কালো দিবস ২৪ নভেম্বর ২০০৭ সাল, আমার মহামানব পিতা শফিকুর রহমান চৌধুরীর চিরবিদায়
আমার বাবার কথা লিখতে গিয়ে আমি কিছুই লিখতে পারিনা। বুকের এক বিষাক্ত যন্ত্রণা এসে আমার কলমকে আটকে দেয়। তারপরও আমার বাবার কথা শতকষ্ট হলেও লিখতে হবে। আমাকে জানাতেই হবে সমাজের একজন পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ‘দলুমিয়া’ স্যার যিনি আমার বাবা শফিকুর রহমান চৌধুরী জীবনে কতটুকু উচ্চতা ও মহানুভবতা ধারন করেছিলেন। বিপদ আপদে অবিচল ধৈর্য্যধারন, যারা তাকে বারবার অন্যায়ভাবে জ্বালাতন করেছে, সেই যন্ত্রনা ভূলে গিয়ে সহজে ক্ষমা করে দেওয়া। যে বিপত্নীক বড়ভাইয়ের কাছ হতে পৈত্রিক সম্পদের কিছুই পাননি, বুড়ো বয়সে ঘরে এনে রাতজেগে এই চাচার মলমূত্র নিজহাতে পরিষ্কার করাসহ সব ধরনের সেবাশুশ্রূষা করতে আমি আব্বাকে দেখেছি। মসজিদের মোতাওয়াল্লী থাকাকালে একবার একটি লোক বিরূপ মন্তব্য করলে আমি তাকে অবগত করি। আমার বক্তব্য শুনে তিনি বললেন, কে কি বলছে এসবে কান দিবেনা, নিজের কর্তব্য কর্ম একমনে করে যাবে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনাকেও লোকে কত গালাগাল করে, আমিতো তাদের তুলনায় কিছুই না।
১৯১৬ সালের ১লা অক্টোবর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই উম্মাতাল দিনে তিনি সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমার ঐতিহ্যবাহী দাউদপুর চৌধুরী পরিবারে হযরত শাহজালালের(রহঃ) আরব থেকে বেরহয়ে আসা প্রথম ১২জন সহচরের অন্যতম হযরত শাহদাউদ কুরেশীর (রহঃ)
বংশে ১৭তম প্রজন্ম হয়ে জন্মগ্রহন করেন।
তিনি ১৯৩৭ সালে ভাদেশ্বর পূর্ববাগ নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিকুলেশন, ১৯৩৯ সালে এম. সি.সরকারী কলেজ থেকে
ইন্টারমেডিয়েট ও ১৯৪১ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ. সমাপ্ত করেন। তিনি বলতেন ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তাদের এই বিএ পরীক্ষা
অনুষ্ঠিত হয়। এই বিএ পরীক্ষা
অনুষ্ঠানের কিছুদিন আগে জাপানীরা
মিয়ানমার দখল করে মনিপুরে ঢুকে পড়ে। জাপানীরা আর সামনে এগিয়ে আসলে এই পরীক্ষা আদৌ হবে কি হবে না, এমনই এক অনিশ্চয়তার ভিতর শেষপর্যন্ত
পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হল। সে সময় বিএ/এমএ
পাশকরা লোকের সংখ্যা ছিল নেহায়েত
হাতেগুনা। তাই অনেকে উচ্ছসিত হয়ে নিজনামের পিছনে বিএ কিংবা এমএ সংযোজন করে
নিজেকে উচ্চশিক্ষিত প্রকাশ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন। যেমন মৌলভী আব্দুল করিম বি এ। আব্দুর রহমান এম এ, এল এল বি ইত্যাদি।
বি এ পাশ করেই তিনি বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি সুরমাভেলিতে
চাকুরিরত থাকাকালে
অনেক ইংলিশ, স্কটিশ ও আইরিশ সেনা অফিসারদের সাথে কাজ করেন। বৃটিশ সামরিক যানবাহনে
বসে শ্বেতাঙ্গ সেনাপতিদের সাথে তাদের নানান স্থানীয় বৃটিশ সুরে কথাবলার স্টাইল
রপ্তকরে নেওয়ার গল্পও আমাদেরকে বলতেন। কয়েক বছর পর বৃটিশবিরোধী সরকারি চাকুরি ছাড়ার আন্দোলন শুরুহলে সেই আন্দোলনে সাড়া দিয়ে সেনাবাহিনীর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।
ছোটকাল হতেই খেলাধুলায় তার খুব ঝোঁক
ছিল। সেনাবাহিনীতে খেলাধুলা করার অবাধ সুযোগ পান এবং অনেক মেডেল অর্জন করেন। এক
সময় কলিকাতা মহামেডান ক্লাবেও ফুটবল খেলার সুযোগ পান। পরবর্তীকালে শিক্ষক জীবনেও
খেলাধুলা এবং স্কাউট পরিচালনায় সব সময় নেতৃত্ব দেন।
একসময় পাকিস্থান আন্দোলনে যোগদান করে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৪৭
সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্থান স্বাধীন হবার পর তিনি নবগঠিত পাকিস্থান সীমান্ত রক্ষী
বাহিনীর অফিসার ইন চার্জ হিসাবে কিছুকাল চাকুরি
করেন। কিন্তু এই সরকারী চাকুরী মনঃপুত না হওয়ায় এক সময় চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ভুমিকর বিভাগে চাকুরি নেন। পাকিস্তান আমলে বেশ কয়েক বছর সুনামগঞ্জ শহরের
সুরমাপারের ভূমিকর অফিসে কানুনগো পদে সরকারি চাকুরী করতেন। সুনামগঞ্জ জেলার ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন ভূমি অফিস পরিদর্শনে যাবার অনেক
গল্প তিনি আমাদেরকে বলতেন।
তিনি ১৯৫৪ সালের ২৫শে মার্চ পাতারিয়া পরগনার দক্ষিণভাগ গ্রামের খলিলুর রহমান চৌধুরী তনয়া আসমতুন্নেছা চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে এই সরকারি চাকুরি পরিত্যাগ করে দাউদপুর গ্রামে ফিরে
এসে দাউদপুর ইউনিয়নের প্রথম চেয়ারম্যান হবার চেষ্টা করেন। তখন ছিল সামরিক শাসক
আয়ুব খানের মৌলিক গনতন্ত্রের যুগ। জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতি ইউনিয়নে নয়জন
মেম্বার নির্বাচিত হতেন। পরে এই নয়জন মেম্বার ভোটাভোটি করে একজন চেয়ারম্যান
নির্বাচন করতেন। সদ্য অবসান হওয়া সামন্তযুগের পরই অনুষ্ঠিত এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আব্বা চেয়ারম্যান
হবার উদ্দেশ্যে ভোটে মেম্বার প্রার্থি হন। কিন্তু এখানেও সুকৌশলে জমিদার নানকার
সাম্প্রদায়িকতার ধুয়াতুলে সামান্য ভোটের
ব্যবধানে কোনারপাড়ার একজন নিরক্ষর মাতব্বর ব্যক্তি জরাফত আলী মেম্বার হয়ে যান। এই
জরাফত আলী মেম্বার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
দাউদপুরের প্রথম চেয়ারম্যান হবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে এবার এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি রেঙ্গা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহন করেন। এই হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি তার প্রিয়জন এলাকার অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব
বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা শ্রীকৃপেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্যের অনুরোধে ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত মোগলাবাজার রেবতী রমন
উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করেন। পরবর্তী ছয়ত্রিশ বছর উক্ত প্রতিষ্ঠানে তিনি কর্মরত ছিলেন। তিনি নিজের পেশায় যেমন ছিলেন সৎ ও নিষ্টবান,
তেমনি সংসারের প্রতি একনিষ্ট দায়িত্ববান। পরম মায়া-মমতা ও ভালবাসা দিয়ে এই আদর্শ শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রী পরিবার পরিজন এবং পাড়াপড়শীকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্নেহসিক্ত করে গেছেন।
১৯৭৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহন করে আবার চেয়ারম্যান হবার
চেষ্টা করেন। কিন্তু ভোটে কারসাজি এবং ভোটবাস্ক ছিনতাই করে হাতেগুনা খুবঅল্প ভোটের
ব্যবদানে তাকে অষ্টমশ্রেণি পড়া একজন প্রতিপক্ষের কাছে সুকৌশলে হারিয়ে দেওয়া হয়।
২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বর শনিবার সকাল ৮টায় পরিবার পরিজন গ্রামবাসী ও অসংখ্য গুণগ্রাহীকে
শোকসাগরে ভাসিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহন করেন আমার পিতা শতাব্দীর মহানপুরুষ এই সরলপ্রাণ মানুষটি, যিনি অনেক পরিবারের পিতা, পূত্র ও নাতি তিন প্রজন্মের শিক্ষাগুরু। যার প্রকৃত নাম সফিকুর রহমান চৌধুরী। প্রায় চল্লিশ বৎসরের সুদীর্ঘ্য শিক্ষকতা জীবন যিনি সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার দাউদপুর গ্রামের অধুনালুপ্ত রেঙ্গা হাইস্কুলে এবং মোগলাবাজার রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ে কাটিয়ে দেন।
১৯৯১ সালে শিক্ষকতা
থেকে অবসর গ্রহন করে তিনি পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত দাউদপুর জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি ও দাউদপুর সিনিয়র মাদ্রাসার কার্যকরী কমিটির সভাপতি হিসাবে
মসজিদ ও মাদ্রাসার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাখালগঞ্জ মাদ্রাসা, মনির আহমদ একাডেমী তুডুকখলা ও মোগলাবাজার
রেবতী রমন উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। নতুন ভবন নির্মাণের জন্য
তিনি দাউদপুর মাদ্রাসায় মূল্যবান ভূমিদান করেন। ১৯৯৮ সালে পত্নি আসমতুন্নেছা চৌধুরীকে নিয়ে পবিত্র হজ্জ পালন করে আসেন।
তিনি অত্যন্ত
সুশৃংখল জীবন যাপন করতেন। দেড়দুই মাইল দূরবর্তী স্কুলে পায়ে হেটে আসা-যাওয়া করতেন। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তিনি কখনও রিক্সা কিংবা গাড়িতে
উঠার পক্ষপাতি ছিলেন না।
তিনি বাড়িতে পরিবারের প্রয়োজনীয় সব তরিতরকারী নিজেই সযতনে ফলাতেন। বৃক্ষরোপনেও ছিল প্রচুর আগ্রহ। তিনি খুব অল্প বয়সে মাতৃহারা হলেও প্রায়ই তার মায়ের কথা বলতেন। পিছনের
পুকুরপারে তার মায়ের লাগানো দুটি নারকেল গাছকে তিনি মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসতেন কেবল
এই কারনে যে এই দুটি নারকেল বৃক্ষ তার মাতা নজিবা খাতুন চৌধুরীর হাতে লাগানো।
সুন্দর শৃংখলাপূর্ন জীবনাচরনের ফলে ৯২ বৎসর বয়সে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত কোনধরনের
উল্লেখযোগ্য রোগব্যাধি তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। এমন কি প্রেসার,
ডায়বেটিস, গ্যাসট্রিক কিছুই ছিলনা তার।
প্রায় সময় নিজের প্রয়োজনীয় কাজ ফেলে রেখে বিচার আচার ও এলাকার উন্নয়নে সময় ব্যয় করতেন। সব সময় অল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। লোভ-লালসা,
হিংসা-বিদ্বেষ সবকিছুর উর্দ্ধে তিনি একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। প্রায়ই বলতেন অতিরিক্ত টাকা পয়সার কিসের
প্রয়োজন। মরণ হলে সবকিছু ফেলে শূন্যহাতে কবরে চলে
যেতে হয়। খাবার ব্যাপারে কোন পছন্দ অপছন্দের বালাই ছিলনা তাঁর, বলতেন প্রতিটি খাবারে আলাদা আলাদা
ভিটামিন ও খাদ্য উপাদান রয়েছে। তাই খাবারে বাছাবাছি করা ঠিক নয়। খাদ্যে বাতবিচার
করলে শরীর সবধরনের দরকারি পুষ্টিশক্তি পাবে না।
তার ভাগনা এবং ভাতিজা ইমামউদ্দিন চৌধুরী (সচিব ও সরকারের উপদেষ্টা), ডঃ
সদরউদ্দিন চৌধুরী (ভিসি, শাবিপ্রবি), বদরউদ্দিন চৌধুরী (সচিব ও বিসিএস বোর্ড
সদস্য), শফি এ চৌধুরী (শিল্পপতি ও এম পি), নাসির এ চৌধুরী (কোম্পানী প্রতিষ্টাতা,
শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী), নুরউদ্দিন এ চৌধুরী (পরিচালক, খাদ্য মন্ত্রনালয়), মুফতি
বদরুউদ্দিন (মহাব্যবস্থাপক, সোনালী ব্যাংক), এমাদউদ্দিন এ চৌধুরী (আই জি পি)
প্রমুখকে সুপারিশ করে মানুষের অনেক কাজ করে দিতেন। সকালে তিনি যখন কোরান তেলাওতে
নিমগ্ন হতেন, তখন দূরদূরান্ত হতে টুকা প্রার্থিরা এসে ভীড় করতেন। তিনি ছোট টুকায়
সুপারিশ লিখে লোকজনকে বিদায় জানাতেন। এসব টুকা লিখায়ে নিয়ে লোকজন চাকুরি লাভ, বদলি, পদোন্নতি, জেলমুক্তিসহ অনেক মসকিল আসান
করে নিত। তখনকার যুগে ফোন কিংবা মোবাইল ছিলনা। তাই সাদা কাগজে একটা সুপারিশ লিখে
দিলেই লোক উপকৃত হয়ে যেত। তিনি তার ভাগনা সাবেক আই.জি.পি. ও পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ই.এ. চৌধূরীকে দিয়ে ১৯৮৫ সালে এলাকাবাসীর সুবিধার্থে চৌধুরীবাজারে পূবালী ব্যাংকের
একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। মানুষের প্রতি খুবই দরদ ও ভালবাসা ছিল তার। তার কাছে এসে মানুষ শূন্যহাতে ফিরে গেছে এমন কোন নজির নেই।
তিনি তার জীবনের
শেষপ্রান্তে এসে দাউদপুর গ্রামের বাড়িতে এবং পুত্র ইসফাক কুরেশীর সাগরদিঘিরপারের বাসায় (জেফার ভবনে) পর্যায়ক্রমে অবস্থান করতেন। নাতি জেফারের সাথে বসে
বসে দাবা খেলতেন। ২০০৭ সালের রমজান মাসের কয়েকদিন পূর্বে তিনি চলে আসেন পুত্রের বাসভবনে। রোজা শেষে চলে আসে অগ্রাহায়ন
মাস। এ সময় দাউদপুরের গ্রামের বাড়িতে ধানকাটা ও সুপারী উঠানো মৌসুম ছিল। ধান উঠাতে যাবার জন্য বাড়ি হতে বারবার তাগদা আসতে থাকে। ২৩ নভেম্বর ২০০৭ সাল,
সেদিন ছিল শুক্রবার, সকালের খাবার শেষে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান।
আমার মাবাবার তিনমাস শহরে অবস্থানকালে গ্রামেরবাড়ির ঘরের বারান্দার টিনছাদের উপর ভীমরূল বাসা বাঁধে ও
জনহীন ঘরের বারান্দার উপর বিশাল ভুলতা চাকে পরিণত হয়। আমার কাছে ভীমরূলের ব্যাপারটা অজানা থাকলেও ছোটভাই নিশাত বিষয়টিকে তেমন
গুরুত্ব দেয় নি। বাড়িতে অবাঞ্চিত লোকজনের আনাগুনা বন্ধ হবে বিধায় সে ভীমরূলের বিশাল কলসি চাকটি ভেঙ্গে দেয়নি। ঐদিন
সন্ধ্যায় কে বা কারা ভূলতা চাকে ঢিল ছুড়ে ভিমরুলকে রাগিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে না পেরে চাকের কাছে আসামাত্র অসংখ্য ভীমরূল তার সারাটা শরীরে হুল ফোটায়। গ্রামের
চৌধুরী বাজারে আমাদের তিনটি দোকান ভাড়া দেওয়া রয়েছে। একটিতে ফার্মেসি পরিচালনা
করছেন পল্লী চিকিৎসক সামাল উদ্দিন। সাথে সাথে মোবাইলে ফোন করে আমার পত্নী ডাঃ নুরজাহান বেগম চৌধুরী ঔষধসহ সামাল উদ্দিনকে পাঠিয়ে দেন।
তখনই গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাই, তাকে নিয়ে আসি। বাসায় সব ধরনের ঔষুধ প্রয়োগের পরও অশান্তি করছেন দেখে কিছুক্ষন পর নিয়ে যাই সেইফওয়ে হাসপাতালে। ডাক্তার
কুন্ডু বাবু রোগী দেখে রয়েল হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। তাঁকে নিয়ে রয়েল
হাসপাতালে সিসিইউতে ভর্তি করলাম। আব্বার পায়ের কাছে
দাড়িয়ে এক দীর্ঘ্য কালোরাত আমি চরম উৎকন্ঠায় নির্ঘুম অতিবাহিত করি। সারারাত হার্ট মনিটরে চিকিৎসক এবং আমার চোখ আটকে থাকে।
পরদিন ২৪ নবেম্বর সকাল ৭ ঘটিকায় এই রয়েল হাসপাতালের সিসিইউতে তিনি মৃত্যুর হিমশীতল বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন। তখন হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন আমার মাতা
আসমতুন্নেছা চৌধুরী, বড়বোন রেহা, ছোটবোন মান্না, ছোটভাই নিশাত এবং ভাগনা ভাগনিরা। প্রতিদিন সকালে উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াত ছিল তার আজন্ম অভ্যাস। এই তেলাওতের শব্দ চাচাত আবুলেইছ ভাই সুদূর মাঝের বাড়ি হতে শুনতে পেতেন। আমি
বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম প্রতিদিনের তার এই কোরান তেলাওতের সময়টিতেই মহান
আল্লাহতায়ালা তাকে সাদরে গ্রহন করে নেন। মহান আল্লাহ ও ইসলাম
ধর্মের প্রতি তাঁর ছিল অবিচল ইমান। একদিন আমার ভাগ্না
সাস্টের ছাত্র হুদহুদ বলল নানা আপনি এত যতনে ও নিষ্ঠায় ইবাদাত বন্দেগি করেন,
মৃত্যুর পর যদি দেখেন কিছুই নেই, সব ফাঁকা। তাহলে কি হবে? আব্বা তখন জবাব দেন
পরজগত না থাকলে তা আমারও নেই, তোমারও নেই। মৃত্যুর সাথে অনন্তকালের জন্য একটানা
ঘুমিয়ে পড়ব। আর যদি থাকে তাহলে আমার বিপদ নেই, আমি পার পাব কিন্তু তোমার বিপদ আছে।
কারণ অবিশ্বাসীরা পার পাবে না। আমি কোনদিন আব্বার নামাজ কিংবা ফরজ রোজা ক্বাজা হতে দেখি নি এবং এই শেষবিদায়ের দিন ছাড়া তাকে কোনদিন আমি অসুস্থ্য হয়ে
হাসপাতালেও ভর্তি হতে দেখি নি। এটাই ছিল তার
সুদীর্ঘ্য জীবনের প্রথম এবং শেষ হাসপাতাল পর্যটন।
আমার বাসায় পিতার পবিত্র দেহ মোবারক গোসল করায়ে সযত্নে রাখা হয়। সাগরদিঘিরপারের বাসায় সব আত্মীয়স্বজন এসে ভিড় জমান। পূবালী
ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আব্দুল করিম চৌধুরী এসে ড্রয়িংরোমে আমার বাবার লাশ দেখে
যান। আমি শান্তসৌম হয়ে ঘুমিয়ে থাকা আমার বাবাকে জীবনের শেষবারের দেখা সাদা কাফন
সরিয়ে বারবার দেখে নেই। হাত পা কপাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলাম বরফের মত শীতল হয়ে আছে।
এইদিন বাদ যোহর হযরত শাহজালালের(রঃ) দরগাহ মসজিদে প্রথম জানাজার পর তাকে তার প্রিয় জন্মভূমি দাউদপুর গ্রামের পূর্ব চৌধুরীবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। আসরের জামাতের পর
লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে দাউদপুর ইদগাহ ও মসজিদ চত্বর।
এখানে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষ হলে আমি তারপক্ষে বক্তব্য রাখি এবং সবার কাছে
তার জন্য দোয়া ও ক্ষমা চেয়ে নেই। বিশাল জনতা এসময় উচ্চস্বরে আমার পিতার ভাল ইমান ও আখলাকের স্বাক্ষ্য প্রদান করেন। হেমন্তের রৌদ্র
উজ্জ্বল সেইদিনটি ছিল নাতিশীতুষ্ণ ও আরামদায়ক। খননকরা কবরটি এতই সুন্দর ছিল যে
কেউকেউ বললেন কবরটি যেন একটি বেহেশত। জানাজা শেষে বড় মসজিদের সামনে পারিবারিক গোরস্থানের সেই বেহেশতি
কবরেই তাকে সমাহিত করা হয়। পশ্চিমে বড়মসজিদ এবং হযরত শাহদাউদ কুরেশীর(রহঃ)
পবিত্র দরগাহ শরিফ, পূর্বদিকে দাউদপুর আলিয়া মাদ্রাসা, এই দুই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের মধ্যবর্তী
অত্যন্ত পুত-পবিত্র পারিবারিক গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন আমার জীবনে দেখা সর্বোত্তম চরিত্রের মানুষ আমার এই শ্রদ্ধেয় পিতা সফিকুর
রহমান চৌধুরী।
তাঁর স্মৃতি বিজড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহে তাঁর প্রিয়জনরা স্মরণসভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে তাকে হৃদয়ের
স্বতঃস্পূর্ত শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দাউদপুর মাদ্রাসার
স্মরনসভায় আমার দাওয়াত আসে। সেখানে আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে এক দীর্ঘ্য বক্তব্য প্রদান
করি। মাদ্রাসার হেড মাওলানা সভাপতির বক্তব্যে মাদ্রাসায় তার অবদান ও কিছুদিন আগে
মাদ্রাসার ফান্ডে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা রাখার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। প্রধান শিক্ষক শ্রীগুনেন্দ্র
চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে মোগলাবাজার রেবতী রমন হাইস্কুলের স্মরণসভায় আমি কোন এক ব্যস্ততার জন্য অংশ নিতে পারি নি। রাখালগঞ্জ মাদ্রাসার
শোকসভা আমি ঢাকায় থাকায় যেতে পারি নি।
সবশেষে আমি মহান আল্লাহর দরবারে তার আত্মার
মাগফেরাত কামনা করছি, সেইসাথে আমার আত্মজীবনীর সব
পাঠকের কাছে দোয়া কামনা করি, আমার পরম আপনজন মহাত্মা বাবাকে আল্লাহ রাহমানুর রাহিম যেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারে সম্মানিত করেন।
আমার যখন
জন্ম হয়, তিনি তখন উনপঞ্চাশ বছরের একজন প্রৌড় ব্যক্তিত্ব। আমার জন্মদিন হতে
পরবর্তী জীবনের বিয়াল্লিশ বছর সম্মানিত পিতার সাহ্নিধ্যে কাটাই। বিপদে আপদে তার
দোয়া চাওয়ামাত্র আমার মনোবল কয়েকগুন বেড়ে যেত। তার মৃত্যুর সাথে মনে হল আমরা যেন
চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে গেলাম।
বাদাই পুতী,
লালই পুতী, দছির পুতী সহ অনেকে আব্বাকে ডাকতেন ‘পীরসাহেব’, অথচ তিনি কোন ধর্মীয়
পীরফকির ছিলেন না। আমি একদিন তাদের কাছে এইনামে কেন
ডাকেন জানতে চাইলে তারা জবাব দেন, একসময় তিনি দুনিয়াদারী নিয়ে বেখবর ছিলেন।
বড়ভাইরা ঘরসংসার চালাতেন আর তিনি খেলাধূলা, আড্ডা, রাজনীতি, ধর্মচর্চা ইত্যাদি
নিয়ে সারাক্ষন ব্যস্ত থাকতেন, তাই অনেকে তাকে পীরসাহেব নামে ডাকতে শুরু করেন।
আব্বা দোয়া করতেন, আল্লাহ তাকে সুদীর্ঘ্য আয়ু দিলেও যেন অচল করে বিছানায় ফেলে না
রাখেন। তিনি আল্লাহর কাছে আর চাইতেন, তিনি
যতদিন বেঁচে রইবেন, নামাজটা যেন যথাযথ নিয়মে আদায় করে যেতে পারেন। তার এই
দুই প্রার্থনাই দয়াময় আল্লাহ কবুল করেন। তাকে মৃত্যুর আগে কোনদিন না দাড়িয়ে চেয়ারে
বসে কিংবা ইশারায় সেজদা দিয়ে নামাজ পড়তে আমি দেখি নি।
আমরা
পরিবারে আজন্ম যে নয়জন সদস্য ছিলাম, তারমধ্যে কনিষ্ট ভ্রাতা মিল্লাতুর রহমান ১৯৭৮
সালে মাত্র দেড় বৎসর বয়সে হারিয়ে যায়। অবশিষ্ট আটজনের মধ্যে এবার আমার পিতা বিদায়
নিলেন। চিকন ভারহীন দেহাবয়বের প্রিয় পিতার লাশ আমাকে একদিন দেখতে হবে কখনও চিন্তা
করি নি। ভাবি নি, একদিন আমাকে তার কফিন বইতে হবে এবং আমিই নিজহাতে তাকে শুয়ায়ে দেব
কোদালে মসৃনকরা কবরের মাটির বিছানায়।
অনেকদিন পর
রাতে গ্রামের স্মৃতি বিজড়িত ঘরে আবার কয়েক রাত আরামের ঘুম দেই। তিনচার দিন ছুটি
কাটিয়ে অফিসে যোগদানের পর প্রতি সন্ধ্যায় গাড়ি নিয়ে বাড়ি গিয়ে জেয়ারত করে আসতাম।
অফিসের জাহাঙ্গীর সাহেব একদিন রাতে আমার সহগামী হয়। বাড়িতে গরুসিন্নী করা হলে
এবারও পূবালী ব্যাংকের অঞ্চলপ্রধান আব্দুল করিম চৌধুরী এবং
অধ্যাপক ডাঃ নিয়াজ আহমদ চৌধুরীসহ অনেক ঘনিষ্টজন অংশগ্রহণ
করেন।
ইদগাহ শাখার ব্যাংকের বার্ষিক সমাপনীর কঠিন ধাক্কা আমরা কঠোর পরিশ্রম করে সমাধা করি। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে আমি বেশ কয়েক রাত ১২টার পর আমার নিজ গাড়িতে করে অফিসের সবাইকে তাদের বাসায় বাসায় পৌছে দেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন