আমার
জনক সফিক চৌধুরী ও জননী আসমতুন্নেছার হজ্জযাত্রাঃ
তখন ১৯৯৮
সাল। আমার জননী আসমতুন্নেছা ছিলেন খুব ধর্মপরায়ানা মহিলা। পবিত্র হজ্জ পালন করা
তার আজীবনের লালিত স্বপ্ন। আমার লন্ডনের ভ্রাতা তাহমিদ চৌধুরী বললেন, আমি সম্পূর্ন
খরচ বহন করব, আম্মা ও আব্বা দুইজনেরই হজ্জে গমনের ব্যবস্থা করা হউক। আম্মার
সামান্যমাত্রায় ডায়বেটিস হলেও তিনি ছিলেন তখন মোঠামোঠি শক্ত সামর্থ্য। আব্বা
সফিক চৌধুরীর বয়স তখন আশি বৎসর হলেও শরীরে কোন রোগ ছিলনা, না প্রেসার, না
ডায়বেটিস, না গ্যাষ্টিক। কেবল শুনতে একটু সমস্যা হত মাত্র। আলম ট্রেভেলসের মালিক
সাহাবউদ্দিন ভাই ছিলেন আমাদের খুব ঘনিষ্ট একজন। তিনি ছাতকের সৈয়দপুরের আমাদের একজন
আত্মীয় পীরসাহেবের মুর্শিদ। সাহাবউদ্দিন ভাই তার কয়েক পুরুষ পরম্পর পীরসাহেবের
মুরিদ হওয়ার সুবাদে পীরের এই স্বজনদের হজ্জযাত্রার কাজ সাশ্রয় ও যতনের সহিত আয়োজন করেন।
রনকেলী গ্রামের আমাদের কয়েকজন আত্মীয় এই হজ্জযাত্রি দলে শরিক হন।
হজ্জকরে
প্রচুর টাকা হাতে রয়ে গেলে আম্মা মালামালের সাথে সোনার অলঙ্কারও নিয়ে আসেন। দেশের
ঘনিষ্টদেরকে সোনার বালা, দুল, হার ইত্যাদি উপহার দেন। আম্মার ধারনা ছিল লন্ডন
আমেরিকায় অর্থ ও সোনার বন্যা বয়, তাই লন্ডনের বড়ভাবীকে সোনা প্রদান নিষ্প্রয়োজন,
তাই তাকে তিনি কোন সোনাদানা দেননি। পরে বুঝতে পেরে এই হজ্জের খরচদাতা বড়ভাবী
কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হন। অবশ্য আমার লন্ডনের ভাতিজি নওসিনকে একটি সোনার চেইন প্রদান
করেন।
তারা মদীনা
হতে কিনে খেজুরপুর্ন একটি বড়ব্যাগ অতিকষ্টে বিমানে করে নিয়ে আসেন। সব মালামাল
তাদের সাথে আসলেও খেজুরের ব্যাগটি বিমান কতৃপক্ষ বললেন পরে আসবে। সিলেট
এয়ারপোর্টের মাল গোদামে তিনচার দিন তাদের কথামত মেমো নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করার পরও বিমান কতৃপক্ষ খেজুরব্যাগটি
খোঁজে বের করে দিতে ব্যর্থ হন। অনেক
প্রচেষ্টার পর অবশেষে আমরা এই খেজুরের আশা চিরতরে ছেড়ে দেই, না জানি এই আধমন খেজুর
কোন খাদক দলের উদরে গেল।
হজ্জ হতে
ফিরে এসে আম্মা ছোটখাট ইন্দোনেশিয়ান হাজীদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কাল মানুষের
চেহারা সুরত পোষাক ও তাদের কাবাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বসার গল্প বলতেন। যখন তার সাথি
মহিলারা হোটেলের কক্ষে বসে মেয়েলী আলাপে নিমগ্ন হয়ে অলস সময় পার করে যান, মা তার
মুল্যবান সময়টা তখন যতটুকু সম্ভব মক্কা ও মদিনার মসজিদে কাটান। আম্মা আসমতুন্নেছা
মসজিদে নবুবীতে একদিন রসুলের (সঃ) রওজা মোবারক জেয়ারত কালে হজরত আবু বকরকে(রাঃ)
তার মাঝারের উপর দেখে ফেলার এক অদ্ভুদ কাহিনী শুনান। আমি
বললাম বিষয়টি তোমার চোখে হয়ত একধরনের সম্মোহন হতে পারে।
তখন আম্মা
আমাকে বললেন, হজরত আবু বকরকে(রঃ) আমি বয়ঃবৃদ্ধ, হালকা দাড়িওয়ালা, চিকনতনু ও মোবারক
চেহারায় দেখেছি। তিনি বললেন তার এই দেখাটা এতই
সুস্পষ্ট ছিল যে, প্রচন্ড শিহরনে তার সারাটা শরীরের সবকটি লোম খাড়া হয়ে যায়, দুচোখ
বয়ে অশ্রুর ঢল নামে ও তিনি হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠেন। এই গল্পটি তিনি আমি
ও আমাদের পরিবারের দুই একজন ছাড়া কাউকে বলতেন না বরং এই বিষয়টি তিনি কাউকে নাবলে
গোপনই রাখতেন। মায়ের মৃত্যুর এত বছর পর আমি তার এই গোপনীয় খবরটি তাঁর সন্তান
হিসাবে আমার আত্মজীবনীতে সবার জন্য উম্মুক্ত করে দিলাম।
৯
ফেব্রুয়ারী ১৯৯৮ সাল। এবার আশরাফুল আলম ভাইয়ের রিলিভিং ডিউটিতে ছুটলাম বাসিয়া
নদীরপার বিশ্বনাথে। সুনামগঞ্জের ভাটিঅঞ্চল তাহিরপুরের আশরাফ সাহেবের সাথে আমি
ইতিপুর্বে সিলেট শাখায় কাজ করি। সেখান হতে তিনি ব্যবস্থাপক হয়ে বিশ্বনাথ শাখায়
আসেন। তিনি ধার্মিক ও হৃদয়বান লোক। তার জায়া ভাটি অঞ্চলের এক অপরূপা সুন্দরী। তার
মনে সন্থান না পাওয়ার এক প্রচ্ছন্ন
যন্ত্রনা ছিল। এই মনঃযন্ত্রনার মধ্যে একসময় পত্নীর সাথে ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়। আমি
বিশ্বনাথবাসীর সান্নিধ্যে এক সাপ্তাহ কাটিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি
সিলেট শাখায় ফিরে আসি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন