জেফারের
স্কুলযাত্রা ও রিকশা কাহিনি
২০০১ সালের
পহেলা জানুয়ারী জেফারের বয়স চার বৎসর পুর্ন হল। অনেক
ভেবেচিন্তে আমরা তাকে ব্লু বার্ড স্কুল এন্ড কলেজের কে জি ওয়ানে ভর্তি করি। প্রথম
প্রথম সে কান্নাকাটি করত, স্কুলে যেতে চাইত না, তাই বেশ বুঝিয়ে শুনিয়ে মনমরা
অবস্থায় তাকে গেটের ভিতর ডুকিয়ে ফিরে আসতে হত। চার বছরের শিশুটাকে ঠেলেঠুলে ভিতরে
পাঠিয়ে দিয়ে মাতৃস্নেহে তার মা অনেকক্ষণ স্কুলের গেটে বসে থাকতেন। ইতিমধ্যে
জেফারের সমবয়সী ফুফুত ভাই সাদাত ভর্তি হলে দুইজনের মধ্যে বেশ সখ্যতা জমে উঠে। ডাঃ নুরজাহান
খুব ব্যস্ত হলেও সাদাতের আম্মার যথেষ্ট অবসর ছিল। তিনি সাদাতের সাথে জেফারকেও
মাতৃস্নেহে দেখাশুনা করতেন। অন্য শিশুদের সাথে জেফারের বন্ধুত্ব জমে গেলে একসময়
তার স্কুল ভীতি দূর হয়ে যায়।
সকালে আমি
কার চালিয়ে জেফারকে রেখে আসলেও দিনে আমার অফিস থাকায় তার মাকেই স্কুল হতে বাসায়
নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করতে হত। মায়েরা শিশুদেরকে গেটের ভিতর ডুকায়ে বাহিরে বসে
আড্ডা জমাতেন ও সন্থান স্নেহে বারবার ভিতরের পানে উঁকিঝুঁকি দিতেন।
আমরা দুইজন
খুব ব্যস্ত থাকায় মাসিক বেতনে একজন রিকশার ড্রাইভার রাখলাম, নাম আব্দুর রহিম। সকালে
কাজলশাহের বাসা হতে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার দূরে ব্লুবার্ড স্কুলে জেফারকে নিয়ে
যাওয়া আসা করবে। বেতন দিতাম মাত্রাতিরিক্ত, কারন লোকটার একহাত
পঙ্গু। অল্প পরিশ্রম করে পঙ্গু বেঁটে লোকটা যেন দিন গুজরান করতে পারে, তাই বেতন এত
বেশি। কিন্তু সমস্যা হল সে মাস আসার আগেই তার বেতন চেয়ে নিত
এবং পরে ডাঃ নুরজাহানের কাছে বারবার বড় অঙ্কের টাকা ঋন চাইত। তার চাহিদামত কর্জ
নাদিলে চেঁচামেচি হৈচৈ শুরু করত। তাকে দিয়ে এই ঋন উদ্ধারের আশাও শুন্য। কাজের মেয়ে
জরিকে চানাস্থা দেওয়ার আদেশ করত। সে আমাদের বাসায় প্রায়ই চানাস্থা ও খাবার খেত।
আমি ডানপায়ে
সামান্য ক্রুটি নিয়ে জন্মি এবং মহান আল্লাহর মেহেরবানিতে আলৌকিকভাবে সম্পুর্ণ
উদ্ধার পাই। তাই অক্ষম লোকজনকে আমি সব সময় খুব সহানুভূতির নজরে দেখে থাকি। কাজের
মেয়ে জরি দারুন বিরক্ত কারন বাসায় এসেই আব্দুর রহিম তার গায়ের ঘাম মুছতো জরির
টাওয়েলে। আমি বলতাম সব সয়ে যাও লোকটা যে অসহায়, সে পঙ্গুহাতে আয় রোজগার করে তার
সংসার চালাচ্ছে। ডাঃ নুরজাহান তাকে অনেক অনেক টাকা ধারদেন যা পরে আর খোঁজতেও লজ্জা
হত। আমরা তাকে যতই স্নেহ করি ততই লোকটার মানসিক অত্যাচার দিনকে দিন বাড়তেই থাকে।
আমার আব্বা সফিক চৌধুরী বলতেন, বাড়ে বন পোড়ে। অতীষ্ট হয়ে এই রিকশাচালকটাকে
শেষপর্যন্ত একদিন বিদায় দিলাম।
এবার খালাত
বোন রেবু আপার কাছ থেকে পৌরসভার প্লেটসহ একটি রিকশা ক্রয়করা হল। ভৈরবের কাছে বাড়ি
একজন চালক নিয়োগ করা হল। তার নাম আক্কেল আলী, সে জেফারকে স্কুলে আনা নেওয়া করত,
সেইসাথে ডাঃ নুরজাহানকে চেম্বার, ক্লিনিক ও ডায়াগনেষ্টিক সেন্টারে নিয়ে যেত। তিনি
নায্য পারিশ্রমিক তাকে সাথে সাথে পরিশোধ করে দিতেন। লোকটি ছিল ভাল, সে সিলেটে
একাকী থাকত ও আমাদের ড্রয়িংরোমে রাতে ঘুমাত। সে আমাদের ফুট ফরমায়েশ কাজ করে দিত।
কোন এক
রমজান মাসে আমি আক্কেল আলীকে নিয়ে বন্দরবাজারে মালামাল কিনতে যাই।
বাজার করে ফিরে এসে দেখি রোজাদার লোকটা কাঁদছে। কারণ
জিজ্ঞেস করলে সামনের জুতার দোকানের এক যুবককে দেখিয়ে বলল ওর নির্দেশমত দোকানের
সামনা থেকে রিকশা সরাতে একটু দেরী হওয়ায় তাকে বেশ কয়েকটি চপেটাঘাত মেরে বসে। আমি
রোজাদার লোকটাকে মারধর করার কৈফিয়ত তলব করলে জানোয়ারটা আমাকেও রাগ দেখায়। কিছু
লোকজন জমে যায়। আমি বিষয়টি আর না বাড়িয়ে বললাম, ধনী গরিব আল্লাহর সৃষ্টি, এত
অহঙ্কার করবেন না, আল্লাহতায়ালা অহঙ্কারীকে একদম পছন্দ করেন না। আল্লাহ চাইলে
আপনাকেও একদিন এই রকম একজন ছিন্নমুল রিকশাওয়ালা বানিয়ে শহরের রাস্থায় ঘুরতে বাধ্য
করতে পারেন, এটা তার জন্য কোন কঠিন কাজ নয়।
আক্কেল আলী
যেদিন একটু বেশী, মানে শত দেড়শত টাকা রোজগার করত, সেদিন টাকা হাতে নিয়ে বারবার
জুরে জুরে গুনত ও ঘরের সবাইকে বলে বলে আনন্দ প্রকাশ করত। লোকটার এত আনন্দ দেখে
আমার দারুন দুঃখবোধ হত, এই মানুষটা গায়ের ঘাম ঝরিয়ে এই সামান্য টাকা পেয়ে যে আনন্দ
করে আমরা লাখ টাকা আয় করেও এত আনন্দ পাইনা। তখন আমার মনে হত কোন কিছু লাভ করে
মানুষ যে আনন্দ পায় তার মাত্রাটাও জনে জনে ভিন্ন হয়। লোকটা তিন চার মাস আমাদের
সাথে কাটায়। সে তার রোজগারের টাকা ডাঃ নুরজাহানের কাছে গচ্ছিত রাখত। কোন এক বুরো
মৌসুমে সে তার সব অর্জিত অর্থ নিয়ে গ্রামে ধান কাটতে চলে যায় কিন্তু আর ফিরে
আসেনি।
এখন একজন
বস্তিবাসী চালককে আমরা রিকশাটি ভাড়া দিলাম এই শর্তে যে সে জেফারকে ব্লুবার্ড
স্কুলে আনা নেওয়া করবে ও প্রতিদিন সামান্য কিছু ভাড়া পরিশোধ করবে। লোকটা প্রথম
কয়েকদিন শর্ত মত কাজ করল, তারপরই যন্ত্রনা দিতে শুরু করল। দৈনন্দিন যে
নামকাওয়াস্তে ভাড়া আমাদেরকে দেওয়ার কথা তাতো দিতইনা, বরং এটা ওটা মেরামতের কথা বলে
উল্টো টাকা চেয়ে বসত। ভাড়াতো মিলতনা উল্টো জরিমানা গুনতে হত। গরিব মানুষ হিসাবে
আমরা লোকটাকে এতই ছাড় দিয়েছিলাম যে ভাড়া যাহা দেয় দিবে ছেলেটার স্কুলে যাওয়া আসার
কাজটা ঠিকমত চললেই হল। কিন্তু না এবার একদিন আসে তো একদিন
নেই। নিজস্ব রিকশা থাকা সত্বেও অন্য রিকশায় জেফারকে তার মা স্কুলে নিয়ে আসা যাওয়া
করে যান।
প্রতিরাতে
রিকশাটা এনে আমাদের বাসায় রাখার কথা, তাও আস্তে আস্তে সে বন্ধ করে দিল।
একবার পনের বিশ দিন ধরে আমাদের রিকশা ও চালকের কোন খবর নেই, সেইসাথে ভাড়া
পরিশোধেরও নামগন্ধ নেই। আমার মনে হল হয়ত সে রিকশাটা নিয়ে পালিয়েছে, নতুবা বিক্রি
করে ফেলেছে। শুক্রবারে বাগবাড়ি বস্তিতে গিয়ে রিকশা ও চালকের সন্ধান অনেক খোঁজে বের
করলাম।
আমি লোকটাকে
বললাম রিকশাটি এতদিন বাসায় নিয়ে রাখনি কেন? সে জবাব দিল, আমি আপনার গাড়ি কি চুরি
করে ফেলেছি। এতদিন যাওনি কেন? এবার জবাব দিল, অসুস্থ ছিলাম তাই যাইনি, যদিও লোকটা
পুরাপুরি সুস্থ্য সবল। এবার ভাড়ার কথা বললে
সে জবাব দিল, সুস্থ্য নই ভাড়া আবার কিসের, এতদিন আপনার রিকশা চালাইনি, তাছাড়া
গাড়িতে উঠে লাভতো হয়নি উল্টো হাজার টাকা আপনার গাড়ি মেরামতে গচ্চা দিয়েছি।
গরিবমানুষ
বলে এই লোকটাকে আমরা খুব স্নেহ করতাম, বাসায় আসলে সোফাসেটে বসতে দিতাম, এমনকি
চানাস্তাও করাতাম। সেইদিন মনে হল কেন এই শ্রেণীর সব মানুষকে আদর করতে নেই। এদেরকে
আদর করলে বাদরের মত কাধ চড়ে বসে। আমাকে সে চালিয়ে বাসায় নিয়ে আসার সময় আমি যাই
বলিনা কেন সে বেয়াদবের মত খুব তিতা তিতা জবাব দিতে থাকে।
আমার
উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। একটি রিকশা কিনে পরীক্ষা করে দেখি, যদি ভাল ফল আসে তবে আর কিছু
রিকশা কিনে গরিব লোকদেরকে সামান্য ভাড়ায় চালাতে দিয়ে সাহায্য করব। কিন্ত
ফলাফল পেলাম এতই যন্ত্রনাময় যে এখনই রিকশাটা বিক্রি করে দিলে
প্রানে বাঁচি। একমাসের পাওনা ভাড়া ও রিকশার নিচের হারিকেনটা আদায় না করেই এই
রিকশাচালককে সেদিন বিদায় দিলাম। তারপর দশ
হাজার টাকায় কেনা রিকশাটি মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়ে এই ব্যবসার ইতি
টানলাম।
আমার মনে হল এত
পেইনফুল রিকশা ভাড়ার ব্যবসা লোকেরা করে কি করে। পুবালী ব্যাংকের গাড়িচালক কামাল
বলত, স্যার একটা মাইক্রোবাস কিনেন। আমার ছোটভাই
ড্রাইভার সে চালাবে, প্রচুর টাকা ভাড়া আসবে। কিন্তু এই ছোট্ট রিকশা
ব্যবসার অভিজ্ঞতা পরে আমাকে গাড়ি কিনতে বাঁধা দিল ও গাড়ি ভাড়া প্রদান ব্যবসা করার
ইচ্ছাকে অবদমিত করেদিল। আমার শিক্ষা হল সব ব্যবসা সব ধরনের লোকের জন্য নয়। কাজেই
আমার দ্বারা কোন ব্যবসাটি হবে আগে তাই আমাকে খোঁজে নিতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন