্জাময়। এখানে কক্সবাজারের লাবনী উপকূলের মত সশব্দে সাদা ফেনা তৈরি করে তরঙ্গমালা এসে একের পিঠে আরেক আচড়ে পড়ছে।

সেন্টমার্টিন এমন একটি দ্বীপ রিকশায় চড়ে পুরো দ্বীপটি মাত্র দেড়দুই ঘন্টার ঘুরে আসা যায়। সাগরতটে কেয়াবন, কেয়াবনের পাশ ঘিরে শ্বেতশুভ্র অজস্র প্রবাল পারের স্তূপ। এখানে লোকজন সাগরে মাছ ধরে এবং জলের নিচের সুন্দর প্রবাল পার সংগ্রহ করে এনে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা ধান ফলায় এবং নারিকেল বিথি গড়ে তুলে। সৈকতে বসে আমরা নারিকেল জিঞ্জিরার ডাবের পানি পান করে ভিতরের নরম শাঁসের স্বাধ নিয়ে ফিরে এলাম জেঠিতে। কোয়ারি সিন্দবাদের টেকনাফে ফেরত যাত্রার সময়ক্ষণ আগেই আমাদেরকে গাইড জানিয়ে দেন। আমরা নির্ধারিত সময়ে ফিরে এসে আরব্য উপন্যাসের সওদাগর সিন্দাবাদের জাহাজ ‘কোয়ারি সিন্দবাদে’ চেপে বসলাম। জাহাজ টেকনাফের পথে সেন্টমার্টিনের জেঠি ছাড়ল, তখন পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের অথৈজলে ঢেউভেঙ্গে আধো আলো আধো ছায়ার বর্নাচ্ছোটায় সূর্যমামা ডুব সাঁতার দিয়ে জলতলার রাজপ্রসাদে ঘুমে যাবার আনন্দে বিভোর ছিলেন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন