সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

স্বপত্নীক হজ্জ যাত্রা; সৌদি সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতি দর্শন- এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা

 

স্বপত্নীক হজ্জ যাত্রা; সৌদি সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতি দর্শন- এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা

যাত্রাঃ ১লা নভেম্বর ২০১০ সাল, ঢাকা ফেরাঃ ১৬ই ডিসেম্বর ২০১০ সাল।

সৌদি আরবে অবস্থানঃ ৪৬ দিন, মদিনাঃ ৬ দিন, মক্কাঃ ৩৮ দিন ও জেদ্দা ২দিন।

 

আমি যখন হাইস্কুলের ছাত্রতখন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে কবি গোলাম মোস্তফার লিখাবিশ্বনবীগ্রন্থটি পাঠ করি। বিভিন্ন ধরনের বই পুস্তকে মনোনিবেশ করা আমার এক চিরন্তন অভ্যাস। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদের (সঃ) জীবনী পাঠ করে আমি খুবই আন্দোলিত হতাম। পরবর্তীকালে বড় হয়ে যখন সৈয়দ আমির আলীর রচিতদি প্রিট অব ইসলামঅধ্যয়ন করিতখন প্রাচীন আরবদের জীবনসংস্কৃতিবিশ্বাস ও আরবের ভূপ্রকৃতি গোত্র ব্যবস্থাআবহাওয়া ইত্যাদি নিয়ে মনরাজ্যে নানা জিজ্ঞাসার মুখোমুখী হই। নবীর (সঃ) স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরী নিয়ে মনোরাজ্যে বিভিন্ন ধরনের কল্পনার সৃষ্টি হত। বাস্তবে এ অঞ্চলটি মানুষ ও তাদের ধর্মাচারণ এবং সংস্কৃতি কেমন তা দেখার জন্য প্রায়ই তীব্র মানসিক তাগিদ অনুভব করতাম। আরেকটি কারণে মক্কার প্রতি আমি তীব্র আকর্ষন অনুভব করতাম- তা হচ্ছে আমার সতের জেনারেশন আগের পূর্বপুরুষ হযরত শাহ দাউদ কুরেশী(রঃ) তের শতাব্দীতে হযরত শাহজালাল(রহঃ) এর প্রথম বারো জন সহচরের একজন হিসাবে এই পবিত্র নগরী হতে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার দাউদপুর গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। কাজেই শৈশব হতেই আরবের এই হেজাজ অঞ্চল দেখার আগ্রহ আমাকে পেয়ে বসেছিল। আব্দুল আলিমের গাওয়া আমার প্রিয় গানকে যাওরে মদীনায়এই অধমের সালামখানি পৌঁছাই দিও রসূলের রওজায় রসূলের রওজা মুবারক দেখতে আমাকে অনুপ্রাণিত করত। ইসলামের পাঁচটি ফরজের মধ্যে হজ্জ অন্যতম। ২০০০ সন হতে আমার মনে হচ্ছে আমি ও আমার স্ত্রী ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরীর হজ্জ ফরজ হয়ে গেছে এবং পবিত্র হজ্জ পালনের একটা মানসিক তাগিদ অনুভব করছিলাম তখন থেকেই। মনে হত হঠাৎ যদি মারা যাই তাহলে পাঁচটি ফরজের একটি অপূর্ণ রয়ে যাবে। ২০০৯ সনে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অফিসের জটিলতায় হজ্জে যেতে পারিনি। কাজেই ২০১০ সনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই। শেষ পর্যন্ত রব্বানী ট্রাভেলসের মাধ্যমে যাবতীয় ব্যবস্থাদি সম্পন্ন হয়। ২০১০ সনের ১লা নভেম্বর মধ্য রাতে বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া করা বিশাল বিমানে আমরা ৪৩৯ জন যাত্রি ঢাকার হযরত শাহজালাল(রঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে জিদ্দা নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ঐদিন সিলেট হতে ট্রাভেলসের একটি ভাড়া গাড়িতে করে ঢাকার হজ্জ্ব ক্যাম্পে যাই। আমাদের ঢাকার আত্মীয়রা এসে দেখা করেন ও বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়ে যান। সিলেটে অনেক আত্মীয়-স্বজন যাবার পূর্বে দাওয়াত খাওয়ান ও হজ্জ্বে গিয়ে ব্যবহার করা যায় এমন ধরনের জিনিসপত্র পুস্তকাদি দিয়ে সহায়তা করেন। এমনকি পূর্বে হজ্জ্বে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গুরুজনরা রীতিমত প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তাদের মধ্যে বিশেষ করে আমার মেঝমামা ফজলুর রহমান চৌধুরীমামী কুহিনূর চৌধুরী ও আমার স্ত্রীর মেডিকেল কলেজ জীবনের সহপাঠিনী ডাঃ রাজিয়া সুলতানার নাম উল্লেখযোগ্য

১লা নভেম্বর রাত ১০টায় ঢাকা হতে বিমানটি পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে স্থানীয় সময় শেষ রাতে জেদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সিলেট হতে একটানা প্রায় ১৮ ঘন্টার যাত্রা পরিসমাপ্তি ঘটে। বিমান হতে ৪৩৯ জন যাত্রি বেরিয়ে বিমানবন্দরে কাঁচঘেরা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হলরুমে অবস্থান করে সবাই প্রাকৃতিক কাজ এবং অজু সেরে কসরের নামাজ আদায়ে রত হন। সৌদি আরব এক তৈল সমৃদ্ধ ধনী রাষ্ট্র কিন্তু বিমান বন্দরের পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা আমাকে হতাশ করে। ছোট ছোট বাথরুমনিচে জমানো পানি এক দারুণ বিরক্তির সৃষ্টি করে। পরে শুনেছি এই বিমান বন্দরে হজ্জ টার্মিনাল আলাদা ও সাধারণ। এখানকার যাত্রি সেবাও সাধারণ। বিমানবন্দরে ভিআইপি রাষ্ট্রের লোকজনের জন্য উন্নত সেবা রয়েছে। ২/৩ ঘন্টা অতিবাহিত হবার পর নিয়ে যাওয়া হয় বহির্গমন কক্ষে। আরব দেশে জনসংখ্যা অল্প। শিক্ষার হার নিম্নমানের হওয়ায় অফিস চালানোর মত দক্ষ লোকজনের অভাব রয়েছে। হজ্জ মৌসুমে প্রায় ৩৫/৩৬ লক্ষ লোক এই বিমান বন্দর দিয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ করে। এই বিশাল হজ্জ যাত্রীগণের ইমিগ্রেশনের অফিসিয়েল কর্ম সম্পাদনের জন্য সৌদি সরকার তাদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অল্প বয়সের অপ্রশিক্ষিত ছাত্রদের নিয়োগ করে। চার-পাঁচটি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে একজন একজন করে পার হতে হয়। এখানে অত্যন্ত ডিমেতালে কাজ পরিচালিত হয় ও দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে মানুষের মনে বিরক্তির সৃষ্টি হয়। বের হয়ে টার্মিনালে বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইনের ভাড়া করা জায়গা রয়েছেযেখানে ঐসব দেশের যাত্রীদের বসানো হয়। আমাদের টার্মিনালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাসহ বরাদ্দকৃত স্থানে সবাই চলে যাই। আমাদের পিছনে গাড়িতে করে সবার মালামাল ঐ জায়গায় নিয়ে আসা হয়। তারপর মদীনার বাসে আরোহনের পালা। আমাদের মদীনায় নিয়ে যাবার জন্য রব্বানী ট্রেভেলসের লোক বড়লেখার হুজুর এসে আমাদের সহিত মিলিত হন। ২/১ ঘন্টা পর সৌদি আরবের দাল্লাহ কোম্পানীর একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে আমাদের উঠানো হয় মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের ড্রাইভার সিরিয়ান লোক। এদেশের হজ্জ মৌসুমে পাশের গরীব রাষ্ট্র সিরিয়াইয়ামেনমিশরসুদান ইত্যাদি হতে অস্থায়ী ড্রাইভার নিয়োগ করা হয়। তাদের কাজের মধ্যে অনভিজ্ঞতার ছাপ দৃষ্টিগোচর হয়। আমাদের সকলের পাসপোর্ট ড্রাইভারের হাতে চলে যায়। পাসপোর্টের সহিত যাত্রী সংখ্যা মিলানোর পর বাস জেদ্দা হতে মদীনার দিকে রওয়ানা হয়। ইতিমধ্যে জেদ্দা টার্মিনালে একজন বাংলাদেশী লোকের কাছ হতে একটি আরবি সিম কিনে আমাদের মোবাইল সেটে ঢুকাই। আমাদের গাড়িতে একজন বৃদ্ধা মহিলা উঠেন কিন্তু তার স্বামী তারা মিয়া আমাদের পিছনে অন্য গাড়িতে উঠে পড়েন। উক্ত ভদ্রমহিলা স্বামী হারিয়ে সারাটা পথ অশান্তিতে কাটিয়ে মদিনায় গিয়ে স্বামীকে ফিরে পান

জেদ্দা হতে মদিনা বিশাল মহাসড়ক। মোট বার লেন বিশিষ্ট সড়ক। জেদ্দা হতে মদীনার দূরত্ব ৪৫০ কি:মি:আসা ও যাবার ছয়টি করে লেন মধ্যভাগে প্রচুর খালি জায়গা থাকায় দুদিকের গাড়িগুলোর লাইটের তীব্র বিপরীতমুখী আলো ড্রাইভারগণের চোখে পড়তে পারে না। রাস্তার দুই পাশে রুক্ষ পাথরের পাহাড়মাঝেমধ্যে বালির উপত্যকা ও সেই উপত্যকায় হলুদ ও ফাকাসে মরুদ্যান। দেশটি বৃক্ষলতা তেমন নেই। আমাদের দেশের মত নেই পাখি ও প্রাণী বৈচিত্র। দুই দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে যেন চাঁদের উপর দিয়ে গাড়ি চলছে। এখানে বাতাস আছে কিন্তু চাঁদে নেই। এই যা পার্থক্য। মাইলের পর মাইল বাংলাদেশের মত কোন নদী-নালাপানিবৃক্ষলতার অস্তিত্ব নেই। বারবার মনে হয়েছে আরবের গোত্রগুলো প্রাচীনকালে এই মৃত অঞ্চলে কেমন করে টিকে ছিল। অসম্ভব কষ্ট সহিষ্ণু ছিল সেই আরবরা এই কঠিন রুক্ষ অঞ্চল দেখলেই অনুমান করা যায়। অসংখ্য গাড়ী রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। বিশ চাকাবিশিষ্ট বৃহদাকার লরী এক সাথে ১৫টির মত কারমাইক্রোবাসের মত গাড়ি পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে- যা বাংলাদেশের সড়কগুলোয় চালানো সম্ভব নয়। মধ্য রাস্তায় গাড়ি থামল, আমরা নেমে খাওয়া-দাওয়া ও নামাজ সেরে আবার গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি দ্রুত মদিনার পানে ছুটে চললো। মদিনা শহরে ডুকার পূর্বে একটি বৃহৎ টার্মিনালে গাড়ি থামলো। আমাদের সাথের অন্য গাড়িটি না আসা পর্যন্ত আমাদেরকে পড়ে থাকতে হল। সুদীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে সবার অবস্থা জর জর। সবাই হোটেলে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ক্লান্তিমুক্ত হয়ে রসুলের (সঃ) রওজায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। হজ্জে গমন ধৈর্যের এক অগ্নি পরীক্ষা। প্রতিটি ঘাটে দীর্ঘ লাইনপ্রচুর সময়ের অপচয়বসে-দাঁড়িয়ে ধৈর্য্য ও কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছার পর গিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল হয়। ক্লান্ত হাজীরা সুদীর্ঘ সময় পর ধৈর্য্যচুতির চুড়ান্ত সীমা অতিক্রমের পর বাস শহরে প্রবেশের অনুমতি পায়। মদীনা শহর-আল্লাহর রসূলের প্রিয় শহর। খোলাফায়ে রাশেদিন ও রসূলের সময় ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। গোত্র বিভক্ত আরবের হেজাজ অঞ্চলের এই ইয়াসরিব নগরে সর্বপ্রথম আরব জাতির রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)ইসলামের বড় বড় বিজয় অভিযানও এই নগর হতে পরিচালিত হয়। শহরটি অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম। বিশাল বিশাল পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। টালীর ওয়ালঘেরা সুরম্য ভবনগুলো দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ইতিমধ্যে রাত্রি নেমে এসেছে। আমাদেরকে কিং ফাহাদ রোডের ফখরানী হোটেলে উঠানো হয়। মদীনার নবুবী মসজিদের সামনের কিং ফাহাদ গেট হতে হোটেলটি ৫/৭ মিনিট হাঁটার রাস্তা দূরত্বে অবস্থিত। রসূলের রওজার গমনের জন্য আমাদের হৃদয় উদগ্রীব। আমার স্ত্রী ডাঃ নূরজাহান বেগম চৌধুরী দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন। আমি তখন চলে আসি মসজিদে নবুবীতে। দূর হতে ভারী সুন্দর মিনারগুলো ঝলমল করছে দেখে দেখে হেঁটে ৫/৭ মিনিটে রসূলের মসজিদে উপণীত হই। মসজিদের ভিতর ঢুকে চোখে ঝলসে যায়। এত সোনালী রং ও ঝাড়বাতি আমি কোনদিন দেখি নাই। মসজিদে নবুবীর মত এত উন্নত ও আধুনিক স্থাপত্য কর্ম আমাদের দেশে বিরল। মসজিদের চতুর্দিকে বিশাল চত্বর-যা মসজিদটির সবদিক অবর্তন করে রেখেছে। বাহিরের চত্বরে অসংখ্য ছাতি- যা নামাজের সময় মেলে ছায়া দেয় ও পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়। মসজিদের ভিতরে সুপেয় ঠান্ডা পানির পীপাগুলো পানের জন্য সারিবদ্ধ রাখা- পাশে ওয়ানটাইম হাউজ গ্লাস রাখা। পানি পানের পর গ্লাসগুলো ফেলারও সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা যখন পৌঁছি তখন মদিনাতে শীতকাল। বাতাস বেশ ঠান্ডা। কিন্তু বাতাস এতই শুস্ক যে নাসারন্ধ্র ও গলা শুকিয়ে যায়। পায়ের পাতা ও চামড়ার অনবরত ভেসেলিন মাখাতে হয়। মসজিদের বাথরুম ও অজুখানা মাটির নীচে চারতলা বিশিষ্ট। চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে একের পর এক নীচে নামা যায়। এক সাথে হাজার হাজার মানুষ অজু ও বাথরুম সারতে পারেন। মসজিদটি অত্যন্ত উন্নতমানের মারবেল পাথরে নির্মিত। মসজিদটির ভিতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ও মাইকিং ব্যবস্থা দারুণ উন্নত। ইমাম সাহেবের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুমধুর। মসজিদটিতে অবস্থান কালে খুব বেশী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং তার সাহাবিগণের কথা মনে পড়ে। মহানবী (সঃ) তাঁর জীবনের শেষ ১১ বৎসর এই নগরীতে অতিবাহিত করেন। মাঝে মাঝে মনে হয় তারা যেন এখনও এখানে বিচরণ করছেন। মসজিদটির একদম দক্ষিণ প্রান্তে মূল মসজিদে নবুবীযেখানে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ছাহাবীগণকে নিয়ে নামাজ আদায় করতেন। এখানে মসজিদের ভিতর বামদিকে একটি সবুজ গম্বুজের নীচে শায়িত আছেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সঃ) ও তাঁর প্রিয় সহচর হযরত আবু বক্কর (রাঃ) ও হযরত ওমর (রাঃ)রওজার উত্তরে একটি মঞ্চ রয়েছেযেখানে হযরত (সঃ) তার সহচরদেরকে উপদেশ দিতেন। সবুজ হচ্ছে হযরত মুহাম্মদের (সঃ) প্রিয় রঙ্গ। তার রওজার গম্বুজটি তাই সবুজ এবং তার মাজার হতে নবুবির মিম্বর পর্যন্ত জায়গাকে লোকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে যা বেহেস্তের একটি টুকরা মনে করা হয়। উহাও হালকা সবুজ গালিচায় আবৃত যদিও সারাটা মসজিদের গালিচা লাল বর্ণের। হযরত মোহাম্মদের(সঃ) রওজার জায়গাটি তার জীবদ্দশায় হযরত আয়েশার (রাঃ) ঘর ছিল। রসূল (সঃ) এখানেই পরলোকগমন করেন এবং এখানেই তার সমাধি রচিত হয়। নবীজির (সঃ) রওজায় ঢুকতে গিয়ে প্রথমেই হোচট খেতে হয়। হাজার হাজার লোক ঢুকার জন্য অপেক্ষা করছে অথচ পুলিশ গেইট বন্ধ করে দিয়েছে

মদিনা মসজিদের অসংখ্য দরজা বা গেট রয়েছে। প্রতিটি দরজার স্বতন্ত্র নামও রয়েছে। রসুলের রওজা মুবারকে প্রবেশের গেটের নামবাবে সালামবা সালাম গেইট। তারপর রয়েছে হযরত আবু বকর গেটওমর বিন খাত্তাব গেইবেলাল গেট ইত্যাদি। বর্তমান সৌদি রাজ বংশের রাজাগণের নামেও অসংখ্য দরজা রয়েছে যেমন- কিং ফাহাদ গেটকিং ইবনে সৌদি গেট ইত্যাদি। এশার নামাজের পর বাবে সালাম খুলে দেওয়া হয়। দুরূদ শরীফ পাঠ করে করে হাজার হাজার মানুষ প্রবেশ করে রওজার পাশ অতিক্রম করে বাহিরের গেট দিয়ে বের হয়ে যায়। বিভিন্ন রং-বর্ণভাষাপোশাক আশাক ও সংস্কৃতির মানুষের ভীড়ে নিজেকে বিলিয়ে দেই। রসুলের জীবনের তীব্র কষ্টযন্ত্রনাসংগ্রাম এবং তার সাফল্য মনে পড়ে। চোখ পানিতে ভিজে যায়। মোট বার দিন মদিনায় অতিবাহিত হয়। শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজের আগে মসজিদে গিয়ে সূর্য উঠার পর হোটেলে ফিরতাম। মসজিদে মহিলা ও পুরুষের আলাদা নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। আবার মহিলাদের জন্য মসজিদে অজুখানাটয়লেট ও আলাদা প্রবেশ পথ রয়েছে। মসজিদটিতে এক সাথে ৫/৭ লক্ষ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। জোহরের নামাজ জামাতে পড়ে এসে খাওয়া ও হালকা ঘুম সেরে আছরের সময় মসজিদে গিয়ে এক সাথে এশার নামাজ পড়ে ফিরে আসতাম। আমার রূমমেট ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার জনাব সাইদুল হাসান। বর্তমানে তিনি প্রাইমারি শিক্ষক হতে সদ্য অবসর নিয়েছেন। তার স্ত্রী সব সময় আমার সহধর্মিনীকে সঙ্গ দিতেন। সাইদুর সাহেবের গ্রামের ছেলে নূর হোসেন। তিনি দীর্ঘদিন হতে মদিনায় আছেন ও ছোটখাটো ব্যবসা করেন। একদিন তিনি প্রচুর বিভিন্ন ধরনের ফল নিয়ে আসেন। আঙ্গুরপেঁপেকলাআপেলচেরিফল ইত্যাদি। রূমমেট হিসাবে আমরা খাবারে শরিক হই। পরদিন নুর হোসেন গাড়ী ভাড়া করে আমাদেরকে পুরো মদিনা শহর ঘুরে দেখান। ওহুদের যুদ্ধক্ষেত্র ও ওহুদ পাহাড়হযরত হামজার (রাঃ) মাজার ও হামজা মসজিদ ঘুরে দেখি। মসজিদুল কুব্বা-মদিনার এই প্রথম মসজিদে নামাজ পড়ি। তারপর চলে যাই মসজিদুল কিবলা তাইনে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে নামাজের কিবলা ছিল জেরুজালেম মসজিদ। পরে উক্ত মসজিদে এসে রসুলউল্লা (সঃ) মুসলমানদের কিবলা আল্লাহর নির্দেশে কাবাগৃহের দিকে নির্ধারণ করেন। খন্দকের যুদ্ধক্ষেত্রের এরিয়া ঘুরে দেখি। রাস্তাগুলো বৃহদাকার হওয়ায় ১০০ কি:মি: বেগে গাড়ি শহরটি প্রদক্ষিণ করে। একটি পাহাড়ে কৃত্রিম পানির ঝরণা রয়েছেপাহাড় বেয়ে পানি নিচে নেমে আসছে। দুটি রাস্তা যেখানে ক্রস হবে সেখানে একটি রাস্তা অন্যটির উপর ওভারব্রিজ করে দেওয়া হয়। ফলে কোন যানজন নেই। শহরের মধ্যে পাহাড় কেটে অসংখ্য সুড়ঙ্গ রাস্তাও করা হয়েছে। এখানে পানির তৃষ্ণা হয় প্রচুর ও প্রচুর পানি পান করলেও সে অনুপাতে প্রস্রাব হয় না- শুষ্ক বাতাস শরীর হতে পানি চুষে নেয়। প্রায়দিনই ফজরের নামাজের পর মুহাম্মদের (সঃ) রওজা ও জান্নাতুল বাকী জেয়ারত করতাম। জান্নাতুল বাকী হচ্ছে রসুলুল্লাহের রওজা হতে খানিক দূরে এমন এক সমাধি ক্ষেত্র যেখানে মা ফাতেমা(রাঃ), হযরত হাসান(রাঃ), হযরত উসমান(রাঃ) হযরত তালহা(রাঃ), হযরত জুবায়ের(রাঃ) হযরত আয়শা(রাঃ)সহ প্রায় দশ সহস্রাধিক সাহাবি ঘুমিয়ে রয়েছেন। এখানে শেষ নিদ্রায় শায়িত আছেন অসংখ্য সাহাবিতাবেয়িতাবে তাবেয়িসহ অসংখ্য পূণ্যবান মানুষ

মাজারকে কেন্দ্র করে ব্যবসাবাতি জ্বালানোধূনা পোড়ানোগোলাজল ছিটানো ও টাকা উঠানো এগুলোর প্রচলন আরব দেশে নেই। আরবরা মাজারের দিকে মুখ করে দুয়াদুরূদ পড়া বা প্রার্থনা করেন না। তারা কবরের পাশে গিয়ে কিবলা মুখী হয়ে দোয়া দুরূদ পড়েন ও প্রার্থনা করেন। কোন ধরনের কবরের দিকে হাত উঠানো ও বাতি ধুনা জ্বালানোআতর ছিটানো তারা বেদাত মনে করেন। বিখ্যাত বিখ্যাত সাহাবিদের কবরে কোন বাতি নেই,  এমনকি স্মৃতিফলকও নেই। রসূলের(সঃ) রওজা শরিফেও এ ধরনের কোন ক্রিয়াকর্ম করতে দেওয়া হয় না। মানুষ হৃদয় দিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন কিন্তু বাহ্যিক আচার আচরণ প্রদর্শনে আমাদের দেশের মত অতি বাড়াবাড়ি করতে দেওয়া হয় না। মদিনায় আমরা সকালের নাস্তা নিজেরা করতাম। দুপুর ও রাতে টুকেন দেওয়া হত। উক্ত টুকেন দিয়ে পাশের চট্টগ্রামী হোটেলে খাবার সেরে নিতাম। খাবার ছিল হরেক রকম মাছমোরগগরু ও খাসির মাংস। সাথে ডাল ও সবজি। রান্না বাংলাদেশীখাবারও মনে হত বাংলাদেশ হতে সরবরাহকৃত। হোটেলে কাজ করেন কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকেরা। তাদের ব্যবহার অত্যন্ত ভদ্র। তাদের বিরতিহীন পরিশ্রমী জীবনেও মধুর আচরণ আমাদেরকে মুগ্ধ করে

মদিনার মানুষকে আমার অত্যন্ত সজ্জ্বন মনে হয়েছে। নামাজে যাবার সময় লোক দেখলেই গাড়িগুলো থেমে যায়। সালাম দেয় ও হাজীগণ রাস্তা পার হবার পর তারা রাস্তা অতিক্রম করে। ফুটপাতে আফ্রিকার গরীব-সুদানী-সুমালী কালো মহিলারা সামান বিক্রি করেন। আসরের পর সব দল বেঁধে তারা বাসমতি পোলাও ও মোরগের রোস্ট রাস্তার ফুটপাতে বসে মিলেমিশে খায়। দৃশ্যটা উপভোগ্য, কারন এখানে ধনী-গরীব সবাই রোস্ট পোলাও খেতে পান অনায়াসে। মদিনাবাসী যেন মানুষের জন্য কোন ধরনের খেদমত করতে পারলেই আনন্দ পান। মাগরীবের আজানের পর তারা মসজিদে খেজুরকিমা ও পানীয় বিতরণে নেমে পড়েন। সকালে ও রাতে ট্রাকে করে খাবারের দামী প্যাকেট পানীয় শরবত এনে রাস্তায় বিতরণ করেন। মদিনা এমন একটি স্থান- যেখানে কোন মানুষ না খেয়ে থাকবে না। সেখানে মানুষ আসলেই মানুষের জন্য এমনটিই মনে হয়েছে। মদিনার যেদিকে আমাদের হোটেলঐ দিককে বাংলাদেশী এলাকা বলা হয়। চট্টগ্রামের বাংলাদেশী ভাইয়েরা এখানে অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক দোকানে বাংলাদেশী সাইবোর্ডও রয়েছে। তাবু আকৃতির বিশাল ব্যবসা কেন্দ্রে প্রচুর বাংলাদেশী মানুষ খেজুর জায়নামাজসহ প্রচুর মালামাল বিক্রি করছেন। নানা দেশের লোকেরা কিনে নিচ্ছেন। আমরা মসজিদে নবুবীর যাবার পথে অবস্থিত উক্ত বাজার হতে প্রচুর ভাল খেজুর ক্রয় করি। সোনার মদিনায় এভাবে কেটে যায় আমাদের বারটি দিন। তারপর আসে পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য মক্কা যাত্রার পালা। রসুলের রওজা শেষবারের মত জেয়ারত করি দীর্ঘ সময় নিয়ে। তারপর কি যেন তীব্র বিরহ ব্যথা নিয়ে হোটেল ফখরানীতে ফিরে আসি

দুইটি বড় গাড়ীতে করে মক্কায় রওয়ানা হই আমরা সবাই। রাস্তা ঐ মদীনা জেদ্দা রোড। রাস্তায় দূরত্ব প্রায় ছয় শত কি.মি.এক সময় মহাসড়কের পাশে একই সাইবোর্ড দেখা যায় লিখা-মক্কা রোডবাম দিকে মোড় নিয়ে মক্কা রোডে ডুকে পড়ে গাড়ী দেড় দুই ঘন্টা পরই চোখে পড়ে কাবাঘরের সামনের বিশাল মিনার ও মিনার ঘড়ি। যাত্রীরা সবাইলাব্বায়েকআল্লাহুম্মা লাব্বায়েকউচ্চস্বরে পড়তে থাকেন। যাত্রীদের সবাইকে এ সময় চোখ মুছতে দেখা যায়। এই সেই পবিত্র নগরী যেখানে হযরত মুহাম্মদের(সাঃ) জীবনের বায়ান্ন বৎসর অতিবাহিত হয়। এই শহরে ইসলামের জন্ম হয়। এই শহরে পৃথিবীর প্রাচীনতম আল্লাহর ইবাদতখানা কাবাগৃহ অবস্থিত। উল্লেখ্য যেআমরা মদিনা হতে বের হয়ে ত্রিশ চল্লিশ মাইল দূরে যুল হুলাইফা নামকস্থানে আলী মসজিদে নামাজ পড়ে এহরাম বাঁধি। এই মসজিদের হজ্জ করার জন্য হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) এরহাম পরতেন। মদীনা হতে আগত হজ্জ যাত্রীদের ঐ মসজিদে এহরাম বাঁধা সুন্নাত

মক্কার ঢুকার সময় মক্কা শহরে প্রচন্ড মানুষের ভীড় লক্ষ্য করি। যানবাহনও প্রচুর। রাস্তাঘাট মদীনা কিংবা জেদ্দার মত এত প্রশ্বস্ত নয়। অসংখ্য সুউচ্চ ভবন ও পাথুরে পাহাড়ে শহরটি পরিপূর্ণ। কাবাগৃহের পাশ দিয়ে গাড়ী চলে গেল বেশ দূরে হাইয়্যাল হিজরা নামক স্থানে। এখানে একজন পাকিস্তানী আরব নাগরিকের চারতলা বাসা ভাড়া করা হয়েছে। এখানে একদিন একরাত অবস্থানের পর ছুটে যাই মিনার ময়দানে পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য। মিনার তাবুতে তিন দিন তিন রাত অতিবাহিত করে আরাফাতের দিন বিকালে আরাফাতের ময়দানে হাজির হই। আরাফাতের ময়দানে অসংখ্য গাছের ছড়াছড়ি। আনন্দদায়ক বাতাসে গাছের ডালগুলো দোলছিল। আরাফাত হতে ফিরে মুজদালিফার খোলা চত্বরে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পাঁচ ছয় মাইল হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। লক্ষ লক্ষ নর-নারীজোয়ান-বৃদ্ধ-শিশু হেঁটে হেঁটে মুজদালিফার প্রান্তরে ছোটে আসেন রাতভর। মানুষের এই চলমান গতি আমাদেরকে মুগ্ধ করে। এই হজ্জ্ব এনথ্রপোলজি বা মানববিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য অসাধারণ অভিজ্ঞতার জায়গা। এখানে এই পৃথিবী নামক গ্রহের সৃষ্টির সেরা প্রাণী মানুষের সব নৃ-তাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ও ভাষাভাষি মানুষের সমাবেশ ঘটে। কেউ কালোকেউ সাদাকেউ কয়লা কালোকেউ বেগুনী কালোকেউ দুধে আলতাকেউ বা পীত বর্ণের। চেহারার বৈচিত্রও রয়েছে। এমন সুন্দর নর-নারী রয়েছেন- আমাদের বাংলাদেশে তাদের একজনের মত সুদর্শন মানুষ হয়তো বের করা সম্ভব হবে না। আবার কালোদের মধ্যে এমন বিকট আকৃতির লোকও রয়েছেন যাদের বাংলাদেশের রাস্তায় সন্ধ্যার পর নামানো হলে মানুষ ভূত মনে করে ভয়ে পালাবে। পোশাক পরিচ্ছদের বৈচিত্রতো রয়েছেই। কেউ মাথায় ভারি পাগড়ীকেউ রুমালকেউ বা নানাধরনের টুপী পরে আছেন। বেশীর ভাগ মানুষের লম্বা জোব্বা-পাজামাই পরিধান করতে দেখা গেছে। আফ্রিকার বিভিন্ন কালো মানুষের জোব্বায় তাদের দেশের ও অঙ্গরাজ্যের নামও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমাদের দেশের কিছু পীর সাহেব তাদের মুরিদ নিয়ে হজ্জ্বে যান। তাদের কাপড়ে পীরদের নাম ও পীরদের ট্রেভেলসের নাম রয়েছে

কোন কোন মানুষের চুল কুকড়ানো কালোকারো পাটের মত সাদাকারো ক্ষেতের ধানের গোছার মত গুচ্ছ গুচ্ছ। আফ্রিকার চাঁদ দেশের কিছু লোককে কাবাঘরে দেখেছি যারা লম্বা পাগড়ির রুমাল দিয়ে চোখ ছাড়া সারাটা মুখ ঢেকে দেয়। খুব সম্ভব সাহারা মরুভূমি ভীষণ বালি প্রবাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই পোষাকের প্রচলন হয়েছে। ভারতীয় মুসলমানদের ধূতি ও লুঙ্গি। পাকিস্তানিরা শেরওয়ানি পাঞ্জাবিনারীরা সেলোয়ার কামিজবাংলাদেশীরা লুঙ্গি ও পাজামাইন্দোনেশিয়ার  পুরুষরা রঙ্গীন লুঙ্গি ও শার্ট ও মেয়েদের সাদা প্যান্ট ও কামিজ পরতে দেখেছি। ইন্দোনেশিওয়া প্রায়ই অল্প বয়স্ক মনে হয়েছে

আরাফাতের পরদিন মক্কায় প্রচন্ড বৃষ্টি হয়। এধরনের মুষলধারে বৃষ্টি বাংলাদেশেও খুব কম হতে দেখা যায়। সেই সাথে প্রচন্ড বজ্রধ্বনী। জামারাতে মাগরীবের আগে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। কাজেই প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে মক্কা হতে তওয়াফে জিয়ারত শেষ করে জামারাতে হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হই মাথায় একটি প্লাস্টিকের টুকরা ধরে বৃষ্টির মধ্যে /৩ ঘন্টা দৌড়ে জামারাতে গিয়ে পাথর বর্ষন করি। বাংলাদেশে বিগত ২০ বৎসরেও আমি এত বৃষ্টিতে ভিজি নাই। মক্কায় হাইয়্যাল হিজরায় ফিরে রাত্রি কাটিয়ে পরদিন কাবাঘর হতে প্রায় একশত হাত দূরে মিছফালারমদীনা প্যালেস’ হোটেলে উঠি। তীব্রভাবে জ্বরাক্রান্ত হয়ে ২ দিন কেটে যায়। কাবাঘরের এত কাছে হোটেলটি যেআমরা আজান শুনে বের হয়ে কাবাঘরে ঢুকে জামাতে শরিক হতে পারতাম। কাবাঘরের সামনের গেইট হতে হোটেলটির দূরত্ব বড়জোড় একশত/দেড়শত হাত হবে। এখানেও বাংলাদেশী লোকদের অনেক ব্যবসাপাতি রয়েছে

কাবাঘর অত্যন্ত সম্মানিত আল্লাহর ঘর। প্রায় চৌত্রিশ লক্ষ লোক সমবেত হয়েছেন এখানে। এই ঘরটি পৃথিবী সৃষ্টির পর আল্লাহ তাঁর পবিত্র  উপাসনা গৃহ হিসাবে নির্ধারণ করেন। দুইজন আরবী শাসক উক্ত গৃহে হামলা করে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। একজন আবরাহা আল হাবসি, যিনি আবাবিল পাখি কর্তৃক হস্তি বাহিনীসহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হন। অন্যজন ইয়াজীদ ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান। তার বাহিনী কাবাঘরে আগুন ধরিয়ে দিলে সাতাশ দিনের মাথায় রাজধানী দামেস্কে হঠাৎ মারা যান। প্রাক ইসলামি যুগ হতেই মানুষ প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনে এই পবিত্র গৃহটি তাওয়াফ করে আসছেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত ইসমাইল (আঃ) ও হাজেরার (রাঃ) পবিত্র স্মৃতি বিজড়িত রয়েছে এইখানে। হযরত ইব্রাহীমের পত্নী মা হাজেরার দোয়ায় কাবাগৃহের নীচ হতে বেরিয়ে আসছে জমজমের পানি। সারা পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে হাজীগণ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই পানি-অথচ এর কোন ঘাটতি নেইশেষ নেই। বৃষ্টিহীন এ মরুশহরে আল্লাহর এক অশেষ নিয়ামত এই জমজমের পানি। হয়তো বা এই পানিকে কেন্দ্র করে এই শহরটি মরুভূমিতে টিকে রয়েছে যুগের পর যুগ। কাবাকে কেন্দ্র করে আরবে যত লোক ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রবেশ করে তাহা বাংলাদেশের মত এক ছোট গরীব দেশের হয়ত বাজেটেরও অধিক হয়ে যাবে

পৃথিবীর দুইশত ত্রিশ কোটি মানুষের সেজদা ও জিকির আজকার এসে পড়ে এই কিবলা-কাবাঘরে। পৌঁছে যায় পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে। কাবাকে আমার মনে হয়েছে মানুষ ও আল্লাহর মধ্যকার যোগাযোগ টাওয়ার হিসাবে। কাবার কাছাকাছি গিয়ে আমি ভীত হতাম আবার খোদাপ্রেমে উদ্দীপ্ত ও হতাম। মনে হত আমার মত একজন ক্ষুদ্র তুচ্ছ সামান্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর একদম সামনা সামনি

আমরা কিবলাকে সম্মান করে ঐদিকে পা রাখি না অথচ মক্কায় মানুষ অহরহ কাবার দিকে পা রেখে ঘুমিয়ে পড়েএবাদত বন্দেগী করে। মদীনায় মসজিদে নববীতেও মানুষ রওজার দিকে পা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি হঠাৎ লক্ষ্য করি আমার হোটেলের সিটটি এমনভাবে সাজানো ঘুমালে পা কাবাগৃহের দিকে হয়ে যায়সাথে সাথে তা পরিবর্তন করে কিবলা শিয়রের দিকে নিয়ে যাই। আসলে ঐসব দেশের মানুষের কিবলা কিংবা রওজার দিকে পা রাখা নিয়ে কোন ধরনের আদবী-বেআদবীর ধারনার প্রচলন নেই- যা আমাদের মধ্যে রয়েছে। নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মানুষ আমাদের মত সুন্নত কিংবা নফল নামাজের গুরুত্ব দেয় না। তারা মসজিদে ঢুকে দুই রাকাত দাখিয়াতুল মসজিদ নামাজ পড়ে ফরজ নামাজ জামাতে আদায় করে চলে যায়- প্রায় ক্ষেত্রেই সুন্নত নফল নামাজ পড়ে না। অনেকের সহিত আলাপ করে দেখেছি সুন্নত ও নফল নামাজ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। এমনকি বিতির ওয়াক্তের নামাজ কেউ ১ রাকাত পড়েকেউ আদৌ পড়ে না। আমরা কাবাগৃহ হতে মাইল খানেক দূরে জান্নাতুল মাওলা কবরগাহ জিয়ারত করি- যেখানে অসংখ্য ছাহাবীগণের সহিত রসুলের(সঃ) প্রিয়তমা পত্নী হজরত খোদেজা(রাঃ) ঘুমিয়ে রয়েছেন। হাইয়্যাল হিজরায় অবস্থানকালে হযরত মুহাম্মদ(সঃ) হিজরতের সময় যে পাহাড়ের গর্তে তিন দিন তিন রাত আত্মগোপন করেছিলেনসেই ছুর পর্বতে এক ঘন্টা বিশ মিনিট পাহাড় বেয়ে উঠি। গুহাটি প্রায় মাইল দেড়েক উপরে অবস্থিত। নীচের গাড়ী ও মানুষগুলোকে অত্যন্ত ছোট দেখাচ্ছিলো। পাহাড়টি শক্ত পাতুরে। কিছু কিছু বিশালাকার পাতরের বল পাহাড়ে আটকে আছে। এসব পাতরের চিপাচাপা দিয়ে উপরে যেতে বেশ ভয় লাগে যদি বলের মত একটি পাতর ঝরে ছুটে আসে, তাহলে একদম পিষে মেরে ফেলবে। মাইলখানেক নিচ পর্যন্ত পর্বতগাত্রে নামা-ওঠা রত মানুষের অবিরাম সারিকে দেখে মনে হচ্ছিলো পীপীলিকার ধাবমান দল। পথে পথে পানি পান করে করে উঠতে হয়েছিল। এত উচ্চতায় আমি আমার জীবনে আর কোনদিন আরোহন করি নাই। মোহাম্মদ(সঃ) এতই বুদ্ধিমান ছিলেন যে শত্রর চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য তিনি মদীনার রাস্তার বিপরীত দিকে এই গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন

মক্কায় অবস্থানকালে একদিন আমাদের রুমের বৃদ্ধ ভদ্রলোক বিয়ানীবাজার গড়েরবন্ধের আবুল হাসান ও নজরুল ইসলামের একজন আত্মীয় আসেন আমাদেরকে জেদ্দায় নিয়ে যাবার জন্য। নতুন দেশ ও জায়গা দেখার লোভ আমার জন্মগত স্বভাব। গাড়ী ভাড়া করে আমরা তিনজন ও ভদ্রলোক মক্কা হতে জেদ্দায় রওয়ানা হই। আশি মাইল দূরত্ব। সৌদি আরবে দেড় ঘন্টার রাস্তা। মধ্যভাগে এসে প্রচন্ড বৃষ্টি। রাস্তার উপর বাংলাদেশের মত পানি বয়ে যায়। পথিমধ্যে আলাপক্রমে জানতে পারলাম আমাদের মেজবান জেদ্দার ভদ্রলোক হচ্ছেন আমার এলাকার লোক,  নাম তার আব্দুল মজিদতিনি মোগলাবাজারের নেগাল গ্রামের জনাব আরকান আলীর পুত্র। অত্যন্ত সদালাপী ও উন্নত মনের মানুষ এই আব্দুল মজিদ। জেদ্দা শহরের এক প্রান্তে তার গাড়ী মেরামত ওয়ার্কশপ। আরও কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে সুন্দরভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। উপরে শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত কার্পেট মোড়ানো বাসা। ঠান্ডা ও গরম পানির লাইন রয়েছে বাসায়। স্ত্রী কলি বেগমএক পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের লোহিত সাগরের পাড়ে সুন্দরভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন জীবনের চাকা। ভদ্রলোক আমাদের খাওয়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। গাড়ীতে করে মধ্যপ্রাচ্যের এই কম্পিউটার নগরী জেদ্দাকে ঘুরে দেখান সস্ত্রীক। আরবিতে কথা বলতে পারেন অনর্গল। দেশ বিদেশের বিভিন্ন ধরনের নাম নাজানা ফল ও খাবার এতই পরিবেশন করেন যে আমাদের দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়। বিশাল বিশাল রাস্তার শহর এই বন্দর জেদ্দা। লোহিত সাগরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে রাস্তা। সেতুর মাধ্যমে সাগরের জলের উপর দিয়ে গিয়ে সমুদ্রে স্থাপন করা বৈঠকখানায় বসি। স্বচ্ছ পানিতে দৃষ্টিগোচর হয় নানা ধরনের মাছ। সমুদ্রে ভাসমান তাবু আকৃতির হোটেল ও বাড়ীগুলোতে মানুষ অবকাশ যাপনের জন্য অবস্থান করে। কোথাও বা খালের মত নালা কেটে সাগরকে ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে নগরীর ভূভাগেগড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। লোহিত সাগরে আমাদের বঙ্গোপসাগরের মত এত ঢেউ কিংবা বাতাস নেই। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের মত ছোট ছোট ঢেউ দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কক্সবাজারের মত এত সামুদ্রিক গর্জনও নেই। মনে হয়েছে আরবীরা আমাদের কক্সবাজারের বেলাভূমি দেখলে লোহিত সাগরকে হয়ত সমুদ্রই বলত না। জেদ্দায় একটি মসজিদ রয়েছে যাকে আমাদের সিলেটিরা কল্লাকাটার মসজিদ বলে থাকেন। মসজিদটির সামনে যখণ ট্রাক দিয়ে বালি ফেলা হয় তখন মানুষ ধারণা করে শিঘ্রই বাদ জুমুয়া এখানে কোন অপরাধীর মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হবে। অপরাধীদেরকে এখানে এনে পিছন দিকে দুই হাত বেঁধে হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রকাশ্যে জল্লাদ তরবারীর এক ঘাঁয়ে দেহ হতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে বালিতে ফেলে দেয়। পরদিন বিয়ানীবাজারের গড়ের বন্ধ কুড়ার বাজার নির্বাসী হাজি আকবর আলীর ছেলে আলী হোসেন তার বাসায় দাওয়াত করেন। ভদ্রলোক তীক্ষ্মবুদ্ধি সম্পন্ন। আরবদের সাথে বন্ধুত্ব করে খুব ভাল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন জেদ্দায়। থাকেন রাজকীয় বিলাসবহুল বাসায়চালান অত্যন্ত দামী গাড়ী। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে ভাবনায় তিনি। খাবারে বসে দেখি বাংলাদেশের সমুদয় খাবার চলে এসেছে। রান্নাও বাংলাদেশী। মনে হলো যেন বাংলাদেশের কোন বড়লোকের ঘরে নিমন্ত্রণ খেতে  বসেছি। ফেরার সময় আমাদের প্রত্যেককে একশত রিয়াল করে দেনআমি খুব কষ্ট করে ফেরত দেই। পরদিন মজিদ সাহেব গাড়ীতে করে তার জরুরী সময় নষ্ট করে আবার মক্কায় নিয়ে যান। উপহার দেন দুইটি ভাল জায়নামাজ একটি আমাকে ও অন্যটি আমার স্ত্রীকে। আসার আগেও তিনি সস্ত্রীক মক্কা এসে আমাদেরে দেখে যান। আল্লাহ তাদেরকে সুখী করুন

হজ্জ হচ্ছে ইসলামের পাঁচটি ফরজ কর্মের একটি। হজ্জকে আমার মনে হয়েছে নতুন নিয়োগ সেনা অফিসারদের প্রশিক্ষণ। এখানে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দৌঁড়াতে হয় মাইলের পর মাইল। মুজদালিবায় ঘুমাতে হয় খোলা আকাশের নীচেমিনায় তাবুতে। বাথরুমগোসলখাবার কেনায় লাইন ধরে দাঁড়াতে হয়। পদে পদে ভীড়ের মধ্যে ধৈর্য্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। হজ্জের মৌসুমে সবকটি ট্রেভেলস হজ্জের দালালে পরিণত হয় যদিও বেশীর ভাগের কোন লাইসেন্স নেই। এরা হজ্জ এজেন্টের দালালী করে কোন ধরনের কাজ ও পরিশ্রম ছাড়াই প্রতি হাজীর ৪০/৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। কাজেই ঠিক হজ্জ এজেন্ট ছাড়া অন্য কোন ট্রেভেলসের মাধ্যমে কাজ করা ঠিক নয়

হজ্জের সময় প্রচন্ড ভীড়ে কাবায় নারী পুরুষ একত্রে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন। ভীড় কমে আসলে কাবাঘরের ধর্মগুরুগণ নারী পুরুষ আলাদা করে দেন। কাবাঘরের সন্নিকটে গড়ফরহধ চধষধপব এ মোট আটাশ দিন অবস্থান করি। ভীড় কমে আসলে দিনে অসংখ্যবার তওয়াফ করি। ভীড়ের সময় ছাদে কিংবা ২য় তালায় সাতবার তওয়াফ করে সময় লেগে যায় ৫০/৫৫ মিনিট। ভীড় কমার পর নীচে সাত তাওয়াফ ১৫ মিনিটের মধ্যে হয়ে যেত। উক্ত সময়ে আমি ও আমার স্ত্রী ডাঃ নূরজাহান বেগম ছয়বার করে উমরা করে আসিআমাদের সাথে অনেক হুজুরও যানযারা একাধিকবার হজ্জ করেছেন। বদলা হজ্জে ছওয়াবতো হয়ই। সেই সাথে আর্থিক লাভও হয় প্রচুর।

একজন বয়স্ক হুজুরের জ্ঞানের বহর দেখেও অবাক হই, যিনি ১১/১২ বর্ষের ক্লাস শিক্ষক। কাবাঘরে নামাজ আদায়ের সময় হঠাৎ বলে উঠেন কোরেশী সাবএই কাবাঘরের ছাদ ধরে রেখেছে অসংখ্য খুঁটি অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আকাশকে ধরে রেখেছেন কোন খুঁটি ছাড়াই। তার ধারণা পৃথিবী গোলাকার নয়, সমতল। আকাশকে উপরের স্বস্থানে বহাল থাকতে হলে পৃথিবী হতে আকাশের ওজন ধরে রাখার জন্য বড় বড় খুটির ঠেস প্রয়োজন। কিন্তু আল্লাহ পাকের কুদরতে তা ছাড়াই এত লোড শূন্যে ঝুলে আছে। হুজুর মাদ্রাসা শিক্ষকের এসব কথাবার্তা শুনে বুঝলাম পৃথিবীগ্রহনক্ষত্র ও মধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই।

একদিন একজন ভারতীয় ও একজন পাকিস্তানির সাথে আমাদের গল্পের আসর জমে উঠে। সবাই নিজ নিজ দেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভারতীয় হাজী বললেন তাদের সরকার ভাল, হজ্জ পালনে প্রচুর ভর্তুকি দেয়। তারা তাই অর্ধেক খরচে হজ্জ করতে পারেন। এবার একজন পাকিস্তানি এগিয়ে এসে বললেন, আমাদের রাষ্ট্র শক্তিশালী, আমরা মুসলিম বিশ্বে একমাত্র পারমানবিক বোমার অধিকারী। আমাদের প্রফেসর আব্দুস সালাম বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। অমনি একজন বাংলাদেশী বললেন, আব্দুস সালাম একজন কাদিয়ানি। এবার আমরা বাংলাদেশের প্রসংশায় পঞ্চমুখ হই। একজন বললেন, চীনের পর সবচেয়ে বড় গারমেন্টস রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সবচেয়ে বড় সেনাদল আমাদের, আমরা এখন সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছি। এই সৌদি আরবেও আমরা সবচেয়ে বড় বিদেশী জনগোষ্টি।      

হজ্জ পালনকালে ২৪শে নভেম্বর ছিল আমার শ্রদ্ধেয় পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরীর তৃতীয় ইন্তেকাল দিবস। ঘুম থেকে উঠে তার কথা মনে পড়লে উমরা করি ও ছালাতুত তাছবীহ নামাজ আদায় করে তার জন্য দোয়া করি

এখন আমি সৌদি আরব ও আমাদের বাংলাদেশ নিয়ে একটা তুলানামূলক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করব। সৌদি আরবদেশটির আয়তন আট লক্ষ চল্লিশ হাজার বর্গমাইল। আমাদের দেশের চেয়ে পনের গুণ বড়। দেশটির লোক সংখ্যা অল্প। মাত্র দুই কোটি। দেশটির মানুষ তিন স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তর হচ্ছে শাসক পরিবার বা সৌদি রাজবংশ। সংখ্যায় বিশ পঁচিশ হাজার জন। এরাই রাষ্ট্রের শাসক। রাষ্ট্রের সহায় সম্পদ ভূমি খনি সবকিছুর মালিক

দ্বিতীয় স্থরে বাকী সৌদি নাগরিক। মূল আরব ও আরব নাগরিকত্ব গ্রহণকারী নাগরিকবৃন্দ। এরা ভূমি ও সম্পদ ক্রয়একামা প্রদানব্যবসার অনুমতিপত্র সহ বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। তৃতীয় স্থরে রয়েছেন এক কোটির মত বিদেশী মানুষ- যাদের শ্রমে ও ঘামে আজকের আধুনিক সৌদী আরব গড়ে উঠেছে। এই বিদেশীদের মধ্যে প্রায় বিশ লক্ষ বাংলাদেশী রয়েছেন, যারা এককভাবে সৌদি আরবে সবচেয়ে বড় বিদেশী জনগোষ্ঠী। কাবাঘরমসজিদে নবুবী থেকে শুরু করে সারা আরবে বাংলাদেশীদের বিচরণ করতে দেখা যায়। খালেদা জিয়ার আমলে সৌদী সরকার বাংলাদেশীদের একামা-ভিসা প্রদান বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী কোন সরকারই সৌদিদের সহিত আলোচনা করে এখনও একামা-ভিসা চালু করতে পারে নাই। অন্যদিকে ভারতপাকিস্তানশ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্থানের ভিসা চালু থাকায় সৌদি আরবে আমাদের যেখানে জনসংখ্যা কমে আসছে অন্যদের তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সরকারের দুর্বল কুটনীতি আমাদেরকে আহত করে। ফলে দিন দিন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও কমে আসছে

অটোমন সাম্রাজ্য হতে পৃথক হয়ে আজকের সৌদ রাজ্য গঠনের পূর্বক্ষণে আরবে এক ধর্ম সংস্কারকের আবির্ভাব হয়। তার নাম আব্দুল ওয়াহাব নজদী। তিনি তাঁর জন্মভূমি পূর্ব আরবের নজদে ওয়াহাবী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। ধর্মান্ধ ওয়াহাবী ধর্মযুদ্ধাদের তরবারী ব্যবহার করে ও ইংরেজদের সহায়তায় ইবনে সৌদ শক্তি প্রয়োগে প্রথমে নজদ অঞ্চল ও পরে হেজাজ অঞ্চল দখল করে সৌদি আরব গঠন করেন। আব্দুল ওয়াহাব নজদীর দর্শনকে অনুসরণ করে বর্তমান সৌদি আরবের ধর্মসমাজ ও রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের তুলনায় সৌদি আরবের রাজনৈতিক উন্নয়ন অনেক পিছনে রয়েছে। সেখানে এখনও মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র চালু রয়েছে। জাতীয় সংসদ কিংবা স্থানীয় সরকারের কোন ধারনা সৌদিদের নেই। তাদের কোন রাজনৈতিক দলও নেই। সৌদিদের শিক্ষা নিম্নমানের। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান অনেকটা অনুপস্থিত। দেশ পরিচালনার জন্য রাজতন্ত্রকে বিদেশীদেরকে নিয়োগ করতে হয়। সৌদিদের আমার মনে হয়েছে অলস ও আরামপ্রিয়। তাদের উচ্ছাকাঙ্খাও অল্প। দোকানবাসাট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদি বিদেশীদেরকে ভাড়া দিয়ে তারা আরাম আয়েশে দিন কাটায়। সৌদি নারীদের অধিকার আমাদের নারীদের চেয়ে অনেক নীচে। আমাদের মেয়েরা যেখানে জজ-ব্যারিস্টারচিকিৎসক-ম্যাজিস্টেট হচ্ছেনবিভিন্ন বাহিনীতে পুরুষের সাথে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছেনবিমান বাহিনীর বিমান নিয়ে আকাশে উড়ছেনসেখানে সৌদি আরবে এখনও মেয়েদের গাড়ী চালানোর অধিকার নেইএমনকি নারীদের ভোটাধিকারও নেই। আরব সমাজে বহু বিবাহের প্রচলন রয়েছে, তাতে মেয়েদের বাঁধা প্রদানের কোন অধিকার নেই। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌদের সন্তান সংখ্যা শতাধিকস্ত্রী সংখ্যা অগণিত। তার পুত্র আব্দুল আজিজের পত্মীসংখ্যা অনেক এবং সন্তানাদি অর্ধশত। সৌদিরা টাকা হাতে এলেই বিয়ে করেন। ইয়ামেনসিরিয়ামিশর হতে বিয়ে করে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বউ নিয়ে আসেন। অথচ সৌদি মেয়েরা কোন বিদেশী পুরুষ বিয়ে করতে পারেন না। প্রচুর টাকার বিনিময়ে বিয়ের নামে নাকি সৌদিরা কন্যাকে বিক্রি করে দেন। ধনী বুড়োরা মেয়ে বিয়ে দিয়ে উক্ত টাকায় অল্প বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে করে নিয়ে আসেন প্রাসাদে। অথচ সৌদি গরীব যুবকরা টাকার অভাবে দেরীতে বিয়ে করতে বাধ্য হন। সৌদিদের সংস্কৃতিও আমাদের চেয়ে নিম্নমানের। নাচগানবাজনার তেমন প্রচলন নেই। নাটকও অনুন্নত

সৌদিদের বিচার ব্যবস্থাও পূর্বকালের প্রাচীন রীতিনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার সমাবেশ তেমন নেই। শেষপর্যন্ত রাজতন্ত্রের নির্দেশনাই সেখানে আইন হিসাবে কাজ করে। যেখানে সংসদই নেই সেখানে মানুষের বিচার বিবেচনা প্রসূত ও রচিত আইন আসবে কেমন করে। তৈলখনি আবিস্কারের পূর্বে গরিব যুগে আরবদের মধ্যে আমাদের মত অনেক অনাচার ও ঠগবাজী ছিল। আরবরা যতই সচ্ছল হয়েছে ততই চরিত্র পরিবর্তন হয়ে তারা খুবই ভাল মানুষে পরিণত হয়েছে। বর্তমান আরবদের দেখলে পূর্বকালের আরবরা যে দুর্দান্ত ও ভয়ঙ্কর ছিল- তা ভাবাই যায় না। আরবরা বর্ণে কালো ও শ্বেত এই দুই ভাগে বিভক্ত। ইউরোপ ও আমেরিকার মত আরবে সাদা ও কালো মানুষের মধ্যে তেমন কোন বিরোধ নেই। পূর্বকালে আফ্রিকার কালোরা এসে শ্বেত সেমিটিক আরবদের সহিত মিশে যায়। উভয় বর্ণের আরবদের মধ্যে আন্তরিকতার বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। এতকিছুর পরও সৌদি নারীরা একটি অধিকার ভোগ করে যা আমাদের নারীদের নেই। তাহলো তারা মসজিদে পুরুষদের সাথে জামাতে নামাজ পড়তে পারে। প্রতিটি মসজিদে নারীদের জন্য আলাদা পর্দাঘেরা জায়গা রয়েছেরয়েছে আলাদা বাথরুম ও অজুখানা। আমাদের ধর্মীয় হুজুররা কেন যে নারীদের মসজিদে ডুকতে দিতে রাজি হন না- তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আরবদের মসজিদ নির্মাণে আমাদের চেয়ে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য দেখেছি। প্রতিটি মসজিদে ঠান্ডা খাবার পানি রাখা হয়। একটি মসজিদে মানুষ বসে ইবাদত করার জন্য চতুর্দিক ঘিরে চেয়ারের মত বসার জায়গা রয়েছে। একটি মসজিদে প্রতি সারিতে হেলান দিয়ে বসার জন্য পিছনে হাতা বসানো দেখেছি

আরবদের মধ্যে পীর মুর্শিদ প্রথার প্রচলন নেই। আমরা খোদাকে পাবার জন্য চরমুনাইআটরশীমাইজভান্ডারী কিংবা এনায়েতপুরী ধরি। আরবরা কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহকে ধরে- কোন পীর-ফকিরের আশ্রয় নেয় না। আরবদেশে সবাই নিজেই নিজের পীর। নিজেই নিজের ধর্মীয় হুজুর। আমাদের দেশের কিছু পীররা দুএকটা মসজিদ-মাদ্রাসাএতিমখানা দেখিয়ে মানুষের লিল্লা ও জাকাতের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে রাজকীয় আয়েশী জীবন যাপন করেন, গড়ে তুলেন সম্পদের পাহাড়। কিন্তু আরবরা কোন হুজুর কিবলার ধার কাছেও যান না। মানুষের লিল্লাহ নিয়ে হুজুরদের কোন ধর্মব্যবসা সৌদি আরবে নেই। সৌদিরা দলবদ্ধ ভাবে দুরূদশরিফ পড়ে না। নামাজের পর হাত তুলে মোনাজাত করে না। নামাজের মধ্যে ছুরা ফাতেহা পাঠের পর উচ্চস্বরেআমিনবলে উঠেনতখন সারাটা মসজিদ আন্দোলিত হয়ে উঠে। তাদের লম্বা পরিস্কার আলখেল্লার মত জীবনটাও সরল ও পরিস্কার। তাদের দৃষ্টিতে সুন্নত হচ্ছে মাথার রুমাল ও উপরের কালো বেড়ী। আরব সমাজে আমাদের মত তাবিজ-কবজ বা পানিপড়ার প্রচলন নেই। আমাদের দেশে নামাজের সময় মানুষ সামনা দিয়ে চলে গেলে বাঁধা দেওয়া হয়। বাচ্চারা নামাজে ঢুকলে লাইনের দূর প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয় কিন্তু আরবদের মধ্যে এসব প্রথা নেই। 

সৌদি আরবের প্রসিদ্ধির কারণ হচ্ছে এটি মহানবি হজরত মোহাম্মদের(সঃ) জন্মস্থান। এই নবিজির মোহব্বতে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান এই উসর মরুময় দেশটিতে ছুটে আসেন। মহানবির জন্ম না হলে দেশটির এত গুরুত্বই থাকত না। কাজেই দেশটির নামমোহাম্মদি আরবঅথবা শুধুইআরবহওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল। দেশটির নামের আগে “সৌদি” শব্দটি লাগিয়ে দেয়া মহানবির(সঃ) প্রতি এক ধরনের দৃষ্টতা বলেই আমার মনে হয়। অনুরূপভাবে পবিত্র মদীনায় রসূলের প্রসিদ্ধ সাহাবাদের নামে কোন রাস্তাঘাট দৃষ্টিগোচর হয় নি। সবগুলোই ইবনে সৌদ রাজবংশের লোকদের নামে নামকরণ করা হয়েছে

কিছু শব্দ আমরা ধর্মীয় শব্দ হিসেবে ব্যবহার করি, যেমন খোদানামাজরোজা ইত্যাদি। এই শব্দগুলোর প্রচলন আরবে নেই। তারা নামাজকে সালাত ও রোজাকে সওম বলেন। খোদা শব্দটি মোহাম্মদ(সঃ) কখনও উচ্চরণ করেন নি। আমাদের ভাষায় এই শব্দগুলো খুব সম্ভব ইরান, আফগান ও মধ্যএশিয়া হতে প্রবেশ করেছে। আমাদের হুজুররা দয়াল্লিন ও যোয়াল্লিন নিয়ে রাজনীতি করেন। অথচ কাবা ও নবুবি মসজিদের নামাজে খুব পরিস্কার ভাবেদয়াল্লিনশব্দটি উচ্চারিত হতে শুনেছি। আমাদের দেশে নোয়াখালী অঞ্চলের লোকেরাএর উচ্চারণ এর মত এবং রংপুর অঞ্চলের মানুষ এর উচ্চারণএর মত করে থাকে। ইসলাম খুবসম্ভব আরব হতে আমাদের দেশে আসার পথে কোন অঞ্চলের লোকজন আরবি অক্ষর দয়ালের উচ্চারণ প্রায় জোয়াল এর মত করে ফেলে। যাহা বাংলাদেশে সংক্রমিত হয়ে আমাদের আলেমদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করে

আমি কোনদিন বাংলাদেশে জন্মগ্রণের জন্য আল্লাহর শোকর গোজার করি নি। মনে হত এক অনিশ্চিত জীবনের দেশে আমার জন্ম হয়েছেঅথচ সৌদি আরবে গিয়ে বুঝতে পেরেছি- এত সুন্দর দেশপ্রাণী বৈচিত্রের দেশতরুলতার দেশনদ-নদী সাগরের দেশপাখিদের গানের দেশ, শাপলা ফোটা জলার দেশপৃথিবীতে খুবই বিরল আর আবহাওয়া তারতো তুলনাই হয় না। আমাদের বিদ্যুৎ না হলেও যে আবহাওয়া ও পরিবেশ বিরাজ করে তাহা এসব দেশের চেয়ে অনেক উত্তম। অথচ সেসব দেশে ১ ঘন্টা বিদ্যুৎ ছাড়া মানুষের পক্ষে টিকে থাকা খুবই কঠিন। আরবরা আমাদের দেশে আসলে বিস্মিত হয়ে বলবে- এই তো বেহেশত। তাদের জীবন পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর আর আমাদের জীবন প্রকৃতি নির্ভর। প্রযুক্তির সাহায্যেই তারা বেঁচে থাকে

আস্তে আস্তে সময় ফুরিয়ে আসে। কাবাঘর শেষবারের মত আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে তওয়াফ করে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে চলে আসি হোটেলে। আসার তিন চার দিন আগে দেশে পরিচিতজনকে বিতরণের জন্য আমি সত্তুর/আশি হাজার টাকার তসবিহজায়নামাজঝরের বাটিশবাধারের ঢাকনাকাপড়চুলের বেনীবোরকামাথা ঢাকনা, হেন্ডব্যাগ ইত্যাদি ক্রয় করি। পনের কেজির মত জমজমের পানি বোতলজাত করি। ষোল ডিসেম্বর ২০১০ইং সনে জেদ্দা বিমানবন্দরে আসি। বিমান ঠিক নির্দিষ্ট সময়েই ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টায় বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ১লা নভেম্বর হতে ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ইং দেড় মাস সময় স্বপ্নের মত হারিয়ে যায় জীবন হতে অথচ দিয়ে যায় এক বিরাট অভিজ্ঞতা। এক রাত ঢাকায় ধানমন্ডিতে সমনদিক আব্দুল আজিজ চৌধুরীর বাসায় কাটিয়ে পরদিন তাদের গাড়িতে করে সিলেট চলে আসি। সৌদি আরবের এই ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা চির জাগরুক হয়ে আমার মননে বিরাজমান থাকবে। আরব সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা অত্যন্ত রক্ষণশীল ও প্রাচীন রীতিনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও মনে হয়েছে- আমাদের আধুনিক বাংলাদেশের তুলনায় সেখানে অনেক বেশী নিরাপত্তা বিদ্যমান। মানুষের ইমান সুদৃঢ় ও খোদার ভয়ে তারা সবধরণের অপকর্ম হতে সম্পূর্ণরূপে দূরে অবস্থান করে।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন