সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় একদিনঃ

 

বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় একদিনঃ

ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল। আমার জন্য বেশ স্মরণীয় এজন্য যে সেই ভাষার মাসের কোন একদিন আমি ঢাকার বাংলা একাডেমী বইমেলায় এই প্রথম যোগ দেই। এই বইমেলায় আমার বন্ধু ও বিশ্ববিদ্যালয় সহপাঠী লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের কলাম ও প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জীবনের জলছবি’ প্রকাশিত হয়। সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরকে নিয়ে আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক আব্দুস সবুর মাখন ভাই পুবালী ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে এসে হঠাৎ হাজির হন। অনেক অনেক দিন পর প্রিয় মানুষদেরে কাছে পেয়ে হতচকিত হয়ে যাই। হারানো প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তারা কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনে হোটেল আলফারূকে ঊঠেন। আমরা তিনজন হোটেল আলফারূকে গিয়ে নামাজ পড়ি ও দুপুরের খাবার এনে খাই, তারপর হেঁটে হেঁটে মতিঝিল শাপলাচত্বর এসে শাহবাগের বাসে উঠি। সেদিন ছিল তীব্র যানজট, বিলেতবাসী নির্ঝর ভয়ে চুপসে যান। যানবাহনের ঠেলাঠেলি দেখে তিনি দুর্ঘটনা হতে বাঁচার নানান শলাপরামর্শ দিতে থাকেন।

ঘন্টাখানিক পর শাহবাগ নেমে আমরা হেটে হেটে বাংলা একাডেমী ও সোহরওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলায় হাজির হই। ‘জীবনের জলছবি’ বইটির প্রকাশক ইত্যাদি প্রকাশনের স্টলে আমরা বেশ সময় কাটাই। এই প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী শ্রীমঙ্গলের সন্তান দিলীপ বাবুর সাথেও আমাদের দেখা হয়। আমরা সারাটা বইমেলা ঘুরে দেখি। ছোট-বড়, বিখ্যাত-অখ্যাত মিলে সারাদেশের প্রায় সাতশত প্রকাশনী সংস্থা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই বইমেলার অংশ নেয়। সিলেট থেকে ‘ইত্যাদি’, ‘উৎস্য’, ‘বাসিয়া’, ‘জালালাবাদ’ ইত্যাদি প্রকাশনী সংস্থা এই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বইমেলায় যোগ দেয়। এই বইমেলায় দেশের সব স্বনামধন্য কবি ও লেখকের লেখা আসে। অনেক নতুন পুরাতন লেখকের বইয়ে স্টলগুলো ছেয়ে গেছে। সে বছর এই একুশে মেলায় বিভিন্ন লেখকের প্রায় চারহাজার বই প্রকাশিত হয়। আলোকসজ্জায় একুশের বইমেলা ঝলমল করছে এবং নদীর প্রবাহমান বন্যার মত এই মেলায় নরনারীর বন্যা বইছে। লক্ষ্য করি প্রখ্যাত লেখক হুমাউন আহমদ এবং হুমাউন আজাদ বেঁচে নেই অথচ বইমেলায় তাদের বইয়ের কাটতি একটুও কমেনি। ডঃ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, সেলিনা হক, আনিসুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ম্যাক্সিম গোর্কি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আইজ্যাক অসিমাভ প্রমুখের বই স্টলগুলোতে চোখে পড়ে।   

ক্লাসিক লেখামালা একেক জন লেখকের এক একটা নিজস্ব সৃষ্টিরাজ্য, লেখক তার এই আপন সৃষ্টিরাজ্যে বেঁচে থাকেন যুগের পর যুগ। তিনি বেঁচে থাকেন প্রিন্টেড এবং ইলেকট্রনিকস বইয়ের ভিতর। জনতার ব্রেইন নামক সুপারকম্পিউটার এই দুই মাধ্যমে প্রবেশ করে লেখকের সৃষ্টিরাজ্যে হানা দেয়। এই পাঠকজনতা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, আনন্দে কিংবা বেদনায়, প্রয়োজনে কিংবা বিবেকের তাড়নায়, যুক্তি কিংবা বিশ্বাসের খোঁজে লেখকদের কাছে এসে হাজির হন। তাই কালজয়ী লেখকরা পাঠকের ব্রেনের যাদুঘরে তার সৃষ্ট সাম্রাজ্য নিয়ে যুগে যুগে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। বর্তমান যুগ ঞ্জানের যুগ, এযুগে ঞ্জান ছাড়া টিকে থাকা যায়না। ঞ্জানের খোঁজে আমজনতা বই ও লেখকের কাছে ধর্না দিতে বাধ্য সর্বক্ষন। তাই লেখা আছে, লেখা থাকবে, লেখা চলবেই। বইয়ের চাহিদা ফুরায় নাই, ইলেক্ট্রনিক্স কিংবা প্রিন্ট বইয়ের প্রয়োজন সভ্যতার অগ্রযাত্রায় আর বাড়বে বৈ কমবেনা কোনদিন।

সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝরের ‘জীবনের জলছবি’ আমি এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করি। এই বইয়ের অনেক আত্মজৈবনিক লেখায় আমার অতীত জীবনের বেশকিছু ছায়াচিত্র খুঁজে পাই। বইটি আমাকে আবার সিলেট এম এম কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে টেনে নিয়ে যায়। লেখকের মানবপ্রেম ও আধুনিক জীবন দর্শন আমার মতের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বেশ কয়েকজন স্কলারকে আমি বইটি উপহার দেই। তারা সবাই বইটি পড়ে বেশ প্রশংসা করেন এবং এই বইয়ে লেখকের বর্ণিত মতাদর্শের সাথে সহমত প্রকাশ করেন।

ঢাকায় আমি একা মানুষ। ফেব্রুয়ারির এক শনিবার ঢাকায় ছিলাম। ধানমন্ডি হতে হেঁটে হেঁটে আবার বইমেলায় যাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার কাছ দিয়ে মেলা প্রাঙ্গনে প্রবেশ করি। সারাদিন বিভিন্ন স্টলে স্টলে হেঁটে বই নাড়াচাড়া করে পার হয়। লেখক জাফর ইকবাল লেকপারে একটি চেয়ারে বসে আছেন। কিশোরের দল তাকে ঘিরে ধরে বইয়ে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। একপ্রান্তে বাংলা একাডেমির বইয়ের মোড়ক উম্মোচন মঞ্চ। একজনের পর একজন লেখক তার প্রকাশক ও মোড়ক উম্মুচনকারী গুণীজনকে নিয়ে মঞ্চে উঠে মেলায় প্রকাশিত স্বপ্নের বইয়ের মোড়ক উম্মোচন করছেন। প্রকাশিত বই নিয়ে তারা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখছেন। বাংলা একাডেমির একজন উপস্থাপক তাদেরকে সহায়তা করছেন। একসময় নিরাপত্তাবেষ্টিত হয়ে আসেন জাতীয় সংসদের ডিপোটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া। তিনি উত্তর বঙ্গের একজন প্রবাসী কবি বিজয় সরকারের দুইটি কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উম্মোচন করেন। কবি বিজয় সরকার এই বই বিক্রির টাকা একজন ক্যান্সার রোগীকে দান করবেন। সামনে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা ষাট সত্তুর জন শ্রোতা হাততালী দিয়ে মঞ্চের লেখকদেরকে অভিনন্দন জানান।       

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল। ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী ফোন করে বললেন হাসমতি ঝি মারা গেছেন। আমার শৈশবস্মৃতিতে হাঁসমতি ঝি বেশ জায়গা দখল করে আছেন। অঞ্জাতকুলশীল হাঁসমতি ঝিকে আমার নানা-নানি লালনপালন করেন এবং বিয়ে দিয়ে নানাবাড়িতে রেখে দেন। তার বাচ্চাকাচ্চাদেরকেও তারা প্রতিপালন করেন। তিনি নানাবাড়িতে আমার মা ও খালাদের খেলার সাথি ছিলেন। আমাকে আদর করতেন নিজ সন্তানের মত এবং আমার ডাকনাম ধরে ডাকতেন ‘সেফাক পুয়া’। আমার যৌবনে একবার হাঁসমতি ঝির ‘সেফাক পুয়া’ ডাক শুনে আমার এক বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান নির্ঝর কৌতুক করে বলেছিল ‘হাওর হলো হাকালুকি, বাকী সব কুয়া/ বেঠা হলো ইসফাক কুরেশী, আজও তিনি পুয়া’। আম্মার সমবয়সী হাসমতি ঝি আমার মায়ের চেয়ে হয়ত বেশি দিনই আয়ু পান, তবে শেষজীবন কাটান বিছানায় শুয়ে। আমার নানাবাড়ির সবাই যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলে তিনি তার দুই প্রজন্মের বংশধরদেরে নিয়ে হাওরঘেরা বড় বাড়িটি আগলে রাখেন। আমি ঢাকায় অবস্থান করায় তার জানাজায় যেতে পারিনি। তাকে নানাবাড়ি পাতারিয়ার পারিবারিক কবরগায় দাফন করা হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন