আমার শুভ জন্মদিন, সেই জন্মতারিখ ও জন্মমুহুর্তের ইতিকথা
আমরা সবাই কোন না কোন এক তারিখে পৃথিবীতে আসি। সেই তারিখ কেউ কেউ জানি, কেউবা জানিনা। নাজানার দলই ভারী। জানিনা কারণ তা লিখে রাখা হতনা। সরকারও তখনকার দিনে জন্ম নিবন্ধন করতনা। জাতকের অনুসন্ধানে জন্মের বছর হয়ে যেত বড়বন্যার বছর, যুদ্ধের বছর কিংবা এরশাদের পতনের বছর, ইত্যাদি। মুসলিম জাতি জন্মতারিখ নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। গরীব দেশে জন্মবার্ষিকি পালনেরও তেমন রেওয়াজ নেই। তাই আমাদের যুগে জন্মতারিখ ছিল একটি গুরুতেহীন বিষয়।
আমরা ভাইবোন সবার জন্মতারিখ আব্বা একটি সুন্দর ডায়েরিতে লিখে রাখেন। অল্প বয়সে মাঝেমধ্যে ডায়েরিটি আমি নাড়াচাড়া করতাম। সেখানে আমার জন্ম তারিখটি কেবল বাংলাসনেই লিখা ছিলঃ ৯ই পৌষ ১৩৭২ বঙ্গাব্দ, রোজঃ বৃহস্পতিবার।
আমার মা
আসমতুন্নেছা বলতেন, আমার জন্ম হয়েছে ১লা রমজান,
রোজা মাসের সূচনালগ্নে, আকাশে রমজানের নতুন চাঁদ দেখার রাতে।
আমার ভাগনা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স
কম্পিউটার ইজ্ঞিনিয়ার মুফতি মোঃ তাসনিম হিমু গোগল সার্চ দিয়ে “৯ই
পৌষ ১৩৭২ বঙ্গাব্দ” তারিখের ইংরেজি ও হিজরি সনে কি
তারিখ ছিল তা বের করে। এটা ছিল আমার জন্য বহু প্রতিক্ষীত
এক জটিল ঐতিহাসিক সত্য ও তথ্য আবিস্কারের মত চিত্তাকর্ষক ও
আনন্দদায়ক ঘটনা।
ইংরেজি সনে
জন্মতারিখটি হলঃ ২৩ ডিসেম্বর ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ, রোজঃ
বৃহস্পতিবার।
হিজরি সনে জন্মতারিখটি ১লা
রমজান ১৩৮৫ হিজরি, কিন্তু রোজঃ শুক্রবার।
বাদসন্ধ্যায়
জন্মগ্রহণ আমার জন্মতারিখকে রমজান মাসে ও
সেইসাথে শুক্রবারে ঢুকিয়ে দেয়। কারণ কেবল হিজরি
সনের বার ও তারিখ সুর্যাস্তের পরপরই আরম্ভ
হয়।
তাই মা
আসমতুন্নেছা চৌধুরী প্রায়ই বলতেন আমার ছেলে খুব ভাগ্যবান হবে,
কারণ সে জন্মমাত্রই পবিত্র রমজান ধরেছে, সেইসাথে সাপ্তাহের
পুণ্যদিন শুক্রবারও। রোজার নতুন চাঁদ দেখে গাঁয়ের মানুষ যখন
রোজা রাখার ও তারাবির নামাজে যাবার প্রস্তুতি নেয়, তখনই আমার
জন্ম হয়।
শৈশব হতে দেখেছি
আমার গ্রামের মানুষ পাক্কা নামাজি ও রোজাদার। দুই এক জন দুষ্টলোক ছাড়া নিরানব্বই
জন মানুষই সহজ সরল ও ধর্মপ্রাণ ভদ্রলোক।
আমার
জন্মক্ষণটি হল বাদসন্ধ্যা অনুমানিক ৮/৯
ঘটিকা। ঋতুচক্রে সময়টা ছিল শীতকাল।
জন্মতারিখ
অনুসারে আমি মকর রাশির জাতক এবং আমার জন্মসংখ্যাঃ ৫ (পাঁচ)।
আমার এস এস সি সনদপত্রে ভুলবশতঃ জন্মতারিখ লিখা হয় ৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ। কারণ তখনকার দিনে অর্ন্তজাল প্রযুক্তি ছিল না, ফলে আব্বার ডায়েরিতে লিখিত বাংলা বঙ্গাব্দ তারিখ হতে ইংলিশ খ্রিষ্টাব্দ তারিখ বের করা বেশ কঠিন কাজ ছিল। সেকালে গ্রামের হাইস্কুলের সাধারণত ছাত্রছাত্রীদের জন্মতারিখ কোন মাবাবাই লিখে রাখতেন না। ফলে শিক্ষকগণ অভিভাবকদের পরামর্শে একটা অনুমানিক জন্মতারিখ বসিয়ে দিতেন। প্রায় ক্ষেত্রেই ছাত্রছাত্রীদের অনুমানিক জন্মতারিখ হত ৩১ ডিসেম্বর কিংবা ১লা জানুয়ারি।
একবার জাপানে অধ্যয়নের জন্য বৃত্তির আবেদন করে বাংলাদেশের অনেক ছাত্রছাত্রী। জাপান এম্বেসি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের জন্মতারিখ ৩১ ডিসেম্বর কিংবা ১লা জানুয়ারি। আমার বেলায়ও তাই ঘটল, এস এস সি সনদে আমার জন্মতারিখ হয়ে গেল ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৬। একজন ছাত্রকে জাপানি অফিসার প্রশ্ন করেন, তোমাদের দেশের সবাই কি কেবল এই দুটি তারিখেই জন্মগ্রহণ করে থাকে।
এমন কি আমার প্রকৃত জন্মতারিখ আমি হারিয়ে ফেলতাম, যদি না আব্বা সফিকুর রহমান চৌধুরী তাঁর ডায়েরিতে অন্ততঃ বাংলা বর্ষসনে জন্মতারিখ ৯ পৌষ ১৩৭২ বঙ্গাব্দ লিখে না রাখতেন এবং যদি মা আসমতুন্নেছা ১ম রমজান চাঁদ দেখার পর বাদসন্ধ্যায় জন্মক্ষণের বিষয়টি না বলতেন।
এই আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে আধুনিক
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বঙ্গাব্দ হতে খুব সহজেই হিজরি ও খ্রিষ্টাব্দে আমার
জন্মতারিখ পেয়ে যাই। মহান আল্লাহপাকের
প্রতি অজস্র শোকরিয়া তিনি আমার প্রকৃত জন্মক্ষণ এবং জন্মতারিখটি
সংরক্ষিত করে দেন।
মানব শিশুরা
মাতৃগর্বে সাধারণত নয় মাস
দশ দিন অবস্থান করে থাকেন। সেই হিসাবে
আমার মাতৃগর্ভে অস্তিত্বে আসার সময়কালটা
অনুমিত হচ্ছে জন্মের নয় মাস আগেকার মার্চ ১৯৬৫ সাল।
মহান আল্লাহ
রাব্বিল আলামিন এই শুভসময়ে তাঁর
অসীম দয়ামায়া ও অনুগ্রহে মহাশুন্য হতে সৃষ্টির সেরা জীব
আশরাফুল মাখলুকাত মানবরূপে আমাকে সতীসব্ধী,
বিদুষী, পীরানী একজন মহামানবী আসমতুন্নেসা চৌধুরীর ঔরসে অস্থিত্ব দান করেন।
মহান আল্লাহপাকের
প্রতি আমার আরও অশেষ অশেষ শোকরিয়া, ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের
২৩ ডিসেম্বর বাদসন্ধ্যা তিনি আমাকে
সুখশান্তি ও আনন্দময় এই দীর্ঘজীবন
উপহার দেন। পৃথিবী নামক এই ছোট্ট গ্রহের এক অনন্যসুন্দর মানব সভ্যতায় আমাকে স্থান করে দেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন