গ্রামে কিছু গণপ্রতিষ্ঠান গড়তে গিয়ে বিড়ম্বনাঃ
পিতৃগ্রাম দাউদপুরে স্থায়ী
কল্যাণকর কিছু একটা করার আমার স্বপ্ন ছিল বহুদিনের। মাবাবার মৃত্যু আমার সেই
ইচ্ছেকে আর শানিয়ে দেয়। ২০১৩ সালে আম্মা মারা গেলে ২০১৪ সালে আমি মাবাবার স্মৃতি ও
তাদের উদ্দেশ্যে সদকায়ে জারিয়া হিসাবে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ার সিন্ধান্ত নেই।
মাদ্রাসায় কিছু জায়গা দান করার পরও দাউদপুর মাদ্রাসার উত্তর সীমানায় আমাদের প্রায়
একুশ ডেসিমেল জায়গা ছিল। আমি এই জায়গাটি প্রতিষ্ঠান গড়ায় নির্ধারণ করি একারণে যে
জায়গাটি গ্রামের ছয়পাড়ার কেন্দ্রে রয়েছে এবং পাশের প্রাচীন মাদ্রাসাটি আমার একাজে
সহায়ক হবে।
আমি চিন্তা করলাম গ্রামে দরকার
আছে অথচ নেই এমন কিছু করব। আমি একনিষ্ঠ পাঠক, কিন্তু শৈশবে পল্লীগাঁয়ে তেমন বই
পেতাম না। আমি একজন লেখক ও কবি, তাই ভাবলাম ‘ইসফাক কুরেশী গণপাঠাগার’ করব। এখানে
আমার রচনাবলি সংরক্ষণ ও গবেষণা হবে। বিশ্বের সবকটি দেশে মহিলারা মসজিদে জামাতে
নামাজ পড়তে দেখেছি, কিন্তু বাংলাদেশে মোঠ জনসংখ্যার অর্ধেক এই অবলা জনতা আল্লাহর
পবিত্রঘর মসজিদ বর্জিত। এখানে মাদ্রাসার মেয়েদের সাথে অন্ততঃ জোহরের নামাজ গাঁয়ের
মহিলারা এসে জামাতে পড়তে পারবেন। আর ভাবলাম মহিলারা ছুরা তেলাওত ভূল করলে সংশোধনের
জায়গা নেই। মাদ্রাসার মহিলা আলেমকে কিছু সময়ের জন্য এখানে যুক্ত করে দিলে তিনি এই
মাতৃজাতিকে নামাজ ও সুরা কালাম পড়াবেন, পড়া শুদ্ধ করে দিবেন। রমজানে মহিলা তারাবী
জামাত হবে, এমনকি মহিলারা এখানে রমজানের শেষদিকে এতেকাফ করতে পারবেন। মনে মনে
স্থির করলাম প্রতিষ্টানের নাম হবে ‘আসমতুন্নেছা সফিক চৌধুরী মহিলা মাদ্রাসা ও
এবাদাতখানা’। এখানে গ্রামের মহিলারা ঐক্যবদ্ধ হবেন, নারী নির্যাতন রুখবেন এবং ধর্মে
কর্মে বিকশিত হবেন।
কিছুলোক আমাকে নিরুৎসাহিত করে বললেন,
মহিলাদের জামাতে নামাজ পড়া উচিত হবেনা। তারা বেপর্দা হয়ে এখানে আসবে, আর পাপটা হবে
আপনার। কারণ আপনি এই ফেতনাখানার কারিগর। এত টাকা ঢেলে এবাদাতখানা করে সওয়াবের বদলে
গোনাহ দিয়ে আমলনামা পরিপুর্ণ করবেন। আমি জবাব দেই- পাপ আমার কেন হবে? আমি মহিলাদেরকে
এখানে বেপর্দা হয়ে আসতে বলিনি। যে বেপর্দা হয়ে আসবে পাপ হবে তার। তারা বলল
মহিলাদের জামাতে নামাজ পড়ার ব্যাপারে ফতোয়া কি? এবার ফতোয়া নিয়ে জানলাম আল্লাহর
রসুল(সঃ) এবং হজরত আবু বকরের((রঃ) আমলে মসজিদে নবুবীতে মহিলারা শেষলাইনে দাঁড়িয়ে
নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করতেন। হজরত ওমরের(রঃ) আমলে কি এক কারণে তিনি মহিলাদের
জামাতে আসতে বারণ করে দেন। তবে বর্তমানে এই সম্মানীত নবুবি মসজিদে নারীরা পৃথক
পর্দাঘেরা স্থানে জামাতে নামাজ আদায় করেন। তারা আলাদা টয়লেট ও অজুখানা ব্যবহার
করেন।
আমার উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমের
কবরগাহ সংলগ্ন বড়মসজিদের ঈমামের ঈমামতিতে মাইকের সাহায্যে এই জামাত পরিচালিত করা। ফতোয়া
পেলাম মধ্যভাগের কবরগাহের বিশাল ফাকা জায়গা রেখে বড়মসজিদের সাথে এক জামাত হবেনা। ফতোয়াদাতা
আলেম বললেন ইমামকে পুরুষ হতে হবে এবং পিছনে পুরুষ মুছল্লিদের দুই একটি সারি থাকতে
হবে। তারপর পর্দা টেনে পিছনে মহিলারা জামাতে দাড়াবেন।
আমাদের নির্ধারিত এই জায়গার ভিতর
আমার পাঠশালার সহপাঠি ছয়ফুল আলীর দুই ডেসিমেল ও ফয়জুল আলীর দুই ডেসিমেল জমি ছিল।
ফয়জুল আলী উক্ত জমি আমাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এবার ছয়ফুল আলীর কাছে তার দুই
ডেসিমেল কিনতে গেলাম। তার বাবা লন্ডনি এবং আর্থিক অবস্থা সচ্ছল। সে বলল আপনি এখানে
ভাল কিছু করলে আমরা এই সামান্য জায়গা বিনামূল্যে দান করে দেব। পরে কাজে নেমে দেখি
দান করা দূরে থাক সে এক ইঞ্চি পরিমান জায়গারও হিসাব নিচ্ছে। আমাদের জমির একপাশে
ছিল ইস্রাব আলীর তিন ডেসিমেল জায়গা। এই জমিটায় আমাদের শৈশবে ধান্যচারা ফলানো হত। বহুবছর
আগে ইস্রাব আলী রাস্থার পাশের তিন ডেসিমেল জায়গা আমাদেরকে দিয়ে পিছনের সমপরিমান
জায়গা আব্বার কাছ থেকে বদলা নেয় এই অজুহাতে যে তার ধান্যচারা রাস্থার গরু-ছাগল খেয়ে
ফেলে। ইস্রাব আলী তার কালো মেয়ে আফিয়াকে ভাটি হতে আসা মোরগ বিক্রেতা ছিন্নমূল ছমির
আলীর সাথে বিয়ে দেয়। শ্বশুরের রাস্থাহীন এই জায়গায় ছমির আলী বাড়ি নির্মাণ করে
বসবাস শুরু করে। আসলে তার বাড়ির জায়গাটি আমাদের নামে রয়ে গেছে। এই সমুদয় জায়গা
একত্রিত করে আমি চাইলাম ভাল ড্রয়িং করে ভবন নির্মাণ করি। কিন্তু ছমির আলীকে নিয়ে
সমস্যা হল, জমিটি কিনতে চাইলে সীমাহীন দাম সে দাবি করল। বাহিরে আমরা রাস্থার পাশে
দ্বিগুণ জায়গা বদলা দিয়ে ঘর বানিয়ে দিলেও সে যেতে রাজি হলনা। ছমির আলী যাবেনা, সে
ভাবল আমরা ঠেকায় পড়ে গেছি তাই তার বাড়ি কয়েকগুন বেশি দামে কিনতে বাধ্য হব। ছয়ফুলও
দুই ডেসিমেল স্বেচ্ছায় প্রতিশ্রুতি দিয়েও দান কিংবা বিক্রি কিছুই করলনা। গ্রামের
মুরব্বিদের অনুরোধে আমরা শেষপর্যন্ত ছমির আলীকে আমাদের জায়গার উত্তরসীমা ঘেষে পাচফুট
প্রশস্থ একটি রাস্থা দান করি।
এবার হাতে সীমিত টাকা নিয়ে বেশ
জুরেসুরে কাজ শুরু করি। বাড়ির বড়পুকুরের পুর্বপারের জমি হতে লক্ষাধিক টাকার মাটি
কেটে ট্রাক্টরে করে এনে জমিটিকে উচু ও ভরাট করি। সিলেট থেকে নগদ প্রায় দুই লক্ষ
টাকার রড কিনে ঘরে রাখি। বালু পাতর এবং চারহাজার ইট কিনে আর এক লক্ষ টাকা গচ্চা
দেই। আমার নানাবাড়ির মিস্ত্রি মনাইকে কাজের দায়িত্ব দেই। সে বেশ কয়েকজন ভিন জেলার
মিস্ত্রি নিয়ে রডকেটে সব প্রস্তুতি সমাপ্ত করে। এবার ভিত্তিপ্লেটের মাটি কাটা শুরু
হল। দুই এক দিনের মধ্যে ভিত্তি স্থাপন করা হবে। আমি অফিসে এমন সময় ঠিকাদার মনাই আলী
ফোনে বলল, ছমির আলী দা হাতে নিয়ে এসে তাদের কাজে বাধা দিচ্ছে। এই মিস্ত্রিরা সবাই
বিদেশী তারা হাত বন্ধ করে বসে রইল।
অনুজ নিশাত এবং আমি বেশ কয়েকবার
মুরব্বিদেরকে নিয়ে আলোচনায় বসি, আমিন ডেকে জমি জরিপ করি। বারবার
বাড়ি গিয়ে ঝামেলা করে সারা দিন নষ্ট করে আসি। লোকেরা সবাই গরিবমানুষ ছমির আলীর
পক্ষে সুপারিশ করে। আসল কাজ কিছুই হয়না। তারা বুঝতে অক্ষম যে তারা কিছু সুন্দর
প্রতিষ্ঠান পাবে, যা যুগে যুগে মানুষের কাজে লাগবে। ভবনের নকশার কিছু অংশ মৃত ইস্রাব
আলীর নামের জায়গায় হওয়ায় ভাবলাম পুন্যকাজ শুরুর আগে পুরো জায়গাটা হালাল করে নেই। স্থির
করলাম আগে জায়গাটা পুরো হস্তগত করি, তারপর ধীরেসুস্থে প্রতিষ্টান গড়ার কাজে নামব।
সেই ঘনবাদল দিনে আমি কাজ বন্ধ করে দেই। শ্রমিকদেরকে তাদের পাওনা বুজিয়ে বিদায়
জানাই।
বিনাস্বার্থে নিজ টাকায় নিজ মূল্যবান
জমিতে জনসেবা করতে গিয়ে লোকদের আচার আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে প্রায় পাঁচ লক্ষটাকা
গচ্চাদিয়ে শহরে ফিরে আসি। আমি কিংবা আমার বংশধরগণের কারও গ্রামে ফেরার আর তেমন কোন
সম্ভাবনা নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো হলে গ্রামবাসীরাই উপকৃত হত। কিন্তু দেখলাম কাজটি নিয়ে
কারও কোন আগ্রহ নেই, তেমন কোন সহযোগিতা নেই। সবার ভাবটি এমন, এসব না হওয়াই ভাল, না
হলেই আমরা বাচি।
অধিকন্তু আমি বিপদ ও যন্ত্রণায়
পড়লাম, মানসিক অশান্তি পেলাম। বেগম সাহেবা রেগে বললেন তুমি সবকিছুতে তাড়াহুড়া কর?
এবার জনসেবার ঠেলা সামলাও। রবীন্দ্রনাথের ‘দানের বিড়ম্বনা’ গল্পটি পড়েছি, এবার
জনসেবার বিড়ম্বনা নিজে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। মনে হল ‘জনসেবার বিড়ম্বনা’ নামে একটা
গল্প লিখে ফেলি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন