স্পিকার
হুমাউন রশিদ চৌধুরী সকাশে একশীতের সকালবেলাঃ
প্রকৃতির
নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যের এক অপরূপ লীলাভূমি সিরাজনগর চাবাগান। রশিদ ওয়াকফ এস্টেটের
এই বাগানটি মরহুম স্পীকার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমাউন রশিদ চৌধুরীর মাতা
সিরাজুন্নেছা চৌধুরীর নামে প্রতিষ্টা করেন তার স্বামী বৃটিশ আমলের ডিপোটি
ম্যাজিস্টেট আব্দুর রশিদ চৌধুরী। রাজনগর উপজেলায় আটশত একর পাহাড়ি জায়গা জুড়ে
বাগানটির অবস্থান। চাবাগান, রাবার প্ল্যান্ট, মাছের হ্রদ, ডায়রী খামার, ধানক্ষেত,
ফল বাগান, চারাগাছ প্ল্যান্ট, আগর গাছ, এমনকি মৌমাছি খামারও রয়েছে এই বাগানে।
এই সুন্দর
বাগানটির মালিক জাহানজেব রশিদ চৌধুরীর পত্নী দিলারা আপা আমার দোলাভাই আব্দুল
কুদ্দুস চৌধুরীর চাচাত বোন। আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী তার গ্রামের চেয়ারম্যানি
পরিচালনার সাথে এই বাগানটির ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। প্রতি বছর শীতে
দিলারা আপা তার দুই পুত্র ও একমাত্র কন্যা সাবরিনাকে নিয়ে এই বাগানে আসতেন। দিলারা
আপার ভাই জিনবিঞ্জানী ডঃ আবেদ চৌধুরীও অস্ট্রেলিয়া হতে এসে মাঝে মাঝে যোগ দিতেন।
তখন আমিও প্রকৃতিকে
উপভোগ করতে দুইতিন দিনের জন্য বাগানটিতে ছুটে যেতাম। বাগানের চার পাশের অজস্র
জাতের ফুলের সহাস্য রূপ ও সুভাসে মন ভরে যেত। বারান্দার সামনে আজোয়া খেজুরগাছে
ফুলসহ ঝুলে থাকত থোকা থোকা খেজুর। লেকে ডুব সাঁতার দিত পরিযায়ী জল বিহঙ্গরা। সবুজ
টিয়ারা পাতায় পাতায় একাকার হয়ে যেত। অনবরত শোনা যেত একটি পাখির গান- ‘বউ কথা কও,
বউ কথা কও’। কিংবা থেমে থেমে কানে বাজত কুকিলের কুহু
কুহু সুমধুর সুর। দিনদুপুরে ডানবামে শেয়ালের ক্রন্দনধ্বনি হুঁ ক্কা
হুয়া, হুঁ ক্কা হুয়া, হুয়া হুয়া হুয়া নির্জন বনভূমি প্রকম্পিত করে দিত। সুউচ্চ
টিলায় চিরশায়িত আছেন একজন ইংলিশ মহিলা, যিনি কয়ছর রশিদ চৌধুরীর পত্নী। ঘাতকব্যাধী
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা গেলে তার ইচ্ছায় এই সুন্দর উচ্চভূমিতে তাকে
একটি উইলো বৃক্ষের তলায় দাফন করা হয়।
বাংলোর
বাহিরের পাকঘরে রান্নাবান্না হত, খাবার পরিবেশন করে কর্মীরা ডাইনিং টেবিলে বসানো
ঘন্টি বাজাত। আমরা সবাই ঘন্টি শুনে একসাথে এসে খেতে বসতাম। বাহিরে জ্বলন্ত
অঙ্গারের আগুনে সেকে মাংস পুড়িয়ে তৈরী করা হত মজাদার শিক কাবাব। পোষা গাইয়ের গামলা
ভরা দুধ ও পাত্র ভরা থাকত মমসহ খাটি মধু। আমরা মধুর সাথে মম চুইতাম, এযেন অনেকটা
আজকের দিনের চুইঙ্গাম। মৌয়াল ছিলেন একজন খাসীয়া কর্মি, তিনি মধু সংগ্রহ করে বড়বড়
পাত্র ভরে ফেলতেন। মাছ ধরার টিম মৎসের সেবাযত্ন করত,
তারা সদ্যধরা মাছ এনে পাকশালের ডেগ পূর্ন করে দিত।
বাগানের
ওয়ালে গাথা ছিল বহু প্রাচীন একটি কাল শিবমূর্তি, কিছুদিন আগে শুনলাম মুল্যবান এই
মূর্তিটি চোরে নিয়ে গেছে। ডাইনিং রোমে ছিল অপুর্ব সুন্দর একজন নারীর অর্ধ উলঙ্গ
তৈলচিত্র, সিটিং রোমে ছিল গ্রীক উলঙ্গ দেবীর স্টিলের মূর্তি। ডাইনিং এর নিচে
বাহিরে খাচাবন্দি ছিল একটি সজারু। দোলাভাই আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী সপরিবারে
ক্যানাডা চলে গেলে আমার পদচিহ্ন পড়েনি এই স্মৃতিময় বাগানটিতে কোনদিন আর।
তিনদিকে
পাহাড়ি লেইক ও একদিকে পাহাড় সংযুক্র দুইটি টিলার উপরিভাগ সমতল করে সামনের টিলায়
একটি বাগানঘেরা দুতলা ডুপ্লেক্স বাংলোবাড়ী। এই বাড়ির ডিজাইন এতই সুন্দর ও
বৈচিত্রময় যে কেউ এর ডিজাইনারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ না হয়ে পারবেন না। পিছনের টিলায়
টেনিস গ্রাউন্ড, দোলনা ও ব্যায়ামের হুইলার রয়েছে। কয়েক সিঁড়ি নিচে নেমে একটি
সুন্দর সেতু, লেকের উপর স্থাপিত অপূর্ব এই কাটের সেতু হেটে পার হয়ে এই বাগান
বাড়িতে ডুকতে হয়। গাড়ি রেখে আসতে হয় লেকের ওপারে গ্যারেজে।
মনে পড়ে,
তখন জানুয়ারী ১৯৯৮ সাল। একরাতে তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পীকার হুমায়ন রশিদ চৌধুরী
এই বাংলোয় রাত্রিযাপন করেন। তিনি এই ডুপ্লেক্স ভবনের উপরতলার বড় কক্ষে এবং আমি
নিচের একটি কক্ষে ঘুমিয়ে রাত পার করি। লেকের বাহিরে সরকারি পুলিশ ও ভিতরে বাংলোর
নিরাপত্তা কর্মিরা পাহারা দেন। সকালে গিয়ে ড্রয়িং রোমের সোফায় বসে আছি। এমন সময়
প্রশান্ত মনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আমার সামনের সোফায় এসে বসেন বাংলাদেশের জানু
কূটনৈতিক, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও তখনকার
স্পীকার হুমাউন রশিদ চৌধুরী। দারুন কর্মব্যস্ত এই প্রতিভাকে সেদিন মনে হল যেন
বিশ্রামে আছেন। আমার পরম শ্রদ্ধার এই মানুষকে এত কাছে পেয়ে আমি তার কাছে তার
জীবনের কিছু কাহিনী জানতে চাইলাম। সুশান্ত ও অতিভদ্র মানুষটি আমাকে বঞ্চিত করলেন
না। বললেন শৈশবে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে বড় হয়ে ওঠার বিচিত্র কাহিনি।
পাঞ্জাবের সর্দারদের লম্বা গাড়ি কেনার প্রতিযোগিতার কাহিনিও শুনালেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন