সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ভোলা ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল সফর

 

ভোলা ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল সফর

বদ্বীপ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রমত্তা নদী মেঘনা। চাঁদপুর হতে বঙ্গপোসাগর পর্যন্ত মেঘনা যেন কূলকিনারাহীন সাগর। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি মহানদী গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র এবং সিলেট-কুমিল্লা অঞ্চলের নদীসমুহের সম্মিলিত প্রবাহধারা মেঘনা। ধারণা করা হয় বাংলাদেশের নৌপথের অর্ধেক পানিই এই পথে বঙ্গপোসাগরে যায়। প্রতি বছর প্রায় পঞ্চাশ কোটি টন পলি এসে জমা হয় মেঘনার মোহনায়। এই পলি জন্ম দেয় অসংখ্য চর ও দ্বীপের। বাংলার উপকূলে এভাবেই শত শত বছরে বয়ে আসা পলি জমে জন্ম দিয়েছে আজকের ভোলা, হাতিয়া, মনপূরা, চরকুকড়িমুকড়ি, নিঝুম, ভাসানচর ইত্যাদি অপার সম্ভাবনাময় উর্বর দীপাঞ্চলের। স্বাধীনতার পর সরকার সাগরে নতুন ভূখণ্ড জাগাতে আশ্রয় নেয় বিজ্ঞান ও টেকনোলজির। দ্রুত দ্বীপ জাগানোর জন্য বাংলাদেশ বনবিভাগ এসব চরাঞ্চলে লাগিয়ে দেয় দেয় গাঢ় সবুজ ম্যানগ্রোভ বন। ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরা লবণনাক্ততা সহে হিজল গাছের মত জলে ডুবেও বেঁচে রয়। তাঁরা জোয়ারে জলে ডুবে তো ভাটায় ভেসে উঠে। গুচ্ছমূল দিয়ে আকড়ে ধরে পলিমাটি, জেগে উঠে নতুন নতুন দ্বীপ ও চরাঞ্চল।

বাংলাদেশের সর্ব্বৃহৎ দ্বীপ ভোলা এবং মেঘনার মোহনার দ্বীপ ও চরাঞ্চল দেখতেই আমাদের এবারের বরিশাল যাত্রা।

যীশু, আমি ও সৈয়দ ইয়াহিয়া সন্ধ্যায় মতিঝিল পূবালী ব্যাংক হেডঅফিসের বাহিরে এসেই তীব্র যানজটে পড়ি। বেবিট্যাক্সি নেই, রিকশায় সময় নষ্টের ঝুঁকি, যীশুকে বললাম, চলো হাঁটি, ওসবের আগেই হেঁটে হেঁটে আমরা গুলিস্থান পৌঁছে যাব। ওসমানী উদ্যানে গিয়েই যীশু বলল, স্যার আমরা ঘোড়ার গাড়িতে সদরঘাট যাব। অস্টাদশ শতাব্দির আগে ঘোড়ার গাড়িই ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে বিলাশবহুল যান, অভিজাত বাহন। ঘোড়ার গাড়িতে বসেই সৈয়দ ইয়াহিয়া সাহেবকে বললাম, আপনি আজ খুব ভাগ্যবান, আপনি এখন বাদশা হারুনুর রশিদ, নতুবা সম্রাট আকবর। এই কাস্টচাকার বাহন চড়েই তাঁরা বাদশাহী জীবন পার করে যান।

সৈয়দ মোঃ ইয়াহিয়া চট্টগ্রামের ধনী অভিজাত পরিবারের সন্থান, চট্টগ্রাম ছাড়া দুনিয়ার আর কোথায়ও পা রাখেননি, বিয়েসাদিও করেননি। বললেন, আর ভাগ্যটা বেশ ভাল যে আরে পূবালী ব্যাংক মৌলভীবাজার পাঠাইছিল। মৌলভীবাজার একখান দারুণ জায়গা, লোকজন ভাল, এই সুন্দর জিল্লা খুব উপভোগ কইচ্ছি। এখন ইয়াহিয়া সাহেব আছেন বাংলার রাজধানী ঢাকায়। একদিন আমাকে বললেন, আন্নি প্রায়ই এদিক সেদিক যান, বড় দুঃখের কথা খারে খই, নিজের মানুষ হয়েও আন্নি আরে ডাহেন নো। তাই এবার সিলেটি ভাষায় তাঁকে সজুরে ডাক দিলাম, চট্টগ্রামী ভাইসাব, জলদি আউক্কা। ডাক পেয়েই আমার চিরকুমার চাটগাইয়া বন্ধু সহকারী মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া সাড়া দিয়ে একপায়ে খাড়া, খোরেশী ভাই, আই ফস্তুত।                

৯ ডিসেম্বর ২০২১, রাত ৯টায় তিনতলা জাহাজ পারাবত-১১ চার-পাঁচ শত যাত্রী নিয়ে ঢাকা সদরঘাট হতে দুরন্ত বেগে বরিশালের উদ্দেশ্যে ছুটে যায়। তিতলার ছাদের ককপিটে বসা লুঙ্গিপরা খাস বাঙ্গালি নাবিক দল ভেপু বাজিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দৈতাকার জাহাজকে যখন টার্মিনাল থেকে সদম্ভে বুড়িগঙ্গার মাঝখানে নিয়ে আসেন তখন আমরা চারজন পূবালী ব্যাংকার সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশু, ফারুক আহমদ, সৈয়দ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া এবং আমি ককপিটের নাবিকদলের সামনে আকাশতলে পায়চারি করে তাঁদেরকে বিরক্ত করছি। আমরা দেখছি আলো ঝলমলে বুড়িগঙ্গাপারের অপরূপ ঢাকা, ওপারের শিল্পনগরী কেরানিগঞ্জ, পার হচ্ছি একটার পর একটা বুড়িগঙ্গা সেতু এবং চোখ ধাধানো অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। বিষ্মিত চোখে দেখছি জুরকদমে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে। আদেশ পেলাম দয়া করে সরে আসুন, সামনা দেখতে আমাদের আসুবিধে হচ্ছে।  

জাহাজের তিনতলায় ৩৪২ নম্বর কেবিনে ঢুকেই খাবার ও কমেট ট্যাবলেট খেয়ে দুই পালঙ্কে আমি ও ইয়াহিয়া সাহেব নিদ্রা যাই। জাহাজের মৃদু ঝাঁকুনি ও কাঁপুনি যেন “খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিবো কিসে” ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে নিমিষেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে বাহিরে বাথরুমে যাই। জাহাজের মেঝে দলে দলে মানুষ চাদরে চোখমুখ ঢেকে ঘুমাচ্ছে। কারো কারো নাক ডাকছে। জাহাজের কিনারে গিয়ে নদীতে চোখ মেলি। এখানে নদী যেন নদী নয়, সাগর। যতদূর দেখা যায় শুধু জল আর জল। দূরে দূরে জল ভেঙ্গে উজান ও ভাটিতে ধাবমান তিনচারতলা জাহাজের সারি। প্রতিটি জাহাজের বাতির আলো জলে টিকরে পড়ছে। এই কূলকিনারাহীন নদীতে এসে জাহাজের গতি বেড়ে যায়। খোলা সলিল ময়দানে প্রবল বেগে ছলাত ছলাত নাদে জলরাশি পশ্চাতে পালাচ্ছে, আর উথাল পাতাল ঢেউ তুলে জাহাজ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এত বড় জাহাজও এই বিশাল মেঘনার তুলনায় একটি ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকাই টাহর হচ্ছে।

সবে ভোরের আজান হয়েছে। নামাজ পড়ে বেরিয়েই দেখি বরিশাল নদীঘাটে বরিশাল শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক জনাব আরিফ রাব্বানী হাসিমুখে আমাদের অপেক্ষায়। আমাদের সাথে শরিক হন বরিশাল শাখার ইসলামী উইন্ডো প্রধান মোঃ এনায়েতুল্লাহ। এই নদীবন্দরের আরেক প্রান্তে স্পিডবোট ঘাট।

একদ্বীপেই একজেলা, তাঁর নাম ভোলা। আমরা ছয় জন ভোলার স্পিডবোট ঘাটে যাই। ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা। স্পিডবোটের একজন চালক ও একজন সাহকারী। পাশে কয়েকটি লাইফ জ্যাকেট রাখা। চালক আর দুইজন যাত্রী উঠাতে চাইলে আমরা বললাম, লাগবেনা আমরা আটজনের ভাড়া ১২০০ টাকাই দেবো। পাঁচছয়টি সুরমার সমপ্রশস্ত নদী কির্তনখোলার বিশাল জলরাশি দিয়ে সাই সাই করে স্পিডবোট ছুটে চলল ভোলা দ্বীপে। কির্তনখোলা হতে স্পিডবোট একটি ছোট জলভরা নদী কালাবদরে প্রবেশ করে। ভোরের কালাবদর নদী, সূর্য উদয় হয়নি, জলের উপর ধূয়ার মত হালকা কুয়াশা উড়ছে। দুইপারের উপরিতল ছুঁয়ে আছে ভরানদীর জল। সিলেটের বর্ষার নদীর মত জলে টইটুম্বুর হয়ে আছে বরিশালের শেষ হেমন্তের নদী কালাবদর। নদীর কিনারায় অপরূপ কাশফুলের বন। সাদা, খয়েরি এবং হালকা বেগুনি কাশফুলের ছড়াছড়ি। কালাবদরের জলে পা ডুবিয়ে মাথা উচিয়ে আছে কেওড়া ও হুগলা বন। হাটুজলে একপায়ে দাঁড়িয়ে বকেরা ভোরের তপস্যায়। সাঁতার কাটছে দেশী হাঁস ও পরিযায়ী বুনো হাঁসের ঝাঁক। নদীর জলতলের দুই ফুট উপরে সমতল ধানক্ষেত হলুদে হাস্যমান। জলের কাছাকাছি সুশ্যামল পল্লীগ্রাম। নদীজলে কৃষাণ কৃষাণীর আনাগুণা, বনবনানী, জীবনের জলছবি। সূর্য মুখ মেলতেই জলে পড়ে দুপারের সবুজের প্রতিবিম্ব। বরিশালের এই অপরূপ নৈসর্গিক সুন্দরই কবি জীবনানন্দ দাস অবিকল এঁকে দিয়েছেন ‘রূপসী বাংলার’ কবিতায়। বরিশাল হয়ে গেছে রূপসী বাংলার মুখ, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাইনা আর’।

ছোটনদী কালাবদর হতে বের হয়ে আমরা ভোলা চ্যানেলে আসি। এই চ্যানেল ভোলাকে বাংলাদেশ হতে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এই চ্যানেলের নাম তেতুলিয়া নদী। সাত আট মাইল প্রশস্ত তেতুলিয়া নদী যেন আমাদের বর্ষার হাকালুকি হাওর। পূর্বাকাশে ভোরের হিমেল হাওয়ায় শীতল সূর্য জ্বলছে। সূর্যের প্রতিবিম্ব ঢেউয়ে খেলা করছে। দূরে দূরে কয়েকটি চলমান ফেরি কচ্ছপ গতিতে অনেকগুলো বাস, ট্রাক, গাড়ি নিয়ে ভোলাদ্বীপে আসা যাওয়া করছে। আশপাশে নৌকা চলছে, মাঝিরা মাছ ধরছে। মেঘনার মোহনার এই জলাভূমি ইলিশের স্বর্গরাজ্য। দূরে দূরে হিজিবিজি জনপদ দেখা যাচ্ছে। সামনে ভোরের ছায়ায় ভেসে উঠে একটি নদীঘাট, চারপাশে নোঙ্গর করা লঞ্চ, নৌকা ও স্পিডবোট। এটি ভোলা শহরের কাছের নদীবন্দর, ভেদুরাঘাট। বরিশাল হতে স্পিডবোটে একঘন্টায় আমরা ভোলার ভেদুরাঘাটে এলাম। নিকটে ইলিশের নিলাম-হাট, চারপাশে সুপারি ও নারকেল গাছের ছড়াছড়ি।  

সাতটি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভা নিয়ে ঘটিত ভোলা জেলার আয়তন ১৩১৫ বর্গমাইল। এই আয়তনের মধ্যে আছে কিছু চরাঞ্চল ও মনপূরা দ্বীপ। এই জেলায় রাজত্ব করেন সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ সহ চারজন দাপুটে সাংসদ। পূবালী ব্যাংক ভোলা শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ শাফায়েত হোসেন অসুস্থ, তিনি মাইক্রোবাস পাঠান ভেদুরাঘাটে। চালক আব্দুল আজিজ আমাদেরকে ভোলা শহর খানিক দেখিয়ে চরফ্যাশন নিয়ে যান। সিমসাম সুন্দর পৌরসভা চরফ্যাশন। চরফ্যাশন একটি জমজমাট উপজেলা শহর। এখানকার রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন প্রভাবশালী জ্যাকব পরিবার। গাড়ি হতে নেমেই চরফ্যাশন শাখার ব্যবস্থাপক রেজাউল করিমকে পেয়ে যাই। তিনি আমাদেরকে জ্যাকব টাওয়ারে নিয়ে যান। এই টাওয়ারটি নির্মাণ করেছেন চরফ্যাশনের বর্তমান এম পি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। আমরা ১০০ টাকার ৮টি টিকেট কেটে লিফটে টাওয়ারের চূড়ায় যাই। টাওয়ারের মাথায় নিলচে গ্লাসের একটি বৃত্তাকার হোটেল। ফ্লাওয়ার বক্সে সাজানো এই হোটেল। আমি দেড়-দুই হাজার ফুট উচ্চতার দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফা, মালয়েশিয়ার কে এল টাওয়ার এবং টরেন্টোর সি এন টাওয়ারে আরোহন করেছি। জ্যাকব টাওয়ার ওসবের ধারে কাছে না হলেও এটিই সম্ভবতঃ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ টাওয়ার। রাজধানী ঢাকায়ও এমন উচ্চতার কোন ভবন আছে কিনা সন্দেহ। টাওয়ার হতে দেখা যায় ভোলার অফুরন্ত চিরসবুজ দূর-দূরাঞ্চল।

জ্যাকব টাওয়ার পুরোটাই স্টিল ও গ্লাসে নির্মিত। এই টাওয়ার উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। লোকজন বলল এই টাওয়ারটি বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণ না করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি সংসদে উষ্মা প্রকাশ করেন। আওয়ামী সাংসদ আব্দুল্লাহ আল ইসলাম তাই জ্যাকব টাওয়ারের সামনে শেখ রাসেল উদ্যান নির্মাণ করেন। জ্যাকব টাওয়ারের সামনে একটি বড় পুকুর, পুকুরের চারপাশে সুপ্রশস্ত টালির চত্বর, দুইদিকে ব্যবসাকেন্দ্র, অন্য দুইদিকে জ্যাকব টাওয়ার ও রাসেল উদ্যান। শেখ রাসেল উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা এবং শেখ রাসেলের ম্যুরাল শোভা পাচ্ছে।

গাড়ি আমাদেকে ভোলার পূর্ব উপকূলের একটি নদীঘাটে নিয়ে যায়। এখান থেকে স্পিডবোটে মেঘনায় ঢেউভেঙ্গে ১৫/২০ মিনিটে আমরা মনপূরা ঘাটে এসে যাই। মনপূরার নৌঘাট অনন্য। একটি লম্বা সেতু মাঝসাগরে চলে গেছে। এই সেতুর শেষপ্রান্তে সিঁড়ি নেমে গেছে সাগরে। আমরা সন্ধ্যার আঁধারে সিড়ি বেয়ে সেতুঘাটে আসি। এই সেতুতে বসে মনপূরার জনগণ পূর্ণিমার রাতে সাগরের ঠান্ডা হাওয়া খান। সেতুর নিচ দিয়ে বইছে সলাত সলাত করে মেঘনার জল। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী এইচ এম এরশাদের জন্মস্থান স্বর্ণদ্বীপ মনপূরা। যীশু ও আরিফ রাব্বানীর মত তিনিও একজন সাস্টিয়ান। সাস্টিয়ান হবার সুবাদে এরশাদ আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। আমাদের জন্য তিনি মনপূরা সরকারি ডাকবাংলো বরাদ্ধ করে দেন। মনপূরা দ্বীপে পা রাখামাত্রই এইচ এম এরশাদের ঘনিষ্ঠ তিনচার জন তরুণ মোটরসাইকেল চালিয়ে এসে আমাদেরকে নৌবন্দরে বরণ করে ডাকবাংলোয় নিয়ে যান। তাঁরা মনপূরা কলেজের ইংরেজির লেকচারার মাকদুদুর রহমান ও ফরিদ উদ্দিন। আরেকজন জসিম উদ্দিন, যিনি সর্বক্ষণ আমাদেরকে সঙ্গ দেন। বেশ বুদ্ধিমান জসিমউদ্দিন জানালেন তিনি ঠিকাদারী করেন ও মনপূরার উপজেলা চেয়ারম্যান হবার আশা রাখেন। নেমেই টাহর পেলাম এই দ্বীপে এরশাদ সাহেবের বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি। তিনি এই দ্বীপের একজন উচ্চশিক্ষিত গণ্যমান্য ব্যাক্তি। অনুপস্থিত থেকেও টেলিফোনে তিনি আমাদের খোঁজখবর নেন এবং দ্বীপাঞ্চলে আনন্দবিহারের সব ব্যবস্থা করে দেন। এইচ এম এরশাদ তাঁর অপরূপ সুন্দর জন্মভূমি মনপূরায় একটি পর্যটন রিসোর্ট করার ভাবনায় আছেন।

ভোলার দক্ষিণের সুন্দর পর্যটন দ্বীপ মনপূরা। ৩৭৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই মনপূরা দ্বীপ ভোলা জেলার একটি উপজেলা। সাগর মোহনার এই দ্বীপের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মেঘনার অথৈ জলরাশি বহমান ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। মনপূরার পূর্বসাগর পারি দিলেই নোয়াখালির হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ। পশ্চিমের জলাভূমি পার হলেই ওপারে ভোলা, যেখান থেকে আমরা এখানে এসেছি।

একটি সরকারি জেনারেটর সন্ধ্যা হতে রাত ১টা পর্যন্ত মনপূরা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। সেই সাথে আছে সৌরবিদ্যুৎ। মনপূরা সরকারি ডাকবাংলো একটি তিনতলা আধুনিক ভবন। ডাকবাংলোর সুপ্রশস্ত কক্ষগুলো উন্নত বাথ ও আসবাব সজ্জিত। পাশে আছে বাসার মত আরেকটি একতলা ঘর।

রাতে মনপূরা বাজারে খেতে যাই। হোটেলে ইলিশ, কোরাল, মোরগ, গরুমাংশ সব আইটেম আছে। ইলিশের পিছ ছোট হওয়ায় আমি কোরালের অর্ডার দেই। আমার দেখাদেখি সবাই কোরাল মাছে ঝাঁপ দেন। অনেক পর্যটক আসেন, তাই হোটেলের রান্নার মান বেশ ভাল।

ভোরের আজান শুনামাত্র ইয়াহিয়া সাহেব নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে যান। আমি ফজরের নামাজ পড়তেই যীশু ও আরিফ রাব্বানী এসে মর্নিংওয়াকের আমন্ত্রণ জানান। ভোরের হিমেল হাওয়ায় তিনজন হাঁটছি, সেইসাথে ছবি তুলছি। বড় বড় তিনটি দিঘির পারে পারে মনপুরা শহর। সরকারি স্কুল, কলেজ, মহিলা কলেজ, অফিস সবই কোন না কোন দিঘিপারে। মনপূরা শহরের রাস্থাগুলো ঢালাই কংক্রিটে নির্মিত ও সুপ্রশস্ত। এই দ্বীপাঞ্চলে দিঘি খনন খুবই সহজ, দুই তিন ফুট মাটি কেটে চারপাশে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করে দিলেই একটা বড় দিঘি হয়ে গেল। এসব দিঘি এত বড় যে এক একটি দিঘিতে মৎস্য চাষ করে অনেক অনেক বেকারের সদগতি হয়ে যাবে অনায়াসে। জসিম উদ্দিন বললেন এই জনপদ, এমন কি আমাদের ডাকবাংলোও এক সময় মেঘনা নদীর মধ্যে ছিল। অনেক অনেক বছরে পলি জমে জমে এই শহরের অবকাঠামো গড়ে উঠে।

মনপূরা দ্বীপের বাহন বিশেষ এক ধরনের কেদারাকার যান্ত্রিক ত্রিচক্রযান ও মোটর সাইকেল। কোন বাস, কার, ট্যাক্সি দেখিনি। খুবসম্ভব এই দ্বীপে কোন গাড়ি নেই। দ্বীপের সবগুলো জনপদের কাছাকাছি সমুদ্র, সম্ভবত একারণে চারপাশের জলপথ দিয়েই স্পিডবোট ও নৌযানে এই ছোট্ট দ্বীপের পরিবহন চাহিদা মিঠে যায়।

এইচ এম এরশাদের আদেশে কয়েকজন যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির। তাঁরা আমাদেরকে নিয়ে মনপূরা দ্বীপের সুন্দর সুন্দর স্পট দেখাবেন। এই স্বর্ণদ্বীপ মনপূরা তাঁদের জন্মভূমি, আমরা তাঁদের দ্বীপের সম্মানিত মেহমান।

আমরা ডাকবাংলোর সামনে আসতেই একজন অশীতিপর বৃদ্ধ পাশের বাংলোঘর হতে বের হন। আমরা কোথাকার লোক জেনে নিয়ে বললেন, আমি কামাল উদ্দিন চৌধুরী, এক সময় মনপূরার উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম। আমরা তাঁর বয়স জানতে চাইলে বললেন, জন্ম ১৯২৯ সালে এই দ্বীপে, আমরা এই দ্বীপের জমিদার ছিলাম। গণনা করে দেখালাম তাঁর বয়স ৯২ বছর। মনে পড়ে গেল আমার পিতা সফিকুর রহমান চৌধুরী এই বয়সে পরলোকগমন করেছিলেন। লম্বা কৃশকায় বৃদ্ধার স্বাস্থ্য বয়সের তুলনায় বেশ ভাল। মনপূরার বিশুদ্ধ আলো বাতাস হয়ত তাঁকে আল্লাহপাকের কৃপায় সুস্থ্য শরীরে এই দীর্ঘজীবন দান করেছে।

মনপূরার জমিদার কামাল উদ্দিন এবার বললেন, আমার পূর্বপুরুষরা বাংলার সুবাদার শাহ সুজার সভাসদ ছিলেন। ১৮৩৩ সালে তাঁর পূর্বপুরুষরা বৃটিশদের কাছ থেকে এই দ্বীপ ইজারা নিয়ে এখানে আসেন। বললেন এই দ্বীপে বংশ পরাম্পর তাঁদের কয়েক পুরুষের জমিদারী ১৯৫০ সালে শের ই বাংলার প্রজাসত্ব আইন পাশের পর বিলুপ্ত হয়। আমি জানালাম সিলেটে আমাদের জমিদারীও ১৯৫৫ সালে পরিসমাপ্ত হয়। আমাদের অভ্যর্থনাকারীরাও দেখি এই মুরব্বির সামনে মাথা নত করেন। জসিম উদ্দিন বললেন, তিনি আমাদের জমিদার, তাঁর আত্মীয়রা সবাই বড়লোক ও রাষ্ট্রের বড় বড় পদে আছেন। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোশাররফ হোসেন তাঁর ভাগনা।

কামাল উদ্দিন চৌধুরীকে তাঁর লোকেরা সামনের একটি ত্রিচক্রযানে নিয়ে যায়। তিনি প্রস্থান হলেই এবার সবাই মুখ খুলল, বৃদ্ধ কামাল উদ্দিন একজন ভয়ংকর প্রকৃতির লোক, তিনি শত শত একর জমির মালিক। থাকেন সরকারি ডাকবাংলায়, যেন নিজের বাবার ভিটে। প্রভাবশালী হওয়ায়, পুলিশের ওসি, ইউএনও, ডিসি সবাই তাঁকে ভয় পায় ও খাতির করে। আগের জামানায় কামাল চৌধুরীরাই ছিলেন মনপূরা দ্বীপের একছত্র অধিপতি। যাক আমাদের সৌভাগ্য মনপুরার প্রাচীন রাজবংশের শেষ রাজাকে পেয়ে গেলাম। যীশু বলল এই বুড়া জমিদারের চোখ থেকে আগুন টিকরে বের হচ্ছে, মনে হয় যৌবনে তিনি অনেক খুনখারাবি করেছেন।

জমিদার কামাল উদ্দিন চৌধুরীর বিদায়ের পর আমরা প্রত্যেকে এক একটা মোটরসাইকেলের চালকের পিছনে বসি। দ্বীপের রাস্থা আরসিসি ঢালাই করা। দুইদিকে পাকা হলুদ ধানক্ষেত, ঘরবাড়ি, জলভরা পুকুর ও রবিশস্যের মেলা। পুকুরে হাঁসের ঝাঁক। বাংলার এক নিভৃত পল্লীদ্বীপ মনপূরা। এই ছোট্ট দ্বীপে নদীও আছে। এই নদীর সুদীর্ঘ্য সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নদীপারের জাহাজ নির্মাণ কারখানা দেখি। দ্বীপের কারিগরেরা দেশীয় প্রযুক্তিতে কাটের জাহাজ ও নৌকা এখানে তৈরি ও মেরামত করেন। জুতা আকৃতির নৌযানগুলোর সামনা খাড়া, পিছন কাটা। দ্বীপের নদী এখন শুকনো, জোয়ার এলে জলে ভরে যায়, মেরামতের পর জাহাজ তখন জোয়ারের জলে সাঁতর কেটে সাগরে চলে যায়।

মনপূরা দ্বীপের দক্ষিণে বঙ্গপোসাগর। একটি পাকা সিবিচের গেটে লিখা ‘দখিনা হাওয়া সিবিচ’। দক্ষিণ সাগরপারে মনপূরা দ্বীপের এক অপরূপ সুন্দর সিবিচ ‘দখিনা হাওয়া’। এই গেট দিয়ে সোজা সৈকতের বেলাভূমিতে চলে যাই। মাদার বৃক্ষে ছাওয়া সৈকতের পা  সাগরের উর্মিমালা ধূয়ে দিচ্ছে, কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে। লোকজন  বলল লঘুচাপ ‘জওয়াদ’ পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে। জওয়াদের প্রভাবে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। খানিক বৃষ্টির ফোটা নামছে। আমরা দ্রুত দখিনা হাওয়া সৈকতের কাছের বাজারে এসে গেলাম।

এইচ এম এরশাদ মেঘনার মোহনার নানা চর, পর্যটন স্পট ও নিঝুম দ্বীপ দেখানোর জন্য একটি স্পিডবোট বরাদ্ধ করেছেন। ইলশেগুঁড়ি থেমে গেল। চালকরা মেঝবানদেরে নিয়ে যান মনপূরার পূর্বপ্রান্তে মেঘনা উপকূলের একটি পর্যটন নৌঘাটে। সৈকত পাকা, নদীপারে হাওয়া খানা, পরিপাঠি বৈঠকখানা, দূর সাগর দিগন্তে দ্বীপের মত সবুজ প্রান্তর। জায়গাটি মনপূরার একটি নিসর্গ। সাগর-নদী-স্থল, সবুজ ও নীলে এখানে রঙিলা মেঘনার মোহনা। এই নির্জন বিশুদ্ধ আলো-বাতাস-পানি এখানকার জমিদার কামাল চৌধুরীদের এত দীর্ঘজীবী করে দেয়। এই দ্বীপ ছেড়ে তাঁরা তাই দুনিয়ার অন্য কোথাও যেতে চাননা।

আমাদের নির্ধারিত স্পিডবোট এলোনা। আমরা এরশাদ সাহেবকে ফোন করলে আরেকটি বোট আসে। চালক আনাড়ি। সে দ্বায়ছাড়া গোছের লোক। মেঘনার এপার বরিশাল ওপার নোয়াখালী। আমরা এবার বরিশাল হতে চলে যাব নোয়াখালী। স্পীডবোট মোহনার চর কুকড়িমুকড়ির এক অপার্তিব সুন্দর দীপাঞ্চলে প্রবেশ করে। ম্যানগ্রোভ বৃক্ষলতা সুশোভিত এই চরাঞ্চল যেন একদম সুন্দরবন, আবার কিছুটা সিলেটের রাতারগোলের সোয়াম্প ফরেস্ট। চরসমূহের মাঝখান দিয়ে জলভরা আঁকাবাঁকা ছোটনদী বইছে। বনবৃক্ষরা সিলেটের হিজলতরু নয়। উঁচু উঁচু গাছ অনেক উপরে মাথা তুলে গাঢ় সবুজ রঙ মেখে আছে। নীল সমুদ্রের জলে হাস্যমান এই অরণ্যের সৌন্দর্য্য বর্ণনাতীত কিন্তু বনানীর শিকড় জলসিক্ত কিংবা কর্দমাক্ত। তাই ইচ্ছে হলেই এসব সুন্দর বনচরে নামা যায় না। কিছু বক, মরাল, সরালি হাঁটছে। গাংচিল উড়ছে। আকাশের মেঘে ও রোদে লোকাচুরি খেলছে।

মেঘনার ঢেউভেঙ্গে সাগর পেরিয়ে আমাদের স্পিডবোট একটি সুন্দর উপকূলে আসে। আমরা একে একে সবাই সেই সৈকতে নামি। একটি রাস্থা এসে এখানে সাগরপারে শেষ। রাস্থার দুপাশ পল্লবঘন বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত। রাস্থার দুইদিক দিয়ে দুইটি খাল এসে সাগরে মিশেছে। হুররে, জায়গাটা ভারি সুন্দর, ভারি চমৎকার।

রাস্থায় জনকয়েক পর্যটক হাঁটাহাঁটি করছে। তাঁরা বলল এই জায়গাটি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া দ্বীপের বেড়িবাঁধ। সুউচ্চ রাস্থা হতে স্পিডবোটে ফিরে আসছি সবাই। এমন শুভ সময়ে ঘটে গেল এক হরষে বিষাদ। উঁচু সড়ক হতে কর্দমাক্ত খাদ বেয়ে স্পিডবোটে নামার সময় আমাদের রসিক সাথী ফারুক আহমদ উঁচু স্থান হতে পা পিছলে  গোলাকার বলের মত কাদাজলে গড়িয়ে পড়লেন।

তাকে এতই করুন দেখাল যে আপাদমস্তক পলিকাদায় লেপ্টে একেবারে কিম্ভুতকিমাকার। তাঁর চোখ-মুখ কিছুই কাদার প্রলেপ হতে রেহাই পায়নি। কাদামাখা ফারুক আহমদকে চেনাই দ্বায়। আহারে, স্যুটেড-বুটেড মানুষটা কি ছিল আর এখন কি বেহাল হল।

বিনামেঘে বজ্রপাতের মত আচমকা আছাড় খাবার লজ্জায় গাত্রব্যথার আলামত তিনি সযতনে গোপন করলেন। তবে আমরা তাঁর ব্যথার কষ্ট মনে মনে বেশ অনুভব করলাম। সৈকতের কোমর জলে গোসল করলেন, নতুন জামা পরলেন। যাক এবার তাঁকে চেনা গেল, তিনি সেই বেঁটে কৃশকায় ভ্রমণসাথি ফারুক আহমদ। আমরা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম।

কাদামাখা ফারুক সাহেবের এই নাজেহাল অবস্থা দেখে আমরা একরাশ দুঃখ পেলাম সত্য, তবে মনের গহিনে একটা লোকানো হাসিও অপ্রকাশ্যে উঁকিবুকি মারছিল।  

যাক, ফারুক সাহেব এই শনির দশা হতে বের হয়েই আনন্দবিহারের মাঝে হঠাৎ আপতিত গোমরা ভাবটা তাড়াতে কসুর করলেন না। একটা রসালো গল্প বলে ভ্রমণানন্দ আবার জাগিয়ে দিলেন। মুছে দিলেন ব্যাদনার রেশ।

গল্পটা ফাটাবাঁশের চিপায় পড়া একজন অসহায় ইমাম সাবেবের। মৌলানা আব্দুল গফুর মোবারকপুরী ঢাকার অভিজাত এলাকার তাকওয়া মসজিদ কমিটির সামনে সুললিত কন্ঠে কেরাত তেলাওত করে ইন্টারভিউ দিয়ে বেশ কঠিন প্রতিযোগিতা পার হয়ে বড় বেতনে ইমামতির চাকুরী পান। শর্ত, প্রতি শুক্রবারে তাঁকে মসজিদে খুতবা পড়ায় আগে ওয়াজ করতে হবে

তাকওয়া মসজিদে নতুন ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরী যোগদান করলেন। ইমাম হুজুরের কাছে খবর আসে এখানকার বলোকেরা খুব বেশি সূরাপায়ী হুজুর ভাবলেন সুরাপান মহাপাপ। এই নাজায়েজ কাজ হতে মহল্লাবাসীকে উদ্ধার করা দরকার। শুক্রবারে ইমাম হুজুর খুতবায় বললেন, মদ্যপান হারাম, তিনি কোরআন হাদিসের আলোকে খুৎবায় দেখিয়ে দেন যারা মদ্যপান করে তাঁরা দোযখের আগুনে পুড়ে ছারখার হবে।

ইমাম সাহেব নজির পেশ করেন, মদ্যপানের শাস্তি হতে খলিফা উমর ফারুক(রাঃ) নিজপুত্র আবু শামাকেও রেহাই দেননি। মদ্যপানের শাস্তি আশিটি বেত্রাঘাত। ন্যায়পরায়ণ খলিফা উমর ফারুক(রাঃ) রায় দেন, আবুশামা খলিফার পুত্র, তাই তাঁর শাস্তি দ্বিগুণ, অর্থাৎ একশত ষাটটি দুররা। খলিফা উমর ফারুকের(রাঃ) নির্দেশে জল্লাদ ১৬০ বার দুররা মেরে খলিফার চোখের সামনে তাঁর রুগ্নপুত্র আবুশামাকে পিটিয়ে হত্যা করে।

পুত্র আবুশ্যামা প্রাণবাঁচানোর জন্য পিতার পায়ে লোটে আকুল আবেদন জানায় কিন্তু পিতা ওমর ফারুককে(রঃ) পাথরকঠিন হৃদয় একটুও টলেনি। মদখোর রুগ্নসন্থানকে পিঠিয়ে হত্যা এক অমানবিক নিষ্ঠুরতা। তবে তাবৎ জনতা খলিফাকে তার ন্যায়পরায়ণতা ও কঠোরতার জন্য বাহবা দিল।

ইমাম মোবারকপুরী উপযুক্ত বিষয়ে বয়ান করে খুব খুশি, প্রথম ওয়াজেই বাজিমাত। নামাজ শেষ হবার পরই ইমাম হুজুরকে তলব করলেন মোতাওয়াল্লি, ইমাম ভাবলেন সুন্দর বায়ানের জন্য নিশ্চয় বাহবা দিতে তাঁকে ডাকা হয়েছে। কিন্তু ইমাম অবাক হলেন যখন মোতাওয়াল্লি থ্রেট দেন, হুজুর আপনি পয়লা দিনই বয়ানে বেয়াদবির চুড়ান্ত করে ছাড়লেন। আমি আপনার চাকুরীদাতা, আর আপনার এত্তবড় সাহস,  আপনি কিনা আমার চোখে চোখ রেখে আমার মদ্যপান নিয়ে লম্বা লম্বা কথা বললেন।

শঙ্কিত ইমাম আব্দুল গফুর চাকুরী বাঁচাতে বললেন, মুহতারাম, আপনি মদপান করেন তা আমার জানা ছিলনা, আমাকে দয়া করে মাফ করে দিন। আমি মদ্যপান নিয়ে আর কখনও কোন বয়ান করবনা।

মোতাওয়াল্লি বললেন আপনি নতুন তাই ভূল করেছেন, এজন্য মাফ করা হলো, তবে সাবধান।

হুজরায় বসে লোকের কাছে নতুন ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরী জানতে চাইলেন, এই অভিজাত পাড়ায় এত এত সুন্দর সুন্দর আলিশান বাসা-বাড়ি-গাড়ি, এখানকার লোকেরা এতটাকা পায় কোথায়? বোকা মুসল্লিরা বলল টাকা দেন আল্লায়, তাই তাঁরা এত টাকা পায়। তবে সরলের দল চলে গেলে চালাকেরা ইমামকে কানে কানে বলল, হুজুর এসব গাড়ি-বাড়ি আল্লাহ দেন নি, হয়েছে ঘুষের টাকায়।

তাঁরা জানালো এপাড়ায় ভূমির দাম এত বেশি যে, ঘুষখোর ছাড়া কেউ এখানে বাসা কিনতে পারেনা।

ইমাম হুজুর ভাবলেন এই শুক্রবারে তাহলে ঘুষ নিয়ে ওয়াজ ফরমাবেন।

ইমাম খুতবায় বুখারী শরিফের হাদিস পেশ করেন, ঘুষদাতা ও ঘুষখোর উভয়েই দোযখের আগুনে জ্বলবে। শুনালেন, মহানবী(সঃ) তাঁর নিযুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরে কোনধরনের ঘুষ কিংবা উপহার গ্রহণ করতে নিষেধ করে দেন।

ঈমাম সাহেব সুন্দর ওয়াজ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন।

নামাজ শেষে মুসল্লিরা বেরিয়ে গেলেই মসজিদের সেক্রেটারি তাঁকে তলব করলেন। হুজুর আপনি আজ বয়ানে আমাকে অপদস্ত করে ছাড়লেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে ঘুষ নিয়ে এত গলাবাজি করলেন। জানেন, আমি চাইলে আপনার বেতন আটকে দিতে পারি।

সাবধান ঘুষ নিয়ে আর কখনও টু শব্দটি করবেন না বলে দিচ্ছি।

ইমাম সাহেব দেখলেন পহেলা মাসের বেতনই আটকে যাচ্ছে।

তাই ঠেলায় পড়ে বললেন, জী আচ্চা।

ইমাম সাহেব তাঁর ওয়াজের তালিকা হতে মদ ও ঘুষ বাদ দিলেন।

শহরের বড় লেকপার্কের একপ্রান্তে এই মসজিদুল তাকওয়া। ইমাম দেখেন এখানে ওখানে নরনারীরা বেপর্দা বসে আড্ডা দেয়। হাইস্কুলের ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই স্কুলড্রেসপরা সদ্য হালকা গোঁফগজানো কিশোর কিশোরীরা প্রেমালাপে নিমগ্ন হয়। তরুণ তরুণীরা পরস্পর গা ছোঁয়াছোয়ি করে ঘণ্টার পর ঘন্টা নিরালায় বটতলে বসে গুনাহে জ্বিনা করে যায় অবলীলায়। পাশদিয়ে ভদ্রলোকেরা অনেকেই আসে-যায় কিন্তু কেউ দেখেও দেখেনা, বাঁধাও দেয়না।

ইমাম সাহেবের পাড়াগায়ে মাইয়াগো এসব বেলাজ কাজ কারবারে নেই। হায়রে শহর, এখানে জিনা আর জিনা, এসব দেখার কিংবা আটকাবার মত লোকজন কেউ নেই।

ইমাম সাহেব ভাবলেন, এবার বেহায়া বেপর্দা বেগানা আওরত নিয়ে ওয়াজ করবেন।

এই আখেরি জামানার নারীদের বেলেল্লাপনা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। জিন্সের প্যান্ট-সার্ট পরিহিত নরনারীর চোখের জিনা, ছোঁয়ার জিনা, পোষাক ও সাজসজ্জার জিনা নিয়ে বলবেন।  

মুসল্লিরা স্ত্রীজাত বিষয়ক ওয়াজ শুনতে খুব মজা পান, হুজুরকে বাহবা দেন।

ইমাম সাহেবের পল্লীগ্রামে আওরাতরা ধরাধরি করেনা, জড়াজড়ি করেনা, এতসব পাপাচার মোবারকপুরে নেই।

গ্রামবাংলার মাইয়ারা বড় নিরীহ প্রাণী, তাঁরা লজ্জাবতীর লতা অথচ গ্রামের ওয়াজি হুজুররা ইচ্ছেমত সেই অবলাদেরে তুলোধুনো করে নিজেরা আনন্দ পান, মুসল্লিদেরেও আনন্দ দেন।

ইমাম মোবারকপুরী মনে মনে ভাবেন এই মাইয়া গো নিয়্বে ওয়াজ বেশ জমবে।

মাইয়ারা অবলার দল, সরলার দল, নিশ্চয় ওদেরে নিয়ে ওয়াজ করে কোন বিপদ হবেনা।

ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরী পরের শুক্রবারের বয়ান তাই মাইয়ামানুষের জন্য বরাদ্ধ করলেন।

ইমাম সাহেব খুতবায় একটি হাদিস বয়ান করলেন। মহানবি(সঃ) বলেছেন, আমি যদি আল্লাহ ছাড়া কাউকে সেজদা করার নির্দেশনা পেতাম, তাহলে মহিলাদেরে তাঁদের নিজ নিজ স্বামীগণকে সেজদা করার আদেশ দিতাম।

রাসুলে খোদা(সঃ) মেরাজের রাতে দোজখ দর্শনকালে দেখতে পান সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই নারী। কারণ তাঁদের বেপর্দা চলাফেরা ও স্বামীর সাথে বেয়াদবি।

পুরুষরা একসাথে চারজন বিবি রাখতে পারবেন, কিন্তু মহিলাদের বেলায় একজনের বেশি স্বামী রাখা দুরস্ত নেই।

পিতৃসম্পদে বোন পাবে ভাইয়ের অর্ধেক।

স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেশত।

যেই নারীর প্রতি স্বামী অসন্তুষ্ট হয়ে রাত কাটাবে সেই নারীর প্রতি ফেরেশতারা সারারাত লানত বর্ষণ করেন।

‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত স্বরূপ, তোমরা তোমাদের শস্যক্ষতে যেমন খুশি গমন করতে পার।‘ সুরা আল বাকারা। আয়াত নং ২২৩

আপত্তিকর বিষয় বউরা অবাধ্য হলে দুচারটা ঘা-চটকনা লাগিয়ে দেবার অনুমতি শরিয়ত স্বামী ব্যাটাদের দিয়েছে।

সবশেষে কবিতা, পতিভক্তি কর সব সতী নারীগণে, বেহেশতে করবে বাস নিজ স্বামী সনে।

বয়ান শেষে একজন নারী অন্যজনকে বলল, আমার ওকে নিয়ে দুনিয়ায় বড় মুছিবতে আছি। জান্নাতে ওকে আমার কোন দরকার নেই।

সাথে সাথে দ্বিতীয় নারী বলল, বোন আমারও একই দশা, জান্নাত পাই না পাই কোন দুঃখ নেই। কেবল এই লোকটার হাত থেকে পরকালে মুক্তি চাই।

খতিব মোবারকপূরী খুব খুশি তিনি একখান জাঁদরেল ওয়াজ বহুদিন পর করেছেন। এবার ইনশাহ আল্লাহ মুসল্লিরা খুশি হবে, সাবাস সাবাস করবে।

তাকওয়া মসজিদের ভূমিতল কক্ষে নারী মুসল্লিরা নামাজ পড়েন। ঢাবি, বুয়েট, ডিএমসি, চবি, সাস্ট ইত্যাদি পাশ করে রাষ্ট্রের উঁচুপদে বসা জাঁদরেল জাঁদরেল মহিলারা এখানে জামাতে আসেন।

তাঁরা এই ওয়াজ শুনে বেশ অপমানবোধ করলেন। সম্মানিত মোহতারামারা খতিবের উপর ভীষণ চটে গেলেন।

তাঁরা বাসায় ফিরে কর্তাদেরে বললেন, এই নতুন খতিব নারীবিদ্বেষী। ওকে বিদায় করুন নইলে আমরা নারীবাদীরা রাজপথে আন্দোলনে নামব।

গিন্নীদের ধাক্কা খেয়ে কর্তারা মসজিদে জমায়েত হয়ে ইমাম সাহেবকে রেগে বললেন, নারীরা কিভাবে চলাফেরা করবে, কোথায় যাবে, এটা তাঁদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তাঁরা কি পরবেন, কেমনে সাজবেন, কার সাথে নাচবেন এটা তাঁদের স্বাধীনতা। এসব নিয়ে আপনার ভাবনার দরকার নেই, বয়ানেরও দরকার নেই।

পুরুষের চেয়ে নারীদেরকে খাটো করে ওয়াজ করলেন আপনি, আর বিপদে পড়লাম আমরা। বেগমদের রণহুঙ্কারে আমরা এখন ঘরছাড়া হবার উপক্রম।

কর্তারা চরম আদেশ দিলেন, ইমাম সাহেব আজ থেকে নারী বিষয়ে আর কোন ওয়াজ করবেন না প্লিজ। দেশের স্পিকার মহিলা, প্রধানমন্ত্রী মহিলা, বিরোধীদলের নেত্রী মহিলা। আপনি মহিলা বিষয়ে কথা বলে দয়া করে আমাদের সবার উপর কোন বিপদ টেনে আনবেন না।

নারীগণ কর্তাদেরে ঘরছাড়া করবেন এটা আবার ক্যামন কথা। বিষয়টা ইমামকে বেশ ভাবিয়ে দিল।

বোকারা বুঝবে না, ইমাম সাহেব তাই চালাক মুসল্লিদেরে হুজরায় ডাকলেন।

তাঁরা হুজরায় ঢুকেই দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিল।

তারপর ফিসফিস করে হুজুরকে বলল, মসজিদ কমিটির সদস্য এইসব শ্রদ্ধাভাজন সাবেক সচিব, মুখ্যসচিব, এমপি, জজ, ব্যারিস্টার, মেজর জেনারেলরা সবাই ঘরজামাই। তাঁরা বড়লোকের মাইয়া বিয়ে করে এই অভিজাত পাড়ায় শ্বশুরবাড়ির বাসিন্দা। তাঁদের লাগাম শক্ত করে ধরে আছেন পাওয়ারফুল বেগমরা। বেগমেরা ক্রুদ্ধ হলে তাঁদেরকে বাসা হতে তাড়িয়ে দেয়া মাত্র এক মিনিটের ব্যাপার। তাই এপাড়ার সাহেবরা বেগমদেরে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পান।

শরিয়তে একাধিক স্ত্রী রাখা দুরস্ত হলেও একাধিক স্বামী রাখা দুরস্ত নয়।

নইলে এই বড়লোকের এক একজন মাইয়াগোর ঘরে গোটা দুইচারজন স্বামীদাস বসে বসে পত্নীসেবা করতেন।

একজন অতি চালাক বলল, ইমাম সাহেব, আপনি বেগম রোকিয়ার নারীস্থান পড়েছেন?

না, পড়িনি।

তবে শুনুন, বেগম রোকিয়ার নারীস্থানের পুরুষরা ঘরে পর্দাবদ্ধ থাকেন। তাঁরা রান্নাবান্না করেন, বাচ্চা লালনপালন করেন, গৃহবন্দি থাকেন। নারীরা বাইরে পুরুষের মত চরে বেড়ায়।

ইমাম হুজুর কিছুক্ষণ ধ্যান করে বললেন, বাহ্যিক হায়হালতে এই অভিজাত পাড়া পুরুষস্থান মনে হলেও বাতেনে দেখছি বেগম রোকিয়ার বইয়ের নারীস্থান।

সাবাস, হুজুর আপনি এবার সঠিক রহস্য বেদ করতে পেরেছেন। আল্লাহ আপনাকে প্রচুর ইলমে লাদ্দুনি দান করেছেন। 

চালাকেরা বলল, হুজুর মাইয়াগো নিয়ে আর কোন ওয়াজ করে নিজের সর্বনাশ করবেন না। আল্লাহ না করুক, ওরা চাইলে অজামিনযোগ্য নারী অপমান দমন আইনে আপনাকে চিরদিনের জন্য জেলেও পাঠিয়ে দিতে পারে।

ভীত মনে ইমাম হুজুর বললেন, বহুত আচ্ছা।

হে আল্লাহ রহমানুর রাহিম, দয়া করুন, আওরাতদের চাবুক হতে একটিবার আমাকে বাঁচিয়ে দিন। আজ থাইকা আমি আর কোনদিন আওরাতগো বয়ান করব না।

ইমাম সাহেব পস্তালেন তাঁর ভান্ডার হতে বয়ানের আরেকটা মজার জিনিস নাই হয়ে গেল।

ইমাম অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন আগামী শুক্রবার ওয়াজের বিষয় হবে সুদ।

ইমাম হুজুর হাদিস বললেন, সুদ দেয়া, সুদ নেয়া, সুদে সহযোগিতা করা, সুদের হিসাব নিকাশ করা, সুদের চুক্তিনামায় স্বাক্ষি হওয়া সবই হারাম।

সুদ খাওয়া গোনাহে কবিরা। নবিজি(সঃ) বলেছেন, যে সুদ খাইলো সে যেন নিজ মায়ের সাথে জিনা করল। 

নামাজ শেষে মুসল্লিরা বেশ হৈ চৈ শুরু করলেন।

একদল বলল, আমরা সুদে ধার নিয়ে বাসা, বাড়ি, গাড়ি, টিভি ফ্রিজ কিনেছি। এখন আমাদের কি হবে গো।

আরেক দল বলল, আমরা সুদি ব্যাংক ও এনজিওতে চাকুরী করি। চাকুরী ছেড়ে দিলে ইমাম সাহেব কি আমাদের বৌবাচ্চাদের ভাত কাপড় যোগান দিবেন।

গরিব মুস্ললিরা বলল, আমরা এনজিও হতে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা করে খাই। আমাদের ব্যবসা বন্ধ হলে সপরিবারে না খেয়ে মরব। আগে দুনিয়ায় বাঁচি। পরে আখেরাত। আখেরাত আসুক, তখন দেখা যাবে।

মাওলানা আব্দুল গফুর মোবারকপুরী জনতার হাল্লাগোল্লায় পড়ে সুবহান আল্লাহ, সুবহান আল্লাহ জপে জপে মহান আল্লার দরবারে আকুল আবেদন জানান আল্লাহ আমাকে বাঁচাও, এই সুদখোর জনতা আমাকে মেরে ফেলতে পারে গো আল্লাহ।

এই অভিজাত পাড়ায় অনেক লেডিস ক্লাব, হনী ক্লাব, মেডান ক্লাব আছে। ইমাম শুনতে পান এসব ক্লাবে জুয়ার আসর বসে। জুয়াড়িরা জুয়া খেলে সারারাত পার করে।

ইমাম হুজুর মাথায় হাত দিয়ে ভাবেন, আহারে এত লোক জুয়া খেলে দোযখে যাবে। আর আমরা নীরবে দেখে দেখে যাব। অন্ততঃ একজন মানুষকেও যদি দোজখের আগুন হতে বাঁচানো যায়, তা ছোট্ট পূণ্যকাজ না। আমার বয়ানে একটা মানুষ যদি জুয়া ছাড়ে তবে খতিব হিসাবে আমার জীবন ধন্য।

ইমাম হুজুর জুয়া ও জুয়াড়ি নিয়ে যত মসলা মাসায়েল আছে যোগাড় করলেন। পরের শুক্রবারের ওয়াজে সব বর্ষণ করলেন। নামাজ শেষে ইমাম তাঁর হুজরায় ঢুকলেন।

ইমাম হুজুরের পিছু পিছু তাঁর একজন সুহৃদ মুসল্লিও ঢুকে বললেন, হুজুর আপনি এ কি করলেন। আপনাদের দৌড় বড়জুর মসজিদ। উঁচু অদৃশ্য দেয়ালঘেরা মাদ্রাসা নামক দুর্গ হতে এসেছেন। আপনারা আখেরাত নিয়ে এত ব্যতিব্যস্ত থাকেন যে দুনিয়ার কোন খবরই রাখেন না।

কিসের খবর? জানতে চান ইমাম।

কিসের আবার, এসব জুয়াড়িদের হাত কতখানি লম্বা তা কি আপনি জানেন।

পাড়ার গুন্ডা মাস্তান, পুলিশ, কমিশনার, এমপি হয়ে মন্ত্রিপরিষদ পর্যন্ত এদের সিন্ডিকেট। জুয়া ক্লাবের কমিশন পাতাল টু আসমান পর্যন্ত সবাই খায়। দোয়া করি, আপনি যে বয়ান করেছেন আল্লাহ তা যেন ওদের কানের পর্দায় না পৌছায়। ওরা শুনলে আপনাকে জীবন্ত কবরে পাঠিয়ে দেবে।          

মাওলানা আব্দুল মজিদ মোবারকপুরী ভাবনায় পড়লেন, তাঁর ইলিমের গোদামের মাল যেভাবে নিঃশেষ হচ্ছে, আগামী শুক্রবার তিনি কি বিষয়ে বয়ান করবেন।

ইমামের আলেম বন্ধুরা বলল, কেন? ইসলামে কি বয়ানের জিনিসের কোন অভাব আছে।

Islam is the  whole code of life.

একজন উচ্চশিক্ষিত বলল, এটা ইসলাম ধর্মের জবরদস্তি। Whole code of life বলে ইসলাম ধর্ম মানুষের সবধরনের কাজে হস্তক্ষেপ করে। মানুষের উঠ-বস, হাগু-মুতু, স্বামীস্ত্রীর কুতুকুতু সব ধর্মের অচলায়তনে বন্দি করে দেয়। হউল কোড অফ লাইফ মানুষকে ধর্মের পুতুলে পরিণত করে।

Whole code of life এর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ আর মুক্তচিন্তা ও মুক্তকর্ম করতে পারেনা। সে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা হারায়। তাইতো মুসলমানরা মেধাশূন্য 

তারচে আপনি জাকাত নিয়ে বলতে পারেন।

বলতে পারি, তবে জাকাত যে ধনীদের পকেট খালি করে।

এই জামানার ধনীরা তাঁদের স্বার্থহানী হয়না, ধর্মের এসব বিধান মানেন। যেখানে স্বার্থে টান পরে সেখানে তাঁরা নেই। তাই জাকাত নিয়ে এযুগে বয়ান করা অরণ্যে রোদন।

তাহলে আপনি ইসলামের রাজনীতি ও জেহাদ বিষয়ে বয়ান করতে পারেন।

অনেক আলোচনার পর শেষসিন্ধান্ত হল পরের শুক্রবারে ইসলামি রাষ্ট্র ও জেহাদের বয়ান দিবেন হুজুর মোবারকপূরী।

ইমাম মোবারকপুরী জেহাদের একটি চটিবই বন্ধুর কাছ থেকে ধার করলেন। এখানে জেহাদের গুরুত্ব ও জেহাদের অগণিত ফজিলত লেখা আছে। শত শত অনিন্দ্যসুন্দরী হুর গেলমান শরাবান তহুরা হাতে নিয়ে জেহাদের সব শহিদানের অপেক্ষায় জান্নাতে অধির আগ্রহে বসে আছে।

জান্নাতের হুরসুন্দরীরা চিরকুমারী, যতবারই উপবিষ্ট হন না কেন তাঁরা তাকত হারায়না।

প্রতিবারই সোহবতের পর তাঁরা আবার নতুনভাবে কুমারিত্ব লাভ করে।

সবাই বলল সুবহান আল্লাহ।              

শুক্রবারের বয়ানে জেহাদের এই চটিবইয়ের সব মালামাল অকাতরে ঢেলে দেন আব্দুল গফুর মোবারকপূরী। দারূন উদ্দিপনাময় বয়ান শুনে কিছু ইসলামি রাজনীতি করা ওলামারা তাকে উপাধি দেন মাওলানা আব্দুল গফুর জেহাদি। নতুন লকব পেয়ে ইমাম হুজুর খুশিতে আটকানা।

অনেক অনেক মোল্লাহ মুসল্লি তাঁকে বাহবা দেন।

জিন্দাবাদের চুটে হুজুর আব্দুল গফুরের রাতে চোখে ঘুম আসছে না।

সামান্য মোবারকপুরী থেকে এখন জেহাদি হয়ে গেলাম। ইমাম ছিলাম, আজ ইসলামি নেতাও হয়ে গেলুম রে।

চোখে একটু তন্দ্রাভাব আসতেই মাওলানা আব্দুল গফুর জেহাদি মোবারকপুরী স্বপ্নে দেখেন, হাজার হাজার সাদা পাজামা পাঞ্জাবি ও টুপিধারীরা বঙ্গভবনে ঢুকে গেছে। নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর আওয়াজ আসছে। দেশে ইসলামি হুকুমত কায়েম হয়ে গেছে।  

আচমকা দরজায় ধুড়ুম ধুড়ুম ধাক্কার শব্দে ইমাম মজিদের ঘুম ছুটে যায়।

আপনারা কারা দরজার কড়া নাড়ছেন?

আমরা গোয়েন্দা সংস্থার লোক। আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। দরজা খোলুন নইলে কপাট ভেঙ্গে ঢুকতে বাধ্য হব।      

কেন এসেছেন?

আপনাকে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সামনে যেতে হবে।

কাউন্টার টেরোরিজম আবার কি? আমার বাবাও এই নাম শুনেনি।

আগে দরজা খোলেন, সেখানে গিয়ে এই তাগুতি শক্তির মুখোমুখি হবেন, কেমন?

হুজরাখানায় ওয়াজ বানাতে ধার করে আনা জেহাদের চটিবইসহ মাওলানা আব্দুল গফুর জেহাদিকে ধরে নিয়ে গেল এন এস আই এর লোকজন। হুজুরের ফলকাটার ছুরিটাও আলামত হিসাবে জব্দ করল।      

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের মুখোমুখি ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরী আল জেহাদি।

আপনি কি বাংলাভাইয়ের লোক?

না।

আপনি কি শায়েখ আব্দুর রহমানের নাম শুনেছেন?

না, শুনিনি।

জে এম বি/ আল্লার দল করেছেন?

না। করিনি।

নিশ্চয় আই এস/ আল কায়দার ফাঁদে পড়েছেন?

না, আমি একজন নিরীহ আলেম। কারো ফাঁদে টাদে পড়িনি। কোন জঙ্গি দলে আমি নেই।

সত্যি বলছেন আপনি জঙ্গিদলে নেই, তাহলে জঙ্গি ওয়াজ করছেন কেন?

আর করবনা। আমার বউবাচ্চারা কান্নাকাটি করছে, চাকুরিটাও হারাবো।  

তবে মুচলেকা দেন, জীবনে আর কখনও জঙ্গি বয়ান করবেন না।

মুচলেকা দিলাম, দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।

আপনার জেহাদি টাইটেল বাদ দিন।

ওটা আমি লাগাইনি। মতলববাজরা দিয়েছে, ওদেরে চিনিনা। আজ থেকে ‘জেহাদি’ উপাধি বাদ দিলাম।

ফজরের নামাজে এসে মুসল্লিরা জানলো জঙ্গি কানেকশনের কারণে ইমাম সাহেব পুলিশ হেফাজতে।

দুদিন পর মসজিদ কমিটির সভা বসল। ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপুরীকে ডাকা হল।

কমিটির লোকজন মহাবিরক্ত।

ইমাম সাহেব, আপনি প্রতিটি ওয়াজে একটা না একটা জংঘট বাঁধিয়ে দেন। আপনাকে নিয়ে আমরা মহা সমস্যায় আছি। আপনি চাকুরী করবেন, না কি চলে যাবেন, স্পষ্ট করে বলে দিন।   

সাতজোড়া জুতার তলা ক্ষয় করার পর আপনাদের দয়ায় এই চাকুরী পেয়েছি। মেহেরবানরা তাড়িয়ে দিলে আমি যাব কোথায়? সংসার চালাতে আমাকে রাস্থায় রাস্থায় হাতপাততে হবে যে।

কমিটি সদস্যরা বললেন, কেউ বুদ্ধি খাটিয়ে একটা উপায় বের করুন, যাতে ইমাম হুজুর বাঁচেন, আমরাও বাঁচি।

কমিটির ক্ষমতাবান সভ্য সাবেক সচিব আবুল হাসনাত ম করিম একটা সহজ রাস্থা বাতলে দেন।

ইমাম সাহেব আপনি তো ভাল আরবি-ফার্সি জানেন?

হ্যাঁ জানি।

এখন থেকে বাংলা বাদ, কেবল আরবি-ফার্সি-উর্দুতে বয়ান করবেন।

কেন? আরবি-ফার্সি-উর্দু তো আমজনতা বুঝবে না।

না, সবার সবকিছু বুঝনের দরকার নাই। কেবল আলেম উলামারাই বুঝলে চলবে। আগে নিজের পিঠ বাঁচান।

বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে দুই চারটা ইংলিশ বলা যাবে কি? একটু আধটু ইংলিশ ছাড়া বয়ান ফাটাফাটি হয়না স্যার।

আরে বাবা, আপনার ইংলিশ হয়ে যাবে বাংলিশ। পান্ডিত্য দেখাতে গিয়ে আর বড় বিপদে পড়বেন।

কেন?

এই দেশ চালায় ইংরেজি জানেওয়ালারা। দেশবিদেশে ইংলিশ পড়ে এসে তাঁরা এদেশের সব উঁচু ডালে ডালে বাসা বাঁধে। তাঁরা আপনাকে ছাড়বেনা। আপনার সব ভূলেবালেভরা ইংরেজি ওরা ধরে ফেলবে। পান্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে অপদস্ত হবেন। ভাগ্যের জুরে জেলঘাট থেকে সে রাতে ফিরে এসেছেন, এবার ক্রসফায়ারে পড়বেন। হেনস্তা কারে কয় হাড়ে হাড়ে টাহর পাবেন, আমরা কেউই আপনাকে তখন বাঁচাতে পারবনা।

মসজিদ কমিটির বিজ্ঞ সদস্য সাবেক সচিব আ হা ম করিম দারু বিরক্ত।  

পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের মত আঙ্গুল উচিয়ে ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপূরীকে তিনি শক্ত ঝাড়ি দেন, বক বক বন্ধ করুন। বাংলা-ইংরেজি নয়, কেবল আরবি-ফার্সি-উর্দু এই তিনই হবে জুমুয়া বয়ানের একমাত্র ধর্মভাষা।

জি জনাব, তাই হবে, তাই হবে।     

গল্পে গল্পে আমাদের স্পিডবোট নিঝুমদ্বীপের নৌঘাটে এসে হাজির। গল্পের শুরু হাতিয়ায়, নিঝুমদ্বীপে এসে শেষ।

সর্বজনাব সায়েদ আব্দুল্লাহ যীশু, ফারুক আহমদ, এনায়েত উল্লাহ, আরিফ রাব্বানী, সৈয়দ ইয়াহিয়া ও ইসফাক কুরেশি নামীয় ছয়জন পূবালিয়ান পর্যটক গল্পের ইমাম আব্দুল গফুর মোবারকপূরী আল জেহাদিকে নীল দরিয়ায় বিসর্জন দিয়ে নিঝুমদ্বীপের হরিণবনের নিঝুম হাওয়ায়  গা ভাসিয়ে দেন।       

নিঝুমদ্বীপ বাজার-মসজিদে তখন জুমুয়ার খুতবা শুনা যাচ্ছে। আমরা সবাই মসজিদে ঢুকে গেলাম। মসজিদটি সুন্দর। নামাজ হতে বেরিয়ে এসে কয়েকজন দ্বীপবাসীর মজলিশে বসি। তাঁরা বলল নিঝুমদ্বীপ হাতিয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন। দ্বীপের একাংশে মানুষ বসবাস করলেও বেশিরভাগ জায়গা ম্যানগ্রোভ বনভূমি। বনভূমির মালিকানা বনবিভাগের। বনবিভাগ এক সময় এখানে দুইজোড়া চিত্রল হরিণ ও মায়া হরিণ অবমুক্ত করে। এই চারটি হরিণের বংশধরের সংখ্যা এখন বাইশ হাজার।

নিঝুমবাজারে ঘুরাঘুরি করি। হোটেলে বসে চা-বিস্কুট ও কলা খাই। লোকেরা নোয়াখালী ভাষায় কথা বলেন। তাঁরা সহজ সরল ও পরিশ্রমী। কৃষিকাজ করেন ও সাগরে মাছ ধরেন। বললেন তাঁরা সহায় সম্বলহারা ছিলেন, সরকার মাত্র ৫টাকা বিঘা দরে তাঁদেরকে জমি বরাদ্ধ দেয়। নিঝুমদ্বীপে তাঁরা সুখেই আছেন। ঊনিশ শ সত্তুরের জলোচ্ছাসে একজনমাত্র মহিলা ছাড়া দ্বীপের সব মানুষ মারা যান, বলল লোকজন। সরকারের একজন মন্ত্রী এসে জনমানবের চিহ্ন না পেয়ে বললেন, হায় হায় কি নিঝুম। সেই থেকে এই দ্বীপের নাম ‘চর ওসমান’ পাল্টে হয়ে যায় নিঝুম দ্বীপ। সত্তুরে প্রবল সাইক্লোনে গাছের আগা আকড়ে ধরে বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান আকড়া বুড়ি বেশ দীর্ঘজীবী হন ও এই কিছুদিন আগে তিনি মারা যান। একজন আঙ্গুল উচিয়ে দেখাল, ঐ দেখুন সেই আকড়া বুড়ির নতুন কবর।     

আমরা বনবিভাগের পর্যটন রিসোর্ট ও অভয়ারণ্যে যাই। মাটি হতে দশ বার ফুট উঁচু খুঁটির উপর সাইক্লোন সেন্টারের মত রিসোর্ট ভবন। সামনে বনভূমি দেখার সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। আমরা সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে টাওয়ারের উপরে আরোহন করি। এখান থেকে বনভূমি, দুরের শ্যামল চরাঞ্চল, নৌবন্দর এবং সাগরের দৃশ্য অপরূপ।

মনে মনে স্রষ্টাকে বললাম, হে আল্লাহ, তোমার সৃষ্টি এত সুন্দর, নাজানি তুমি কতনা সুন্দর।

মেঘনা মোহনার জেলাদ্বীপ ভোলা, উপজেলাদ্বীপ মনপূরা দেখা শেষে ইউনিয়নদ্বীপ নিঝুম আমাদের দেখা হয়ে গেল।

নোয়াখালীর হাতিয়া প্রান্তরে বসে ময়মনসিংহী ফারুক আহমদ নোয়াখালীর রসাত্মক গল্প শুনান।

মতিঝিলের ফুটপাতে স্বপ্নে পাওয়া সর্বরোগের মহৌষধ বিক্রি করেন একজন কবিরাজ। ঔষধের ফজিলত বর্ণনা করার আগে কবিরাজ দেখে নেন আসপাশে নোয়াখালীর লোকজন কেউ আছে কিনা। কবিরাজ সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হিন্দু ভাইদেরে আদাব আর মুসলিম ভাইদেরে সালাম। আমার দাদাজানের স্বপ্নে পাওয়া এই ঔষধের গুণাগুণ আপনাদেরে জানাব। তবে নোয়াখালীর কেউ শুনলে এই ঔষধের গুণাগুণ বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই দয়া করে নোয়াখালীবাসী কেউ এখানে থাকলে হাত উঠান। কয়েকবার একথা বলার পরও জনতার মধ্যে কেউ হাত উঠাল না। কবিরাজ নিশ্চিত হন এখানে নোয়াখালীর কেউ নেই।  

লাউডস্পিকার হাতে নিয়ে কবিরাজ ঔষধের মাহাত্ম্য বলা শুরু করলেন, এই মহাঔষধ মানুষকে চিরযৌবন দেয়, ক্যান্সারসহ যে কোন কঠিন রোগ চিরতরে সুস্থ্য করে, ইহা এমন এক আলৌকিক গাছের পাতার রসে তৈরি যে গাছের পাতা জলে পড়লে কুমির হয় এবং ডাঙ্গায় পড়লে বাঘ হয়। জনতা সমস্বরে বলল, মাশা আল্লাহ।

এমন সময় জনতার মধ্যে মাত্র একজন লোক মাশাআল্লাহ না করেই বলল, ডাক্তার সাহেব, বুঝলাম আপনার স্বপ্নে পাওয়া বৃক্ষপত্র জলে পড়লে কুমির হয় এবং ডাঙ্গায় পড়লে বাঘ হয়। এখন বলুন তো এই পাতা যদি অর্ধেক জলে পড়ে এবং বাকি অর্ধেক ডাঙ্গায় পড়ে তাহলে কি হয়।

ধূর্ত কবিরাজ এই প্রশ্নের জবাব দেন, তাহলে ব্যাঙ হয়।

কবিরাজ এবার বললেন, নিশ্চয়ই আপনি নোয়াখালীর লোক, আগেই বলেছি নোয়াখালীর কোন লোকের সামনে এই আধ্যাত্মিক ঔষধের ক্যানভেসারি আমি করিনা। আপনার সামনে ক্যানভেসারি করে ঔষধের মহাশক্তি নষ্ট করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আপনি দয়া করে যান, বলেই সর্বরোগের এই মহাঔষধ নিয়ে কবিরাজ মিয়া নিজেই উদাও।

নোয়াখালীর মানুষ যে অতিমাত্রায় চালাক ও প্রগ্রসর, তাই এখানে হাস্যরসাত্মক গল্প হয়ে এসেছে।

নিঝুমদ্বীপের খালপারে নৌঘাট যেয়ে স্পিডবোটে উঠে বসি। সংকীর্ণ খালে একটি বড়নৌকা আমাদের পথ আটকে দেয়। স্পিডবোটের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে এই নৌকাটাকে একটানে খালের ওপার। স্পিডবোট  আমাদেরকে নিয়ে ভোলার চরফ্যাসন পানে ছুটে। পথে একটি অজানা দ্বীপের সবুজ উপকূলে নামি। প্রচুর খাওয়া দাওয়া হচ্ছে। তাই সুগার কমাতে সাগরপারের দূরের সুরম্য বনের পাশ পর্যন্ত দৌড়াতে থাকি। বিচিত্র ধরণের ময়নার ঝাঁক সবুজ মাঠ ছেয়ে আছে। আমাদের ভয়ে পাশের ম্যানগ্রোভ বনে পাখিরা উড়াল দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে পড়ে। বনবৃক্ষের এমন এক প্রকার গাছের বিচিত্র সুন্দর পাতার দেখা পাই, যা দেখতে ফুল নাকি পাতা বুঝা কঠিন। হাতে নিয়ে দেখি পাতার কিনারে সুচালো কাঁটা। অদ্ভুদ পাতা যা একই সাথে ফুল ও পত্র, আবার পাতার কিনারে মূল গজায়ে বংশবিস্তার কাজও করে থাকে। পাতাটি পর্যবেক্ষণ করে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ।

স্পিডবোটে আরোহন করার পর সাগরের মাঝ দিয়ে পানি ছিটায়ে আমরা এক ভো-দৌড় দেই। এক দৌড়ে ভোলাদ্বীপের চরফ্যাসন নৌঘাটে গিয়ে নামি। সেখানে ভোলা শাখার গাড়িচালক আব্দুল আজিজ গাড়ি নিয়ে সামনে হাজির। গাড়ি আমাদেরকে আবার জ্যাকব টাওয়ারে নিয়ে গেল। জ্যাকব টাওয়ারে আসতেই পূবালী ব্যাংক চরফ্যাসন শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ রেজাউল করিম আমাদেরকে সাদরে বারণ করেন। সামনের দিঘিপারের মার্কেটে একটি ফাস্টফুডের দোকানের সামনে চেয়ার পাতা। রেজাউল করিম আমাদের সম্মানে গরম গরম পিয়াজু ও সিঙ্গারা পরিবেশন করেন। চরফ্যাসনের এই পিয়াজু ও সিঙ্গারার স্বাদ এত বেশি যে মনে থাকবে বহুদিন। তরুণ ব্যবস্থাপক রেজাউল করিমের সাথে হাত মেলায়ে এবার গাড়ি ছুটে গেল জেলাশহর ভোলায়।

ভোলাদ্বীপের দৈর্ঘ্য ৮১ মাইল। রাস্থা-ঘাট পাকা। দ্বীপে প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি আছে। দ্বীপে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। ভোলার চারপাশে অগভীর সমুদ্র, উপকূলে উপকূলে অনেকগুলো নৌঘাট। একটা প্রাকৃতিক জলপথ সারাটা দ্বীপকে চারদিকে ঘিরে আছে। গাড়ি আমদেরকে নিয়ে যায় পূবালী ব্যাংক ভোলা শাখায়। ভোলার ব্যবস্থাপক মোঃ শাফায়েত হোসেন বিনয়ী তরুণ। অসুস্থ্য থাকায় আমাদেরকে বেশি সময় দিতে পারেন নি বলে বেশ দুঃখ প্রকাশ করেন। শাফায়েত হোসেন আমাদেরকে ভোলার একটি ভাল খাবার হোটেলে নিয়ে যান। মনপূরায় সাগরের কোরাল মাছ খাই। তবে ভোলায় ফিরে এসে ভাগ্যে জুটে মেঘনার মোহনার সতেজ বড় ইলিশ। এই ইলিশ দেশের অন্য কোথায়ও বিরল। রান্না ভাল, খেতে খুব সুস্বাদু।

ভোলা একটি জেলাশহর। আমরা এই ছোট্ট শহরটি সহজেই অল্প সময়ে দেখে নেই। একজন সাস্টিয়ান মোঃ হারুনুর রশিদ, যিনি সোশ্যাল ওয়ার্কে মাস্টার্স দিয়ে সরকারি কলেজের প্রভাষক পদে যোগ দেন। এখন ভোলা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর আমন্ত্রণ পেয়ে দেখা করতে ছুটলাম। একটি সংকীর্ণ রাস্থা দিয়ে ঢুকে মধ্যভিত্ত জনপদ। রাস্থা প্যাঁচালো, লোকজন বলল, এই সামনে গিয়েই ডানদিকে কলেজ। কিন্তু কলেজের গেটের দেখা পেলাম অনেক কাটখড় পোহায়ে। নিরিবিলি তিন চার তলা কলেজ। সামনে বড় মাঠ, দুচারটা ফুলগাছ। কলেজটি গাঢ় সবুজ ও শান্ত। হারুনুর রশিদ স্যারের অফিসে বসে চা-পান হল। ফটোসেশন হল।

কলেজ হতে বের হয়ে গাড়ি আসরের সময় মন্ত্রী তোফায়েল আহমদের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত মসজিদে আসি। আমরা এই সুরম্য মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করি। দুতলা ডুপ্লেক্স মসজিদের সৌন্দর্য প্রশংসনীয়। মসজিদের দক্ষিণ পাশে ভোলা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। শীতপ্রধান দেশের খাড়া ঢালু ছাদের ডিজাইনে নির্মিত বহুতল ভবনটিও দেখতে অনন্য। এই দুইটি স্থাপনার চারপাশে প্রচুর খোলা প্রাঙ্গণ। এবার ভোলা ছাড়তে আবার ছুটে এলাম ভেদুরাঘাটে। এই সেই ঘাট, যে ঘাট দিয়ে ঢুকেছিলাম ভোলায়।

বিদায় ভোলা, জানিনা কোনদিন তোমার চিরসবুজ বুকে পদচিহ্ন আঁকা আবার হবে কি আমার। তুমি সুখে থাকো, সমৃদ্ধ হও।   

এবার আমাদের গন্তব্য চরমুনাই পীরসাহেবের দরবার শরিফ। স্পিডবোট তেতুলিয়ার বুকে ঢেঊ তুলে ছুটলো চরমুনাই পীরের আস্থানায়। ঘুর্ণীঝড় জওয়াদ পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে। জওয়াদের ধাক্কায় মেঘনার মোহনা খানিকটা উত্তাল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, নদীতে ঢেউ ও বাতাসের খেলা। ঢেউয়ের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে আমাদের স্পিডবোট চরমুনাইয়ের ঘাটে আসে। নামার পরপরই বরিশাল শাখার গাড়িচালক শাহিন মিয়া মাইক্রোবাসে তুলে আমাদেরকে চরমুনাই দরবার শরিফের গেটে নিয়ে যান।

চরমুনাই একটি বিশাল ইসলামি কমপ্লেক্স। চার থেকে ছয়তলা অনেকগুলো ভবন পাশাপাশি সংযুক্ত। এখানে একাডেমিক ভবন আলাদা নয়। আবাসিক হোটেলের ফাঁকে ফাঁকে ক্লাস কক্ষ। আলাদা একটি সুবিশাল মসজিদ। চরমুনাই জলসা মাঠে লক্ষাধিক মানুষের স্থান হবে অনায়াসে। তিনদিনের জলসা উপলক্ষে অনেকগুলো অস্থায়ী দোকানপাঠ তৈরি করা হচ্ছে। এসব দোকান বরাদ্ধ বাবদ মদ্রাসা কতৃপক্ষ লাখ লাখ টাকা আয় করেন।

মসজিদের পূর্বদিকে খানিক দূরে চরমুনাই পীরগণের সমাধিক্ষেত্র। এখানেও পীরদের কবরে নামফলক ছাড়া কোন স্থাপনা নেই। সাধারণ লোহার গ্রীলের বেড়া দিয়ে পীরগণের সমাধি ঢেকে রাখা হয়েছে। চিরসবুজ ঘাসের চাদরের নিচে শুয়ে আছেন পীরবংশের লোকজন। বেশ ভীড় ঠেলে চরমুনাই মসজিদে মাগরিবের নামাজ জামাতে পড়ি। মুসল্লিরা প্রায় সবাই হুজুর, সবার গায়ে পাঞ্জাবি ও মুখে দাড়ি।

মসজিদের কাছে পীরগণের আবাসিক ভবন দেখতে পাই।

প্রধান পীর ফজলুল করিম চরমুনাই এখন ঢাকায়। জলসায় প্রধান আকর্ষণ হতে তিনি শিঘ্রই চরমুনাই ফিরবেন।  

জলসামাঠে প্যান্ড্যাল নির্মাণ করছেন এক বিশাল স্বেচ্ছাসেবক হুজুরবাহিনী। দুইদিন পরই বার্ষিক জলসা, তাই উৎসবের আমেজে ভাসছে দরবারে চরমুনাই। ফোটা ফোটা বৃষ্টির জল চরমুনাই দরবার দর্শন আমাদের জন্য বিরক্তিকর করে দেয়। গতবার আমরা ছারছিনা শরিফে প্রপার চ্যানেলে যাই। তাই বেশ খাতিরযত্ন পাই। চরমুনাই এসেছি সাধারণ পাবলিক হয়ে এবং আম পাবলিক হিসাবেই খুব সংক্ষেপে দরবার প্রদক্ষিণ করে গাড়িতে গিয়ে উঠি। গাড়ি ছুটলো বরিশালে।

চালক শাহিন বরিশালে ঢুকে কবি জীবনানন্দ দাসের সাদামাটা  পাকাবাড়ি ও পাঠাগার দেখান। রাতের আঁধারে আবার বি এম কলেজ ঘুরে দেখি।

বরিশালের একজন বিখ্যাত মুক্তমনা দার্শনিক আরজ আলী মাতব্বর। বরিশালে তাঁর কোন স্মৃতিচিহ্নের দেখা পেলাম না। মুক্তমনা ও ভিন্নচিন্তার মানুষেরা সর্বকালে সর্বসমাজে অবহেলিত। জীবনকালে তাঁদের ভাগ্যে জুটে দেশান্তর, জেল, জুলুম কিংবা চাপাতির কোপ। প্রাচীন ভারতীয় মুক্তমনা চার্বাকরা ভারতে টিকতে পারেনি। আমাদের দেশের বর্তমান মুক্তমনারা প্রচলিত ধর্ম ও প্রথায় বিশ্বাসী আমজনতার গালী ও কিলের চুটে পিঠে শক্ত খোল বেঁধে যুক্তি ও বিজ্ঞানের বস্তা কাঁধে নিয়ে সদাসর্বদা দেশে বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সাহস করে স্বদেশে থাকা মুক্তমনা অনেকেই চাপাতির কোপে বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবারও হচ্ছেন। তবে খুব ধীরে ধীরে হলেও তাঁরা মানুষের চিন্তাজগতকে বদলে দিচ্ছেন।   

বরিশাল শাখায় ডাবের পানি পান করে নৈশভোজ সেরে মাইক্রোবাসে বসি। বরিশাল নদীবন্দরে এসে জাহাজে ঢুকি। এমভি এডভেঞ্চার-৯ জাহাজের তিনতলায় ৩৪২ নম্বর কেবিনে আমি ও সৈয়দ মোঃ ইয়াহিয়ার রাতের ঠিকানা হয়। সারাদিনের একটানা ভ্রমণে আমরা ক্লান্তশ্রান্ত। তাই এসি চালু করে দুইখাটে শুয়ে আমরা দুইজন চাদরমুড়ি দিতেই  মহানিদ্রায় ডুবে যাই।

ঢাকা সদরঘাটে এসেই ভোরের আজান শুনে জাহাজের মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ি।

রিকশায় চড়ে অল্পক্ষণে পৌঁছে যাই ইয়াহিয়া সাহেবের কমলাপুরের সিমসাম বাসায়। বাসায় দুইটি কক্ষ সম্পূর্ণ খালি, পরিপাঠি বিশাল পালং সাজানো, যেন ঘুমানোর জন্য লোক খোঁজছে। একটি বড় পালঙ্কে আরেক লম্বা ঘুম দেই। উঠে দেখি দশটা বাজার তেমনটা দেরি নেই। সৈয়দ মোঃ ইয়াহিয়ার জসিম উদ্দিন রোডের বাসাটি পূবালী ব্যাংক হেডঅফিসের এতই কাছে যে মাত্র সাত-আট মিনিট হেঁটে হেঁটে খানিক বৃষ্টিতে ভিজে ঠিক ১০টায় অফিসে ঢুকে যাই।

মেঘনামোহনার দ্বীপাঞ্চলে মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টার এই ঝটিকা সফর আমার জীবনে অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।                                       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন