শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

জাতীয় ব্যবস্থাপক সম্মেলন- ২০০৭ ঢাকা, বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল সফরঃ

 

জাতীয় ব্যবস্থাপক সম্মেলন- ২০০৭ ঢাকা, বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল সফরঃ

২০০৬ সালের জাতীয় ব্যবস্থাপক সম্মেলনে আমি গিয়েছি কিনা তেমন একটা মনে নেই, তবে ২০০৭ সালের সম্মেলনটির কথা একারনে মনে আছে যে এই সম্মেলন শেষে আমি স্বপ্নের যমুনাসেতু পার হয়ে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে এক অন্তঃজেলা ঝটিকা সফরে বের হই। এই সফর বগুড়া হতে সুদূর সুন্দরবন পর্যন্ত প্রসারিত ছিলএকদিনের সেই সম্মেলনটি রাজধানী ঢাকার বিয়াম অডিটরিয়ামে অনুষ্টিত হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের নেতৃত্বে অনুষ্টিত এই আনুষ্ঠানিক কর্পোরেট সভায় দেশের সব শাখার ব্যবস্থাপক, আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক এবং হেড অফিসের বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধানগণ যোগদান করেন। একদিনের প্রগ্রাম অনুষ্ঠানিক নিয়মেই পরিচালিত হল। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করলেন পুবালী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ ও প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আমার চাচাত ভাই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ই এ চৌধুরী।

রাতের খাবারের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল, কিন্তু সেখানে তেমন দর্শক নেই। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় ডিনার শেষে পুবালীয়ানরা যে যার পথে চলে যানএমন কি চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকও কর্তব্যপালনে খানিকক্ষণ বসে বিদায় নেনহাতেগুনা যে কয়েকজন এই সঙ্গীতসন্ধ্যা শেষ পর্যন্ত উপভোগ করলেন তাদের একজন এই আমি। আমার ভাতিজিবর আব্দুল হালিম চৌধুরী খুবসম্ভব তখন মহাব্যবস্থাপক, সামনের সারিতে তাকে বেশ তৎপর দেখলামতার বাসা লালমাটিয়া, আমার গন্তব্য পাশের ধানমন্ডি। ভাবলাম তার কারে বসে ধানমন্ডির আসপাশে নেমে পড়ব। কিন্তু ইশারা দিয়ে বুঝলাম সেই গাড়ি যাত্রী ঠাসা, তাই একটি বেবিট্যাক্সি ভাড়া করে ধানমন্ডির গন্তব্যে ছুটে গেলাম।

ঢাকা যাত্রার আগে আছিরগঞ্জের ব্যবস্থাপক খলিলুর রহমান আমাকে ফোন করে বললেন, কুরেশী স্যার আপনি রাজী হলে আমরা দুইজন ঢাকা হতে এবার সুন্দরবন ঘুরে আসব। আমি বললাম ইনশাহআল্লাহ

মহান পুরুষ বস আব্দুল করিম চৌধুরী স্যারের কাছ থেকে আমি আগেই ছুটি ও অনুমতি আদায় করে নিলাম। খলিল সাহেবকে সাথি করে পরদিন আমরা দুইজন পুবালীয়ান বগুড়ার বাসে চেপে বসলাম। আমার ছোট সমনদিক আজিজ ভাই আমাদেরকে বেশ কয়েক বছর আগে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে নিয়ে যান। এই প্রথম স্মৃতিসৌধ পার হয়ে সাভারের পশ্চিমে আমরা ছুটে গেলাম। খলিল সাহেব সহজ সরল ভাল মানুষ। তার মস্তিস্কে তেমন কোন  পেচপ্যাচ বা কূটচাল নেই। তার সাথে ঘুরে মনে হল সারা দেশের মানুষ যদি এমন হত, তাহলে বাংলাদেশ বদলে অনেক আগেই সুখী দেশ হয়ে যেত। তিনঘণ্টা পর গাড়ি যমুনা সেতুর উপর উঠামাত্র হৃদয়টা এক দারু আনন্দে নেচে উঠল, এযে দেখছি আমার বাংলাদেশের গর্বের ধন- যমুনা সেতু।

সাড়ে পাঁচ মাইল দীর্ঘ এই সেতু পার হতে প্রায় চৌদ্দপনের মিনিট সময় কেটে গেল। প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা জার্নি করে আমরা যখন ক্লান্ত হয়ে বগুড়ার সাতমাথায় নামলাম, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। নেমেই হোটেল খুঁজতে লাগলাম। সাতমাথা হতে তিনমাথা পর্যন্ত ঘুরে তেমন কোন ভাল  থাকার হোটেল পেলাম না। খলিল সাহেবকে বললাম, দেখুন আমরা আসলে শিক্ষা সফরে বেরিয়েছে। নিছক ভাল হোটেলে ঘুমিয়ে আনন্দফূর্তি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আসুন এত খোঁজাখোজি না করে একটি হোটেলে হাতমুখ ধুয়ে মশারি টাঙ্গিয়ে শুয়ে পড়ি। ছারপোকা কামড় না দিলেই হল। সকালে ঘুম হতে জেগে আমরা সকালের নাস্তা সেরে ঘন্টা চল্লিশ টাকা  দরে একটি রিকশা ভাড়া করি। ড্রাইভারকে বললাম আপনি বগুড়ার সব দর্শনীয় জায়গা একেএকে ঘুরে আমাদেরকে পরিদর্শন করাবেন। রিকশাচালক জানতে চাইলেন আমরা কোথাকার লোক। বললাম সিলেট থেকে এসেছি। ভদ্রলোক বললেন আপনারা এতদুর হতে এসেছেন অবশ্যই বগুড়ার সবকিছু দেখাতেই হবে।

আসল বগুড়া শহরে তেমন ভবনের সমাহার না থাকলেও রিকশায় চড়ে বুঝলাম শহরটি আদৌ ছোট নয়। তারেক জিয়ার সৌজন্যে স্থাপিত বগুড়া পর্যটন হোটেল, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ এবং বগুড়া সেনানিবাস শহরটির এক বিশাল এলাকা দখল করে বসে আছে। করতোয়া নদীর অনেক নামডাক শুনেছি। মহাভারতেও এই পবিত্র নদীটির অনেক উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুন্ড্রবর্ধ নগরী এই প্রশস্থ বেগবান নদী করতোয়ার তীরে গড়ে উঠেছিল। মহাস্থানগড়ের পাশে স্বচক্ষে এই নদীটিকে দেখে আমি অবাক হলাম। কোথায় সেই ঐতিহাসিক প্রমত্তা নদী করতোয়া? এটা যেন নদী নয়, শৈবাল ও পেনাভরা একটি মরা খাল।

রিকশাচালক এবার আমাদেরকে নিয়ে ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় পানে রওয়ানা হন। গায়ের এক ফাড়ি রাস্থা দিয়ে রিকশা চলছে। দুইপাশে ক্ষেত। ক্ষেতের মঝে মাঝে পারবিহীন জলাশয়। মনে হল সিলেটের মত এত বৃষ্টি নেই এখানে, তাই ফসলের পানি ধরে রাখার জন্য এই অভিনব ব্যবস্থা। বনভূমিও বিরল। পাশে একটি টিলায় শাহ সুলতান মাহিসওয়ার(রঃ) নামক একজন পীরের মাজার। এই শহরে কোন টিলা নেই, এই টিলা একাকী দাড়িয়ে রয়েছে। আমার সন্দেহ হল এই টিলাটি হয়ত প্রাকৃতিক টিলা নয়, কোন যুগের মানবসৃষ্ট টিলা হতে পারে।

এবার রিকশা হতে নেমে সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে প্রবেশ করলাম। লালমাটির বুকে খোলা এই প্রাঙ্গণটি প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুন্ড্রবর্ধন নগরী। আড়াইহাজার বছর আগে ছোটছোট লাল পোড়া ইস্টক চুনসুরকির মসলায় জমাটবদ্ধ করে এই দুর্গ নগরের ওয়াল ও স্থাপনামালা সেই প্রাচীনকালের মানুষরা নির্মাকরেছিল। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এইস্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন শাসকদের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তী সময়ে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল। আমাদের প্রত্নতত্ব বিভাগ মাটি খূড়ে বেশ মুন্সিয়ানা করে এই ঐতিহাসিক দুর্গ নগরটিকে বের করে এনেছেন। সেই ইট সেই চুনসুরকি সেই স্থাপনা আমার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এযে হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের জীবন্ত স্বাক্ষী। ইতিহাসের এই ধুসর নগরে হাঁটতে গিয়ে আমি কল্পনায় দুইহাজার বছর আগের বাংলার বৌদ্ধযুগে চলে যাই। সামনে আদিগন্ত মাঠে ইতিউতি মাথা উচু করে আছে সেই আমলের বেশবড় বৌদ্ধমট বাসুবিহারএই বিহারগাত্রের অসংখ্য কুতে মনে হল হলুদবসনা ন্যাড়ামাথা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন।  

প্রাচীন যুগের আদি সনাতন ধর্মের বুকচিরে বেরিয়ে আসে সাম্যবাদী বৌদ্ধধর্ম। এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধের বাড়ি এখান থেকে প্রায় চারশত মাইল উত্তরে নেপালের লুম্বনির অন্তর্গত কপিলাবস্তু জনপদে। বৌদ্ধধর্ম জন্মের পর এই অঞ্চলেই বিকশিত হয়। ইসলাম ধর্মের তখন জন্মই হয়নি। তাহলে আমাদের আদি পুরুষরা নিশ্চয়ই এই বৌদ্ধধর্মকে লালন পালন করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এবার আমরা মহাস্থানগড় যাদুঘরে প্রবেশ করি। এখানে বিগত শতশত বছরের বাংলার রাজাদের মুদ্রা, দেবদেবীর মূর্তি, রাজারাজড়াদের পাতরের ভাস্কর্য্য, সিংহাসন, রাজমুকুট এবং তাদের ব্যবহৃত নানা পণ্যসামগ্রী দেখতে পেলাম।

মহাস্থানগড় যাদুঘর হতে বেরিয়ে আসতেই রিকশাচালক বললেন, আপনারা কি বেহুলার বাসরঘর দেখবেন? মনে করলাম বেহুলার বাসরঘর হয়ত না জানি আবার কি হয়? আমরা সায় দিলাম। রিকশাটি অনেক পথ পার হয়ে একটি সুপ্রাচীন বৌদ্ধমটে আমাদেরকে নিয়ে গেল। ধানক্ষেতের মাঝে এটি একটি প্রাচীন ইটের তৈরি ছোট বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছু নয়। এযেন শুনলাম সোনা মাই, এসে দেখি কিছুই নাই।

আমাদের বগুড়া সফর শেষ, এবার রাজশাহীর বাসে চেপে বসলাম। আমার দুই ফুফুতো ভাই ডঃ সদরুদ্দিন ও রোকন উদ্দিন দীর্ঘ্যদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান এবং পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। আমার এই ফুলবাড়ির ফুফু প্রায়ই রাজশাহীর গল্প বলতেন। পুলিশের আইজি চাচাতো ভাই এমাদ উদ্দিন চৌধুরী রাজশাহীর সারদা পুলিশ ট্রেইনিং কলেজে প্রশিক্ষন গ্রহ করেন। এবার আমি এই ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিবিজড়িত রাজশাহীতে জীবনের প্রথম পদচিহ্ন আঁকতে যাব। তিনচার ঘন্টা ভ্রম করে এক সংক্ষিপ্ত পথে বগুড়া হতে আমাদের বাসটি রাজশাহী মহানগরীতে পৌছে গেল।

বাস হতে নেমেই একটি হোটেল খোঁজে নিলাম। বগুড়ার মত দুরাবস্থা হলনা, মোঠামোঠি চলনসই একটি হোটেল পেলাম। ক্লান্তি নাশ হলে আমরা হোটেল ছেড়ে বেরুলাম- আমার কাছে মনে হল রাজশাহী একটি শান্ত গ্রাম্যশহর। আমরা দুজন হেটে হেটে সোজা চলে গেলাম পদ্মার পার। যতদুর দৃষ্টি যায় ধূধূ বালুচর, মাঝে বইছে এককালের প্রমত্তা নদী পদ্মার কলকল জলধারা। এই সেই পদ্মা নদী যাহা বাংলাদেশের গানের নদী, কবিতার নদী, প্রাণের নদী, কিংবদন্তীর নদী। ফারাক্কার বিষবাধ আজ উম্মুক্ত পদ্মার সেই ভয়ঙ্কর দুরন্তপনাকে থামিয়ে দিয়েছে। বিশাল বালুকাময় পদ্মার এপারে রাজশাহী, ওপারে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলা।

রাজশাহী মহানগর প্রশাসন পদ্মাপারে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল সুরম্য পার্ক। প্রাতঃভ্রমণের জন্য বেশ দারু এক জায়গা বটে। এখানে পদ্মার মৃদুমন্দ বাতাস শরীরে আরামের শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। পার্ক হতে বেরিয়ে এসে পাশে হজরত শাহ মখদুমের(রঃ) মাজার মসজিদে নামাজ পড়লাম। মাজার জেয়ারত করে ফিরলাম হোটেলে।

রাজশাহী বিভাগ প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সমৃদ্ধ বরেন্দ্র অঞ্চল। বরেন্দ্র যাদুঘরটি আমাদের সন্নিকটে অবস্থিত। এই বরেন্দ্র যাদুঘর বাংলাদেশের এক সমৃদ্ধ ও অমূল্য প্রত্নসম্পদ। একটি বড় পাকা টিনের দালানে যাদুঘরটির অবস্থান। এখানে প্রাচীন প্রাকমুসলিম যুগের সাথে সুলতানী, পাঠান ও মোগল আমলের বেশকিছু মুল্যবান নিদর্শন চেখে দেখে নিজের জ্ঞানরাজ্য বেশ প্রসারিত করে নিলাম। একটি রিকশা নিয়ে এবার আমরা ছুটে গেলাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রতিষ্টিত মহাবিদ্যাপিঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস জুড়ে  মনে হল বিরাজ করছে এক স্বর্গীয় সুনসান নিরবতা। রিকশাচালক পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখালেন। রাজশাহী শহরে সিলেটের মত এত বহুতল ভবনের ঠাসাঠাসি ছিলনা। তবে রাস্থাঘাট সিলেটের চেয়ে অনেক প্রশস্থমনে হল গ্রামের মত নিরব এই শহরে শান্তি আছে।

এবার আমরা ছুটে গেলাম বাংলাদেশ পুলিশ প্রশিক্ষ একাডেমি সারদায়। পথে রাজশাহির গ্রাম দেখে নিলাম। ধান্যমাঠের আলে আলে ছোট ছোট বামন আমগাছ। একই মাঠে একি সাথে আম ও ধান চাষ করছেন রাজশাহীর কৃষকেরা। শহর হতে বেশ দূরে সারদা নামক স্থানে এই পুলিশ প্রশিক্ষন একাডেমির অবস্থান। সুরম্য এই একাডেমি পদ্মার বিশালতা বক্ষে ধার করে পদ্মাপারে সেজেগুজে রয়েছে। পুলিশ প্রশিক্ষ মাঠ, ঘোড়রেস মাঠ, শারীরিক কসরত চর্চাকেন্দ্র, গোলী বর্ষন মাট, আবাসিক ভবন সবই যেন এই মহান পদ্মাকে জড়িয়ে আছে। একাডেমির ঘোড়াশালে বড়বড় অনেক হৃষ্টপুষ্ট  ঘোড়া দেখে মনে পড়ল আমার প্রথমচড়া সেই কুতুবের ঘোড়ার কথা, জানিনা সেই স্মৃতির ঘোড়াটি পুলিশের এইসব ঘোড়ার অর্ধেকও ছিল কিনা।

এবার আমরা যশোরের বাসে চেপে বসলাম। ঈশ্বরদির কাছে বৃটিশ আমলের লৌহনির্মিত লালন শাহ সেতু দিয়ে সুপ্রশস্থ পদ্মানদী পার হয়ে দক্ষিণের জেলা কুষ্টিয়ায় আসলাম। এক সময় এই সেতু দিয়ে মুলতঃ ট্রেন চলাচল করত। এখন ট্রেন ও বাস উভয়ই চলাচল করে থাকে। যশোরে আমরা বেশ আরামদায়ক একটি হোটেলে প্রবেশ করলাম। হোটেলের ওয়ালে বেশ বড়বড় টিকটিকি চোখে পড়ল। আসলে যশোর ও খুলনার টিকটিকি সিলেটের তুলনায় বেশ হৃষ্টপুষ্ট মনে হল। বেশ পরিপাটি ছিমছাম শহর যশোর পরদিন ভোরে বেশ সুন্দর একটি পার্কে অনেক মানুষকে প্রাতঃভ্রমন করতে দেখে আমরাও গিয়ে শরিক হলাম। এই পার্কে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা একটি টিলা দেখতে পাই। বাংলাদেশের দক্ষিন পশ্চিমের এই বিশাল এলাকায় কোন পাহাড় টিলা নেই। পাহাড় টিলার জন্য এই অঞ্চলের মানুষের সেযে কি দুর্নবার আকর্ষন এই ছোট্ট টিলা সেই স্বাক্ষী দিচ্ছে। অথচ দুঃখ হল আমাদের সিলেট অঞ্চলের সৌন্দর্য্যের আধার অতি মূল্যবান পাহাড় টিলা অবিবেচক মানুষেরা কেটেকুটে নিঃশ্বেষ করে দিচ্ছে। এই ছোট্ট শহরে চল্লিশ টাকা ঘন্টা দরে একটি রিকশায় পূরো শহর আবর্ত করে এসে খুলনার একটি বাসে আমরা উঠে পড়লাম।

যশোর হতে খুলনা বাসে মাত্র দুই ঘন্টার রাস্থা, সড়কটিও পিচঢাকা মসৃন। বাস ছাড়ার পরই চোখে পড়ল দুইপাশে শতশত চিংড়ি ঘেরের ছড়াছড়ি। ধানক্ষেত খুব একটা দেখা গেলনা। বড়বড় মাঠের চারপাশে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখা হয়েছে। প্রতি জলাশয়ের পানির উপর বাশের মাচাং ঘর। এই ঘরে মৎস্যখাবার নিয়ে বাস করেন এই চিংড়িঘেরের সতর্ক পাহারাদার। এবার বাস খুলনা মহানগর প্রবেশ করল। মহানগরের ভিতর দিয়ে প্রায় অর্ধঘন্টা গাড়িটি চারলেনের এক প্রশস্থ রাস্থা দিয়ে এগিয়ে গেল। খালিশপুর, খুলনা শিল্পনগরী হয়ে সুদূর রূপসাঘাট গিয়ে রাস্থাটি শেষ হল, যে দূরত্ব চৌদ্দপনের মাইলের কম হবেনা।

সেতুবিহীন রূপসা পারের একটি বাস টার্মিনালে আমরা অবতররি। এই প্রধান রাস্থাটির নাম একাত্তুরের একজন স্বাধীনতা বিরোধী নেতা খান এ সবুরের নাম ধারন করে আছে। যখন রাস্থার দুপাশের অসংখ্য দোকানের সাইবোর্ডে এই জগন্য মানুষটির নামে খুলনার এই রাজপথ ‘খান এ সবুর রোড’ দেখলাম তখন নিজেকে আমার ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হল। লক্ষপ্রানের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার এত বছর পর স্বাধীন এই দেশে এইসব কি দেখছি। খুলনায় চারতলা একটি ছিমছাম সুন্দর হোটেল পেয়ে গেলাম। বিশ্রামের পর আবার ঘন্টায় চল্লিশ টাকা দরের রিকশায় চড়ে সারাটা খুলনা মহানগরী একপলক দেখে নিতে বেরিয়ে পড়ি। রিকশায় চড়ে বুঝলাম এই শহরটি খান এ সবুর রোডকে কেন্দ্র করে অন্ততঃ পনের বিশ মাইল লম্বাকার, কিন্তু প্রশস্থতা তেমন একটা নেই। রাজপথ হতে প্রায় অর্ধ মাইল ডানবামে ঢুকলেই সবুজ ধানক্ষেত ও চিংড়িঘের। এই শহরটি আদতে একটি শিল্পনগরী, এখানে অসংখ্য পাটকল, বস্ত্র কারখানা, সুতা কল ইত্যাদি দেখলাম কিন্তু এসব শিল্পের অবস্থা খুব একটা ভাল মনে হলনা।

এবার খলিল সাহেব বললেন, ও স্যার আমরা এখন সোনাডাঙ্গায় এরশাদ শিকদারের বাড়ি দেখব। রিকশাচালককে বলতেই বাসাটির ঠিকানা সে চিনে ফেলেসোনাডাঙ্গা খুলনা মহানগরীর অভিজাত এলাকা। এখানে খুলনার সব ধনী লোকজনের বসবাস। বাড়িটির সামনে দাড়িয়ে দেখি গেটে খোদাই করে লিখা আছে ‘স্বর্নকমল’ এই প্রসাধদ্যোম বাড়িটির রাজাধিরাজ ছিলেন রূপসাঘাটের কুলী এককালের রাঙ্গাচুরা এরশাদ আলী শিকদার। পরে নানা অকাম-কুকাম করে বড়লোক হয়ে এই শহরের সে একজন কমিশনার বনে যায়। ঠান্ডামাথার কুখ্যাত খুনী এরশাদ আলী শিকদার অর্ধশতাধিক মানুষকে খুন করে লাশ সিমেন্টের বস্থায় বেঁধে রূপসার অথৈ জলে ডুবিয়ে দেয় তার অবৈধ হালুয়া রুটিতে ভাগ বসানো নিমকহালালের এক বড়দল নিয়ে মিছিল করে এরশাদ শিকদার যখন যে দল ক্ষমতায় আস সেই সরকারী দলে  ঢুকে যেত। সরকারি দলে ঢুকে সব পাপ হালাল করে নিত। কিন্তু একসময় তার পাপ বালেগ হয় এবং পত্র পত্রিকায় তার সব কুকীর্তি বেরিয়ে আসে। প্রতিপক্ষ একজন রাজনৈতিক নেতাকে খুন করে সে ফেসে যায়। ডুবুরীরা রূপসার তলায় অভিযান চালিয়ে অসংখ্য মানবকঙ্কাল বের করে আনেন। বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান। শেষমেষ এক বিচারিক রায়ে খুলনার এই মানুষখেকো নরপশুটার ফাঁসি হল। ফেরার পথে একটি কবরগায়ের পাশ দিয়ে আসার সময় রিকশাচালক একটি নতুন কবর দেখিয়ে বললেন এই দেখুন এরশাদ শিকদারের কবর।

এবারের যাত্রা শুরু হল বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মংলায়। একটি ভাঙ্গাচুরা রাস্থা দিয়ে বাস হেলেদুলে এসে মংলাবন্দরে হাজির হল। ছোট্ট মংলাবাজার এবং সমুদ্রবন্দরে খানিকক্ষন হাটাহাটি করে আমরা পাশের নৌঘাটে হাজির হলাম। জীবনের এই প্রথমবার সুন্দরবনে আমাদের অভিয়ান রচনা করব।

পশুরনদী, মংলার পাশদিয়ে বয়ে যাওয়া সুন্দরবনগামী এই নদীটি বেশ প্রশস্থ ও গভীর। আমরা একটি ছইওয়ালা ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করলাম মাঝি ইঞ্জিন চালু করলেন। ধমধম ধমধম আওয়াজ তুলে নৌকাটি পশুর নদীর বুকে ঢেউকেটে বনের গহীনে এগিয়ে গেল। নৌকাটি যতই সামনে অগ্রসর হল নদীটি ততই প্রশস্থ হতে লাগল। একটু অগ্রসর হতেই সুন্দরবনের দৃশ্যাবলী আমাদের সামনে ভেসে উঠে। দুইপারে গুচ্ছমুলের বনবনানী কালো কাদায় শিকড় গেঁথে দাড়িয়ে আছে। এই বৃক্ষরাজির উপরের দিকে যত ডালপালা আছে, নিচে প্রায় সমপরিমান গুচ্ছমুলের শাখা প্রশাখা বিস্তৃত রয়েছে। নদীপারের এই অরন্যানি যেন পানিতে কোমর ভিজায়ে জলের উপর শির তুলে দাড়িয়ে আছে। সুন্দরী, কেওরা, গেওড়া ইত্যাদির জঙ্গল নিরীক্ষা করে মনে হল এখানে আমাদের সিলেটের মত সুউচ্চ বৃক্ষের সমাহার নেই। নৌকায় বসে বনবৃক্ষে দুই একটি খর্বাকার বানর চোখে পড়ল। দুই চারটা বনমোরগ দৌড়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে গ

নদীর দুইদিকে অসংখ্য খাল এসে পশুর নদীর সাথে মিশে গেছে। কোন খালে জল আছে, আবার কিছু খালের তলায় কালো কাদা। মাঝি বললেন জোয়ারের সময় এইসব খাল জলে ভেসে যায় এবং ভাটার সময় শুকিয়ে কাদা বেরিয়ে আসে। সেইসাথে এই সুন্দরবনও জোয়ারের জলে গোসল করে আবার ভেসে উঠে। নৌকাটি প্রায় দেড়দুই ঘন্টা চালিয়ে সুন্দরবনের অনেক ভিতরে চলে গেল। দুপাশে কেবল জল জঙ্গল খাল। মাঝি পশুর নদীতে এসে পড়া একটি খালে তার নৌকা নিয়ে ঢুকে যান। তিনি বেশ ভিতরের জঙ্গলে গিয়ে খালপারে নাও ভিড়িয়ে আমাদেরকে নামতে বললেন। আমরা বললাম এই জনহীন অরন্যে কি বাঘ আছে? মাঝি বললেন আগে ছিল এখন নেই। কিন্তু নিচে এত কালো কাদা যে পা ফেলার মত কোন জায়গা নেই। তারপরও নামলাম, এই যে আমাদের গর্বের সুন্দরবন, এই বনের মায়াবী কাদা গাঁয়ে না মেখে কি করে ফিরে যা। এখানে কাদায় নেমে কিছুক্ষন একই স্থানে দু চার পা হাঁটাহাঁটি করে নোনাজলে পাধুয়ে আবার নৌকায় আরোহন করি

মাঝি আমাদেরকে করমজল কুমির প্রজনন ও পর্যটনকেন্দ্রে নিয়ে যান। এখানে নৌকা হতে নেমে নদীতীরের বনময় এই পর্যটন কেন্দ্রে নদীর তীর বরাবর একটি পাকারাস্থা দিয়ে হেঁটে হেটে আমরা দুইজন বেশ গভীর বনের ভিতরে চলে যাই। লোকজন খুবই বিরল। এবার খলিল সাহেব বললেন, কুরেশী স্যার আমার ভয় হচ্ছে। এখানে বাঘ এসে পড়লে বাচা যাবেনা, আসুন এবার ফিরে যাই। ফিরে এসে সিঁড়ি বেয়ে বনবিভাগের একটি টাওয়ারে আরোহন করলাম। এই সুউচ্চ টাওয়ারে দাড়িয়ে পর্যটকরা দিগন্ত বিস্তৃত এই জলমগ্ন নিরব মনগ্রোভ বনের অপার সৌন্দর্য্য উপভোগ করেন। এবার খুব কাছে গিয়ে কয়েকটি ঘুমিয়ে থাকা কুমির দেখলাম। একজন বললেন খুব একটা কাছে যাবেন না, এরা সজাগ শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। আটদশ হাত দীর্ঘ্য কুমিরগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। তাদের বুকের রঙ সাদা হলেও বাকী ত্বকজুড়ে কাল ও শ্বেত বর্গাকার কারুকাজ দেখে মনে হয় কোন শিল্পী যেন সযতনে এই সুন্দর সাদা এবং কালো বর্গক্ষেত্র গুলো আঁকে পাশাপাশি তাদের সারা শরীরে বসিয়ে দিয়েছে।

করমজল পর্যটন কেন্দ্রে অনেকক্ষন কাটিয়ে আমরা এবার নৌকায় ফিরলাম। নৌকা কিছুপথ আসার পর মাঝি বললেন এই দেখুন বানিয়াশান্তা নিষিদ্ধ পল্লী, চারপাশে সুন্দরবন ঘেরা একটি নির্জন গ্রাম। বেশ কয়েকটি পাকাসিঁড়ি নদীঘাট হতে নেমে এসেছে পশুর নদীর বিশাল জলসাগরে। এই পল্লীর মেয়েরা এসব ঘাটে বসে আছেন খদ্দরের অপেক্ষায়। পশুরনদীর হালকা  নোনাজলে এই পল্লীর অনেক মেয়েকে স্বল্পবসনে স্নানরতা দেখলাম। খলিল সাহেব বললেন স্যার চলুন একটিবার নেমে কেবল এই পল্লীটা দেখে আসি। আমি বললাম দরকার নেই, এই নদী থেকে নৌকায় বসে বসে দেখে নেব। নাছোড়বান্দা খলিল সাহেবের পীড়াপীড়িতে শেষে একটি ঘাটে নৌকা ভিড়াতে বাধ্য হইসিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখলাম, পঞ্চাশ ষাটটি টিনের ঘর। আমাদেরকে দেখে এসব ঘরের সামনে মেয়েরা কাষ্টমারের আগমন মনেকরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী ‘উতল হাওয়া’র কথা। এই গ্রন্থ পড়ে আমি প্রথম  মংলার কাছের এই বানিয়াশান্তা নিষিদ্ধ পল্লীর কথা প্রথম জানতে পারি। তসলিমার প্রথম স্বামী মেধাবী কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এই বানিয়াশান্তা হতে দুইবার সিফিলিসের ভয়ঙ্কর জীবানু বহন করে চিকিৎসার জন্য ডাঃ তসলিমা নাসরিনের কাছে ছুটে যান এবং এই রোগই অল্প বয়সে তাঁর জীবনের অবসান ঘটায়।

এই নিষিদ্ধ পল্লীতে আসেন মংলা সমুদ্রবন্দরে ভেড়া বিদেশী জাহাজের ভিনদেশী নাবিকরাআমি পাচসাত মিনিট চারপাশে তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলিয়ে খলিল সাহেবকে বললাম এটি একটি অভিশপ্ত স্থান, এখানে বেশীক্ষ থাকা যাবেনা। এই জায়গা সিফিলিস, গনোরিয়া, এমন কি এইডস ভাইরাসের মত ভয়ঙ্কর জীবননাশক ঘাতকের বিচরকেন্দ্র। জীবনে অন্ততঃ একবার পতিতাপল্লী চোখে দেখার যে ইচ্ছে ছিল তা পূর হয়ে গেছে। আসুন এবার এই মৃত্যুপুরী হতে ফিরে যাই বলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে নৌকায় উঠে পড়ি।

পিছনে পড়ে রইল বানিয়াশান্তা নিষিদ্ধ পল্লী এবং এই পল্লীর অধিকার বঞ্চিত অসহায় উৎপীড়িত সেই মেয়েগুলো যারা নিতান্ত বাধ্য হয়ে এই আত্মসম্মানহীন জীবনে বন্দি হয়ে রোগশোকে ধুকেধুকে একসময় অকালে নিজের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায় মনে হল এইসব অসহায় মেয়েরা আমার আপনার কারও কন্যা, কারওবা বোন। এসব গৃহবন্দি মেয়েদের এজীবন হতে পালাবার কোন রাস্থা নেই। তিনদিকে সুন্দরবন এবং একদিকে পশুর নদী ওদেরকে পাহারা দিয়ে ঘিরে রেখেছে। পাহারা দিচ্ছে বদমায়েশ মাসী ও দালাল চক্র। নৌকায় বসে প্রার্থনা করলাম হে প্রভূ, তুমি এসব নিঃসহায় মেয়েদেরকে মুক্ত করো, সুন্দর জীবন উপহার দাও। আমরা মংলা নদীঘাটে এসে সুন্দরবনের নৌকা হতে নেমে ঐতিহাসিক শহর বাগেরহাটের বাসে চেপে বসলাম।

সন্ধ্যায় বাগেরহাট শহরে আসলাম। একটি সুন্দর জলভরা নদীতীরে চিরসবুজ এই প্রাচীন জনপদের অবস্থান। এই অপরূপ সুন্দর নদীটির রয়েছে এক ভারি সুন্দর কাব্যিক নাম ‘মধুমতি’এই শহরের খুব কাছেই সুন্দরবন। আসলে সুন্দরবনের জঙ্গল হতে এই প্রাচীন জনপদটি এক সময় বের হয়ে এসেছে। এখানে প্রাচীনকালে ছিল অজস্র বাঘের বিচরন, তাই স্থানটির নাম হয় বাগেরহাট। আবার কেউবা বললেন একসময় মধুমতির বাঁকে এই বাজারটি গড়ে উঠেছে। লোকমুখে সেই বাঁকেরহাট একসময় হয়ে যায় বাগেরহাট। গাড় সবুজ শহরটার একটি রাস্থাদিয়ে হাটতে গিয়ে নারিকেল তেলের এতই সুঘ্রান পেলাম যে, ভাবলাম এখানে তৈলখনি আছে। এবার সামনে একটি বড় নারিকেল তেলের কারখানা দেখলাম, যার বিশাল গোদামে পড়ে আছে স্থূপীকৃত টনটন নারকেল। আসলে এই অঞ্চলে প্রচুর নারিকেল জন্মে। নারিকেলের সুবড়া হতে শুরু করে সবকিছুই তারা কাজে লাগায়।

সেইদিন  ভরাপুর্ণিমার ঝলমলে চাঁদনি রাতে আমরা মধুমতি নদীতীরে হাটতে যাই। নরব এশহরের শান্ত নদীটিতে তখন জোয়ার এসেছে, ঘন্টাখানিকের মধ্যে জল উতলে উঠে নদীটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। লোকে বলল ভরা পূর্ণিমায় এই মধুমতির বুকে জোয়ার এসেছে, তাই নদীর বুকে এত জল ছলছল করছেতারা আর বলল ঋতুচক্রের আবর্তনে এখানে নদীর পানির কোন হেরফের হয়না। বঙ্গোপসাগরের তীরঘেষে সাজানো সুন্দরবনের নদী ও খালের জলের লেবেল বর্ষায় যেমন শীতেও তেমন। কেবল চাঁদের দুর্নিবার আকর্ষণে এখানে সর্বদা জোয়ারভাটা হয়, এই জোয়ার ভাটায় নদীর জলতল উচলে উঠে আবার তলিয়ে যায়। মাঝিরা এই জোয়ারভাটাকে ব্যবহার করে নৌকা চালায়। 

পরদিন আমরা দুইজন একটি রিকশা ঘন্টা হিসাবে ভাড়া করে হজরত খানজাহান আলীর(রঃ) মাজারে গিয়ে হাজির হই। খানজাহান আলী(রঃ) ষোড়শ শতাব্দীর একজন প্রজাদরদী মুসলিম শাসক এবং ওলী আল্লাহ। সুন্দরবনের সীমারেখা বরাবর তাঁর রাজ্য খলিফাতাবাদ। জনকল্যানে ষোড়শ শতাব্দীতে তিনি খনন করেন একটি বিশাল খান জাহান আলী দিঘী। এইিঘিপারে তার সমাধি সৌধ। এই সুন্দর  দিঘিটি এত বিশাল যে এর পারে পারে বেশ কয়েকটি বড়বড় গ্রাম গড়ে উঠেছে। দিঘীঘাটে বসলাম, কিছুলোক হাটুজলে নেমে কুমিরকে মোরগ মাছ ইত্যাদি খাবার দিচ্ছেন। কালাপাহাড় এবং ধলাপাহাড় এই দুইটি কুমির নাকি খানজাহান আলীর(রঃ) পোষা কুমির। ভেবেচিন্তে মনে হল লোকের এই ধারনা সঠিকও হতে পারে, কার কুমির এত দীর্ঘায়ু হয় যে তিনচার শত বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

একটি বিরাট গম্বুজের ভিতর খানজাহান আলীর(রঃ) মাজার। পাঁচছয় ফুট পুরু দেওয়ালের একটি ষড়ভূজ আকৃতির স্থাপনা দেখে মনে হল খানজাহান আলী(রঃ) হয়ত তার জীবদ্দশায় এই সমাধি স্থাপনাটি নির্মান করে গেছেন। ভিতরে বেশ লম্বাকার কবর। সারা কবরটি কালপাতরে মুড়ানো এবং এই সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক কালপাতরে আরবি ফারসিতে বানী উৎকীর্ন করা আছে। ভিতরে ডুকতেই পাশের খাদেম এসে বললেন, কিছু মানত করবেন? আমরা বললাম আমাদের মানত করার মত কিছু নেই। এবার তিনি বললেন এই কালপাতরে হাত রেখে কিছু চাইতে পারেন। কিন্তু আমার এসবে তেমন কোন বিশ্বাস নেই। আমি কেবল ইসলাম ধর্মীয় নিয়মে মাজারটি জেয়ারত করে বেরিয়ে আসলাম। লোকজন মাজারের দানবাস্কে প্রচুর টাকা দিচ্ছে কিন্তু আমি কিছুই দেবার প্রয়োজন মনে করলাম না। বুঝলাম আশাবাদি এই খাদেমরা কৃপন এই আগন্তুকদের কাছ থেকে কিছু লাভ করতে না পেরে বেশ নিরাশ হলেন।

খানজাহান আলীর(রঃ) মাজার হতে বের হয়ে এবার ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখতে গেলাম। ফটক পেরিয়ে এক বিশাল প্রাঙ্গণ, এই প্রাঙ্গণে নারিকেল তলায় দুইচার জন ঐতিহাসিক লোকের কবর এবং সামনে সুদীর্ঘ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ। ষোড়শ শতকে নির্মিত এই মসজিদটির বয়স নেহায়েত কম নয়, কমছে কম পাচশত বৎসর হয়ে যাবে মসজিদের পিছনে একটি বড় অজুর দিঘি, প্রশস্থ পাকাঘাট। এই দিঘিটিও আয়তনে এতবড় যে আমাদের রাজনগরের বালিদিঘিকে অনায়াসে হারিয়ে দেবে। স্থানীয়রা বলল প্রাচীনকালে এই দিঘির চারপারে ঘোড়দৌড় হত তাই এই দিঘির নাম ঘোড়াদিঘি, এই ঘোড়াদিঘির বড়ঘাটে আজু করে আমরা আসরের নামাজ জামাতে আদায় করতে মসজিদে প্রবেশ করলাম।

পাঁচছয় ফুট পুরু ইটসুরকির দেওয়ালের এই মসজিদটি শাহি আমলের শান শওকত নিয়ে উনষাটটি বিশাল অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ আকাশের দিকে তুলে ধরে পাঁচশত বছর ধরে দাড়িয়ে রয়েছে। ভিতরে সারিসারি খুটি নয়নতারায় চক্ষুধাধা তৈরি করে, সুউচ্চ ছাদের উচ্চ সীমানায় বড়বড় গম্বুজের সারিমালা প্রানে শিহরন জাগায়। মসজিদটির দৈর্ঘ্য এত বেশি যে নামাজের জামাতে দাড়িয়ে আমরা দেখলাম এক লাইনই পূর্ন হচ্ছে না। হবেইবা কেমন করে, এক লাইন পূর্ন করতে হলে যে তিনচার শত মুছল্লির প্রয়োজন। কয়েক শত বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের গড়া এই বিষ্ময়কর মসজিদের কারুকাজ দেখে মনটা গর্বে ভরে উঠেসেই মহান লোকদের প্রতি শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে আসে।

নামাজের পর আমরা মসজিদটি ঘুরে ঘুরে দেখছি, এমন সময় ইমাম সাহেব ও কয়েকজন হুজুর ভিনদেশী আগন্তুক বুঝতে পেরে আমাদের পরিচয় জানতে চান। আমরা সিলেট হতে এসেছি বলতেই তারা বললেন এতবড় এই বাদশাহি মসজিদটি দেখাশুনা করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। এই এলাকার লোকজন এমন ভিত্তবান নয় যে তারা এই বিশাল বাদশাহি মসজিদটি দেখবাল করার মত সামর্থ্য রাখেতারা বলল আপনারা ধনী অঞ্চলের লোক, কিছু একটা সাহায্য করলে এই মসজিদটি উপকৃত হবে। বললাম সিলেটে বাড়ি হলেও আমরা লন্ডনি কিংবা ভিত্তবান কোনটাই নই। তবে তাদেরকে আমরা নিরাশ করলাম না, সাধ্যমত বড় অঙ্কের কিছু টাকা মসজিদের দানবাস্কে গুজে দিয়ে এবার প্রস্থান করলাম। এইরাত বাগেরহাটে কাটিয়ে পরদিন এক সুদীর্ঘ বাসাযাত্রার প্রস্তুতি গ্রহ করি।

ঘুম হতে উঠে নাস্তা সেরে খুলনায় আসি। খুলনায় আর কোন ঘুরাফেরা না করে আমরা কুষ্টিয়ার একটি বাসে চড়ে বসলাম। খুলনা হতে কুষ্টিয়া প্রায় চারঘন্টার পথ, আমাদের বাসটি পথিমধ্যে এক দুর্ঘটনায় পড়ে। রাস্থার পাশে একটি গরু দড়িবাধা ছিল। আচমকা গরুটি গাড়ির সামনে এসে পড়ে। বাসচালক এই গরুটিকে বাঁচাতে গিয়ে তীব্রগতির মধ্যে ব্রেককষে অন্যদিকে ইউটার্ন দেয়। গাড়ি উলটে সড়কের খালে পড়ার মত অবস্থায় চলে যায়। দুইএক ফুটের জন্য শেষরক্ষা হয়। তবে গাড়িটি প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোনে কাত হয়ে কেমন করে যেন স্থির হয়ে যায়। আতংকিত যাত্রিরা কেউ কলেমা পড়ে, কেউবা রাম রাম জপে ঠেলাঠেলি করে নেমে যান।

আমার পেঠে এই বিপদক্ষণে তীব্র এক পীড়া অনুভব করি। অনেকক্ষণের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পাশের একটি পাকা বাড়িতে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ি। একজন হিন্দু কিশোরীর সাথে দেখা হলে তার কাছে সাহায্য চাই। মেয়েটি এক বদনা পানি এনে আমাকে দিয়ে বাড়ির সামনের পাকা ল্যাট্রিন দেখিয়ে দিল। আমি এতই যন্ত্রনার মধ্যে ছিলাম যে মনে হল ভিনধর্মের এই মেয়েটি আমাকে আজ উদ্ধার পেতে যে সাহায্য করল তার কোন তুলনা হয়না। বেরহয়ে আমি তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই, তখন মেয়েটি বলল আপনি দূরদেশের লোক আসুন এককাঁপ চা খেয়ে যান। আমি সবিনয়ে তার প্রস্থাব ফিরিয়ে দিয়ে বাসে ফিরলাম। ফিরে আসতেই আমার সঙ্গী খলিল সাহেব বললেন স্যার আপনি কোথায় ছিলেন, আমি যে আপনাকে খুজে পাচ্ছিনা। বেশ কয়েকজন লোক ধাক্কাধাক্কি করে গাড়িটিকে লাইনে নিয়ে আসেন। গাড়িটি আবার ছুটে চলল।

কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছার বেশ আগে দর্শনায় আমরা গাড়ি হতে নামি। এবার আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরের পানে যাত্রা শুরু করি। ঝিনাইদহ শহরের পাশদিয়ে গাড়ি চলল, তারপর জেলাশহর মেহেরপুর আসলাম। ঝিনাইদহ শহরটি একটি জেলাশহর, অথচ আয়তনে এতছোট যে মনে হল এটি যেন সিলেটের কোন এক উপজেলা শহর হবেমেহেরপুর জেলাশহরটি এত ক্ষুদ্র যেন আমাদের মোগলাবাজার।

মেহেরপুর বাজার হতে গাড়িতে চড়ে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ঐতিহাসিক মুজিবনগর চত্বরের বাহিরে এসে নামি। একসময় এই জায়গাটির নাম ছিল বৈদ্যনাথতলা। এবার মুজিবনগর চত্বরের ভিতরে প্রবেশ করামাত্রই সেই চিরস্মরণীয় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে মনটা ফিরে গেলসেই গৌরবময় দিনটিতে বাঙ্গালিরা সর্বপ্রথম আস্থায়ী বিপ্লবী মুজিবনগর সরকার গঠন করে এবং এই তারিখেই মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করে১৭ এপ্রিল ১৯৭১ এখানে এই মুজিবনগর সরকার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকার হিসাবে শপথ গ্রহ করেন।

মুজিবনগর প্রাঙ্গন হচ্ছে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়, বিশাল এক আম্রকানন। এই আম্রকাননের রসাল বৃক্ষমালা এমনভাবে সরলরেখায় সারিবদ্ধ করে লাগানো যে সারির প্রথমবৃক্ষের সামনে দাড়িয়ে তাকালে কেবলমাত্র প্রথম গাছের কাণ্ড দৃষ্টিগোচর হয়, বাকি সব বৃক্ষকান্ড দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। ১৭৫৭ সালের ২৩সে জুন পলাশীর আমবাগানে বাংলার স্বাধীনতা সুর্য অস্তমিত হয়। এই স্বাধীনতা হারানোর দুইশত চৌদ্দ বৎসর পর আরেক আম্রকানন, মুজিবনগর আমবাগানে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বাংলার স্বাধীনতা সূর্যের আবার উদয় ঘটে। দুইটি ঐতিহাসিক আম্রকানন- একটি হারানোর, অন্যটি পাবার। মাঝখানে এক গাড় অন্ধকার সুদীর্ঘ ২১৪ বছরের সময়ের সাঁকো।

এই আম্রকানন পার হয়ে ভারতের সীমান্তরেখা বরাবর কাটাতারের বেড়া। আমরা সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে চলে যাই। এই সীমানার কাছেই ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্থম্বের উপর মূলবেদীকে কেন্দ্র করে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, যেখানে তেইশটি ত্রিভূজাকৃতি দেয়াল একেএকে উপরে শিরতুলে দাড়িয়ে রয়েছে। এই দেয়ালগুলো উদীয়মান সূর্যের প্রতীক। স্মৃতিসৌধের মূল বেদিতে গোলাকার বৃত্তের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবদের মাথার খুলি বোঝানো হয়েছে। স্মৃতিসৌধের মূল বেদিতে ওঠার জন্য মোঠ ১১টি সিঁড়ি ব্যবহার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১১টি সেক্টরের প্রতীক হচ্ছে এই ১১টি সিঁড়ি। ৩০ লক্ষ শহিদকে স্মরণীয় করে রাখতে স্মৃতিসৌধের মেঝেতে ৩০ লক্ষ পাতর বসানো হয়েছে। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের মূল নকশাকার হলেন স্থপতি তানভীর করিম।

এবার পাশের মিউজিয়ামে ঢুকে ১০ জন জাতীয় নেতার তৈলচিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ২৪টি বড় আকারের তৈলচিত্র দেখতে পেলাম।

এবার আমরা মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে প্রবেশ করি। ৬৬ একরের বিশাল আয়তনের নান্দনিক এই কমপ্লেক্সে একটি জাদুঘর, মিলনায়তন, প্লাজা, স্বাধীনতা ক্লাব, পাঠাগার, রেস্টহাউস, হ্যালিপ্যাড, পিকনিক স্পটসহ অনেক সুবিধা রয়েছে। এই  মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সটি একটি বৃত্তাকার চারতলা ভবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এই ভবনটির প্রতিতলায় দর্শকদের জন্য বড় করিডোর রয়েছে। প্রতিতলায় করিডোরে দাড়িয়ে নিচে তাকিয়ে বাংলাদেশের বিশাল মানচিত্র দেখতে পাওয়া যায়।

কমপ্লেক্সের বাহিরে সংলগ্ন রয়েছে ছয়টি গোলাপবাগান, যাহা ১৯৬৬ সালের ছয় দফার প্রতীক। এখানে অসংখ্য ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাস। এসব অসংখ্য ভাস্কর্য্যে দেখলাম বঙ্গবন্ধুর আঙ্গুলতুলা ৭ই মার্চের ভাষ, মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহ, সেই প্রথম মন্ত্রিসভা, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ঢাকায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পনএই সৃষ্টিরাজ্যে আর আছে বাঙ্গালি নারী ও জনগণের উপর পাকবাহিনীর নির্যাতনের ভাস্কর্য্য এবং শরনার্থীদের ভাস্কর্য্যইতিহাস কেন্দ্রিক এই ভাস্কর্য্যগুলো দেখে আমার মন সেই অতীতের গৌরবময় দিনে বারবার হারিয়ে যায়। এইখানের দুইটি বিরাট পাকাদালানে লিখা রয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ পত্র।

একজন তরুন বললেন, মেহেরপুর সন্ত্রাস কবলিত এলাকা, এখানে সর্বহারারা দিনেদুপুরে অস্ত্রের মহড়া দেয়, বোমা ফোটায়লোকজনকে ধরে নিয়ে কুরবানীর পশুর মত জবাই করে ফেলে। এলাকাটি এত দরিদ্র যে ভাত খাবার একটি ভাল হোটেল পাওয়া বেশ কষ্টকর। এবার বুঝলাম কেন এই দারিদ্রতা। সন্ত্রাস ও দারিদ্রতা একত্রে বসবাস করে। যে এলাকা সন্ত্রাস কবলিত হয়, সেখান থেকে স্বচ্ছলতা পালিয়ে যায়। মেহেরপুর থাকার মত হোটেল নেই, খাবার নেই। আমরা বেশ রাত করেও তাই কুষ্টিয়া শহরে গিয়ে হাজির হলাম। একটা চলনসই রেস্টহোটেলে ব্যাগ রেখে আমি ও খলিল সাহেব রাতের কুষ্টিয়া শহরে বের হলাম। বাহিরে এসেই দেখলাম এক জমজমাট গানের জলসা বসেছে। গায়কের দল ডোল করতাল বাজিয়ে গাইছেন। লোকজন ফুঁর্তি করে গানবাজনা শুনছেন। সেইরাত গভীর ঘুমে পার করলাম

খুবভোরে উঠে আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহবাজপুর কুঠিবাড়ি দেখতে রওয়ানা হলাম। একটি রিকশা চড়ে আমরা পদ্মার শাখানদী গড়াইয়ের দিকে অগ্রসর হই। আবার উৎসবের কবলে পড়লাম। সনাতন ধর্মের শতশত নরনারী, কিশোর কিশোরী মিছিল সহকারে ডোলক বাজিয়ে আমরত, কাচাফুল এবং অর্ঘ্য বয়ে নিয়ে পূন্যস্নান করতে গড়াই নদীর পানে ছুটে চলেছেন। আমরাও যাচ্ছি সেই একই ঠিকানায় গড়াইয়ের ঘাটে, খেয়াপার হয়ে কুটিবাড়ির পথ ধরব। গড়াইনদীর ঘাটে পুন্যার্থী জনতার গিজগিজ করা ভীড়দেখলাম অজস্র অল্পবসনা নরনারী জলে ভিজে চুপসে গিয়ে গড়াইয়ের পবিত্র সলিলে পূন্যস্নান করে পাপধুয়ে নির্বা হচ্ছেন।

খেয়ানৌকায় বসে বেশ প্রশস্থ এই গড়াইনদী পার হয়ে মনে হল আমরা যেন স্মৃতিভরা বর্ষার সুরমানদী পার হলাম। ওপার হতে আড়াই তিন মাইল উত্তরে পদ্মাপারে রবিঠাকুরের শাহবাজপুর কুঠিবাড়ি। নদীপার বরাবর একটি কাচারাস্থা শাহবাজপুর চলে গেছে। এই রাস্থা দিয়ে চলাচল করে বিশেষ ধরনের এক প্রকার হস্থনির্মিত গাড়ি। একটি ট্রাক্টর ইঞ্জিনের পিছনে দুইচাকা বিশিষ্ট একটি চৌকি জুড়ে দিয়ে স্থানীয়ভাবে গাড়িটি নির্মা করা হয়। এই গাড়িচৌকির তিনদিকে বাহিরে দু পা ঝুলিয়ে গাদাগাদি করে বসে যাত্রিরা চলাচল করেন। ভাড়া অল্প মাত্র দুই এক টাকা পরিশোধ করে করে যাত্রিরা নিজনিজ গন্তব্যে নেমে পড়েন। পথের পাশে একটি তাতিপাড়ায় খানিকক্ষণ নেমে চরকায় সুতাকাটা, তাতে কাপড়বুনা ও রংকরা দেখলাম। গ্রামবাসীরা এই ভিনদেশিদেরকে বেশ খাতিরযত্ন করে সবকিছু বুঝিয়ে বললেন।

আমরা বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শাহবাজপুর কুঠিবাড়ির খুব কাছে নেমে ধীর পদক্ষেপে কবির প্রতি এক শ্রদ্ধাবনত মন নিয়ে এগিয়ে গেলাম। এই জমিদার বাড়ির দুইটি অংশ- প্রথমে বহির বাটি এবং তারপর ভিতর বাটি। চারপাশে পাকা দেয়ালঘেরা প্রথমে বহির বাটির ফটক পার হলাম। বেশ দুরত্ব হেঁটে পার হয়ে ভিতর বাটির ফটকের সামনে আসলাম। ভিতরে চারপাশে পাকা দেয়ালঘেরা ভিতর বাটিতে ঢুকে রবীন্দ্রনাথের তিন পুরুষের স্মৃতিজড়ান ভবনের সামনে উপস্থিত হই। এই বাড়িতে চোর ঢুকতে হলে তাকে বহির ও ভিতর বাটির দুইটি দেয়াল টপকে আসতে হবে। একটু বামদিকে অগ্রসর হয়ে একটি সুন্দর মধ্যমাকৃতির পুকুরপারে আসিপুকুরঘাটে বসলাম, পাশে রবিযুগের একটি বয়স্ক বেলীফুলের গাছ শ্বেতফুলে ছেয়ে আছে তলায় ঘাসের উপর ফুলের আস্তর

এই অপূর্ব সুন্দর কুঠিবাড়িটি বিশ্বকবির তিনপুরুষের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। আড়াইতলা ভবনটির নিচতলা রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, দ্বিতীয় তলা পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অর্ধছাদ বিশিষ্ট তৃতীয় তলা রবিঠাকুর নিজে নির্মা করেন। এই ভবনটি এত সুন্দর এবং শৈল্পিক যে এটি ঠাকুর পরিবারের তিন পুরুষের উচ্চ রুচিবোধের পরিচয় বহন করছে। বাংলাদেশের অন্য কোথায়ও এই ধরনের মনোরম ডিজাইনের বাড়ি আমার চোখে পড়েনি। কবির এই বাসভবনে একটি আরাধনা কক্ষ দেখলাম, কিন্তু যেখানে কোন দেবতার মূর্তি দেখতে পেলামনা। খুবসম্ভব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিরাকার একমাত্র ব্রহ্মার উপাসক ছিলেন। কার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দুধর্মের আধুনিক সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ কতৃক সংঘটিত হিন্দুধর্মের সর্বশেষ সংস্কার ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ছিলেন।

এই ভবনে বিশ্বকবির ব্যবহৃত খাট পালঙ্গ চেয়ার টেবিল ল্যান্টন বিছানা বালিশ পোষাক লাটি সব সযত্নে সাজিয়ে রাখা আছে। দুতলার দুইদিকে দুইটি দীর্ঘ্যাকার বারান্দা আছে যেখানে দাড়িয়ে রবীন্দ্রযুগে পদ্মার তরঙ্গমালা দেখা যেত। বিশ্বকবির বেশ কিছু তৈলচিত্র সারাটা ভবনে ছড়িয়ে রয়েছে। এবার আভ্যন্তরীন সিড়ি বেয়ে ছাদের আড়াইতলায়  উঠলাম। এখানে যে ইজিচেয়ারে বসে রবিঠাকুর পাশেবহা পদ্মার দৃশ্যাবলী উপভোগ করতেন সেই চেয়ারটি সুরক্ষিত দেখতে পেলাম। তিনতলার ছাদবিহীন খোলা প্রাঙ্গনে বিশ্বকবির প্রিয় প্রমোদ নৌকা ‘সোনারতরি’র দেখা পেলাম, যা এখনও বিশ্বকবির পদ্মায় নৌভ্রমনের স্মৃতিবহন করছে। যাদুঘরের কর্মচারিরা বললেন, আদিকালে এই বাড়ির পিছন দিয়ে দিগন্তহীন পদ্মা বয়ে যেত। আজ গতি বদলে সেই দুরন্ত পদ্মা বহুদূর চলে গেছে। এই বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ অনেক অনেক গল্প কবিতা ও গান রচনা করেন। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয় নি কিন্ত এখানে এসে এই মহাজ্ঞানীর প্রচ্ছায়া মনেপ্রাণে অনুভব করে ধন্য হলাম।

ফেরার পথে আমরা ‘বিষাদসিন্ধু’র লেখক মীর মোশাররফ হোসেনের কবরটি জেয়ারত করলাম। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ নামক একটি আত্মজীবনীও তিনি রচনা করেনতিনি আদি বৃটিশ যুগের এমন একজন কিংবদন্তি মুসলিম লেখক ছিলেন যে যুগে বাঙ্গালি মুসলমানরা বাংলাভাষা চর্চা ও শেখার ব্যাপারে ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন

রাতে আমরা একটি রিকশায় চড়ে কুষ্টিয়ার সন্নিকটে লালন আখড়ায় গিয়ে হাজির হই। গেট পারহয়ে সারিবদ্ধ অনেক কবর দেখলাম। এসব লালন সাইজির শিষ্যগনের কবর। বেশ ভিতরের একটি একদরজা বিশিষ্ট ছোট্ট পাকাঘরের ভিতর পালক মায়ের সাথে পাশাপাশি কবরে ঘুমিয়ে রয়েছেন বাংলার উদারপ্রাণ মানবতাবাদী দার্শনিক ও ভাববাদী কবি লালন শাহ। এই সমাধীঘরের বাহিরে লালন শাহের প্রধান শিষ্য দুন্দু শাহের কবর। এই দুন্দু শাহ ছিলেন কুষ্টিয়া অঞ্চলের একজন বিখ্যাত আলেম, যিনি বাউল দর্শনকে মনে করতেন কুফরি মতবাদ। একবার তিনি এই বিষয়ে একগাদা ধর্মীয় কিতাব নিয়ে লালন শাহের সাথে বাহাস করতে আসেন। কিন্তু বাহাসে এসে তিনি লালন শাহের সাথে বিতর্কে হেরে গিয়ে তার শিষ্যত্ব বর করে নেন।

লালন শাহের পরিচয় তিনি নিজেই জানতেন না। খুবসম্ভব তিনি কোন এক অজ্ঞাত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহ করেন। শিশুকালে তিনি গুটিবসন্তে আক্রান্ত হলে পরিবারের লোকজন সামাজিক চাপে বাধ্য হয়ে তাকে একটি ভেলায় শোয়ায়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়একজন মুসলিম কৃষাণী তাকে নদী হতে কুড়িয়ে এনে মাতৃস্নেহে লালনপালন করেন। লালন শত বৎসরের অধিক দীর্ঘজীবন লাভ করেন। অসংখ্য ক্লাসিক গানের রচয়িতা ফকির লালন শাহ মৃত্যুকালে প্রায় দশহাজার বাউল শিষ্য রেখে পরলোকগমন করেন। আমরা তার সমাধি জেয়ারত করে পাশের লালন একাডেমির তিনতলা ভবনের সামনে যাই। ভবনের নিচতলা খোলা প্রাঙ্গণ, এখানে বেশ কয়েকজন লাল ও হলুদ  বসনা বাউল আসরে বসে দুতারা হাতে নিয়ে গল্পগোজব করছেন। লালন একাডেমির উপরের অফিস রাতে বন্ধ, তাই এই ভবনে কি আছে দেখা হল না। বাহিরে বেরিয়ে লালনমেলা প্রাঙ্গণে যাই। এখানে ডোল, করতাল, তবলা, একতারা, দুতারা ইত্যাদির দোকান রয়েছে। খই, মুড়ি, মন্ড, নাড়ু, তালপাখা, ঝুনঝুনি সহ গ্রামবাংলার হস্থকর্মের নানা পসরা সাজিয়ে বসে আছেন গ্রাম্য দোকানিরা। আমাদের দুইদিন দুইরাতের সরাইখানা কুষ্টিয়াকে মনে হল একটি জমজমাট উৎসবের নগরী

পরদিন কুষ্টিয়া বাস টার্মিনালে গিয়ে ঢাকার বাস ধরলাম। তবে রাজধানী ফিরলাম এক ভিন্নপথে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট হয়ে। একগাদা বড়বড় বাস ও ট্রাক বিশালাকার ফেরিতে আরোহন করল। ফেরিটি একটু এগিয়ে পদ্মার মাঝখানে চলে গেলে মনে হল আমরা একটি কুলহীন সাগরে পড়ে গেছি। এখানে আমরা রাজশাহীর বালুচরের পদ্মা নয়, অন্য এক সাগরসম পদ্মার জলরাশির দেখা পেলাম। এই পদ্মাকে ভাল করে দেখে নিতে লোহার সিঁড়ি বেয়ে চালক কক্ষের ছাদে উঠলাম। চারপাশে সীমাহীন ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ ও শীতল বাতাসের শনশন গর্জ খানিকের জন্য হৃদয়রাজ্যে পদ্মার এক তুফানচিত্র রচনা করে দেয়মনের বীণায় বেজে উঠল জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সেই গান ‘পদ্মার ঢেউরে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা রে/ এই পদ্মে ছিলরে যার রাঙ্গা পা, আমি হারিয়েছি তারে, পদ্মার ঢেঊ রে/ মোর পরাও বধু নাই, পদ্মে তাই মধু নাই নাইরে, পদ্মার ঢেঊ রে/ বাতাস কাদে বাইরে, সে সুগন্ধ নাইরে, পদ্মার ঢেঊরে/ মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা রে, পদ্মার ঢেঊ রে’                                                                                            

সিলেট ফিরে এসে দগাহ অফিসে বসতেই আমাদের অঞ্চল প্রধান আব্দুল করিম চৌধুরী স্যার বেশ রাগের সাথে ফোন করে বললেন, অফিস ফেলে রেখে এতদিন ধরে আপনারা কোথায়? বললাম স্যার আপনার অনুমতি পেয়ে দেশের পশ্চিমাঞ্চল ঘুরতে গিয়ে একটু দেরি করে ফেলেছি, আমাদেরকে ক্ষমা করে দিলে খুশী হই। স্যার জিজ্ঞেস করলেন কোন কোন জায়গায় গিয়েছেন? করিম স্যার ভ্রমপিপাসু লোক, আমি বিবর দিতেই খুশী হয়ে বললেন এত অল্প সময়ে এতএত জেলা ঘুরে আসলেন কেমনে? আমাকে একটু ফোন করলেই আর কিছুদিন ছুটি বরাদ্ধ করে দিতাম। দেখলাম মহাব্যবস্থাপক আব্দুল করিম স্যারের রাগাগ্নি মুহুর্তেই মধুজলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আসলে আমাদের বস আব্দুল করিম স্যার ছিলেন এমনই একজন উদার মহানুভব গুরুজন, যিনি শিশুর মত সরল আবার কর্তব্য কর্মে চৌকশ ও পাহাড়ের মত অবিচল।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন