আমার ঢাকা আগমন, রাজধানী জীবন, সারাটা বাংলাদেশ হৃদয়ে ধারণঃ
ঢাকা
আমাদের রাজধানী, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বদ্বীপ রাষ্ট্র বাংলাদেশের হৃদপিন্ড
এই মহানগরী। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের রাজধানী সেসব দেশের কোন এক প্রান্তে কিংবা
কিনারায় হলেও ঢাকা বাংলাদেশের প্রায় কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। সারাদেশের রেলপথ,
রাজপথ, নৌপথ, বিমানপথ সব এসে এই মহানগরে একাকার হয়ে গেছে। এই শহর ছেড়ে উত্তর-দক্ষিণ,
পূর্ব-পশ্চিম যে দিকেই আমরা যাইনা কেন দুই আড়াই শত মাইল পার হলেই সমুদ্র কিংবা
সীমান্ত রেখা। কোটি কোটি মানুষ এই দেশের রক্তপ্রবাহ, যারা অজস্র শিরা উপশিরা বেয়ে
হৃদপিন্ড এই ঢাকায় এসে এক অতি ঘনীভূত মানবপুঞ্জ তৈরি করেছে। হ্যাঁ, এই শহরটি
লোকবন্যার এক প্লাবনভূমি। ঘা ঘেষাঘেষি করে শত সহস্র অপরিকল্পিত বহুতল ভবন ছড়িয়ে ছিটিয়ে
আছে এই শহরের মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে। আছে অনেকগুলো বড় বড় গিঞ্জি বস্তি এলাকা,
মানবেতর জীবন। ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর জুড়ে এই মহানগর এবং এর উপকন্ঠে
বসবাস করেন প্রায় তিন কোটি মানুষ, সেই হিসাবে প্রতি পাঁচজন বাংলাদেশীর একজন এই শহরের
বাসিন্দা। এই মহানগর হতে সৃষ্টি হয় দেশের ২৫% জিডিপি। দক্ষিণ এসিয়ায় একমাত্র
বোম্বে মহানগরী ছাড়া এত উচ্চ জিডিপি আর কোন শহরের নেই। এই নগর বাংলাদেশের প্রাণ, ঢাকার উন্নতি মানে বাংলাদেশের উন্নতি, ঢাকায় অবনতি
মানে বাংলাদেশের সর্বনাশ।
যে
মহানগর লাখ লাখ বাঙ্গালিকে তার বুকে টেনে নিয়েছে সেই ঢাকা এখন আমাকে ডাকছে। এই
মহানগরীর উদাত্ত আহ্বান উপেক্ষা করার কোন সুযোগ অনেকের হয়না, আমারও হয়নি। এই শহর
যেমন শত সমস্যার, তেমন অপার সম্ভাবনার। এই শহরে ধনীরা আসে সম্ভাবনার খনি খুঁজে
নিয়ে বড়লোক হতে, মধ্যবিত্ত আসে সুযোগ খুঁজে ধনী হতে, রাজনীতিবিদরা আসে ক্ষমতাবান
হতে এবং গরিব জনতা আসে ঠেকে, কাজের সন্ধানে প্রাণটা বাঁচাতে। কিন্তু আমি ইসফাক
কুরেশী কেন এলাম? সুযোগ কিংবা সম্ভাবনা এর কোনটার টানেই আমি এখানে আসিনি। এখানে
এসে যখন কোন উন্নতির দেখা পেলাম না, তখন স্বভাবতই মনে হল দেশের ভাসমান গরিব জনতার
মত আমি এখানে এসেছি ঠেকে, কোনমতে চাকুরি বাঁচাতে। এখানে এসে উন্নতি কিংবা অর্থলাভ
কিছুই আমার ভাগ্যে জুটলনা ঠিক, তবে আমার অভিঞ্জতার ভান্ডার সমৃদ্ধ হল, আমি আমার প্রিয়
সবুজ শ্যামল বাংলাদেশকে হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে গেলাম। ছিলাম সিলেটি, এবার হলাম
বাংলাদেশী। এতদিন ছিলাম হাওর, এবার হলাম সাগর।
৬
জানুয়ারি ২০১৯। মৌলভীবাজার হতে সিলেটে এসে চব্বিশ ঘণ্টাও নিঃশ্বাস ফেলার সময়
পেলামনা। কারণ ৮ জানুয়ারি সকাল ১০ ঘটিকায় আমার ঢাকায় যোগদানের আদেশ। আমরা ঢাকায়
গেলেই ছোট সম্মন্দি আজিজ ভাইয়ের ধানমন্ডি লেকপারের বাসায় থাকি। পাচতলা এই ভবনটির
নাম উইন্ডসর পার্ক। গ্রাউন্ড লেভেলে লিফটে চড়ে লেভেল ফোরে সুইচ দিলেই বাসার সামনে
এসে লিফট ওপেন হয়। বাসার উপর আরেক তলা ফ্ল্যাট থাকায় ছাদ তেমন গরম হয়না। সবুজের
মাঝে সুসজ্জিত বাসাটিতে আলো ও বায়ু অবিরাম খেলা করে। ব্যস্ত ও সরগরম ঢাকার বুকে এই
বাসাটি একটি কোলাহলহীন নিরিবিলি শান্তির আশ্রম, যেন একটি নীরব নিস্থব্দ বাগানবাড়ি।
এখানে থেকেই ঢাকার সব কাজ আমরা সেরে নেই। এই সুন্দর বাসাটি ঢাকায় আমাদেরকে পরম
মমতায় আশ্রয় দেয়। আমি একজন চাকুরীজীবী, ঢাকায় এসে কারও পিঠে সওয়ার হওয়া আমার জন্য
শোভা পায়না। আমি মনেমনে ঠিক করি মতিঝিলের আশপাশে একটি বাসা ভাড়া করে নেব। ঢাকায়
বদলি হওয়া দিলীপ বাবু এবং মাহবুব সাহেব মিলে একটি বাসা ভাড়া করার জন্য তাদের সাথে
আলাপ করে রাখি।
আজিজ
ভাই আমার অতি প্রিয় একজন হওয়া সত্বেও তাকে জানাইনি আমি ঢাকায় বদলি হয়েছি। কিন্তু
দুইতিন দিন আগে তিনি সিলেট এসে বিষয়টি জেনে যান। তার দাবী আমাকে ঢাকায় গিয়ে তার
বাসায় উঠতেই হবে। তারপর যেখানে খুশী সেখানে চলে যেতে পারি। তাই ঢাকায় আমাদের সেই
চিরসবুজ আশ্রয়স্থল ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদের পাশে লেকপারের বাসা উইন্ডসর ক্যাসেলে ৭
জানুয়ারির রাতে এসে আমি আশ্রয় নেই। বাসার সামনে মসজিদুল তাকওয়া, নদীর মত আঁকা
বাঁকা সর্পিল ধানমন্ডি লেক, গতিহীন শান্ত জলাশয়, লেকপারে নয়ন জুড়ানো বৃক্ষশোভিত
পার্ক, হাটার রাস্থা, ব্যায়াম ও খেলাধুলার সুরম্য মাঠ। লেকের ওপারে হাজার বছরের
শ্রেষ্ট বাঙ্গালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয়বিদারক হত্যাকান্ডের
স্মৃতিধারণ করে আছে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। এই বাসা
হতে হেঁটে পাঁচ মিনিটেই ডান কিংবা বামের দুইটি সেতুর যে কোনটি দিয়ে দুটি পথেই
বাঙ্গালি জাতির এই তীর্থস্থলে পৌছা যায়। সারা বছর বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ওখানে পুস্পার্ঘ্য
ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ ও সাধারণ আমজনতা। প্রায়ই আসেন রাষ্ট্রীয়
ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ, যাদের আগমনে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বন্ধ
করে দেয় বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনের ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়কটি।
উইন্ডসর
ক্যাসল, রোড নং ১০/এ, বাড়ি নং ৫৫, ধানমন্ডি, ঢাকা। তাকওয়া মসজিদ সংলগ্ন লেকপারের প্রায়
চার হাজার বর্গফুটের এই বিশাল ফ্লাটের বাসিন্দা মাত্র চারজন। ছোটভাই আজিজ চৌধুরী,
ভাবী আনিকা চৌধুরী, ভাইপো আরিক চৌধুরী এবং ভাইঝি আলমা চৌধুরী। আমি এসে যোগ দেয়ায়
এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা হয়ে যায় চার থেকে
বেড়ে পাঁচ জন। গাড়ি চালক খোকন মিয়া ও চারজন গৃহকর্মী সুমন, ফাতুর
মা, রুবিনা এবং সেলিনা বেগম মিলে এই বাসার জনসংখ্যা দশ। যদিও আরিক এখন
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
ধানমন্ডির বাসা হতে
পার্কের ভিতর দিয়ে লেকপার হয়ে কলাবাগান ছয় মিনিটের পায়েহাটা রাস্থা। প্রচন্ড
যানজটের কারণে কলাবাগান হতে
মতিঝিলের অফিস যেতে শহরবাসে আমার প্রায় দুইঘন্টা সময় লেগে যেত। একটু পরপর প্রতিটি
পয়েন্টেই দশ-পনের মিনিট করে থেমে থাকে বাস। ট্রাফিক গ্রীন সিগন্যাল পড়ামাত্রই বাসগুলো ঘষাঘষি করে এমন দৌড় দেয় যে হাত মুখ
জানালার বাহিরে গেলে নিশ্চিত ছিড়ে নিয়ে যাবে। গাড়ির সাথে
গাড়ির টক্কর লাগা এখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে প্রতিযোগিতা এতই বেশী যে
দুইটি বাসের সংঘর্ষ হলেও দাঁড়ানোর অবকাশ নেই। বডিতে জখম নিয়েই বাসগুলো উদ্ধশ্বাসে
দৌড়ায়। কেবল একটি আওয়াজ শোনা যায়, হেই মিয়া চোখ নেই, দেখতে পাওনা। রাস্থার পাশে
দাড়ান জনভীড়ের ঘা-ঘেষে যখন বাসগুলো দৌড়ে যায় তখন গা শিউরে উঠে যেন
জনতাকে পিষে যাচ্ছে। বাসে বসে ভাবি যদি ধাক্কা খেয়ে গাড়ি উলটে যায় তবে কি করব। ঠিক
করি সিটের সাথে শক্ত হয়ে জড়িয়ে রব, নইলে ভর্তা হয়ে যাব। ঢাকার রাস্থার এই অবস্থা
দেখে প্রথম প্রথম আমার ভয় হলেও পরে তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। ধুয়া-বালি উড়ছে, বায়ু ও
শব্দ দুষণে চারপাশে নাকাল পরিবেশ। কাপড়ের মাস্ক কিনে নাক মুখ ডেকে দেই।
অফিসে
যাবার বাসে উঠা ছিল বেশ কঠিন কাজ। সংগ্রাম করে প্রতিযোগিতায় জিতে বাসে উঠতে হত।
প্রায়ই অর্ধেক পথ বাসে দাঁড়িয়ে থেকে কেউ নেমে গেলে তার সিটে বসা হত। গরমে গা ভিজে
যেত। ভীড়ের মধ্যে ম্যানিব্যাগ ও মোবাইল খোয়া যাওয়ার ভয়ে হাত দুটি এই দুইয়ের উপর
সজাগ রাখতে হত। যানজটে বাসের গতি এতই মন্তর যে একদিন আমি হেঁটে বাসায় গিয়ে দেখি বাসের
যাবার সমসময়েই পৌছে গেছি। বাসে চললে যতক্ষণ, হেঁটে গেলেও ততক্ষণ। এযেন ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া
চলিল’। তবে এই ঢাকা শহরে হাটাও তেমন সহজ কাজ নয়, ভাঙাচোরা উঁচু-নিচু ফুটপাথ,
বাতাসে ধুলাবালি ও ধুঁয়ার বিষাক্ত কুন্ডলী এবং সেইসাথে যন্ত্রদানবের কানফাটা আওয়াজ।
পাবলিক
বাসে ছিল ক্যানভেসার ও ফকিরের ভীষণ উৎপাত। পঙ্গু ভিক্ষুকদের জন্য আমি ভাংতি নিয়ে
যেতাম বাসে। কারণ আমি কেউ হাত পাতলে তাকে খালিহাতে ফিরিয়ে দেই না। দুইএক টাকা হলেও
হাতে তুলে দেই। অক্ষমদেরে তো ভিক্ষে ছাড়া বেঁচে থাকার পথ নেই। তবে কিছু কিছু ভিক্ষুক এতই রোজগার করে
যে সক্ষমরা তাদের কাছে হেরে যাবে।
এইসব
ধনী ভিক্ষুকদের নানা রসাত্মক কাহিনি ঢাকায় শোনা যেত। ক্যানভেসারদের আমি শ্রদ্ধা
করি এই কারণে যে তারা বেচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে, ক্ষুদে ব্যবসা করে নিজেকে
টিকিয়ে রাখে। পিয়াজ ও তরকারী কাটার মেশিনের এডভারটাইজ করতে গিয়ে তারা তরকারী কেটে
কেটে একটি বড় ব্যাগ ভরে দিত। অভিনব পন্থায় কিছু সুস্থ্য মেয়েকে আমি ভিক্ষা করতে
দেখি। তারা গাড়িতে উঠে বাসে বসা যাত্রীদেরকে একটি করে চকলেট ও লিফলেট ধরিয়ে দিত।
লিফলেটে ভিক্ষে করার কারণ লিখা থাকত। আমি তাদেরকে ভিক্ষে দিলেও ডায়বেটিসের জন্য চকলেট ফিরিয়ে দিতাম।
অনেকে চিকিৎসকের প্রেস্কিপশন দেখিয়ে ঔসুধ কেনার জন্য সহায়তা চাইত।
পূবালী
ব্যাংকের শাখা ও আঞ্চলিক অফিসে আমি অনেকবার কাজ করেছি। তবে প্রধান কার্যালয়ে আমার
কাজে যোগদান এই প্রথম। আমাকে নিয়োগ দেয়া হয় হেড অফিসের সাধারণ সেবা ও উন্নয়ন
বিভাগে। মতিঝিল শাপলাচত্বরের সন্নিকটে ২৬ দিলকুশা বানিজ্যিক এলাকায় পূবালী
ব্যাংকের বিশাল চৌদ্দতলা নিজস্ব হেডঅফিস ভবন। সামনে গাড়ি রাখার বড় চত্বর। বাসে
ধানমন্ডি হতে সকাল সাড়ে নয়টায় মতিঝিল প্রধান কার্যালয়ে এসে প্রথমেই মানবসম্পদ
বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুরের চেম্বারে যাই। তার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরীর
সাথে দেখা করি। কিছুক্ষণ আলাপ করে তিনি কেন যেন আমাকে বাদশাহ আলমগীরের গল্প শুনালেন। হুমকির সুরে বললেন,
আলমগীর ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ সম্রাট, তিনি তার বাপকেও কোন ব্যাপারে ছাড় দেননি। মানে আমি শ্বশুর হলেও পার
পাবনা। আমি জবাব দেই, আমি সম্রাট আলমগিরকে পছন্দ করিনা। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক
ধর্মান্ধ, তিনি পিতার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন এবং ক্ষমতার লোভে আপন তিন ভাইকে
খুন করেন, বৃদ্ধ পিতাকে আজীবন জেলে বন্দি করে রাখেন।
আচমকা
এই গল্প বলার কারণ আমি তখন সামান্য বুঝলেও পুরো বুঝতে পারিনি, তবে কিছুদিনের
মধ্যেই এই গল্পের শানে নুযুল আমার কাছে পরিস্কার হয়। তিনচার দিন পর মানবসম্পদ
বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মনজুর আমাকে ফোন করে বললেন ব্যাংকের পরিচালক
মনির আহমদের সাথে আমার কি সম্পর্ক? বললাম সিলেট শহরে তিনি আমার প্রতিবেশী এবং আমরা
একই গ্রাম এলাকার জাতক। অধিকন্তু তিনি আমার শিক্ষক পিতার একজন ছাত্র। বললাম মনির
সাহেব অসুস্থ্য হলে আমার চিকিৎসক পত্নী তাকে দেখে আসেন। মনির সাহেবের পত্নীর সাথে
আমার বেগমের ভাল সম্পর্ক রয়েছে। তিনি লন্ডন হতে সিলেট এলে আমার পত্নী গিয়ে দেখা
করেন।
তারপর
মঞ্জুর সাহেব যা বললেন তা আমার কাছে অবিশ্বাস্যই মনে হল। আপনি পরিচালক মহোদয়কে
ব্যাংকের নানা বিষয়ে স্বার্থ আদায়ে গিয়ে বিরক্ত করেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি
তাকে বিরক্ত করলে বিগত দেড় বছর গ্রামের চৌধুরীবাজার ও তিন বছর মৌলভীবাজারে কষ্ট করতাম
না। তাকে দিয়ে সিলেটের মহাব্যবস্থাপককে একটা ফোন করালেই সিলেটে চলে আসতাম।
পৃথিবীতে নানা অবাক করা ঘটনা ঘটে, এবার বললেন আপনি ফটুমিয়া নামে রনকেলীর একজন
লোককে দিয়ে ঢাকায় আসা বন্ধ করাতে তাকে তদবির করেছেন। বললাম ফটুমিয়া নামের কোন
লোককে আমি আদৌ চিনিনা। যে লোকের নামই কোনদিন শুনিনি তাকে দিয়ে কিভাবে বিরক্ত করাব?
এবার এবিষয়ে তদন্ত করতে আমি রনকেলীতে আমার ছোটবোনের কাছে ফোন করি। তিনি বললেন
তাদের গ্রামে ফটুমিয়া নামে একজন ধনী লন্ডনি আছেন, যার সাথে তাদের গভীর আত্মিক
সম্পর্ক বিদ্যমান। আমাদের ব্যাংকের কোন একজন পরিচালকের সাথে ফটুমিয়া
মিয়ার নাকি খুব বন্ধুত্ব রয়েছে। আমার ঢাকায় বদলির আদেশ শুনে তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে
ফটুমিয়াকে এই আদেশ বাতিল করে আমাকে সিলেটে দিতে অনুরোধ করেন। বিষয়টি আমার অগোচরেই
হয়ে যায়। আমি জানলে তাদেরকে নিষেধ করে দিতাম। কারণ মনির আহমদকে ধরতে আমার
লোকমাধ্যমের কোন দরকার নেই। তিনি আমার প্রতিবেশী, কোন মাধ্যম ছাড়াই তার কাছে আমি যেতে
পারি। প্রধান কার্যালয়ে যোগ দিয়েই আমি এই অপমানের শিকার হই এবং সিন্ধান্ত নেই খুব
দরকার ছাড়া আর কখনও মনির মিয়ার ধারে কাছে যাবনা। তিনি হেডঅফিসের কর্তা ব্যক্তিদের
কাছে আমাকে একদম অপদস্ত করে দেন।
আর
অবাক হই, পূবালী ব্যাংকের একজন সামান্য এমডি হয়েই কেউ কেউ নিজেকে হিন্দুস্থানের
বাদশাহ ভেবে বসেন। তাও যেই সেই বাদশাহ নন, আসাম হতে আফগানিস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত
মোঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট আওরঙ্গজেব। এত এত আত্মগরিমা দেখে পূবালী ব্যাংকের
নগন্য প্রাণী আমি ইসফাক কুরেশী (এজিএম) প্রায়ই মনে মনে হাসি। হেসে হেসে ভাবি,
হায়রে দুনিয়া, মাত্র দু’দিনের দুনিয়া। তোমার মাঝে এত রঙ ডং। পুবালী ব্যাংকের
এমডি চেয়ার আজ দিল্লিকা লাড্ডু, এখানে যমুনার রস বইছে। কেউ এই দিল্লিকা লাড্ডু খেয়ে পস্তায়, কেউ
না খেয়ে পস্তায়। কেউ এই রসের সাগরে সাঁতার কেটে ভাবে সে বাদশা আলমগির (বিশ্ববিজয়ী)
হয়ে গেছে।
বিগত
পাঁচ বছর ধরে ব্যাংকে আমাকে নানা ধরনের অপমানকর দুরাবস্থায় ফেলার জন্য আমার আত্মীয়
ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরীর দ্বায়দায়িত্ব কম নয়। আমাকে ঢাকায় না
পাঠালেও চলত। এই এমডি আদৌ কোন ঞ্জানী কিংবা দুরদর্শী লোক নন। ব্যাংক পরিচালনা করেন
অতিদক্ষ ডিএমডি মোহাম্মদ আলী, তিনি কেবল দস্তখত করেন এবং কুটকৌশলের মাধ্যমে এমডিগীরি
শক্ত মোঠোয় ধরে রাখেন। পুবালী ব্যাংকের আধুনিকায়ন ও উন্নতি যাকিছু হয়েছে তা বুয়েট
শিক্ষিত এই মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমেই হয়েছে। তাতে এই এমডি আব্দুল হালিম চৌধুরীর আদৌ কোন
অবদান আছে বলে আমার মনে হয়না। এমন কি তিনি কম্পিউটার চালাতে পারেন কিনা এব্যাপারেও
যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। নিজের শিক্ষা ও যোগ্যতার চেয়ে অনেক বড় কোন পদে ছলে
বলে কৌশলে বসে গেলেই যে কেউ নিজেকে শাহানশাহ আওরঙ্গজেব মনে করাটাই স্বাভাবিক।
৮ জানুয়ারি
২০১৯ ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে আমার দিনটি ভালই পার হয়। লিফটে বারতলায় গিয়ে কাচঘেরা
শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত সাধারণ সেবা ও উন্নয়ন কার্যালয়ে প্রবেশ করি। এই তলায় একটি
মসজিদ ও কর্মচারী ইউনিয়ন অফিস বাদ দিলে বাকী জায়গা জুড়ে সাধারন সেবা অফিস। সুরম্য
এই অফিসের একদিকে কাচঘেরা সাধারন সেবার স্থাপত্য অফিস, অন্যদিকে কাচঘেরা চারটি
চেম্বার। তিনটি চেম্বারের একটিতে বসেন বিভাগ প্রধান মহাব্যবস্থাপক আবু হাবিব
খায়রুল কবীর, আমি যখন সিলেট পুর্ব আঞ্চলিক অফিসে কর্মরত ছিলাম, তিনি তখন পূবালী
ব্যাংকের সিলেট বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি পুবালী ব্যাংকের সিলেট প্রিন্সিপাল
অফিসের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান। স্যার খুব ধার্মিক, পাঁচবার জামাতে নামাজ পড়েন। নামাজে
সুদীর্ঘ সেজদা দেন। তিনি কথা বলেন কম কিন্তু
যাও সামান্য কথা বলেন তা বেশ ভারী ও মূল্যবান। যে কোন সমস্যার সঠিক সমাধান তিনি খুব
অল্প কথায় বলে দেন। ছোটখাট ভুলভ্রান্তিও তাঁর চোখ ফাঁকি দিতে পারেনা। আসলে তিনি একজন ফ্যালকন আই
ব্যাংকার। আমি জিএসডিডি অফিসে ঢুকেই স্যারের সাথে দেখা করি। ময়মনসিংহের জাতক আবু হাবিব
খায়রুল কবীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থবিঞ্জানে অনার্স সহ মাস্টার্স এবং দারুল
ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ।
তারপর
যাই উপমহাব্যবস্থাপক জগত চন্দ্র সাহার চেম্বারে। জগত চন্দ্র স্যার খায়রুল স্যারের
বিপরীত ব্যক্তিত্বের লোক। তিনি হাসিখুশি ও কথাকৌশলি লোক। খুব সুন্দর করে কথা বলেন।
সারা বাংলাদেশ হতে নানা সমস্যার সমাধানে ফোন আসে। জগত স্যার হেসে হেসে তাদেরকে
সঠিক সমাধান বাতলে দেন। ফাইল দেখেন খুটে খুটে, তারপর দস্তখত দেন। তিনি একটু পরপর চা-খান, পান চিবান। আমি জগত স্যারের হাতে তৈরি নানান উপাদান
মিশ্রিত পুষ্টিকর চা প্রায়ই তার চেম্বারে বসে পান করতাম। নেত্রকোনার সন্থান জগত
চন্দ্র সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মার্কেটিং বিষয়ে অনার্স সহ মাস্টার্স। জানিনা তিনি কেন ডিজিএম পদে আটকা পড়লেন, তিনি ডিজিএম হলেও জিএম হবার মত যোগ্যতা
দক্ষতা, ইংরেজি দক্ষতা, কর্মসম্পাদন
ক্ষমতা সবই তার ছিল।
তৃতীয়
চেম্বারে বসে আছেন রংপুরের জাতক সহকারি মহাব্যবস্থাপক ফারুক হাসান। তিনি কেবল বিএ।
পূবালী ব্যাংক সরকারি থাকা কালে তার
পিতা আনোয়ারুল হক ছিলেন এই ব্যাংকের একজন জাঁদরেল মহাব্যবস্থাপক। আবু হাবিব খায়রুল
কবীর, জগত চন্দ্র সাহা এবং ফারুক হাসান তিনজনই ১৯৮৮ সালে একসাথে সিনিয়র অফিসার
হিসাবে পূবালী ব্যাংকে যোগদেন। অথচ সময়ের ব্যবধানে তিনজনের প্রথমজন জিএম, দ্বিতীয়জন
ডিজিএম এবং তৃতীয়জন এজিএম হিসাবে এই একই অফিসে চাকুরী করছেন। একই সময়ে একই পদে
যোগদান করা তিনজন এখানে একে অন্যের বস। ব্যাংকের কর্পোরেট ক্যালচার অনুযায়ী অফিসে
মুখোমুখি হলে তারা পদসম্পর্ক অনুসারে পরস্পর মান্যতার আচরণ করেন। তবে আনোফিসিয়েল
ব্যক্তিগত আলাপে তাদের আচরণে খানিকটা ভিন্নতাও দেখেছি।
চতুর্থ
চেম্বারটি সদ্য নির্মিত এবং সুকেস, বুকসেলফ, ফাইল ক্যাবিনেট সজ্জিত। তাতে একটি
আলনা ও কাপড় রাখার কাঠের আলমিরা রয়েছে। মৌলভীবাজারের আমার প্রিয় সহকর্মি বশির
উল্লা এসে বললেন জিএম স্যারকে বলে আপনি এই চেম্বারে বসে পড়ুন। কেঊ এখনও বসেনি এই
চেম্বারটি যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমার সৌভাগ্য এই সুন্দর চেম্বারটি আমার
ভাগ্যে জুটলো। সাপ্তাহ দিনের মধ্যে আমি চেম্বারে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টার
মেশিন এবং টেলিফোন সংযোগ পেলাম। ব্যাংকের একটি পাঠাগার আমার চেম্বারে ছিল, যেখানে
উপহার হিসাবে ব্যাংকে আসা এসিয়াটিক সসাইটি ও পন্ডিত ব্যাক্তিদের অনেক গ্রন্থরাজি
রাখা ছিল।
আমি
চেম্বারে বসামাত্র যিনি এগিয়ে আসেন, তিনি সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশু। শাহজালাল
বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজবিঞ্জানে সম্মান সহ মাস্টার্স যীশু কয়েক বৎসর সিলেটে কাটান।
তিনি সাস্টের প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। বেশ বুদ্ধিমান ও
করিতকর্মা লোক যীশু ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসাবে যোগদেন ২০১১ সালে । আব্দুল্লাহ
যীশু আমার দেখা একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সাহিত্যমনা মানুষ। লেখালেখিতে তার বেশ
হাত আছে। পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তার ছাপা হওয়া অনেক লেখা আমার হাতে পড়ে। যীশু
নরসিংদী সদর উপজেলার চরদিঘলদী গ্রামের সন্তান।
সহকারী
মহাব্যবস্থাপক সালমা সাফির সাথে দেখা হলে তিনি জানতে চান আমার পরিবার কী করেন।
বেগম সিলেটে চিকিৎসা পেশায় এবং পূত্র ডাক্তারি পড়ায় আছে শুনে সালমা আপা দুঃখ প্রকাশ
করে বললেন, ম্যানেজম্যান্ট কেন যে আপনাকে সিলেট হতে ঢাকায় এনে যন্ত্রণায় ফেলে দিল?
বুয়েট প্রকৌশলী আহমদ ইউসুফ কবির খান ভাস্কর্য্য বিভাগে কাজ করেন। বিকেলে আমি নতুন চেম্বারে বসে ইউসুফকে ডেকে এনে
তাকে দিয়ে মোবাইলে কিছু ছবি তোলাই। সে খানিকক্ষণ এখানে অবস্থান করায় সালমা আপা
আমার প্রতি বেশ বিরক্ত হন এবং মহাব্যবস্থাপক স্যারের কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ দেন
তার লোককে আমি আটকে রেখেছি। এই সামান্য কারণে তার এই অতিমাত্রায় রেগে যাবার কারণ
আমি তখন বুঝতে পারিনি, শেষে জানলাম এই চেম্বার নাকি তার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল।
সুন্দরী সালমা ম্যাডাম এই চেম্বারটি নিজের মত করে সাজান কিন্তু সিনিয়র এজিএম আমি
এসে পড়ায় চেম্বারটি তার হাতছাড়া হয়ে যায়। আমি মনে মনে দুঃখ অনুভব করি যদি অফিসে বসার
মত আরেকটি চেম্বার থাকত তবে আমি তাকে এই চেম্বারটি অবশ্যই ছেড়ে দিতাম। সালমা আপার
বাথরুম সহ একটি চেম্বার ভাস্কর্য্য বিভাগে রয়েছে। আমি না এলে এটি হত তার দ্বিতীয়
চেম্বার।
সহকর্মী বশির উল্লাহ নিখুঁত মানুষ, তিনি
কাজ করেন সযত্নে বেশ দায়িত্ব নিয়েই। তিনি কারও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। তিনি একজন
ক্লিনফিগার মানুষ। মুন্সীগঞ্জের খালেদ আহমেদ একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী অফিসার। তিনি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ বিষয়ে সম্মান সহ মাস্টার্স। তিনি
২০১৪ সালে সিনিয়র অফিসার হিসাবে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করেন। খালেদের কাজকর্ম
নিখাদ। খালেদ, বশির ও যীশু অফিসের তিনজন নিরলস কর্মী।
লক্ষিপুরকন্যা
চিকন ও পাতলা তনু সাইফুন নাহার কথা বলেন বিশুদ্ধ প্রমিত বাংলায়, উচ্চারণে নোয়াখালী
আঞ্চলিক ভাষার কোন নামগন্ধ নেই। তার কাজকর্মও নির্ভুল। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে
রসায়নে সম্মান সহ মাস্টার্স। নারায়ণগঞ্জের
মেয়ে নীলা সুলতানা এসপিও আমার একজন কাছের মানুষ। তিনি সাইফুন নাহারের বিপরীত, বেশ লম্বা
ও চওড়া। নীলা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রাণিবিঞ্জানে সম্মান সহ মাস্টার্স। তার
স্বামীও একজন ব্যাংকার। সাইফুন নাহার ও নীলা দুজনই ধার্মিক ও নামাজি, দুইজনই
অফিসের দায়িত্ববান কর্মী। ------- । -------।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন