সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বুড়িগঙ্গা মেঘনা ও পদ্মায় নৌবিহারঃ

 

বুড়িগঙ্গা মেঘনা ও পদ্মায় নৌবিহারঃ

৯ মার্চ ২০১৯ শনিবার। এই সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি বুড়িগঙ্গায় এক আনন্দ নৌবিহারে অতিবাহিত হয়। পুবালী ব্যাংকের হেড অফিস এই নৌবিহারের আয়োজন করে। ব্যবস্থাপনায় ছিল আমাদের  সাধার সেবা ও উন্নয়ন বিভাগ। যে টিমটি এই বড় নৌবিহার পরিচালনা করেন, তার মধ্যমনি ছিলেন আমার সহকর্মি প্রিন্সিপাল অফিসার সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশু। ৮৬২ জন লোকধারন ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজের একদিনের ভাড়া প্রদান করে ব্যাংক, কেবলমাত্র খাবারের খরচপাতির জন্য সামান্য চাঁদা দেন সবাই। জাহাজটি আমাদেরকে নিয়ে যাবে চাঁদপুর, বাংলাদেশের বিখ্যাত দুই প্রমত্তানদী পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গমস্থলে।

আমি খুব ভোরে সদরঘাট গিয়ে দেখি পরিচিত কেউ নেই। একসময় দুই কন্যা ও স্বামীকে নিয়ে আসেন আমার সহকর্মী নীলা সুলতানা। পত্নী এবং শিশুকন্যাকে নিয়ে আসেন নৌবিহারের আয়োজক সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশু। এজিএম সালমা সাফি, এজিএম দেবাশিষ ভট্টাচার্য্য, এজিএম ইসতিয়াক হামিদ সজল, ডিজিএম দিলীপ কুমার পাল, জিএম এরশাদুল হকসহ অনেকে এসে হাজির হন। আমরা দলবেঁধে জাহাজে আরোহন করি। মহাব্যবস্থাপক আহমদ এনায়েত মঞ্জুর এবং ডিএমডি মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে আমরা জাহাজের একটি কেবিনে যাই। এই জাহাজের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় রয়েছে ১০০টি কেবিন। শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত ভিআইপি কেবিনে রয়েছে বাথরুম। একটু পর এই কেবিনে আসেন ডিএমডি আখতার হামিদ খান। পরক্ষণেই আসেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আব্দুল হালিম চৌধুরী, সাথে ছিলেন তার পত্নী রহিমা আক্তার চৌধুরী রিপা। বিশাল এই জাহাজের নাম এম ভি পারাবত। এবার সপরিবারে আসেন আমার বস মহাব্যবস্থাপক আবু হাবিব খায়রুল কবীর।

দলে দলে পুবালী ব্যাংক লিমিটেড ঢাকায় কর্মরত যোদ্ধারা সপরিবারে এসে জাহাজে এক বড়সড় পূবালীমেলা জমিয়ে দেন। লোকজন তো কম নয়, প্রাচাঞ্চল্যে ভরপুর মিয়া-বিবি-আওলাদ মিলে সংখ্যাটা সম্ভবতঃ পাঁচশত ছাড়িয়ে যাবে। জাহাজ সদরঘাট ছাড়ে সকাল ৯.০০টায়, কিন্তু পাশের বড় বড় জাহাজের সাথে ঠেলাধাক্কা খেয়ে মাঝগাঙ্গে আসতে হয়ে যায় ৯.৩০। বুড়িগঙ্গায় এই আমার প্রথম নৌবিহার, তাই তীব্ররোদে দুপাড়ের দৃশ্য দেখে নিতে একটি কালো সানগ্লাস সাথে নেই। আমার সব সফরই শিক্ষা সফর, জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে সানগ্লাস চোখে নদীর দুইপার পর্যবেক্ষণে লেগে যাই। দুপারে একের পর এক কারখানা ও ইটভাটার সমাবেশ। বুড়িগঙ্গার জলে এসে পড়ছে কারখানার বর্জ্য, পানি যেন পানি নয় ঘোলা ক্যামিক্যালস। যান্ত্রিক নৌযানে ঠাসা বুড়িগঙ্গা- একেকটা জাহাজকে মনে হচ্ছে একেকটা তিনচার তলা ভবন। প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতু পেরিয়ে দেখা হল দ্বিতীয় সেতুর সাথে। দেখে ভাল লাগলো, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বুড়িগঙ্গার বিস্তার বিশাল, নাব্যতাও কম নয়। শতশত দানবাকারের জাহাজ তলায় না লেগেই অনায়াসে চলাচল করে এই নদীতে। এবার জাহাজ জেলাশহর মুন্সিগঞ্জ চলে আসে। বড়বড় সিমেন্ট কারখানা চোখে পড়ে। তারপর দুপারে কেবল সবুজ শ্যামল গ্রামের ছবি ভেসে উঠে। একসময় বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে মেঘনার বিশাল জলধারায় নিজেকে আবিস্কার করি। ভাবনায় এলো, আমি যে জন্মভুমি সিলেটের সবকটি নদীর মিলিত জলের উপর ভাসছি। আস্তে আস্তে চাঁদপুর এসে নদী যেন কুলকিনারাহীন সাগরে পরিত হল। কোনদিকেই নদীর পাড় দেখা যাচ্ছেনা, মনে হচ্ছে আমাদের জাহাজটা মাঝদরিয়ায় আছে। ডিএমডি মোহাম্মদ আলী বললেন এই স্থানটাই সেই বিখ্যাত পদ্মা-মেঘনার ঐতিহাসিক মিলনস্থল। প্রাচীনকালের নাবিকেরা ভুলবসতঃ বিশাল বিস্তারের জন্য চাদপুরের পাশের এই মেঘনাকে মনে করত এটা নদী নয় বঙ্গোপসাগর। সদরঘাট হতে এখানে আসতে ইতোমধ্যে চারঘন্টা পেরিয়ে গেছে। জাহাজ তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে এসেছে, কোথায়ও থামেনি।

জাহাজের ডেকে কার্পেট বিছিয়ে ডিএমডি মোহাম্মদ আলী জামাতে নামাজের আয়োজন করেন। জোহর, আসর ও মাগবিবের নামাজ আমরা জামাতে আদায় করি। মোহাম্মদ আলী একজনকে  ইমামের আসনে দাড় করিয়ে বললেন, কেবল তোমার গায়ে হালাল পোষাক আছে, তাই তোমাকেই ইমাম নির্বাচন করলাম। চেয়ে দেখি এই ভদ্রলোকের প্যান্ট একটু ঢিলেঢালা এবং পায়ের গোড়ালির উপর রয়েছে।    

জাহাজে আয়োজন করা হয় রাজকীয় খানাপিনার। সারাদিন সময়ের ব্যবধানে সুস্বাদু খাদ্য, ফলমূল এবং চা-কফি-পানীয়ে চলে ভোজনবিলাস। পরিচিতরা দল বেঁধে বেঁধে প্লাস্টিকের চেয়ারে বৃত্তাকারে বসে খোশগল্প করে সময় কাটান। অনেকের সাথে ছাদে গিয়ে নদীর চারপাশের দৃশ্যাবলী ও নদীপারের মানুষের জীবনযাত্রা দেখি। বড়বড় জাহাজ নদী তীরে তৈরি ও মেরামত হচ্ছে। নৌভ্রমণের আনন্দ বাস কিংবা ট্রেনের চেয়ে ভিন্ন। বাসে বা ট্রেনে দুপাশের জীবনযাত্রা দ্রুতগতির জন্য খুব ভালভাবে লক্ষ্য করা যায়না। অথচ নৌবিহারে প্রতিটি ঢেউয়ের তালে তালে মন আনন্দে নেচে উঠে। নদী ও তীরের জনপদ যেন কোন বিখ্যাত শিল্পীর তুলিতে আকা নিঃস্বর্গের অমর জলছবি, কিংবা নদী ও তীরের জীবনসংগ্রাম জলের আয়নায় যেন বারবার জয়ী হওয়া বাংলাদেশের প্রতিবিম্ব।

নিচতলায় গোলটেবিল বৈঠকে বসে মাথার উপর আনন্দ কোলাহলের আভাস পাই। উপরে আরোহন করে দেখি দুতলার বিশাল খোলা প্রাঙ্গণ জুড়ে হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- লাইভ কনসার্ট। গায়ক গায়িকারা পরিবেশন করছেন দেশী বিদেশী গান, জলযানের যাত্রীরা গানের তালে তালে নেচেগেয়ে বইয়ে দিচ্ছেন খুশির বন্যা। জাহাজটা হয়ে গেল এক পবিত্র আনন্দ আশ্রম। আমাজনের জঙ্গলে রয়েছে পাঁচসাত শত লোকের বৃহৎ আদিবাসী পরিবার, যারা একটি বৃহৎ ঘরে একত্রে বসবাস করে। আমার মনে হল পুবালীবাসীরা এই জাহাজে চড়ে একদিনের জন্য এমনই এই বড় পরিবার তৈরী করে ফেলেছেন। একসময় অনুষ্টানস্থল হয়ে যায় একটা বড় স্টুডিও। ক্যামেরা ও মোবাইলে পরিচিতজনদের ছবি তোলার ধুম লেগে যায়।

বড়দের এবং বাচ্চাদের খেলাধুলা হয়, লাকি কুপনের র‍্যাফেল ড্র হয়, কুপন বিজয়ীদের নাম বিপরীত দিকে গুণে দশ হতে একে এসে শেষ হয়। অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক উপস্থিত হয়ে পুরস্কার বিতর করেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আব্দুল হালিম চৌধুরী, তখন তার সাথে ছিলেন ডিএমডি মোহাম্মদ আলী এবং ডিএমডি আখতার হামিদ খান। পশ্চিম আকাশে টগবগে লাল সূর্যটা যখন ডুবু ডুবু করছে তখন এক কচিকন্ঠের গান ভেসে এলো ‘দে দে পাল তুলে দে, মাঝি হেলা করিস না, আমি যাবো মদিনা।’ ‘দুনিয়ার নবী এলো মা আমিনার ঘরে, হাসিলে হাজার মানিক কাঁদিলে মুক্তা ঝরে, ও দয়াল মুর্শিদ রে’। ক্ষণিকের জন্য একটা নীরবতা নেমে এলো, সবাই মঞ্চের বালক গায়কের দিকে চেয়ে রইলেন। এযে একজন দশ-বার বছরের পিচ্চি ছেলে যে তার বাপ-মা কে কখনও পায়নি। জাহাজে প্লাস্টিক কুড়িয়ে অন্ন জোগায়, রাস্থাঘাটে ঘুমায়। সামান্য একজন টুকাই বালক সে, যার সুরেলা কন্ঠে গান শুনে আমরা মুগ্ধ হই এবং এই অনাথকে এই সুকন্ঠ দানের জন্য স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বালকটির জন্য প্রাণভরে দোয়া করি। সন্ধ্যার আকাশটা অন্ধকারে ছেয়ে গেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আব্দুল হালিম চৌধুরী এই সুন্দর নৌবিহারের আয়োজনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ ও আগত সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে নৌবিহারের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেন।                                             

জাহাজ সদরঘাটে এসে যখন নোঙর করে তখন রাত সাড়ে সাতটা বেজে যায়। সারাদিনের নৌবিহার ছিল সত্যিই স্মরণীয়, বহুদিন মনে রাখার মত ব্যাপার। আমরা ফিরলাম  ঘরে, অথচ মনটা রয়ে গেল ফেলে আসা জাহাজে, সবার সাথে সবার মাঝে।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                     

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন